২০১০ এ মায়াবীর তখন ০৯ বছরের সংসার। আমাদের প্রেম তখন অনেক ম্যাচিউর। প্রায় ০৯ বছরের উপর। ওর ছোট্ট একটা ছেলে। ওর বর তেমন কিছু করে না, বাবার হোটেলে বউ বাচ্চা নিয়ে ফ্রি থাকা খাওয়া। মায়াবীর বিয়ে হয় ২০০১ এ।
বিয়ের কিছু বছর পর থেকেই আমার মায়াবী, নিজের হাত খরচ, বাচ্চার খরচ আর সাংসারের টুকিটাকি সার্পোটের জন্যে দিন রাত খাটে।
একটা ছোট খাটো কাপড়ের বিজনেজ + বাটিক + ফেব্রিক্স আরও নানা কিছু। দুপুরের রোদেও সে ঘন্টার পর ঘন্টা দুই তলার চিলে কোঠায় কাজ করত। সাদা ফুটফুটে ভীষণ সুন্দরী একটা মেয়ের হাত মুখের স্কীন তখন অনেকটা তামাটে। চোখের নীচে কালি, খুব স্ট্রাগল করছে, চেহারায় ফুটে উঠেছে কষ্টের প্রতিবিম্ব।
সে সময় প্রথম দিকে চিঠি চালাচালি করতাম। পরে ২০০৬ এ মোবাইল কিনি। তখন থেকে আমরা দুজন ফাকে ফোকরে প্রায় ২ ঘন্টা মত গল্প করতাম মোবাইলে, ল্যান্ডফোনে। মোটামুটি ৩০ টার ওপর ম্যাসেজ দেয়া নেয়া প্রতিদিন। ওর বর ওকে সাসাতো, অশান্তি করত। তারপরেও আমাদের অনেক যোগাযোগ হত। কিন্তু ওর সংসারের অশান্তির কথা আমি সে সময় জানতে পারিনি। সব উপেক্ষা করেই যোগাযোগ করত।
২০১০ অক্টোবরে আমার একটা মোটামুটি জব হয়। প্রথম মাসের স্যালারী পেয়ে প্রথম ওর জন্যে একটা কমলা রঙের জামদানী নকশার মনিপুরি শাড়ি কিনি। এরপর পর থেকে প্রায়ই ওর জন্যে এটাসেটা কিনতাম। সে কোন গিফট নিতে চাইতো না। কোন একটা অজুহাত পেলেই আমি গিফট পাঠানোর বায়না ধরতাম। অনেক সময় কিনে ফোন দিতাম। শেষে যখন নিতো না, নিজের কাছে রেখে দিতাম। পরে সুযোগ বুঝে দিতাম। আমি গিফট দিলে, ওর সংসারে ঝামেলা হয়।

মায়াবীর ছোট্ট এক ঘরে বসবাস। গিফট গুলো লুকানোর জন্যেও যথেষ্ট স্পেস নেই। এর ভেতর আমাকে পিন মারা শুরু করল: "টাকা নষ্ট করো না, জমাও। বিয়ের পর আমাকে ভেবে বউকে দিও সব গিফট। "
আমিও বলতাম, "যাকে ভালবাসি তাকে তো আর পাবো না। কাজেই বিয়ের গল্প বাদ। না হয় তোমার বড় চাচার মত চিরাে যুবা হয়ে থাকি। ব্যাচেলর কমিটির সেক্রেটারী হবো"
তারপরেও প্রতিদিনকার টপিকস হয়ে উঠল, আমার বিয়ে। আমাকে বলত, "কেমন মেয়ে লাগবে তোমার?" বলতাম, তোমার মত, তুমি হলে ১০০ তে ১০০।
মায়াবীর কিছুটা নিরবতা, তারপর বলত, আমার তো সে সুযোগ নাই। বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পর তোমাকে দেবার মত আমার আর কোন কিছু বাকি নাই, ছেলেরা যা আশা করে।
আমি পাল্টা জবাব দিতাম, আমি তো অন্য সব ছেলেদের মত নই। তোমার বন্ধুত্ব, সঙ্গ আর হাসি মাখা মুখ নিয়ে আমার কাছে থাকলেই চলবে।
মায়াবী সিরিয়াসলী কোন একদিন বলেই ফেলল, যদি ছেলেটা না থাকতো, সত্যি সত্যি তোমার কাছে চলে যেতাম। এখন ওকে রেখে তোমার সাথে ঘর বাধলে, বাচ্চাটা মারাই যাবে। ওর বাপ দাদা দাদী কেউ দেখবে না। অন্যদিকে ওর নানী বলেছে, নাতি নাতনি পালার ঝামেলা তারা নেবে না। দরকার হলে যেন এতিম খানায় রাখি। ছেলেটা একটু বড় হোক, সত্যি একদিন তোমার কাছে যাবো, চিরদিনের জন্যে।
এভাবে হাজারও উরাধূরা গল্প চলত, নন স্টপ। একদিন হঠাৎ আমাকে বলে, তোমার জন্যে পাত্রি পাইছি। আমার খুব পছন্দ হইছে। তুমি দেখলে চোখ ঘুরাতে পারবা না। কথা বার্তা চালচলন সব আমার মতই। দুই বাসা পরেই থাকে। ক্লাস টেন এ পড়ে। অনেক লম্বা চুল। তোমার তো লম্বা চুল পছন্দ। আমাদের এলাকায় নতুন আসছে।
শুরুতে ওর কথায় মজা ছিল, হাসি ছিল, শেষটায় গলা ধরে গেছে স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। শেষটায়, আমাকে শুধু বলল, তুমি বললে ঘটকালি করব। নিজের মানুষকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিয়ে দিব। সেদিন আর কথা হয়নি। কিছু ভাললাগছিল না।
এরপর মায়াবীর ২-৩ দিন আর কোন খোজ খবর নাই। ফোন দিলে ফোন ধরে না। ম্যাসেজের রিপলাই নাই। ল্যান্ড ফোনে কল দিলে ওর শাশুড়ী ধরে।
দুপুর বেলা হঠাৎ কল আসলে বললাম, কি হইছিল এই কয়দিন? হাওয়া হয়ে গেছো পুরাই? জানোনা তোমার খোজ না পেলে কি হয় আমার?
ঐদিন আমার মায়াবীর গলায় কোন আনন্দ ছিল না। কি করি, খাইছি কিনা এসব টুক টাক কথা শেষে বলল, ঐ মেয়েটার বিয়ের ব্যাপারে কি ভাবলা? সুন্দরী মেয়ে বেশি দিন ফাকা থাকে না।
আমি শুধু বললাম, কোন সুন্দরী মেয়ে আমার দরকার নাই। আর ঐ মেয়েকে বিয়ে করলে তোমাকে আরও বেশি মনে পড়বে। মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। এমনিতে্ই তাড় ছেড়া হয়ে আছি।
ও শুধু বলল, তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেল, দেখবা আমাকে ভুলে গেছো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি বলছিলাম, এতো বছর সংসার করেও তুমি ভুলতে পারছো? কোন দিন পারবা?
আমার কথা কেড়ে নিয়ে বলে, প্রেম ভালবাসা আসলে কিছু না। বিয়ে করলে বউ টাইট দিবে, দেখবা তোমার সব ঠিকঠাক। তুমি সুখি হও সেটাই আমি চাই। আমার মত মেয়ে তোমার সাথে মানায় না। তুমি আরও ভাল মেয়ে পাওয়া যোগ্য।
আমি বলছিলাম, বিয়ে করে আমার বউ না হলেও, বন্ধুত্ব ধরে রেখো। শুরুটা তো বন্ধত্ব দিয়েই হইছিল।
এভাবে প্রায় বছর খানিক কেটে যায়। ২০১১ আগস্টের ২২ তারিখ মায়াবীকে দেখা করতে বললাম। সেদিন প্লান ছিল, ওর ফাইনাল কথা জানবো। সে এল , দেখা করল কিন্তু আমি গুছিয়ে বলার কোন সুযোগ পেলাম না। CNG রিজার্ভ করে শহরের এখানে সেখানে ১ ঘন্টা ঘুরলাম। কোথাও নামল না, বসল না। CNG আলা কান পেতে থাকায়, আর লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে থাকায়, কোন কথাই হল না।
CNG থেকে নেমে আমার কলিজাটাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে শব্দহীন ভাবে মুখে বললাম, I LOVE YOU.
বাসায় গিয়ে আমাকে ফোন দিল, বলল, এই তুমি এসব ফাজলামো ছাড়োতো। তাড়াতাড়ি বিয়ে কর। আমাকে ভুলে যাও। যখন তখন আর ফোন ম্যাসেজ দিও না। রাখি...
মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। দেয়ালে অনেকগুলা ঘুসি মারলাম। মোবাইল ছুড়ে মারলাম। আরএফএল এর একটা দরজা হাত দিয়ে ঘুষি মারতে মারতে ভেঙ্গে ফেললাম। বাসায় তখন কেউ নাই্। গলা ফেটে চিৎকার করলাম। তারপর বাথরুমে গিয়ে ট্যাঙ্ক খালি না হওয়া পর্যন্ত সাওয়ার নিলাম।
এর ভেতরে বাইরে থেকে ফিরে মা সব ভাঙ্গা চুরা অবস্থায় পেল। মা কে বললাম, সব ঘটক কে খবর দাও। ছবি নিয়ে আসতে বলো। যে মেয়ের সাথে রিক্সায় ঘুরলে কেউ বলবে না, মেয়েটার সাথে স্বামীটা যায় না। তাতে মেয়েটা খুশি হবে। আর যেখানে যাবাে, সেই ঘরেই বিয়ে করব। একটাই মেয়ে দেখব।
২৪ তারিখ পাত্রীর পরিবার আমাদের খোজ নিল। ২৬ আগস্ট দেখতে গিয়ে বিয়ে করে ফেললাম নবীনাকে। তখন রমজান মাস। ইফতার শেষে নিজের বাসায় কনে সহ ফিরলাম।
বিয়ে করে যন্ত্রনা আরও বেশি করে আমাকে ঘিরে ধরল। অভিনয় করে যাচ্ছি। বুকের ভতের কষ্ট চেপে রেখে চলাচল করছি। দুনিয়ার সব কিছু ছারখার করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। ৪ দিন পর ঈদ করলাম।
এদিকে মায়াবীর সাথে কোন যোগাযোগ নেই। এক এক টা দিন এক এক বছর মনে হয়। কোন এক ভাবে মায়াবী আমার বিয়ের খবর জেনে যায়। সে রাতেই সে দু পাতা সিডাক্সিন খায়। মাঝরাতে ওকে ক্লিনিকে নাকি ভর্তি করা হয়। তারপর ওয়াস করে পেট পরিস্কার করে। ৩দিন পর জ্ঞান ফেরে। তারপর থেকে অনেক দিন মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল।
ওর শ্বশুরবাড়ী বাপের বাড়ি সহ, এলাকাবাসী মোটামুটি সবাই জেনে ফেলে আমাদের প্রনয়ের কথা। তাদের যন্ত্রনায় মায়াবী নতুন এলাকায় বাসা ভাড়া নেয়। এত কিছুর কিছুই আমি জানতাম না। এদিকে রাগে দু:খে আমি মায়াবীর সাথে কোন যোগাযোগ করিনি প্রায় ২ বছর, মানে নবীনার সাথে বিয়ের পর থেকে। তবে এর ভেতরে কুরিয়ার আসল আমার হাতে। আমার এ যাবৎ দেয়া সব গিফট বড় একটা বক্সে মায়াবী আমাকে রিটার্ন দিয়েছে। সে রাতে সাওয়ার নিতে নিতে অনেক কাদলাম। শীতের রাতে ১ ঘন্টার বেশি পানিতে ভিজলাম...
এরও অনেক দিন পর মায়াবীর একটা মেসেজ পেলাম: কেমন আছো? সংসার জীবন কেমন লাগছে?
কয়েক দিন কোন উত্তর দিলাম না। কিন্তু ম্যাসেজটা কয়েকশত বার পড়া হয়ে গেছে। একটু পর পর চেক করতাম, নতুন কোন ম্যাসেজ আসছে কি না? ৪ দিনের দিন রিপ্লাই দিলাম: আল্লায় যেমন রাখছে তোমার দোয়ায়...
এর পর অনেক দিন আর কোন যোগাযোগ নেই। শেষে আমি লিখলাম, বউ বানাতে পারিনি, কথা ছিল আমাদের বন্ধুত্ব কখনও শেষ হবে না।
এরপর থেকে টুকটাক ম্যাসেজ চলত অফিস আওয়ারে। নবীনা এসবের কিছুই জানতো না। একদিন মায়াবীকে ফোন কল দিয়ে ফেললাম। ওর হ্যালো বলা শুনে পুরো গা শিউরে উঠল। কিছুক্ষণ কথা বের হলো না মুখ দিয়ে। বাংলালিঙ্ক থেকে ওর জিপি নাম্বারে কল করেছি। সে ৩য় বারের মতো হ্যালো বলল। তারপর বলল, কথা যখন বলবাই না, রাখলাম তাইলে...
আমি শুধু বললাম, তোমার কন্ঠ শুনছিলাম। কি বলব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই চুপ করে ছিলাম। কেমন আছো জিজ্ঞেস করতেই মায়াবী বলল, রাখি। ভাল থেকো।
বুকটা মুচড়ে উঠল। চোখে কেন যেন পানি চলে আসলো। আমি জানি ওপাশে সেও কাদছে। হয়ত ওড়না দিয়ে চোখ মুচছে বা ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে কাদছে। আমি অফিস থেকে বের হয়ে এলোমেলো ভাবে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বাইক চালালাম। অনেক রাত করে বাসায় ফিরলাম।
পরে শুনলাম, বিয়ের খবর শোনার পর প্রায় ৬ মাস সে পাগলের মত ছিল। কোন রকম বাচ্চাটার দেখা শোনা করত আর খাবার দিত। সুস্থ্য হবার পরে নতুন বাসায় মায়াবীর স্বামীর সাথে প্রায়ই ঝগড়া লেগে থাকতো। আমি এক সন্ধ্যায় ওর সাথে দেখা করতে গেলাম নতুন বাসার এলাকায়। যা বলতে গেছিলাম, তার কিছুুই বলা হল না। কয়েক মিনিটের মাথায় ফিরে আসলাম।
এরপর মায়াবী বাবার বাসায় এসে স্বামীকে ছাড়া প্রায় ২ বছর বাচ্চা নিয়ে কাটালো। সে সময়টাতেই আমাদের ম্যাসেজিং নতুন করে শুরু।
আরও অনেক গল্প ওর আর আমার। শেষ হবার না... ওপারে না যাওয়া পর্যন্ত চলতেই থাকবে।
আমার বা আমাদের জীবন গল্প সুখকর না। স্বপ্নের মত হতে পারত, হয়নি। কপালকুন্ড বলে কথা...
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২৫ সকাল ৮:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




