somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মা দিবসে মা কথন: ১১মে২০২৫

১১ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার মায়ের অসম্মতিতে অভিভাবকের অনুনয় বিনয়ের চাপে বিয়ে হয় আব্বার সাথে। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমার জন্ম। বংশের বড় নাতনি, তাও ছেলে। ছেলে জন্ম দেয়ায় মায়ের সন্মান বা আদর বেড়ে যায়। কিন্তু আব্বার ওপর মায়ের বিরাগ কমে না। আব্বা ছোট চাকরি করতো। মাসের বেতনের টাকার অর্ধেকটা দাদীকে দিয়ে দিতো। তাই নিজের সংসারে অভাব লেগেই থাকতো বা সাচ্ছন্দ বোধ সংসারে কমই ছিল। মা ইন্টারমেডিয়েট পর্যন্ত পড়ে পড়ালেখার ইস্তেফা দেয়, যদিও ছাত্রী হিসেবে মেধাবী ছিল।

এদিকে আমি সবার কোলে কোলে বড় হতে থাকলাম। ততদিনে দাদা বাড়ি ছেড়ে নানা বাড়িতে পুরোপুরি সিফ্ট হয়ে গেছি আমরা। নানা বাড়িতেই তবে ভাড়াটিয়ার মত। বাসাভাড়া দিতে হয়। ৪ বছর বয়সে আমি আলাদা হই। মানে মা বাবার সাথে আর ঘুমাই না। নানীর সাথে ঘুমাই। সে বছরেই আমার ছোট বোন জন্ম নেয়।

নানী আর মা দুজনে মিলে আমার পড়াশোনার হাতে খড়ি দেয়। ছোট বেলা থেকেই মা পেটাতো। তাই নানী আমাকে পড়াতে বসত। ক্লাস টু এ ওঠার পর নানী অংক বা নিয়ম কানুন তেমন বুঝতো না, বাধ্য হয়ে মার কাছে বসতাম পড়তে। আব্বা অফিস করে আড্ডা দিয়ে ফিরত রাত ৯-১০ দিকে। ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।



আশির দশক তখন। কারেন্ট যায় আসে, ১০০ ওয়াটের বাল্ব মোটামুটি এখনকার জিরো লাইটের মত জ্বলত। তাই হেরিকেনের আলোতে বেশির ভাগ সময় পড়তে হত। সন্ধ্যার পর চলত আমার ওপর গজব। প্রতিটা দিন।

সপ বা মাদুর বিছিয়ে পড়তে বসতাম। কখনও হাত পাখা, কখনও হলুদ কাঠের স্কেল, কখনও কাঠের বানানো স্কেল দিয়ে আমাকে চোর পেটার মত করে পেটাতো। কারন তেমন কিছু না। হয়ত লিখতে গিয়ে লাইন বাকা হল, হয়ত পেন্সিলে কাগজ ফুটা হয়ে গেল বা নামতা মুখস্ত বলতে পাচ্ছি না... হেন তেন চুন থেকে পান খসলেই মাইর। এত মার মারতো যে, আমার হাত কাধ পিঠ বা উরুর চামড়া ফুলে উঠত, কোন কোন দিন রক্ত বের হতো। আমার নানী বলে, যদি আমার পিঠের চামড়া তোলা যেত, তাহলে হয়ত, জখম ছাড়া কিছু দেখা যাবে না।

নানী মাঝে মাঝে আব্বাকে বলত, তোমরা অন্য বাসা ভাড়া নাও। চোখের সামনে নাতিটার এতো পিটন খাওয়া আর দেখা যায় না। আমার মেয়েটা একটা পাগল। খালা ফুফুরা তখন ছোট। মা'র ভয়ে তারা পড়ানোর সাহস পেত না। অভিযোগ পেলে আব্বা মাঝে মধ্যে পড়াতে বসত। দু চার দিন পর আবার আগের মত আব্বা তার কাজে দেরিতে ফিরত। আর আমি মার কাছে পিটন খেতে খেতে চোখের জল নাকের জল এক করে পড়তাম।

এভাবে ক্লাস ফাইভ। ততদিনে মার খেতে খেতে আমি মোটামুটি পাথর হয়ে গেছি। আমার শরীর টাও তখন খুব একটা ভাল না। মারতে মারতে মা হাফিয়ে যেত, কিন্তু আমি আর শব্দ করে কাদতাম না। সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেলে চোখ দিয়ে আমার পানি পড়ত। এতো টুকুই। মার তৃপ্তি না হওয়া পর্যন্ত পেটাতো। অনেক অনেক আজাইরা কথা বলত। মুখ খারাপ করে গালি দিত। আমি বুঝতাম, আমাকে এই বেধরক পেটানোটা তার রাগ কমানোর একটা জায়গা। অন্য কোন মানসিক অশান্তি বা স্বপ্ন পূরণ না হওয়াতেই আমার উপর এই নির্যাতন।

যাই হোক ক্লাস ফাইভে আমি একটা হোম টিউটর পেলাম। নির্যাতনের পরিমান কিছুটা কমল। তারপরেও সন্ধ্যায় পড়াতে বসত মা। ছোট বোনটাও পড়ত। মাইরের পরিমান কমলেও থামেনি। ক্লাস ৬এর পর গায়ে হাত দেয়া বন্ধ করল। কিন্তু কথার তীর ছোড়া বা গালাগালি চলতই।

আমার ছোট দু ভাইবোন কিন্তু আমার নির্যাতনের ১০ ভাগের ১ ভাগও ভোগ করেনি। এমন না যে আমি সৎ ছেলে। এখন আমরা সবাই ম্যাচউর। সবার বাচ্চা কাচ্চা আছে, সংসার করছে। এখনও মার আচরনে আমাকে ইগনোর বা উপেক্ষার প্রতিফলন আছে। আমার টাকা অন্য ভাই বোনদের পেছনে খরচ করবে। বাসায় সবাই থাকলেও নবীনা কে দিয়েই রান্না বান্না থেকে শুরু করে বাসা পরিষ্কার, ছাদভর্তি গাছপালায় পানি দেয়া ইত্যাদি সবই করাবে। একটা কাজের লোকের চেয়েও বেশি পরিশ্রমের কাজ নবীনা কে দিয়ে করাবে। ছোট ছেলে বউ কে বা নিজের মেয়েকেও একবার মুখ ফুটে বলবে না। পরিষ্কার গ্লাসে একবার পানি খেয়ে আবার ধুতে রেখে যাবে।

আমি সহ্য করতে না পেরে মুখ ফুটে মা কে বললাম, নবীনার কিছু কাজে ওরা হেল্প করলে কি ওদের সমস্যা হবে? ছোট বউ যদি সখ করে রান্না করার আবদার করে, সেদিন তুমি সব রেডি করে দাও, আর নবীনা রেগুলার করলেও তুমি হেল্প করো না। এক বাসায় দুরকম ভালবাসা দেখালে তো সমস্যা। আমরা তোমার সন্তান, কিছু মনে করবো না, ওরা অন্য পরিবেশ থেকে এসেছে, তোমার এখন এক চোখা হলে চলবে না। তুমি ছোট হয়ে যাবাতো। কে শোনে কার কথা !

এভাবেও আমার এবং আমার ঘরনীর উপর পরোক্ষ রেশারেশি চলে। আমার শ্বশুড় বাড়িতে ফোন দেয় না। কোন দাওয়াতে ডাক দিতে চায় না। অযুহাত, দাওয়াত দিয়ে কি হবে, আসবে না তো। অথবা বলে, আমি ছেলের মা, আমি কেন ফোন দেব???

আমি চাকরি সূত্রে দূরে থাকি। নবীনা প্রতি ২দিনে একবার ফোন দেয়। আমি ফোন না দিলে মাসের পর মাস কেটে যায়, আমাকে আমার গর্ভধারিনী মা কখনও ফোন দেবে না। যদি বলি, আমাকে একেবারেই ফোন দাও না ক্যান মা? মা বলে, তোর সাথে আর কি কথা? সব তো তোর বউয়ের কাছেই শুনি। আফসোস... এই না আমার মা !

যেদিন থেকে চাকরি পেয়েছি, সেদিন থেকে বাবা-মা কে হাতখরচ দেই। সেটা দিয়ে খাওয়া দাওয়া সব হয়ে যায়। আব্বার ক্যান্সার হলে, আমি অর্ধেকটা খরচ দিতাম। আমার অন্য ভাই বোনেরা কিন্তু দিত না। আব্বা গত হয়েছে। কিন্তু আজও আমি মার হাত খরচ দেই। অন্যরা আমার চেয়ে বেশি ইনকাম করলেও বা টাকা ম্যানেজ করতে পারলেও তারা দেয় না। তবুও আমি মার চোখে ভালবাসার পাত্র হতে পারিনি। আগেও না, এখনও না।

দাদী নানীর কাছে শোনা, আমি নাকি ভূমিষ্ট হবার পর থেকেই মায়ের দুধ খেতাম না। মা'র শরীর খুব রোগা পতলা থাকায় প্রথম ৩ দিন পর আর বুকে দুধও আসেনি। পরে ডাক্তারের কথা মত আব্বা কৌটার দুধ খাওয়াতো। খুব দামী হওয়াতে আব্বা দুধের কৌটা কিনতে হিমসীম খেত। পরে চাউলের গুরা, সুজি, গরুর দুধ এসব খাওয়ানো হত আমাকে। পেট খারাপ সারা বছর কমবেশি লেগেই থাকত আমার। মায়ের দুধের দাম হয়ত চোকাতে হবে না, কারন এক ফোটা দুধ আমার পেটে পড়েনি। কিন্তু জন্মদাত্রী হিসেবে তার ঋণ কখনও হয়ত শোধ হবার নয়। আমি আমার দায়ীত্ব পালন করে যাচ্ছি। কিন্তু কখনই মাকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি।

সবার ভাগ্যে মায়ের মত মা জোটে না। অনেকের মত আমিও মমতাময়ী মা পাইনি। পেয়েছি জন্মদাত্রী। কপালকুন্ড বলে কথা...


সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×