আমার মায়ের অসম্মতিতে অভিভাবকের অনুনয় বিনয়ের চাপে বিয়ে হয় আব্বার সাথে। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমার জন্ম। বংশের বড় নাতনি, তাও ছেলে। ছেলে জন্ম দেয়ায় মায়ের সন্মান বা আদর বেড়ে যায়। কিন্তু আব্বার ওপর মায়ের বিরাগ কমে না। আব্বা ছোট চাকরি করতো। মাসের বেতনের টাকার অর্ধেকটা দাদীকে দিয়ে দিতো। তাই নিজের সংসারে অভাব লেগেই থাকতো বা সাচ্ছন্দ বোধ সংসারে কমই ছিল। মা ইন্টারমেডিয়েট পর্যন্ত পড়ে পড়ালেখার ইস্তেফা দেয়, যদিও ছাত্রী হিসেবে মেধাবী ছিল।
এদিকে আমি সবার কোলে কোলে বড় হতে থাকলাম। ততদিনে দাদা বাড়ি ছেড়ে নানা বাড়িতে পুরোপুরি সিফ্ট হয়ে গেছি আমরা। নানা বাড়িতেই তবে ভাড়াটিয়ার মত। বাসাভাড়া দিতে হয়। ৪ বছর বয়সে আমি আলাদা হই। মানে মা বাবার সাথে আর ঘুমাই না। নানীর সাথে ঘুমাই। সে বছরেই আমার ছোট বোন জন্ম নেয়।
নানী আর মা দুজনে মিলে আমার পড়াশোনার হাতে খড়ি দেয়। ছোট বেলা থেকেই মা পেটাতো। তাই নানী আমাকে পড়াতে বসত। ক্লাস টু এ ওঠার পর নানী অংক বা নিয়ম কানুন তেমন বুঝতো না, বাধ্য হয়ে মার কাছে বসতাম পড়তে। আব্বা অফিস করে আড্ডা দিয়ে ফিরত রাত ৯-১০ দিকে। ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।

আশির দশক তখন। কারেন্ট যায় আসে, ১০০ ওয়াটের বাল্ব মোটামুটি এখনকার জিরো লাইটের মত জ্বলত। তাই হেরিকেনের আলোতে বেশির ভাগ সময় পড়তে হত। সন্ধ্যার পর চলত আমার ওপর গজব। প্রতিটা দিন।
সপ বা মাদুর বিছিয়ে পড়তে বসতাম। কখনও হাত পাখা, কখনও হলুদ কাঠের স্কেল, কখনও কাঠের বানানো স্কেল দিয়ে আমাকে চোর পেটার মত করে পেটাতো। কারন তেমন কিছু না। হয়ত লিখতে গিয়ে লাইন বাকা হল, হয়ত পেন্সিলে কাগজ ফুটা হয়ে গেল বা নামতা মুখস্ত বলতে পাচ্ছি না... হেন তেন চুন থেকে পান খসলেই মাইর। এত মার মারতো যে, আমার হাত কাধ পিঠ বা উরুর চামড়া ফুলে উঠত, কোন কোন দিন রক্ত বের হতো। আমার নানী বলে, যদি আমার পিঠের চামড়া তোলা যেত, তাহলে হয়ত, জখম ছাড়া কিছু দেখা যাবে না।
নানী মাঝে মাঝে আব্বাকে বলত, তোমরা অন্য বাসা ভাড়া নাও। চোখের সামনে নাতিটার এতো পিটন খাওয়া আর দেখা যায় না। আমার মেয়েটা একটা পাগল। খালা ফুফুরা তখন ছোট। মা'র ভয়ে তারা পড়ানোর সাহস পেত না। অভিযোগ পেলে আব্বা মাঝে মধ্যে পড়াতে বসত। দু চার দিন পর আবার আগের মত আব্বা তার কাজে দেরিতে ফিরত। আর আমি মার কাছে পিটন খেতে খেতে চোখের জল নাকের জল এক করে পড়তাম।
এভাবে ক্লাস ফাইভ। ততদিনে মার খেতে খেতে আমি মোটামুটি পাথর হয়ে গেছি। আমার শরীর টাও তখন খুব একটা ভাল না। মারতে মারতে মা হাফিয়ে যেত, কিন্তু আমি আর শব্দ করে কাদতাম না। সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেলে চোখ দিয়ে আমার পানি পড়ত। এতো টুকুই। মার তৃপ্তি না হওয়া পর্যন্ত পেটাতো। অনেক অনেক আজাইরা কথা বলত। মুখ খারাপ করে গালি দিত। আমি বুঝতাম, আমাকে এই বেধরক পেটানোটা তার রাগ কমানোর একটা জায়গা। অন্য কোন মানসিক অশান্তি বা স্বপ্ন পূরণ না হওয়াতেই আমার উপর এই নির্যাতন।
যাই হোক ক্লাস ফাইভে আমি একটা হোম টিউটর পেলাম। নির্যাতনের পরিমান কিছুটা কমল। তারপরেও সন্ধ্যায় পড়াতে বসত মা। ছোট বোনটাও পড়ত। মাইরের পরিমান কমলেও থামেনি। ক্লাস ৬এর পর গায়ে হাত দেয়া বন্ধ করল। কিন্তু কথার তীর ছোড়া বা গালাগালি চলতই।
আমার ছোট দু ভাইবোন কিন্তু আমার নির্যাতনের ১০ ভাগের ১ ভাগও ভোগ করেনি। এমন না যে আমি সৎ ছেলে। এখন আমরা সবাই ম্যাচউর। সবার বাচ্চা কাচ্চা আছে, সংসার করছে। এখনও মার আচরনে আমাকে ইগনোর বা উপেক্ষার প্রতিফলন আছে। আমার টাকা অন্য ভাই বোনদের পেছনে খরচ করবে। বাসায় সবাই থাকলেও নবীনা কে দিয়েই রান্না বান্না থেকে শুরু করে বাসা পরিষ্কার, ছাদভর্তি গাছপালায় পানি দেয়া ইত্যাদি সবই করাবে। একটা কাজের লোকের চেয়েও বেশি পরিশ্রমের কাজ নবীনা কে দিয়ে করাবে। ছোট ছেলে বউ কে বা নিজের মেয়েকেও একবার মুখ ফুটে বলবে না। পরিষ্কার গ্লাসে একবার পানি খেয়ে আবার ধুতে রেখে যাবে।
আমি সহ্য করতে না পেরে মুখ ফুটে মা কে বললাম, নবীনার কিছু কাজে ওরা হেল্প করলে কি ওদের সমস্যা হবে? ছোট বউ যদি সখ করে রান্না করার আবদার করে, সেদিন তুমি সব রেডি করে দাও, আর নবীনা রেগুলার করলেও তুমি হেল্প করো না। এক বাসায় দুরকম ভালবাসা দেখালে তো সমস্যা। আমরা তোমার সন্তান, কিছু মনে করবো না, ওরা অন্য পরিবেশ থেকে এসেছে, তোমার এখন এক চোখা হলে চলবে না। তুমি ছোট হয়ে যাবাতো। কে শোনে কার কথা !
এভাবেও আমার এবং আমার ঘরনীর উপর পরোক্ষ রেশারেশি চলে। আমার শ্বশুড় বাড়িতে ফোন দেয় না। কোন দাওয়াতে ডাক দিতে চায় না। অযুহাত, দাওয়াত দিয়ে কি হবে, আসবে না তো। অথবা বলে, আমি ছেলের মা, আমি কেন ফোন দেব???
আমি চাকরি সূত্রে দূরে থাকি। নবীনা প্রতি ২দিনে একবার ফোন দেয়। আমি ফোন না দিলে মাসের পর মাস কেটে যায়, আমাকে আমার গর্ভধারিনী মা কখনও ফোন দেবে না। যদি বলি, আমাকে একেবারেই ফোন দাও না ক্যান মা? মা বলে, তোর সাথে আর কি কথা? সব তো তোর বউয়ের কাছেই শুনি। আফসোস... এই না আমার মা !
যেদিন থেকে চাকরি পেয়েছি, সেদিন থেকে বাবা-মা কে হাতখরচ দেই। সেটা দিয়ে খাওয়া দাওয়া সব হয়ে যায়। আব্বার ক্যান্সার হলে, আমি অর্ধেকটা খরচ দিতাম। আমার অন্য ভাই বোনেরা কিন্তু দিত না। আব্বা গত হয়েছে। কিন্তু আজও আমি মার হাত খরচ দেই। অন্যরা আমার চেয়ে বেশি ইনকাম করলেও বা টাকা ম্যানেজ করতে পারলেও তারা দেয় না। তবুও আমি মার চোখে ভালবাসার পাত্র হতে পারিনি। আগেও না, এখনও না।
দাদী নানীর কাছে শোনা, আমি নাকি ভূমিষ্ট হবার পর থেকেই মায়ের দুধ খেতাম না। মা'র শরীর খুব রোগা পতলা থাকায় প্রথম ৩ দিন পর আর বুকে দুধও আসেনি। পরে ডাক্তারের কথা মত আব্বা কৌটার দুধ খাওয়াতো। খুব দামী হওয়াতে আব্বা দুধের কৌটা কিনতে হিমসীম খেত। পরে চাউলের গুরা, সুজি, গরুর দুধ এসব খাওয়ানো হত আমাকে। পেট খারাপ সারা বছর কমবেশি লেগেই থাকত আমার। মায়ের দুধের দাম হয়ত চোকাতে হবে না, কারন এক ফোটা দুধ আমার পেটে পড়েনি। কিন্তু জন্মদাত্রী হিসেবে তার ঋণ কখনও হয়ত শোধ হবার নয়। আমি আমার দায়ীত্ব পালন করে যাচ্ছি। কিন্তু কখনই মাকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি।
সবার ভাগ্যে মায়ের মত মা জোটে না। অনেকের মত আমিও মমতাময়ী মা পাইনি। পেয়েছি জন্মদাত্রী। কপালকুন্ড বলে কথা...
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




