আমাদের পায়ের নিচে মাটির ভিতরে লুকিয়ে থাকতে পারে মহা-মূল্যবান খনিজ সম্পদ, যা উত্তোলন করে আমরাও রাতারাতি আরবদের মতন ধনী হয়ে যেতে পারি! দ্রুততম সময়ে ধনী হওয়ার জন্য আপনি কি জানতে চান, ভূগর্ভের কোথায় মূল্যবান খনিজ ও আকরিক পাওয়া যেতে পারে? আপনি জেনে অবাক হবেন যে, এই প্রশ্নের উত্তর উইপোকাদের কাছে থেকে পাবেন।
খনিজ শিল্পে উন্নতির জন্য ভূগর্ভের কোথায় কী ধরণের খনিজ জমা আছে, তা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূতত্ত্ববিদরা মূল্যবান আকরিক ও খনিজ খুঁজে পেতে বিভিন্ন ধরণের কৌশল অবলম্বন করেন। উদাহরণস্বরূপঃ স্থানীয় চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের পরিবর্তন দেখে লোহার আকরিকগুলো সনাক্ত করা যায়। অন্যদিকে, বিকিরণ গ্রাহক যন্ত্র ব্যবহার করে ইউরেনিয়াম আকরিক আবিষ্কার করা সম্ভব হতে পারে। আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে, মাটির নমুনা সংগ্রহ করা এবং তার রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা। কিন্তু এই পদ্ধতিতে সমস্যা হলো, কয়েক মিটার নিচের ভূগর্ভস্থ মাটি থেকে ভূপৃষ্ঠের উপরের মাটি ধরণ আলাদা হয়। ফলে, ভূপৃষ্ঠের উপরস্থ মাটির নমুনা বিশ্লেষণ করে ভূ -অভ্যন্তরের মাটির প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। যদি খনিজ সম্পদের নমুনা ভূমির উপরিভাগে সহজেই লক্ষ্য করা যায়, তাহলে আমরা দ্রুত খনন করে সেখান থেকে আকরিক ও খনিজগুলো উত্তোলন করতে পারি।
যে খনিজ সম্পদ মাটির অভ্যন্তরে থাকে, তা খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। প্রথমে ড্রিলিং অথবা খনন করে ভূগর্ভের বিভিন্ন স্তরের মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এরপরে, তা পরীক্ষাগারে রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে খনিজগুলো সনাক্ত করা হয়। কার্যত এই পদ্ধতি অনেক ব্যয়বহুল। ঠিক এইখানেই উইপোকাগুলো বিনা পারিশ্রমিকে ভূ -অভ্যন্তরের বিভিন্ন স্তর থেকে মাটি খনন করে নমুনা এনে দিয়ে খনিজ সম্পদ সনাক্তকরণের খরচ অনেক কমিয়ে দিতে পারে।
আমার আগের পোস্ট বৈচিত্র্যময় উইয়ের ঢিবি - ছবি ব্লগে সাইয়িদ রফিকুল হক ভাই ও শের শায়রী ভাইকে বলেছিলাম মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং-এ উইদের অবদান নিয়ে লিখবো। আসুন, তাহলে দেখি উইরা মাইনিং করে কিভাবে এই ফিল্ডে অবদান রাখে।
উইদের মাইনিং:
উইয়ের ঢিবি গুলো সাধারণত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল, যেমনঃ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকাতে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। বৈরী আবহাওয়াতে ঢিবির অভ্যন্তরে, তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা স্থির থাকে। এছাড়া তাদের টাওয়ারে ছত্রাক চাষের জন্য স্থির আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মাটি খনন করে পানির সন্ধান করে (নিচের চিত্র)। কখনও কখনও তারা ৭৫ মিটার (২২৫ ফুট) বা শত মিটার গভীর পর্যন্ত পানির সন্ধান করে; একই সাথে, তারা ভূপৃষ্ঠের গভীরে বিভিন্ন স্তর থেকে শক্ত খনিজ পদার্থ, আকরিক ও মাটি সংগ্রহ করে তাদের টাওয়ারটি মেরামত করে ও বড় করতে থাকে।
ফলে উইদের টাওয়ারের মাটিতেই মিশ্রিত থাকতে পারে মূল্যবান খনিজ পদার্থের ছোট ছোট কণাগুলো। এই ক্ষুদ্র কণাগুলো-ই হচ্ছে মূল্যবান খনিজ ও আকরিক খুঁজে পাওয়ার পথচিহ্ন। এই চিহ্ন ধরেই উই-টাওয়ারের মাটি বিশ্লেষণ করে আশেপাশে ভূপৃষ্ঠের গভীরে কী খনিজ পদার্থ ও আকরিক থাকতে পারে তা জানা যায়।
সময়ের সাথে সাথে উই-টাওয়ারে খনিজ পদার্থের কণাগুলো জমে পার্শ্ববর্তী মাটির চেয়ে বেশি ঘন হয়। যা অনেক সময় স্পষ্ট ভাবে চোখে পড়ে। যেমনঃ নিচের ছবির উইয়ের ঢিবিতে ধাতব নীল-ধূসর আস্তরণ সুস্পষ্টভাবে খনিজ পদার্থের ইঙ্গিত দেয়, যা হতে পারে মূল্যবান খনির সন্ধান পাওয়ার পথচিহ্ন।
সিএসআইআরও‘র (CSIRO- Australian Commonwealth Scientific and Industrial Research Organization) বিজ্ঞানীরা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পিলবাড়া অঞ্চলে ছোট আকারের উইয়ের ঢিবি পরীক্ষা করে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪-৫ মিটার নিচে স্বর্ণের সন্ধান পেয়েছেন। এ অঞ্চলের ঢিবিতে উপরের ছবির মত ধাতব নীল-ধূসর ম্যাঙ্গানিজের স্তর দেখা যায়। গবেষকরা তা বিশ্লেষণ করে দস্তা বা জিঙ্ক (Zn) আইসোটোপের সন্ধান পেয়েছেন। অর্থাৎ ঢিবি পরীক্ষা করে সোনার খনির সন্ধানে নেমে বিজ্ঞানীরা মাটির নমুনা পরীক্ষা করে জিংকের আইসোটোপও খুঁজে পেয়েছেন। জিঙ্ক প্রায়শই অন্যান্য ধাতবগুলির সাথে মিলিতভাবে কোবাল্ট এবং নিকেলের আকরিকের সাথে পাওয়া যায়। এছাড়া এটি অন্যান্য উপাদান খুঁজে পাওয়ার পথ দেখায়। জিংকের বিভিন্নতা বা আইসোটোপগুলি সঠিক ভাবে পরিমাপ করা গেলে ভূগর্ভের অতি গভীরে থাকা মূল্যবান ধাতুর অস্তিত্ব নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। তারা এই কৌশল অবলম্বন করে ভূগর্ভে অন্যান্য ধাতুর আকরিকও খুঁজে পেয়েছেন। ভারতের বিজ্ঞানীরাও বিভিন্ন উইয়ের ঢিবি পরীক্ষা করে স্বর্ণ (Au) , ক্রোমিয়াম (Cr), তামা/ কপার (Cu) ও সীসা/লেডের (Pb) খনির সন্ধান পেয়েছেন।
মূল্যবান ধাতব পদার্থ যেমনঃ নিকেল (Ni) এবং কোবাল্টের (Co) মতো ধাতুগুলো বৈদ্যুতিক যানবাহন ও ব্যাটারি তৈরিতে দরকার পড়ে। ফলে, বিশ্বব্যাপী এই ধাতুগুলোর চাহিদা অনেক বেশি।এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে উক্ত ধাতব পদার্থগুলোর নতুন নতুন খনি খুঁজে পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর গবেষকরা ধারণা করেছেন যে, উইয়ের ঢিবির মাটি বিশ্লেষণ করে মূল্যবান ধাতুগুলোর নতুন খনি খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে আফ্রিকাতে বড় আকারের উইয়ের ঢিবি থেকে সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ করে সেখানে বিভিন্ন ধরণের খনিজ সম্পদের সন্ধান পেয়েছেন। উত্তরাঞ্চলীয় ইথিওপিয়াতে গিবা নদীর অববাহিকায় উইয়ের ঢিবি পরীক্ষা করে স্বর্ণ (Au), রৌপ্য (Ag), তামা (Cu), দস্তা (Zn), কোবাল্ট (Co), ম্যাঙ্গানিজ (Mn), আয়রন/লৌহ (Fe) এবং নিকেল (Ni) পাওয়া যায়। পরীক্ষায় আরো দেখতে পাওয়া যায়, উইয়ের ঢিবির মাটিতে ধাতুর অনুপাত মূল আকরিকে ধাতুর অনুপাতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে কী পরিমান আকরিক খনিতে থাকতে পারে তাও অনুমান করা সম্ভবপর।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উইয়ের ঢিবির ভিতরের মাটিতে মূল্যবান ধাতু স্বর্ণ , রৌপ্য , তামার আকরিকের চিহ্ন থাকতে পারে। এছাড়া বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, মানুষের কিডনিতে পাথর জমার মত উইদের পরিপাকতন্ত্রেও এইসব উপাদানের চিহ্ন থেকে যায় (উপরের চিত্র)। এই অনুসন্ধানটিও গুরুত্বপূর্ণ কারণ ঢিবিতে থাকা উইয়ের বিষ্ঠাযুক্ত মাটিতে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে ধাতুগুলোর খনির ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকতে পারে।
মাটির রাসায়নিক বিশ্লেষণ:
উইরা ভুপৃষ্ঠের গভীর থেকে মাটি খনন করে এনে তাদের ঢিবি বানায়। ঢিবির মাটিতে পাওয়া উপাদান আশেপাশের মাটি থেকে পাওয়া উপাদানের চেয়ে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই উইদের ঢিবি বিশ্লেষণ করে আমরা ভূগর্ভস্থ আকরিক সনাক্ত করতে পারি, যা ইতিমধ্যে আলোকপাত করা হয়েছে। এসব মাটির রাসায়নিক বিশ্লেষণ অনেক সহজ করে দিয়েছে ফিল্ড পোর্টেবল এক্সআরএফ এনালাইজার (Field Portable XRF analyser)। উপরের চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে, বিজ্ঞানীরা উইয়ের সরাসরি ঢিবির মাটিতে X-ray fluorescence (XRF) বা এক্সআরএফ প্রয়োগ করে মাটির বিশ্লেষণ করছেন।
এক্ষেত্রে, মাত্র ১- ২ মিনিটে জানা সম্ভব উইয়ের ঢিবির মাটিতে কী কী উপাদান আছে। ফিল্ড পোর্টেবল এক্সআরএফ এনালাইজার ব্যবহার করা খুব সহজ। এক্সআরএফ কি ও কিভাবে ফিল্ড পোর্টেবল এক্সআরএফ এনালাইজার ব্যবহার করতে হয়, তা সংক্ষেপে নিম্নের ২টি ভিডিওটি তে দেখতে পাবেন।
এছাড়াও উইয়ের ঢিবি থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করে তা গুড়া করে নমুনা প্রস্তুত করে, পরীক্ষাগারে তার এক্সআরএফ বিশ্লেষণ করেও মাটিতে মূল্যবান উপাদান গুলোর পরিমাণ জানা সম্ভব। নিচের ভিডিওতে তা কিভাবে করা যেতে পারে তার একটি ধারণা পেতে পারেন।
উইপোকাদের মাটির ঢিবি বিশ্লেষণ করে স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান খনিজ পদার্থ ও ধাতুর খোঁজার কৌশলটি পশ্চিম আফ্রিকাতে অনেক পুরোনো। ১৯৬০ সাল থেকে আধুনিক মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং এই পদ্ধতি ব্যবহার করে। প্রাচীন এবং সস্তা পদ্ধতি কৌশল প্রয়োগ করেই ১৯৭৩ সালে মোজাম্বিকের ভিলা মানিকা তামার খনিটি, এরপরে বোতসোয়ানাতে বিশ্বের বৃহত্তম কিম্বারলাইট হীরার খনি আবিষ্কার করা হয়েছিল।
সর্বোপরি, উইরা যখন আপনার জন্য ভূগর্ভ থেকে খনিজ উপাদানের নমুনা এনে দিতে পারে, তখন কেন কষ্ট করে আপনি ড্রিলিং অথবা খনন করে নমুনা সংগ্রহ করবেন! বিশ্বব্যাপী ৭৫% স্বর্ণ উত্তোলনের ক্ষেত্রে বিষাক্ত সায়ানাইড ব্যবহার করা হয়, যা পরিবেশের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ । উইপোকাকে ব্যবহার করে স্বর্ণ উত্তোলনের এই বিকল্প পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিতে কম ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে অধিক স্বর্ণ উৎপাদন করে ভোক্তাদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতে পারে। তাই বলা যেতে পারে, উইপোকাদের ব্যবহার করে সহজে ও সস্তায় খনিজ সম্পদ আবিষ্কারের পদ্ধতিটি ভূতত্ত্ব ও মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং-এ নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে।
তথ্যসুত্র ও কৃতজ্ঞতাঃ
[১] পোস্টে প্রথম ছবিসূত্রঃ Mineral / Mining Analysis with Skyray XRF Spectrometers
[২] Termite mounds as bio-indicators of groundwater: Prospects and constraints
[৩] Termites: So Rich Their Nests Are Made Of Gold
[৪] Scientists say ants and termites are mining gold
[৫] Termite mound as an Effective Geochemical Tool in Mineral Exploration: A Study from Chromite Mining Area, Karnataka, India
[৬] Termites and humans searching more gold in Mali
[৭] Find Gold Using Termites! - An ancient cheap African method
[৮] Use of termite mounds in geochemical exploration in North Ethiopia
[৯] Pesky termites are proving useful in finding nickel and cobalt
[১০] A nest of little gold-diggers
[১১] Termites are a miner's best friend
[১২] Using hand-held XRF as an indicator for mineralisation in termite hills
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০২০ ভোর ৪:৩৮