somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্পিলবার্গের লিংকন: চলচ্চিত্রে প্রেসিডেন্ট লিংকন ও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্পিলবার্গের লিংকন: চলচ্চিত্রে প্রেসিডেন্ট লিংকন ও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়

তারিক আল আজিজ

চ্যালেঞ্জ ছিল ইতিহাস খ্যাত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সঠিক চরিত্রায়নের। সেই আব্রাহাম লিংকন, যাকে ঘিরে শুধু মার্কিন মুল্লুকের নাগরিকদের নয়, ইতিহাস সচেতন কিংবা গণতন্ত্রমনা মানুষদেরও আবেগ কাজ করে। ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে বাস্তবসম্মত করে চিত্রায়নের চ্যালেঞ্জ ছিল। জেনেশুনেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন স্পিলবার্গ ও তাঁর দল। সময়ের সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক বেশ সফলতার সাথেই পর্দায় তুলে এনেছেন প্রেসিডেন্ট লিংকনকে। সাথে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কেও।
‘লিংকন’ চলচ্চিত্রটি ১৮৬৫ সালের প্রথম দিকের কথা বলে। যে সময় ‘আমেরিকান সিভিল ওয়ার’ চার বছরে পা দিয়েছে। দাস প্রথা বিলোপের প্রশ্নটি তখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট লিংকন নানা ধরণের প্রতিকুলতা পাড়ি দিয়ে কী করে দাস প্রথা বিলোপে ভূমিকা রেখেছিলেন তাই এই চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে। দাস প্রথা বিলোপে প্রেসিডেন্টের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও তাঁর সাহসিকতা চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। আব্রাহাম লিংকনকে পর্দায় এনেছেন ‘গ্যাংস অব নিউইয়র্ক’, ‘দেয়ার উইল বি ব্লাড’ খ্যাত অভিনেতা ডেনিয়েল ডে লুইস।
প্রেসিডেন্ট দাস প্রথা বিলোপে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশের ক্ষেত্রে নানামুখী বিরোধীতার সম্মুখিন হয়েছেন। এমনকি প্রেসিডেন্টের স্ত্রী মেরি টড লিংকনও (শেলি ফিল্ড অভিনিত) এর বিরোধীতা করেন। চলচ্চিত্রের প্রথম দিকেই তাকে আবেগঘন কণ্ঠে স্বামীকে বলতে দেখা যায়, ‘কেউ তোমার মত ভালোবাসার পাত্র নয়। জনগন কখনোই কাউকেই তোমার মত ভালোবাসেনি। তুমি এখন যে কোন কিছুই করতে পারো। কিন্তু এই সংশোধনীর পক্ষে দাঁড়িয়ে তোমার শক্তির অপচয় করো না ..’।
প্রেসিডেন্ট লিংকনের চরিত্রে ডেনিয়েল ডে লুইসের অভিনয় অসাধারন। নানান চরিত্র রূপদানে দক্ষ এ অভিনেতা যে এই চরিত্রের জন্য অনেক চিন্তা করেছেন তা বোঝা যায়। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম ধীরে কথা বলেন। সংযমী, আবার তাঁর মাঝে কৌতুকপ্রিয়তাও কাজ করে। পতাকা উত্তোলনকালে প্রেসিডেন্টের দেয়া স্বল্প বাক্যের বক্তব্যটি অসাধারণ। প্রেসিডেন্ট চোখে চশমা পড়ে মাথার ক্যাপের নীচ থেকে একটা কাগজ বের করেন। কাগজের ভাঁজ খুলে দেখে দেখে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন।
‘আমাকে পতাকা উত্তোলনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কোন কারিগরি ত্রুটি না থাকলে আমি এটা করবো। পতাকা উত্তোলিত হবার পর জনগনের দায়িত্ব হবে একে উঁচুতে ধরে রাখা’। বলে প্রেসিডেন্ট কাগজটি ভাঁজ করে ক্যাপের ভেতর রাখতে রাখতে বলেন, ‘এটাই আমার বক্তব্য’। প্রেসিডেন্টের কথামালায় অভিভূত জনগন হাসে ও হাততালি দেয়।
চলচ্চিত্রের শুরু হয়েছে সিভিল ওয়ার দেখানোর মধ্য দিয়ে। শুরুটা যে কারোর চোখকে আকর্ষণ করার মত। যুদ্ধের খণ্ড খণ্ড শট। একটু পরেই সংলাপ শোনা যায়। এরপরই দেখা যায় একজন নিগ্রো সৈনিক সেই যুদ্ধের বর্ণনাই প্রেসিডেন্টকে শোনাচ্ছেন। পাশে দাঁড়ানো আরেকজন। প্রেসিডেন্ট মনযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনছেন। ফাঁকে দু’জন শেতাঙ্গ সৈনিক এসে প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলেন। এভাবে নিগ্রো, শেতাঙ্গকে নিয়ে এসে প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলানোর মাধ্যমে আব্রাহাম লিংকনের মানুষকে সমান চোখে দেখার নীতিকেই তুলে ধরা হয়েছে বলে মনে হয়। নিগ্রো সৈনিকের প্রস্থানকালের সংলাপ সত্যিই ভালো লাগার মত।
‘দ্যাট দিস ন্যাশন আণ্ডার গড, শ্যাল হ্যাভ আ নিউ বার্থ অব ফ্রিডম, এন্ড দা গভর্ণমেন্ট অফ দা পিপল, বাই দা পিপল, ফর দা পিপল, শ্যাল নট পেরিশ ফ্রম দা আর্থ’। গণতন্ত্রের যে সংজ্ঞা আমরা বইয়ের পাতায় পড়ে থাকি, তার অসাধারণ চিত্রায়ন দেখে বিমোহিত হই।
চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার টনি কুশনার। ডরিস কার্ন গুডউইনের বই থেকে একটি অংশকে তিনি চিত্রনাট্যে তুলে এনেছেন। ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কেই তিনি বাছাই করেছেন। এর আগে টনি কুশনার স্পিলবার্গ পরিচালিত ‘মিউনিখ’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন। আমার মতে, চলচ্চিত্রের সফলতার জন্য টনি কুশনার অনেক বড় ভূমিকা রেখেছেন। প্রথম ধন্যবাদ তাঁকেই দিতে হয়। ভালো চিত্রনাট্য পরিচালকের কাজকে সহজ করে দিয়েছে বলে মনে হয়।
চমৎকার সব সংলাপ, নাটকীয়তা তৈরি করে এগিয়ে গেছে চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্রের ভিজুয়ালাইজেশনও অসাধারণ। প্রেসিডেন্ট লিংকনের দেখা স্বপ্নকে যেভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে তা দর্শক মনে আবেদন তৈরি করার মত। পরিচালক সময়কে মাথায় রেখে বাস্তবসম্মত আলোর ব্যবহার করেছেন। ঘরোয়া দৃশ্য নেয়ার ক্ষেত্রে আলোর উৎস হিসেবে জানালা বেয়ে আসা আলোকে বড় করে দেখানো হয়ছে। সবকিছুর মাঝেই সময়কে ধরার চেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়।
চলচ্চিত্রে প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর চরিত্রে শেলি ফিল্ডের অভিনয়ও ভালো লেগেছে। ‘লিংকন’ ইতোমধ্যেই অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতাসহ আরো কয়েকটি পুরস্কার এই চলিচ্চিত্রের ঝুলিতে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ডেনিয়েল ডে লুইস ইতোমধ্যে এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য গোল্ডেন গ্লোবে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন।
একটা কথা বলা দরকার। প্রথম দেখায় ‘লিংকন’ আমার খুব ভালো লাগেনি। কিন্তু কী মনে হওয়াতে চলচ্চিত্রটি আবার দেখি। এরপর বেশ কিছু অংশ বারবার টেনে টেনে দেখেছি। দ্বিতীয়বার দেখার পর থেকেই মনে হচ্ছে, স্পিলবার্গ এক অসাধারণ কাজ করেছেন। হয়তো এই চলচ্চিত্রে ‘শিন্ডলার্স লিষ্ট’ এর বিশাল কলেবর নেই, ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ এর অ্যাকশন নেই; তবুও এই চলচ্চিত্র নিজস্ব মহিমায় ভাস্বর।
আমরা যতটা না বুঝতে পারবো, মার্কিন নাগরিকরা এই চলচ্চিত্র যে তার চেয়ে আরো ভালো বুঝতে পারবেন, তা বলা বাহুল্য। ইতিহাসের বাস্তবতার সাথে চলচ্চিত্রিক বিচার তারাই ভালো করতে পারবেন। কয়েকটি সমালোচনা পড়ে দেখলাম, সমালোচকরাও চলচ্চিত্রটিকে ভালো ভাবেই নিয়েছেন।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ১৮৬৫ সালে ফটোগ্রাফিও শুরু হয়নি। শিল্পীর আঁকা চিত্র, বই-পত্র ঘেঁটে, গবেষণার সাহায্যে এই চলচ্চিত্রকে পর্দায় আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে জানতে বা সেই সময়কে জানতে মানুষ যে এই চলচ্চিত্রেরও আশ্রয় নিবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:১২
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×