গণহত্যা বন্ধ করতে জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপ করতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের চিঠি
আগুনে জীবন্ত পুড়ছে আরকানি মুসলমানরা
* মানুষ খেকো সরকারী বাহিনী ও বৌদ্ধদের পরিকল্পিত আক্রমণ
* মাত্র তিনটি গ্রামে পুড়ানো হয়েছে ৫৫শ’ ঘড়বাড়ি
* নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক অব্যাহত, কঠোর অবস্থানে বাংলাদেশ
* যুদ্ধজাহাজ নিয়ে আক্রমণ, সাগরে লাশের ঢেউ
মুসলিম অধ্যুষিত জনপদ মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে দাউ দাউ করে আগুনে জ্বলছে। আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছে মুসলমানদের শত বসতভিটে। গতকাল যে লোকটি সহায় সম্পদশালী ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সহায় সম্পদ হারিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে। লুণ্ঠিন বাহিনী লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে সহায় সম্পদ। বৌদ্ধ রাখাইন সন্ত্রাসীরা নিরীহ মুসলমানদেরকে হত্যা করে লাশ সগারে ভাসিয়ে দিচ্ছে। এসব লাশ বাংলাদেশের পানিসীমানায় প্রবেশ করছে। এদিকে মিয়ানমারে নৌ-বাহিনীর আরো দুইটি যুদ্ধ জাহাজ সাগরে অবস্থান করছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানিয়েছে। সেনাবাহিনী একতরফা ভূমিকা পালন করছে। মংডু বমু পাড়াতে ১২ জুন সকাল ১০টার সময় দুটি মুসলমানের ঘর পুড়িয়ে দিয়ে ভাংচুর লুটপাট চালায়। দেশটির বিশেষ বাহিনী তথা লুণ্ঠক বাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীরা যৌথভাবে মিলে আরাকানের মুসলিম অধ্যুষিত জনপদ বন্দরনগরী আকিয়াবের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় গ্রাম নাজির পাড়ার প্রায় ২৭শ’ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে। পুড়িয়ে দিয়েছে বেশ কয়েকটি মসজিদ ও দোকানপাট। মুসলমানদের মৃত লাশ গাড়িতে করে নিয়ে সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছে এবং জীবিত ব্যক্তিদেরকে ধরে নিয়ে গাড়িতে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমার সরকার দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে সেনাবাহিনী নামানোর পাশাপাশি গত ইয়াওমুছ ছুলাছায়ি (মঙ্গলবার) আকিয়াব বন্দরের তাদের নৌসীমানায় দুটি ফ্রিগেট নিয়মিত টহল দিচ্ছে। মুসলমানরা আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে মিয়ানমার নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে পড়ে তাদেরকে সাগরে ডুবিয়ে মারা হচ্ছে। ইয়াওমুছ ছুলাছায়ি (মঙ্গলবার) এসব লাশ সেন্টমাটিনের অদূরে দেখেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী টেকনাফ নয়াপড়ার খুরের মুখের জেলে আবদুশুক্কুর ২টি লাশ দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। ইয়াওমুছ ছুলাছায়ি (মঙ্গলবার) সকালে ১০টার দিকে আকিয়াবের মৌলভী পাড়া ও হাড্ডিহলা গ্রামের প্রায় ২৫শ’ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আকিয়াবের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি:
আরকানে বৌদ্ধ রাখাইন সন্ত্রাসীরা শুধু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ক্ষান্ত হয়নি। মুসলমানদের নগদ টাকা স্বর্ণঅলংকার লুট পাট করে নিয়ে যাচ্ছে। ১২ জুন সকাল ৯টার সময় মংডু বাজারের সামনে মুহম্মদ আলীর রামং ফার্মেসী ও বাড়ির মালামাল লুটকরে নিয়ে যায় রাখাইনেরা। ৩নং সেক্টরে কুকুমো ও আকিয়াব থাইমোসহ সেনাবাহিনী কর্মকর্তার সম্মুখে ঘরবাড়ি ও মসজিদে আগুন ও ভাংচুর করে। আকিয়াবের জেলার মুসলিম অধ্যূষিত এলাকা মেরে বং অগ্নিসংযোগে নিহতদের মাথান্যাড়া করে ভিক্ষুদের লাল পোশাক পরিয়ে দিয়ে মিয়ানমারের টেলিভিশন চ্যানেলে ও ওয়েবসাইটে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এদিকে মংডু ওলামা পার্টির নেতা ছিদ্দিক বাড়িতে ও ৪নং সেক্টরের থানা পুলিশসহ মিলে মুহম্মদ খান ও তৈয়ুবার বসতবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং গদুছড়ার বাজার থেকে রাখাইন সন্ত্রাসীরা মুসলমানদের মালামাল লুট করছে। বুসডং থানাধীন টংবাজার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার উচ্চবিত্ত ২শ’ নেতৃস্থানীয় মুসলিমকে সেনাবাহিনীকে আরাকান রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনের নামে পাঠানো হলেও মূলত তারা মুসলমানদের দমন এবং রাখাইনদের সহযোগিতার পাশাপাশি তাদের সীমান্ত এলাকাকে জোরদার করেছে। মুসলমানেরা ঘর থেকে বের হতে পারছে না। অনেকের পরিবারে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদছে। মংডুসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে রাখাইনদের ও নাসাকা ও পুলিশের অত্যাচারে সহ্য করতে না পেরে জীবন বাচানোর লক্ষ্যে অনেকে যে দিকে পাচ্ছে সেদিকে পালাচ্ছে। তারা জেনেছে মুসলমানদের হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলা হচ্ছে। লুটপাট চালানো হচ্ছে মংডু শহরে মুসলমানদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। পুলিশ প্রহরায় রাখাইনরা হামলা চালাচ্ছে মুসলমানদের উপর।
এক রোহিঙ্গার বর্ণনা :
পেঠান আলী বয়স ৮০ উর্ধ্ব আরাকানের রাজধানী আকিয়াবের জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা। পেশায় কৃষক। ১০ জুন রবিবার দুপুরের আহার শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন বাড়ীতে। চোখে একটু তন্দ্রা ভাব আসতে না আসতেই বাড়ীর আশা পাশে শোরগোলের শব্দ। কাঠের দোতলা বাড়ীর সদর দরজা খুলতেই দেখে পাশের পাড়ায় বাড়ী ঘরে আগুনের লেলিহান শিখা। মুহুর্তেই দা কিরিচ আর লাঠি হাতে পেঠান আলীর বাড়ীতে হানা দেয় একদল সন্ত্রাসী যুবক। তারা সকলেই বৌদ্ধ। পেঠান আলীর সামনেই তার চাচাতো ভাইয়ের পরিবারের ৪ জনকে খুন করা হয়। জ্বালিয়ে দেয়া হয় তার চাচাতো ভাইয়ের বাড়ী। পেঠান আলীর বাড়ীটি পেছনে হওয়ায় তখনো তার বাড়ীতে আগুন দিতে পারেনি। ততক্ষনে তার বাড়ীতে ভিড় করে পুড়ে যাওয়া অপরাপর বাড়ীর আহত ও অক্ষত লোকজন। তারা জানালো পাশের পাড়ায় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে উগ্র বৌদ্ধ যুবকেরা। বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। চলছে ব্যাপক লুটপাট। ১২ জুন ইয়াওমুছ ছুলাছায়ি মঙ্গলবার দুপুরে আরাকানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে বাঁচতে টেকনাফে পালিয়ে আসা আহত পেঠান আলী জানায় এসব কথা।
তিনি জানান, ঐদিন সন্ধ্যা নামতেই তিনি তার পরিবারের ৭ জন এবং অন্য আত্মীয় স্বজন মিলে পার্শ্ববর্তী একটি নদীর তীরে এসে ছোট ইঞ্জিন নৌকায় উঠে গভীর সাগরে পাড়ি দেন। তাদের ছোট্ট বোটে ৪০/৪৫ জনের মতো অন্য রোহিঙ্গা মুসলমান ছিল। তিনি আরো জানান, গভীর সাগরে এসে দেখে তাদের মতো ৪০/৪৫ টির মতো ইঞ্জিন বোটে করে অসংখ্য মুসলমান নিয়ে তারা বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। কিছু দুর এসে দেখে আকিয়াবের উপকূলে মুসলিম পাড়াগুলো জ্বলছে। সারা রাত চলতে থাকে তাদের ট্রলার। সকালে বাংলাদেশের জলসীমায় এসে তারা বিজিবি ও কোস্টগার্ডের বাঁধার মুখে পড়ে। গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় নাফ নদীর পাড়ে পেঠান আলীকে স্থানীয় লোকজন নামিয়ে চিকিৎসা দেয়। কিন্তু তার পরিবারের অন্য সদস্যদের বিজিবি গভীর সাগরের দিকে তাড়িয়ে দেয়। পেঠান আলী জানে না তার স্ত্রী পুত্র কন্যারা কোথায়। মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে।
মজলুম মুসলমানদের পুশব্যাক, কঠোর অবস্থানে আ’লীগ সরকার:
সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারে চলমান অস্থির পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার দেশটি থেকে পালিয়ে আসা এক হাজার মুসলমান শরণার্থী বহনকারী তিনটি নৌকা ফিরিয়ে দিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। এনিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে দাঙ্গা পরিস্তিতিতে পালিয়ে আসা মোট ১৫’শ শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করলো বাংলাদেশ। সূত্র: এপি
এ বিষয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে মোবাইল ফোনে পুলিশ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, বাংলাদেশে যেন কেউ ঢুকতে না পারে সেদিকে আমরা নজর রাখছি। তিনি সহস্রাধিক শরণার্থী বহনকারী তিনটি নৌকা মিয়ানমারের দিকে ফেরত পাঠানোর কথা স্বীকার করেন।
এদিকে, মায়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আবারো কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় দেয়ার ধারণা পুনরায় প্রত্যাখান করা হয়েছে, খবর: বাসস।
উল্লেখ্য গত ১২ই জুন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে, মায়ানমারে দেশটির সরকারের নেয়া পদক্ষেপের প্রশংসা এবং রাখাইন রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মায়ানমারের সরকার ও জনগণের পাশে থাকার অঙ্গিকার ব্যক্ত করা হয়।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান এবং দু’দেশের জনগণের স্বার্থে সাম্প্রতিক সময়ে বহুমুখী দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সন্তুষ্টি প্রকাশ:
মিয়ানমারে মুসলিম গণহত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের প্রতিক্রিয়ায় এখনো পর্যন্ত বার্মার সরকারের কোনো সমালোচনা করেনি। উল্টো ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, প্রেসিডেন্ট থিন সিয়েন-এর সরকার যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে তাতে তারা সন্তুষ্ট।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক দূত ক্যাথরিন অ্যাশটনের পক্ষে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিরাপত্তা বাহিনী যথাযথভাবে দমনের চেষ্টা করছে বলে তারা আশা করে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও বার্মার ব্যাপারে যে বিবৃতি দিয়েছে, তার ভাষাও কিন্তু অনেকটা একই রকম।
গণহত্যায় হস্তক্ষেপ করতে বান কি মুনকে চিঠি :
মায়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয় রুখতে জাতিসংঘকে ভূমিকা নিতে প্রায় অর্থ ডজন সংগঠন চিঠি পাঠিয়েছে। গত ১১ জুন তারা জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বানকি মুনের কাছে খোলা চিঠি প্রেরণ করে। সেখানে জাতিসংঘের প্রতি এক আহবানে বলা হয়, “হস্তক্ষেপ করুন এবং মিলিয়ন মিলিয়ন রোহিঙ্গাকে পরিকল্পিত গণহত্যা থেকে রক্ষা করুন।” চিঠিতে স্বাক্ষর করেন থাইল্যান্ডে বার্মিজ রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংগঠন বিআএটি’র প্রেসিডেন্ট মাওয়াং কায়া নু। তিনি জানান, “নারী শিশুসহ লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে শহীদ করা হচ্ছে।” অন্যান্য সংগঠনগুলো জানায়, “সরকারিবাহিনী ও সন্ত্রাসী রাখাইনরা নিরীহ মুসলমানদের জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে শহীদ করছে।”

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


