somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আপন ফেরোমনে আমিই মাতাল...

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হিমাঙ্কের নিচ থেকে সে আমায় ডেকে তোলে। স্নান করে প্রসাধন শেষে লেখার টেবিলে বসতে হয়, জানো তো কন্যা! ওঠো! বেলা বয়ে যায়!
আমার জেগে উঠতে ইচ্ছে করে না। দীর্ঘ, হ্রস্ব কোনো বাক্য রচনা করার আগ্রহ খুঁজে পাই না।
আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকি...
বসে থাকি...
নিজেকে সময় দেই।
বাইরে বের হবে তুমি!
হুম।
তুমি না অফিসের বাইরে কোথাও যাও না!
এখন থেকে যাবো।
নিজস্ব অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাইরে টিকে থাকতে পারবে!
পারবো!
ভেবে দ্যাখো।
আমি জানি একা থাকতে থাকাটা একটা নেশার মতো! নিজের মতো থাকা যখন এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়, তখন আর তখন আর জনসমাগম ভালো লাগে না। তথাপি জীবন গতিময়। তাকে স্থবির করে দেয়া মানে মৃত্যু। এখনো মৃত নই আমি। তাই দীর্ঘ দীর্ঘ দিবস-রজনীর খোলস থেকে নিজেকে বের করে আ্নবোই।
কোথায় যাচ্ছ শাঁওলী!
বইপাড়ায় ।
আহা! কতোদিন কতোদিন পর আমি বইপাড়ায় যাচ্ছি।
তুমি না , আমি যাচ্ছি।
আমিও যাচ্ছি। তুমি কেরানি, অফিস করো। আমি লিখি, তাই আমি বইপাড়ায় যাচ্ছি।
না, তুমি যাচ্ছো না।
রেগে যাচ্ছো কেন? আমি আর তুমি কি আলাদা!
হ্যাঁ আলাদা, তুমি আমার জীবনকে ধ্বংস করেছ। তুমি বলেছ, শাঁওলী নিজের পায়ের নিচে মাটি বানাও। শাঁওলী অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হও।
ঠিকই তো বলেছি।
ঠিকই বলেছ , আমার জীবন থেকে কতোগুলো সময় নিয়ে নিলে। প্রতিদিন কাওরান বাজার পর্যন্ত যাই, আর একটু পা বাড়িয়ে কোথাও যেতে পারি না। আগে প্রতিদিন বইপাড়ায় যেতাম। মন খারাপ হলে রিক্সায় শাহবাগ থেকে ফুলার রোড হয়ে দোয়েল চত্বর দিয়ে একচক্কর ঘুরে আসতাম। ঘুরে এলেই মন ফুরফুরে! আর বইপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত লেখক, কবি, উঠতি কবি, সুন্দর সুন্দর শাড়িপরা নারী, থরে থরে বিন্যস্ত বই! কি ঘ্রাণ সেই সময়ের! এখনো মনে করতে পারি।
স্মৃতি তো ঘ্রাণ ধরেই আসে! সময়ের কথা মনে পড়া মানে ওই সময়ের ঘ্রাণ মস্তিষ্ক বাইরে নিয়ে আসে।
হুম, অনেক জ্ঞানী তুমি! সেই বইপাড়ায় মাঝে মাঝে হুমায়ূন আজাদ স্যার আসতেন। মাঝে মাঝে কেন প্রায় নিয়ম করেই আসতেন। নানা গল্পের মাঝে আকিমুন রহমানের কথা বলতে ভুলতেন না কখনো। নারী লেখক বলতে তিনি একমাত্র আকিমুন রহমানকেই বোঝেন। তিনি বলেন, কোনো নারী লেখক ওঁর মতো লিখতে পারে না।
তখনও তাঁকে চিনিনা ওভাবে। কেবল ‘বিবি থেকে বেগম; গ্রন্থটি পড়েছিলাম। আমি আর তপতী একসঙ্গে বসে বইটি পড়েছিলাম। তপতী বলল, দেখছিস, কেমন লেখিকা, বেগম রোকেয়াকেও ছেড়ে কথা বলেননি।
তপতীর কথায় বললাম, হুম! উনি যদি ওই সময় জন্মগ্রহণ করতেন রোকেয়া হয়ে, তাহলে উনিও এই রোকেয়ার মতো কাজই করতেন। বেগম রোকেয়া অগ্রগামী ছিলেন বলেই না আজ তিনি আকিমুন রহমান। আর আমি আর তুই একসঙ্গে বসে বাইরে বেরিয়ে বইখানা পড়তে পারলাম!
হুমায়ুন আজাদ স্যার আকিমুন রহমানের প্রসঙ্গ তুললেই আমার বুকের ভেতরে একটু চিন চিন করে ওঠত। ঈর্ষায় কি! স্যারের কাছ থেকে প্রসন্ন বাক্য শোনবার জন্য আকিমুন রহমানের চেয়ে ভালো লিখবো, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। স্যার যেনো বলতে বাধ্য হন, না আরো একজন আছে- শাঁওলী সুমন! খুব ভালো লেখে! নব্বুই দশকের ছাব্বিশ বছরের মেয়ে তখন আমি। কী ছেলেমানুষী ভাবনা! ভাবলেই হাসি পায় এখন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যেতো আড্ডায়।
তোমার এতো আবেগ!
আর, তোমার কোনো আবেগ নেই। কখনো কি আবার সেই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে! কথা হবে! নির্মল আনন্দে ভেসে যাবে কিছু পল!
বন্ধু! তারা কি আসলে বন্ধু, নাকি বন্ধুর মতন!
তুমি সব সময় কথার মধ্যে বাগড়া দাও কেন বলো তো! আদতে আমরা যাদের এখন বন্ধু বলি, তা সৌজন্য। বলছি বন্ধু; আসলে বলা উচিত পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখা হবে। বন্ধু হলো হীরার মতো অমূল্য। একজনমে দেখা পাওয়াই বিরল। জীবন চলে যায়, মনের মানুষ কি মেলে! কি জানি! তবু আশায় আশায় আশাসিন্ধু তীরে বসে অপেক্ষা করি। কবে পাবো এমন বন্ধুর দেখা!
আজ আসলেই আবেগ উথলে উঠছে আমার! সকালে সেতুর কাছে দেখা জারুল আর নাগকেশরই কি আজ আমায় উথাল পাথাল করেছে। নাগকেশর, নাগেশ্বর, নাকি নাগলিঙ্গম! যে নামেই ডাকি সৌন্দর্য কি এতোটুকু ম্লান হবে! নাগকেশরের সুবাস মেখে এখন বসে আছি রিক্সায়। শহরে শহরে এতো এতো জারুল ফুটেছে!
জারুল কোথায় ফোটে, শাঁওলী!
আমি হেসে ফেলি। কিছু বলি না। জারুলের রঙ আমায় দেখিয়ে দিলো, কী গোপন তুমি আগলে রেখেছ কন্যা! আকাশের দিকে চোখ পড়তেই দেখি, চাঁদটিও সামনে সামনে আসছে আমার সঙ্গে, সেই শৈশবের মতো! ভাদ্রের জলজ চাঁদটি মেঘের সাথে উড়ে যাচ্ছে। আমি হাঁটলেই চাঁদটিও সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। বাড়ির উঠোনে শীতল পাটিতে শুয়ে থাকলে চাঁদটি স্থির।
তোমার বাড়ি আছে নাকি কন্যা!
আছে তো!
কোথায় তোমার বাড়ি!
বংশাইয়ের পাড়ে! গন্ধরাজের ঝোঁপঘেরা নদীঘেষা যে বাড়িটা ওটাই তো! আমাদের সেই গ্রামের নামটি কালীয়ান, আমাদের সেই নদীর নামটি বংশাই। আমার নামতো জানে গায়ের পাঁচজনা।
বাবা! আমাদের নদীর নাম কে রেখেছে?
কে রেখেছে, তা তো জানি না। রেখেছে কেউ একজন। এ যে আমাদের বঙ্গের সাঁই। তাই নাম হলো বংশাই।
তাইলে লাইলীরা বঙ্গশ বলে ক্যান?
আদর কইরা বলে। আদর কইরা যে কোনো নামে ডাকা যায় প্রিয় জিনিসকে, প্রিয় মানুষকে।
গ্রাম কালীয়ানের মেয়ে আমি। হাঁটু অব্দি ফ্রক আর সাদা-কালো মোজা-জুতা পরে আমি ঘুরে বেড়াই বাবার আঙুল ধরে। আর রাজ্যের গল্প শুনতে চাই।
আব্বা, আমাদের এই গ্রামের নাম কালীয়ান কে রাখলো?
আব্বাও নির্বিকার বলতে থাকেন, কালীয়ান নামকরণের কাহিনী।
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক ছিলো জমিদার। সে তখন তার জমিদারি চারদিকে বিস্তার করছে। এই গ্রাম সেই গ্রাম করতে করতে শেষকালে এইখানে এসে তার দোয়াতের কালি শেষ। দলিলে সই করবে অথচ কালি নেই। সে নাকি কালি আন বলে এমন জোরে হাঁক ছাড়লো যে নায়েব মশাই বালতি বালতি কালি আনতে লাগলো।
সেই থেকে এই জায়গার নাম হলো কালীয়ান।
আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। জানা গল্পও শুনতে চাই বাবার কাছে বারবার। বিপদে পড়েন মা। বাইর বাড়িতে পাটিতে শুয়ে শুয়ে যখন গল্প শুনতে চাই। প্রতিদিন মা আর গল্প কোথায় পাবেন! একসময় বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা শুরু করলেন।
একদিন এক ছোট্ট মেয়ে তার মায়ের কাছে খালি আবদার করে, মা, ওই চাঁদটা এনে দাও আমি খেলবো। প্রতিদিনই বলে, মা ভাবলো, আচ্ছা আজ তাহলে এনে দেই। দিচ্ছি বলে, আকাশ থেকে চাঁদ পেড়ে দিতে মা, ওঠে গাছের মগডালে । সেখান থেকেও নাগাল পায় না চাঁদের । তার পর আরো উঁচুতে আরো উঁচুতে উঠতে থাকে। গাছটি ছিল নদীর উপরে। ঠিক আমাদের মালদই আমগাছটির মতো,দ্যাখো কেমন নদীর ওপরে অনেকখানিই শাখা বিস্তার করে আছে! মা গল্প বলছে, মা-টি ওই গাছটির মগডালে উঠে যাচ্ছে চাঁদটি ধরবার জন্য। একসময় মা, টুপ করে নদীতে পড়ে যায়। গাছের মগডাল থেকে। আর চাঁদ এনে দিতে পারে না শিশুকন্যাকে। আর আমি কান্না করে সজোরে মাকে জড়িয়ে ধরি। মা খুব অবাক হয় আমার আচরণে।
না, মা তোমাকে আর চাঁদ আনতে হবে না। আমার কিচ্ছু চাই না। কেবল তোমাকে চাই। আমার মাকে চাই।
সেই থেকে একটা ভয় আমার সঙ্গী হয়েছে। ভেতরে ভেতরে ভয়ে ভয়ে থাকি। মনে হতো, মায়ের কাছে কিছু চাইতে গেলে মনে হতো, মা হয়তো হারিয়ে যাবে।
কিন্তু মা, তুমি তো সত্যিই হারিয়েই গেলে! আমি তো তোমার কাছে চাঁদ চাইনি, কিচ্ছু চাইনি। কেবল তোমার আঁচলের ছায়ায় থাকতে চেয়েছি। দিনশেষে বাড়ি ফিরে তোমাকে দেখতে চেয়েছি। সাদা শাড়ি আর চওড়া লালপাড়ের মা আমার কোথায় হারিয়ে গেলো!
মন খারাপ করো না। ওই যে বইপাড়া দেখা যাচ্ছে।
সজাগ হই। আর্দ্র চোের কোণটা মুছে নেই।
বাইরে গেলে আমি সেজে গুঁজে পরিপাটি হয়েই যাই। সাজ বলতে ওই তো চোখের কাজল, লিপস্টিক আর বড় একটা টিপ। নিজেকে অপরিপাটি অবস্থায় কেউ দেখবে এটা ভাবতেও পারি না। সুগন্ধি ব্যবহার না করলেও যে আমার শরীর থেকে তীব্র সৌরভ বের হয় এটা আমি জানি।
ফেরোমন!
ফেরোমন!
ফেরোমন!
আমি বুঝে যাই, চারপাশের মানুষকে তীব্র আকর্ষণ করছে আমার ফেরোমন! তারা আমার গা ঘেষে দাঁড়াতে চায়।

আর আপন ফেরোমনে আমিই মাতাল হয়ে থাকি...
লাবণ্য প্রভা
২৭/১২/২৩
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৮:০৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×