somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মধ্বংসের প্রতিমান এক যজ্ঞের ঋত্বিক: সাবদার সিদ্দিকি

২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ৮:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ধুলোর পাতায় পদচ্ছাপ রেখে হেঁটে যায় এক বাউল; অযৌক্তিক আড়ম্বর আর ক্লান্ত মহাসড়ক পেছনে ফেলে রেখে নির্বান্ধব; একা...

নব্বুইয়ের দশকের গনগনে রোদের ভেতর সূর্য ও পাউরুটি ডুবিয়ে আমি যখন চা পান করছিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে মহানগরীর মহাসড়ক ধরে আমার কাছে দৃশ্যমান হয়েছিল একজোড়া পরিব্রাজক পা; কিংবা একটি প্রজ্জ্বলিত অস্থি। নিজস্ব বেশভূষায়- ‘সন্ন্যাসীর লিঙ্গের মতো নিস্পৃহ’ নির্লীপ্ত এক মানুষ যিনি হেঁটে চলেছেন শহরের দক্ষিণ দিকে। আপন অস্থিতে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি সমেত কে অমন হাঁটতে পেরেছেন- কবি সাবদার সিদ্দিকির মতো! চুয়াল্লিশ বছরে জীবনকে যিনি উড়িয়ে দিয়েছিলেন বেলুনের মতো- আপন জিজ্ঞাসা, আপন ঈক্ষণ নিয়ে।
০২
’৯০ এর গণআন্দোলনের পরবর্তী সময় পার করছিলাম আমরা। অস্থির, অস্থিতিশীলতা, আর গন্তব্যহীনতার মধ্য দিয়ে যেন আমাদের যাত্রা নতুন করে শুরু হয়েছিল। স্বৈরাচার পতনের মধ্যদিয়ে একটি দুঃসময়ের অবসান হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু ততদিনে মধ্যবিত্তের ঘরে চোরা কুঠুরী দিয়ে ঢুকে পড়েছে অনৈতিকতার সাপ। ভোগবাদের কাছে একে একে নুয়ে পড়ছিল নারী ও পুরুষ। হুমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন, এরশাদ আমাদের নারীদের নষ্ট করে দিয়ে গেছে। তবে কেবল নারী নয়, সেই সময় নষ্ট হয়ে গেলো যেন গোটা সময়টাই। সবকিছুতে কেবল পচনের গন্ধ। অনিশ্চেতন সেই সময়ে মুনীর মুরশেদ আর সমুদ্র গুপ্ত হাতে আমাদের হাতে তুলে দিলেন কমল কুমার সমগ্র, চারু মজুমদার সমগ্র, এবং সাবদার সিদ্দিকি রচনা সমগ্র। নিজ দেশের প্রথম পেপার ব্যাক প্রকাশনা হাতে পেয়ে একদিকে যেমন আপ্লুত হয়ে উঠলাম অন্যদিকে চমকে উঠলাম বিষয় নির্ধারণে । যেন নতুন করে আবার আবিষ্কার করা গেল তাঁদের। আর সেই সময় আমাদের আড্ডার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হলেন বোদলেয়ার , নের্ভাল, সাবদার সিদ্দিকি। সাবদার সিদ্দিকির কবিতা সংগ্রহ প্রকাশিত হলে সেই সময় বাংলা বাজার পত্রিকায় ‘কম্পাসহীন কলম্বাস’ শিরোনামে গ্রন্থটির একটি রিভিয়্যু করি আমি। তখন সমুদ্র দা আর মুনীর মুরশেদের কাছ থেকে সাবদার সিদ্দিকির জীবন যাপন কথা শুনে শুনে তরুণ ফ্রান্সদের কথাই বারবার মনে হতো আমার।
আঠারো শতকের মধ্য আকাশে যখন প্রত্ন সূর্যটা বয়স্ক হয়ে উঠছিল সেই সময় একদল তরুণের আবির্ভাব হয়েছিল ফ্রান্সে। একুশ বছরের পেত্রুস, গোতিয়ে, নের্ভাল ও আরো কিছু যুবকের সমন্বয়ে গঠিত হলো একটি গোষ্ঠী। যাঁরা সাহিত্য, রাজনীতিতে নিজেদের আধিপত্য ঘোষণা করলেন স্বদম্ভে। ফ্রান্সের মানুষেরা অবাক বিস্ময়ে দেখল তাদের বেশভূষা; প্রসাধন ও ব্যবহারের অভিনবত্ব। মাথার দু’পাশে সিঁথি কেটে মাঝখানের চুল চুঁড়োর করে তুলে দিলেন। কেউ সাজলেন স্পেনের আমির, কেউবা ভারতের মহারাজা। ১৮৩১সালের কথা। পেত্রুস বরেলের নেতৃত্বে নতুন ঠিকানার আড্ডার নাম হলো ‘তাতার শিবির’। আর গোষ্ঠির নাম তরুণ ফ্রান্স। সমাজের কোনো শাসন মানবেন না তারা, প্রথা ভাঙবেন, করোটিতে করে মদ্যপান করবেন। করোটি হাতে রেস্তোরাঁয় গিয়ে নির্বিকার ঘোষণা করতেন এটি আমার মায়ের/বাবার মাথার খুলি- সংগ্রহ করার জন্য হত্যা করতে হয়েছে। কেউ কেউ চেয়ে বসতেন সমুদ্রের জল পানীয় হিসেবে। গ্রীষ্মকালে তারা নগ্ন হয়ে বসতেন বাগানে। হুল্লোর, চিৎকার আর বিকট বাজনায় প্রতিবেশি এবং পুলিশের সাথে প্রায়শঃই ঝঞ্ঝাট বেঁধে যেত। অতোটা হুল্লোরবাজ ছিলেন না সাবদার সিদ্দিকি। ধীর স্থির সৌম্য শান্ত মানুষ ছিলেন তিনি। অন্তত তাঁকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা সকলেই জানেন।

তাঁর অলৌকিক জীবন যাপন কথা আমাকে বিস্ময়াভিভূত করত। একজন মানুষ কতোটা শক্তিধর হলে বর্জন করতে পারেন ভোগ বিলাসের হাতছানি;যাপিত জীবনের মোহ! আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে রাজপথ ধরে মিলিয়ে যেতে থাকেন এক সৌম্য যুবক। আপন অগ্নিতে অস্থি যজ্ঞ দিয়ে যিনি জ্বালিয়ে ছিলেন হোম। বিবমিষা আর আত্মধ্বংসের প্রতিমান এক যজ্ঞের ঋত্বিক। যেন ইনসমনিয়া আক্রান্ত এক মানুষ হেঁটে যান পৃথিবীর পুরোনো পথ ধরে- ভগ্ন কোনো গীর্জার খোঁজে। কিন্তু ওই গীর্জামুখে দাঁড়িয়ে থাকেন না হার্টক্রেনের প্রেয়সির মতো কোনো নারী। কেননা কোনো নারী সংশ্লিষ্টতা তাঁর জীবনে ছিল না। তাই হয়তো পথে পথে ছড়িয়ে যেতে থাকেন কবিতার পুঁতি যা জড়ো করতে পারলে হয়তো গ্রন্থিত হতো অলৌকিক কাব্যমাল্য। মালার্মের মতো তাঁর আরাধ্য দেবতা ছিল শব্দ। ‘শব্দই ব্রহ্ম’ এই ছিল তাঁর মূলমন্ত্র। মালার্মে বলতেন- কবিতাকে যদি বিশুদ্ধ হতে হয় তাহলে কবির কণ্ঠকে হতে হবে নিষ্পন্দ, এবং উদ্যোগী হতে হবে শব্দসমূহকে, যারা পরস্পরের সঙ্গে অসমমাত্রিক সংঘর্ষের ফলে গতিপ্রাপ্ত হবে। সাবদার বলেন, অক্ষরগণ শব্দ হন/শব্দগণ বাক্য হন/ব্যাকরণ ধ্বনি হন/ধ্বনিগণ হন প্রতিধ্বনি। তবে সাবদারে কবিতা মালার্মের কবিতার মতো প্রাত্যহিক জীবনের বাইরের কোনো বিষয় ছিল না। প্রাত্যহিকতার মধ্যে থেকে জীবনকে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন তিনি। বিলাস আর ভোগের হাতছানি পেছনে ফেলে রেখে কবি কেবল এগিয়ে যেতেই থাকেন। আর নিরীক্ষণ করেন যানজট, হৈ-হল্লা, সোডিয়াম কিংবা নিয়ন আলোর নিস্ফল ফুলঝুরি; অতীত কিংবা ভবিষ্যতের মনোসরণী দেখতে দেখতে তিনি মুখোমুখি হন অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার ।
সংবেদ আর সজ্ঞানে নিজেকে আলাদা করে চিনিয়ে দিয়েছিলেন কবি সাবদার সিদ্দিকি। আশির দশকের গোড়ার দিকে । আড্ডায় উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত পদচারণায় শ্রদ্ধার আসন করে নিয়েছিলেন তিনি। অতৃপ্য আবেগ তবু তাকে তাড়িত করে বেড়িয়েছে- আর তিনি ছুটে গেছেন হেথা নয় , হোথা নয় অন্য কোথাও অন্য কিছুর সন্ধানে। হিয়েনসাংয়ের পরিব্রাজক উত্তরসূরী সাবদার- এক নগর বাউল। জীবনের উধ্যত খড়গের নিচে পেতে চিয়েছিলেন কবিপ্রাণ।
ক্রমশঃ
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ৮:৫২
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×