“স্যার, আপনার ইহজগতে আসার দরকার ছিল না, বেহুদা একটা কাম করলেন। আমরা আপনার সৃষ্টি, আপনি আমাদের স্রস্টা। স্রষ্টা চাইলেই মানুষকে তার কাছে টেনে নিতে পারে। আপনি মিসকল দিলে আমিও ঠুস করে চলে যাইতাম আপনার কাছে। একা যাইতাম না, দলবল নিয়া যাইতাম....”
একসাথে অনেক কিছু বলার পর হুশ ফিরে পাইল হিমু। হিমু তো কখনও এত্ত কথা বলেনা।সে হইল মহাপুরুষ হওয়ার ট্রেনিংপ্রাপ্ত, মহাপুরুষ হইতে পারে নাই এটা কোন বড় ব্যাপার না।
হিমু কখনও অবাক হয় না। না হলে আজকে যা ঘটছে তাতে অবাক হয়ে হিলিয়াম বেলুনের মত ফুলে যাওয়া উচিত। শুধু ফুলে গেলে হবেনা, ফুলে উপরের দিকে উঠে যাওয়া উচিত। তার স্রষ্টা “হুমায়ুন স্যার” তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হিমুর শরীর থাকলে এখন হাতের বুড়া আঙ্গুলে কামড় দিয়া চেক করত, কাহিনি সত্য কিনা!! স্বপ্ন-ও হতে পারে।
রাত তিনটায় টি.এস.সি এর মোড়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে হুমায়ুন স্যার-কে দেখতে পাওয়া, ভুত দেখার চেয়েও সাড়ে সাত গুন অধিক ভয়ঙ্কর। নীরবতা ভাঙতে হিমুই কথা বলল
“স্যার,রাতবিরাতে আমারে তো খুজার দরকার নাই,আপনি আমাকে যেখানে ইয়াদ করবেন, সেখানেই আমি খাড়া হয়ে যাব।“
“ভাবলাম, আত্মা হয়ে যেহেতু ফিরে আসছি, ঢাকা শহর একটু ঘুরেফিরে দেখি। মানুষ হয়ে ঢাকা শহর অনেক দেখলাম, এবার আত্মা হয়ে দেখি। অভিজ্ঞতা অতীব সুন্দর । তুমিও মরে ভুত হয়ে ঢাকা শহর দেখতে পারো। ভুতের চোখে ঢাকা দেখতে মাশাল্লাহ।“
“স্যার এটা একটা কথা বললেন। জ্ঞানী গুনী মানুষ মাঝেমাঝে বোকার কথা বললে মনে হয় মিথ্যা বলতেছে।যেদিন আপনার মৃত্যু হইছে সেদিন আপনার সকল সৃষ্টির ও মৃত্যু হইছে, আমিও সেদিন-ই মরে গেছি। আপনি মরে আত্না হইলে আমিও এখন ডাবল আত্মা”
“এটা অবশ্য ঠিক বলছ। নিজেকে সৃস্টিকর্তা ভাবার মধ্যে আনন্দ আছে। একজন চিত্রকর একটা সুন্দর পেইন্টিং এর সৃষ্টিকর্তা, কুমার পুতুল হাতে নিয়ে ভাবে সেও সৃষ্টিকর্তা, সেই হিসেবে আমিও সৃষ্টিকর্তা।তবে আমার মৃত্যু মানেই তুমি মারা গেছ,কথাটা ভুল। প্রকৃতি সবার মধ্যে একটা করে সৃষ্টিকর্তা ভাব ঢুকিয়ে দেয়, সেটা নিয়েই বেচে থাকে, সেটা নিয়েই মারা যায়,কিন্তু তার সৃস্টিকর্ম বেচে থাকে“
“ আজকে এই মধ্যরাত্রিতে আগমনের কোন কারন?”
“ অনেকদিন তো হল, ভাবলাম যা সৃষ্টি করেছি সেগুলার হেলাফেলা করা উচিত না। একজন সৃষ্টিকর্তা আমাদের সৃষ্টি করে খোলা মাঠে ছেড়ে দেন নাই, কোমরে দড়ি বেধে দিয়ে বলেছেন “যা খেটে খা” সময় শেষ হলেই সেই দড়ি ধরে হেচকা টান মারবেন। আমিও আমার সৃষ্টির কোমরে দড়ি বাধতে এসেছি। ভাল হবেনা??”
কোমরে দড়ি বাধা ব্যাপারটা হিমুকে চিন্তায় ফেলে দিল। মহাপুরুষ-রা থাকবে তেলাপোকার মত। মাথার দুইপাশের এন্টেনা ডানে বামে নাড়িয়ে নাড়িয়ে পথ চলবে। তাদের কোমরে দড়ি বাধাটা উচিত হবে কিনা সেটা স্যারকে জিজ্ঞেস করা উচিত।
হাটতে হাটতে ধানমন্ডি পনেরো নাম্বারের দু তালা এক পুরাতন বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়াল। হুমায়ুন স্যার মৃদু কাশি দিলেন।এইসব কাশি দেয়ার মানে হল বাড়ির ভেতরে কোন মহিলা থাকলে যেন ঘোমটা টেনে দেয়, এখন একজন পরপুরুষ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করবে। এই কাশির শব্দে গলার নেড়িকুত্তার ঘুম ভাঙ্গার ও কথা না।
কিন্তু অবাক করে দিয়ে বাসার দরজা খুলে গেল। গরম ধুয়া উঠা চা এর কাপ হাতে লোকটি ভেতরে যাওয়ার ইশারা করল।
“মিসির আলী দেখা যাচ্ছে ইদানিং রাত ও জাগে!! মৃত্যুর কাছাকাছি চলে আসলেন নাকি?”
স্যর এর প্রশ্ন শুনে হিমু বুঝতে পারল ইনিই মিসির আলী। আগেও দু-একবার দেখা হয়েছে,কিন্তু আজকে সবকিছু কেমন জানেই ঘোরের মত লাগছে। মেসে ফিরে মাথায় বরফশীতল পানি ঢালার ব্যাবস্থা করতে হবে।মেস ম্যানেজারকে বললেই ব্যাবস্থা করে দিবে, তরিতকর্মা মানুষ।
“আমি জানতাম আপনি আজ রাতেই আসবেন। তাই অপেক্ষা করছিলাম”
হিমুকে বললেন ডানপাশের তাক থেকে নীল মলাটের ফাইলটা বের করতে। ওখানে একুশ নাম্বার পৃষ্টায় স্পষ্ট করে লিখা আছে ১৯ জুলায় রাত তিনটায় হুমায়ুন স্যার দেখা করতে আসবেন। হুমায়ুন স্যার কিছুটা বিস্বাদভরা দৃস্টি নিয়ে বললেন
“আমার পক্ষে মিসির আলীকে নিয়ে নতুন কোন উপন্যাস লিখা সম্ভব না। কালকে যদি লাখো মানুষ পল্টন ময়দানে সমাবেশ করেও বলে হিমু/মিসির আলীকে আবারো বই এর পাতায় দেখতে চাই, এরপরেও সম্ভব না। ব্যাপারটা কিভাবে দেখেন??
“স্যার, সাহিত্যিকের মৃত্যু হয় শারীরিক, এরপরেও তারা বেচে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন বহু বছর আগে, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের পুরো আকাশ এখনো তার দখলে। হুমায়ুন আহামেদ মারা গেছেন ব্যাপারটা এক অর্থে ঠিক না।১০০ বছর পরেও যদি গভির রাতে হলুদ পাঞ্জাবি পরে কোন যুবক যদি অজানা এক গলির মোড়ে দাড়িয়ে সিগারেট ফুকে, এরপরও জেনে রাখবেন আপনি বেচে আছেন”

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


