এখন যাহা আসে নাই, আসিবে যে স্থির নহে তাহা।
-উইলিয়াম শেক্সপিয়ার
নয়-
মিলিকে চুমু খাবার পর থেকেই একটা টকটক স্বাদ ঠোঁট বেয়ে ক্রমাগত পেটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সন্ধ্যে থেকে অস্বস্তি সারা শরীরে। ভলবো বাসটা একটা মরণ জ্যামে আটকে আছে, যেমন ভোঁ-কাট্টা ঘুড়ি লটকে থাকে নারকেল গাছের উঁচু পাতার সাথে। বাতাসে লটপট পট-পট। কিচ্ছু করার থাকে না। শুধু বসে বসে ভাবো আর চিন্তা করো। অনেক দিন থেকে ভাবছি মিলিকে বলি আমাকে ছেড়ে দাও। আর কোনো প্রেম নেই তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য কেন কারোর জন্যই কিছু অবশিষ্ট নেই। আমার স্রেফ ভালো লাগছে না। নিত্যদিনের অভ্যাস বশতঃ তোমার কাছে যাওয়া যেমন রোজ ভাত খাই, গোসল করি, চাকরি করি ঠিক তেমনি। এর মধ্যে কোনো ভাব-ভালবাসা নেই। তুমি কী কিছুই বুঝতে পারো না? ধ্যুস্ কারে কী বলছি? অবশ্য প্রথম প্রথম যে রকম উত্তাপময় প্রেম জ্বরে তার কাছে গিয়েছি ভাবলেও হাসি পায়। সেসব এখন কোথায়? খামোকাই মেয়েটাকে টেনে নামানো।
পাশের রো'র সিটে বসা একটা মোটকা মতন লোক গান গাচ্ছে। গলাটা মিহি, স্বরগুলো ঠিক আছে, দেশের গান....ও আমার দেশের মাটি তোমার...পরে ঠেকাই মাথা...। খানিকটা শুনি তারপর মাথার উলেন টুপিটা টেনে কানজোড়া ঢেকে দেই যাতে শব্দগুলো কম শোনা যায়। ওমা এআবার কী? সেল ফোনে একই লোক বউকে ঝাড়ছে। নাক সিঁটকে ওঠে। বাসটা অনড়। আইনস্টাইনের দ্বিতীয় সূত্র এখানে অচল। চোখটা বন্ধ করি। ইস্ যদি ঘুমটা আপসে এখন চলে আসে ! কী ভাল যে হতো।
বাস চাপা মানুষটা নাকি বলেছিল মরার আগে বাংলা লেখা লম্বা হয়ে যায় অর্থাত্ত কিনা স্থির লেখা চুইংগামের মতো চুই করে দেড় হাত গতি পায়। লাল অক্ষর হলুদ আর নীলগুলো ফ্যাকাসে ম্যাজেন্টা। ভুঁই ফোঁড় এক পাবলিক বলেছিল, "ভাই ইংরেজি ভাষার কী হাল হয়?" মৃত্যুগামী লাশ কটমট করে চাইতেই দুই কাঁধ শ্রাগ করতে করতে প্রশ্নকারী বলেছিল, আই এল টি এস পরীক্ষার আগে একবার টেস্ট করতাম? ইংরেজিতে কাঁচাতো তাই ভিসা পাচ্ছি না। ভলবোটা খানিক নড়ে ওঠে। টিকিট চেকার আসে, পকেট হাতড়েও কাঙ্খিত কাগজটা না পেতেই ডবল ভাড়ার রশিদ। দাঁত কেলিয়ে বোরখাওয়ালী হাসে। আর শায়েস্তা করার ভঙ্গিতে আমি চোখ টিপ দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরি নিজেরটা, তাতেই সব ঠান্ডা। ইয়েস আমি পেরেছি, ডিপজল ফেল!
একটা গর্ত প্রায় পনের ফুট গভীর। গ্যাস না টেলিফোন কেবল পোঁতা হবে। থেবড়ে যাওয়া বৃত্তাকার গর্তটার চারিপাশে প্রথমে পাথর আর আলকাতরার প্রলেপ তারপর লাল সুড়কী এরপর ধুসর মাটি। তিন লেয়ারের রঙ দেখলে শেরাটনের ক্রিসমাস কেকের কথা মনে পড়ে যায়। মোমবাতির বদলে খাটো বাঁশের ডগায় লাল কাঁচের হারিকেন। মরিচের মতো দুলছে। একটা ইট ফেললাম বেশ খানিক পরে তার শব্দ পাওয়া গেল। গর্তটার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবছি লাফ দিলে কতক্ষণ পর শব্দটা ফিরে আসবে। একটা পিচ্চি বাদামওয়ালা আসে, বাদাম নেবেন স্যার? আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে পিচ্চিকে বলি তুই এই গর্তে লাফিয়ে পড়লে পাঁচ টাকা দেবো- ফ্রি। পিচ্চি খানিকটা থমকে তাকায় তারপর কিছু দূর গিয়ে শালা চুতমারানির পুত বলে বাদামের ঝুড়িটা সামলে দে দৌড়। আমি ওর দৌড় বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখি।
দুনিয়া কিসিসে পেয়ারি জান্নাত সে কাম নেহি মেহেদি হাসানের গজল মটকুর সেল ফোন থেকে ভেসে আসে। অনেকদিন পর গানটা শুনে হঠাৎই সার্ক সন্মেলনের কথা মনে পড়ে যায়। বিটিভিতে অনুষ্ঠানে বাঁ পাশে আড়াআড়িভাবে হারমোনিয়াম রেখে গজল সম্রাট গাইছেন। সেই প্রথম দেখলাম হারমোনিয়ামের দিক বদল। এবার টুপিটা মাথার দিকে তুলে দিলাম। রাস্তার নানান শব্দের সাথে গজলের সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। আচ্ছা এটা তো বেশ, গান শুনতে শুনতে কেন কেউ সুইসাইড করে না? পিপ পিপ পটাস্ আমার সেলে মেসেজ এসেছে। ফোনটা জিন্সের টাইট পকেট থেকে বের করি, মিলির মেসেজ। মনে মনে বাজি ধরি কী নিয়ে মেসেজ হতে পারে, কাল কোথায় দেখা হবে নাকী আজকের চুমু? মেসেজ ইন বক্সে গিয়ে দেখি ইংরেজি বানানে বাংলা কথা... তুমি ফোন ধরছো না কেন? চার বার ফুল কল দিয়েছি। আমি কাল রাজশাহী যাচ্ছি। মামা নিতে এসেছেন। রাতে কল ব্যাক করো, আমার টাকা নেই। ফোনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। আমার কী একটু একটু মন খারাপ লাগছে। সাথে সাথে ফোন করি। মিলি তুমি কোথাও যেতে পারবে না। ওপাশ থেকে মিলি বলে ওঠে, তোমার এতো ভালবাসা কোথায় থাকে যখন দেখা হয়? আমি জেদি ভঙ্গিতে বলি, এসব শুনতে ভাল লাগে না। তুমি যাবা না ব্যাস। তুমি যা বলবা তাই কী আমাকে শুনতে হবে? আমি খেঁকিয়ে উঠি, হ্যাঁ আমি যা বলবো তাই হবে। তুমি মামাকে বলে দাও তোমার ক্লাস আছে যেতে পারবা না। আর শোনো, ফিসফিস করে বলি, তুমি কখনো জেদ ধরবা না চুমু খাবার জন্য। ওপাশ থেকে অবাক হওয়া কন্ঠে মিলি, মানে? মানে সোজা আমার ইচ্ছে হলে তবে। ইউ রাস্কেল। খটাস। ফোনটা কেটে দেয় মিলি। আমি হতাশ হয়ে এস এম এস টাইপ করি, মিলি লাভ ইউ। প্লিজ আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। 'কুকুর, ঘরে বউ, আখরোট গাছে/ যতই পিটিবে দেখ তত ভাল আছে' মনে মনে কথাটার তারিফ করি। কিন্তু আমি কী মিলিকে পেটাবো বিয়ের পর। কী জানি?
অনন্ত এবাস যাত্রা যেন শেষই হয় না। চলছে থামছে হাঁপাচ্ছে কাশছে। গাড়িটা কী বুড়ো হয়ে গেছে? আহা রে আমিও তো বুড়ো হবো, হবো কী হয়েই তো আছি। ফার্ম গেটে বাসটা থামতেই হুড়মুড় করে যাত্রীরা ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠতে থাকে। সমগ্র বাংলাদেশ যেন এক লহমায় বাসের পেটে সেঁদিয়ে যাবে। মাঝ বয়েসী এক মহিলা ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। আমি তার ফর্সা পেট দেখতে পাচ্ছি। চোখটাকে যতটা সম্ভব সংযত রাখতে চেষ্টা করছি কিন্তু...। হঠাত্ত খেয়াল হলো আমি তার নাভিটা দেখার জন্য উত্তসুক হয়ে আছি। মহিলাটা কী টের পেল, তানা হলে শাড়িটা টেনে দেবেনই বা কেন? মেয়েদের বোধহয় সারা শরীরে চোখ থাকে! এবার তাকে অবাক করে দিয়ে দাঁড়িয়ে সিটটা ছেড়ে দিলাম। মহিলা থ্যাঙ্ক য়ু বলে আমার সিটে আরাম করে বসলেন। উয়াও কী মজা এবার আমি দাঁড়িয়ে বেশ টপ এঙ্গেল ভিউ থেকে তার ফর্সা বুকের কিছু অংশ আরামসে দেখতে লাগলাম। আবার একটা এসএমএস আসার ঢেউ টের পেলাম। ভীড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে কোন মতে মেসেজটা পড়লাম, মিলির। আই হেট ইউ। আমি কাল যাচ্ছি আর ফিরবো না। বাসটা হঠাত্ত ব্রেক কষাতে হাত থেকে মোবাইলটা ছিটকে মহিলার কোলে গিয়ে পড়লো আর আমি তার ঘাড়ের উপর।
আপনি সুইসাইড নিয়ে কখনো ভাবেন? মাসের মধ্যে প্রায় বাইশ দিন এই নিয়েই তো ভাবি। মহিলার পাশ থেকে অন্য যাত্রী উঠে যাওয়াতে বেশ অনেকক্ষণ হলো তার পাশে বসে টুকটাক কথা বলছি। আচমকা এরকম প্রশ্ন করাতে ভেবেছিলাম তিনি অবাক হবেন কিন্তু স্বাভাবিক স্বরেই তিনি কথাগুলো বলে আমাকে তাজ্জব করে দিলেন। আমার ছোটবেলা যে বাড়িতে কেটেছে তার ছাদটা মায়াময়। এক সকালে স্নান শেষে সাদা একখানা পাটভাঙ্গা খদ্দরের শাড়ি পড়ে, ভেজা চুল পিঠে ছড়িয়ে পূবমুখো হয়ে ছাদে বসবো। সুর্যটা একটু একটু করে উঠবে। চৌরাসিয়ার পিলু রাগের বাঁশিতে ভোর বেলাটা জেগে উঠবে। একটা কালো পাত্রে সাদা বেল ফুল থাকবে একথোকা। আমি স্বচ্ছ নিঃশ্বাস নেবো, হাতে উঠে আসবে ঝকঝকে একটা ছুরি, সেটা দিয়ে জাপানী প্রথায় হারিকিরিতে আমার মৃত্যু হবে। সাদা খোলের শাড়িতে একটু একটু রক্ত ছড়িয়ে পড়বে। সাদা জমিনে লাল লাল চেরিফুলের এ্যামব্রয়ডারি। আবেশে আমার চোখ বুজে আসবে। বাতাসে বেলিফুলের গন্ধ নাকে ঝাপটা দেবে। শ্রবণে বাজবে মিঠেল বাঁশির সুর। আমি অনন্তের যাত্রাপথে হাঁটা শুরু করবো।
আমি আবার একা। তিনি নেমে গেছেন তার গন্তব্যে। কে যেন আমায় নাম ধরে ডেকে ফিরে যায়/ আমি তো দেখি নি তাকে/ নয়নে কী অনুভবে/তবে কী এই শেকল নাড়া/ ভুল ঠিকানায়... ক্রমাগত গান ভেসে আসছে সেই লোকের মোবাইল থেকে। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন।
ক্রমশ
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০০৭ দুপুর ১২:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




