বাসটা সেই সকাল থেকে চলছেই তো চলছে। রাস্তার পর রাস্তা জুড়ে সারা দেশটাকে পেঁচিয়ে ফেলেছে যেন। উলের মতো গোল্লা পাকানো। একটা গিঁট ছাড়াচ্ছি তো আর একটা হাজির হচ্ছে। তেমনি রাস্তার একটা বাঁক শেষে শুরু হচ্ছে নতুন রাস্তার সুত্রমুখ। কলা খাবি? মামার ডাকে ঝিমুনি ভাবটা আমার কাটে। ভোটকা মতন হলদেটে একটা বিটকেল কলা মামার হাতে, তাই দেখে আমার চোখ কুঁচকে উঠে। মাথা নাড়ি, মামা বলতে থাকে তা খাবি কেন, যতসব বাজে ফুচকা চটপটি তো গিলতে সময় লাগে না। একটা বড় সড় হনুমানের মতো মামা কলাটা খেতে থাকেন। কী বিশ্রী দৃশ্য?
মাইলের পর মাইল ধান ক্ষেত অবারিত। শুকিয়ে যাওয়া খালগুলোতে বড় বড় বাঁশের সাথে লাগোয়া মশারির জাল আকাশের দিকে উদ্বাহু হয়ে মেঘ ধরার জন্য ফাঁদ পেতে আছে যেন। আশ্চর্য একটা চুমু আমি খেতেই পারি তাই বলে তরুণ এভাবে অপমান করবে! প্রেমের বিষয়টাই গোলমেলে। চুমুটা খেয়ে বাসায় গিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে হয়েছে। তরুণটা দিন দিন অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে।
যে শহরটা ছেড়ে যাচ্ছি সেখানে আত্মীয় বাদেও এক আধটা মানুষ দরকার হয় যাদের কাছে মনটা খুলে দিতে হয়। তরুণের সাথে সম্পর্কটা খানিকটা অভ্যাসের মতো। দেখা হলে খানিক কথা হয়, প্রায় বিরক্তি নিয়ে ওঠে আসা। আর না দেখা হলে মনে হয় কী জানি করা হলো না। বিয়ে পর্যন্ত সম্পর্কটাকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় না। প্রাত্যহিকতায় একটা বৈচিত্র্যহীন মানুষ চারপাশে ঘুরঘুর করবে ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। এমনিতে আমি খানিকটা বোরিং ধরণের আর তরুণের মধ্যেও বোর কাটানোর কোনো ক্ষমতা নেই। তবে কী পরবর্তী প্রজন্মটা গাদা গাদা লুডিওমিল খেয়ে হতাশা কাটাবে?
হঠাত্ত বাসটা মৃদু ঝাঁকানি দিয়ে থেমে যায়। কী হলো জানতে মামা ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে যায়। ব্যাগের উপর হাত পড়তেই বুঝতে পারি মোবাইলটা বেজেই যাচ্ছে। বের করে দেখি তরুণ। রিংগারটোন অফ থাকার কারণে বোঝাই যায়নি কখন ফোনটা এসেছে। মাথায় রক্ত উঠে যায়। একবার ভাবি ধরব না, পরক্ষণে মত পাল্টে কলটা রিসিভ করি। কোন কথা বলি না। ওপাশ থেকে তার গলা ভেসে আসে, কাকুতিপূর্ণ। কথার সামনে পেছনে মাঝে তিনটা করে সরি সম্বিলিত। মনটা ভার হয়ে যায় আমার, এই সম্পর্কের পরিণতি কী? জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই বিরক্তিতে ভ্রুর রেখা আমার পাল্টে যায়। একটু নিচু মতো জায়গায় পরপর তিনজন দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছে নিশ্চিন্তে, কোনো ভাবনা নেই। মনে হচ্ছে পার্কে দাঁড়িয়ে তিন অসম বয়েসী পুরুষ স্টক এক্সচেঞ্জ নিয়ে আলাপ করছে। আমি বাসে বসেই বুঝতে পারি তিনজনই তাদের পুরুষাঙ্গ অবলোকন করছে নির্দ্বিধায়। তিন আদিম পুরুষ গুহা থেকে বের হয়ে প্রাতকৃত্য সারছেন, পৃথিবীর আর সব কিছু অবলুপ্ত। চোখ ফিরিয়ে নিতেই সামনে একটু ঝুঁকে থাকা মানুষটার দিকে দৃষ্টি আটকে যায়। ফোনে তরুণের ক্রমাগত অনুনয়-বিনয় আমাকে শ্রান্ত করে তোলে। মানুষটার পেছন থেকে মামার বপু দেখা যায়। আমি মাঝপথে তরুণের কন্ঠরোধ করে মোবাইলটা জন্মের মতো বন্ধ করি।
বাসটা ঠিক হতে আরো ঘন্টা দুই লাগবে। প্রায় সবাই বাস থেকে নেমে ডানে বায়ে পায়চারি করছে। কেউ কেউ সিগারেট ফুঁকছে, কেউ গাছের ছায়ায় বসে বাদাম চিবুচ্ছে। মামা কয়েকজনের সাথে ভিড়ে তাস পেটাচ্ছে। আমি একা একা বসে আছি একটা শান্ত মতোন জলার ধারে। বাতাস বয়ে যাচ্ছে, আকাশে খানিকটা ছেঁড়া-খোঁড়া মেঘ। নির্দ্দিষ্ট করে কিছুই ভাবছি না। এক্সকিউজ মি- পুরুষ কন্ঠের আহবানে তিল পরিমাণ চমকে উঠি। ঘুরে তাকিয়ে দেখি জলজ্যান্ত মানুষটা দাঁড়িয়ে। আমি ভেতরে ভেতরে ধসে যাচ্ছি যেন, যাকে স্বপ্নে ভাবতাম সেই সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রে গেভাডিনের ট্রাউজার আর খানিকটা কুঁচকে যাওয়া সাদা শার্টে দেহের অভ্রভেদী শক্তি ছিটকে বের হচ্ছে। শুভ্র চামড়ায় সূর্যের আলো পিছলে পড়ছে। সানগ্লাস কপালে তোলা। আমি জনাথন, বাড়ি সুইডেন। আপনি? ইংরেজি শুনে খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। প্রথমে গলা দিয়ে স্বরই বের হচ্ছে না, খানিকটা গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলি। আই এ্যাম মিলি।
মিলি এই নে একেবারে ইন্ডিয়ান এ ক্লাস। মামা এক থোকা আঙ্গুর আমার হাতে দিয়ে চলে যান। যাবার সময় জনাথনকে পরিচিত ভঙ্গিতে কাঁধ চাপড়ে দেন। একটু অপ্রস্তুতভাবে হাসি। আমি জনাথনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেই, সে আঙ্গুরের পুরো থোকাটা হাত থেকে নিয়ে আঙ্গুল ছুঁয়ে দেয়। আমার ভাল লাগে। তখন জনাথন আঙ্গুরের থোকাটা উচুঁ করে মুখের উপর তুলে ধরে একটা আঙ্গুরে ঠোঁট ছোঁয়ায় আর আমার কী যেন হয়? আপসেই চোখ বুঁজে আসে। কী আশ্চর্য চোখের সামনে তরুণ নয় জনাথন তার সমস্ত পুরুষত্ব নিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। আমি তাকে অবলোক করি। চওড়া বুক, চিকন কটিদেশ, স্ফীত পুরুষাঙ্গ, পেশীবহুল কাফ মাসল, পুরু ঠোঁট, চোখে মাদকতার আহবান। আমি মোহবিষ্ট হয়ে অনেকণ স্থান-কাল-পাত্র ভুলে স্থানুর মতো বসে থাকি। বিশ্ব চরাচর বিলীন হয়ে যায় আমি আমার স্বপ্নপুরুষের ধ্যানে মগ্ন। খানিক পরে চোখ মেলতেই দেখি জনাথন ফটাফট ছবিই তুলছে। আমি তো হতভম্ব। আমার অবস্থা দেখে জনাথন মৃদু হাসে।
ছবি তোলা শেষ করে খানিকটা কাছ ঘেঁসে পাশে বসে। সযত্নে সাদা টিস্যুতে মুড়ে রাখা আঙ্গুরগুলো আমার হাতে তুলে দেয়। মৃদু স্বরে বলতে থাকে- আমি পেশাদার ছবি তুলিয়ে। পৃথিবীর বহু দেশে প্রদর্শনী হয়েছে। এবারের ভারতবর্ষে এসেছি ছবি তুলতে, তোমার দেশটাও ঘুরে দেখছি। বাসে উঠেই তোমাকে দেখেছি। আমি বোধহয় তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি চুপ। কী কথা বলা উচিত্ত জানি না। এরকম ভাল লাগছে কেন কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাত্ত মোবাইলটা ব্যাগ থেকে বের করে অন করি, মিউজিক বেজে উঠে। জনাথন হেসে কপাল থেকে সানগ্লাসটা খুলে পকেটে রাখে। মিউজিক থামতেই সে আবার বলে- এবারের আমি বিষয় বেছে নিয়েছি ভারতের নারী। ধূসর বাদামী চামড়ায় মোড়া সম্পূর্ণ নারীর অবয়ব নয় মাত্র একটি পূর্ণাঙ্গ অঙ্গ। কখনো আলো-আধাঁরিতে, কখনো ঘরের জানালার জাফরিতে, কখনো এক থোকা রক্ত গোলাপের পাশে, কখনো সাদা সিল্কের চাদরে, কখনো বা স্বচ্ছ জলে ভাসমান। আমি এই ছবির ভেতর দিয়ে প্রমাণ করে দিতে চাই ভারতীয় নারীর বক্ষদেশ পশ্চিমী ধবল পনির খাওয়া চেপ্টে যাওয়া বুকের থেকে কত সজীব কত মাদকতাময়। মলি তুমি আমার মডেল হবে, মডেল। আমি বিস্ফারিত, চিত্রার্পিত। জনাথন বলেই যায়- না এমনি এমনি নয় আমি তোমাকে হাইলি পেমেন্ট করবো। তুমি হবে আমার তেরোতম মডেল। যদি চাও সম্পূর্ণ গোপন থাকবে তোমার পরিচয়, কেউ জানতেও পারবে না। ইচ্ছে করলে তুমি পেশাদার মডেলও হতে পারবে আমি তোমাকে সাহায্য করবো। আমার অনেক ফটোগ্রাফার বন্ধু আছে, তারা তোমাকে মডেল করবে। তোমার ওয়েব সাই... ধাই করে কষে একটা থাপ্পর মারি জনাথনের মুখে। পাঁচ আঙ্গুলের মসৃন ছাপ লেপ্টে যায় ওর ফর্সা গালে।
(সমাপ্ত)
লাকু রাশমন
১৬/১২/২০০৬
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০০৭ দুপুর ১২:৩৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




