.......... মা হৃষ্টচিত্তে অনুমতি দিয়ে তার পাথেয় প্রস্তুতিতে লেগে গেলেন। রওনার দিন জামার ভেতরে ৪০টি স্বর্নমুদ্রা সেলাই করে দিয়ে তার মা বললেন,”আল্লাহর নাম নিয়ে রওয়ানা হও।সততা ও বিশ্বস্ততাকে নিজের আদর্শরুপে শক্ত হাতে ধারন করবে।”
ঘটনাক্রমে রাস্তায় ডাকাত পড়লো। ডাকাত একজন শিশু বালককে তার কাছে কিছু আছে কিনা জিজ্ঞেস করলো। তিনি অকপটে স্বীকার করলেন তাঁর জামার ভিতর সেলাইকরা ৪০টি স্বর্নমুদ্রার কথা। বালকের সততায় ও সরলতায় ডাকাত মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলো,এবিপদের মুহুর্তে লোকেরা প্রকাশ্য সম্পদও গোপন ফেলে আর তুমি এ গোপন সম্পদের কথা কেন আমাকে দিলে ? বালক জবাব দিলেন,”আমার আম্মা আমাকে সর্বদা সত্য কথা বলার উপদেশ দিয়েছেন।” ইনিই হলেন মাহবুবে সুবহানী কুতুবে রাব্বানী গাউছুল আজম আবু মুহম্মদ মহিউদ্দিন সৈয়দ হযরত আব্দুল কাদির জ্বিলানী রহমতুল্লাহে আলাইহে। সারা বাংলায় যিঁনি বড় পীর নামে সুপরিচিত।
আজ ওনার ওফাত দিবস যাকে আমরা ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম নামে চিনে থাকি। হিজরি ৫৬১ সনের ১১ রবিউস সানি মুসলমানদের নিকট মহান এ পুরুষ দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওফাতের প্রায় ৫০০ বছর পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তখন ইসলাম ধর্ম এক নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল। পবিত্র কোরআন ও আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ ভুলে মানুষ বিপথে পা বাড়িয়েছিল, ঠিক এমনি সময় হজরত বড়পীর সাহেব ইসলামের পথে মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন।
হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহঃ)-এর বাবার নাম সৈয়দ আবু সালেহ এবং মায়ের নাম বিবি ফাতেমা। হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহঃ) ৪৭০ হিজরিতে ইরানের জিলান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাগদাদের মহান পীর হজরত আবু সাঈদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন মাখরুমির (রহঃ) কাছ থেকে মারেফাতের জ্ঞানে পূর্ণতা লাভ করেন এবং খেলাফত প্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন জাহেরি-বাতেনি উভয় জ্ঞানে জ্ঞানবান।
আব্দুল কাদির জিলানী রহঃ এঁর পিতা ও মাতা সম্পর্কে বহুল প্রচলিত আছে যে, তাঁর পিতা সাইয়্যেদ আবু সালেহ মুসা রহঃ একজন বিশেষ পুন্যবান,কামেল ও বোযর্গ ব্যক্তি ছিলেন।সচ্চরিত্রতা ও আল্লাহ প্রেমের বিবিধ গুন তাহার মধ্যে বিরাজমান ছিল। তিনি একদিন নদীর ধারে ক্লান্ত অবস্হায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন একটি সেফ ফল বা আপেল পানিতে ভেসে যাচ্ছে। তিনি ফলটি আনলেন ও পরম তৃপ্তিসহকারে ভক্ষন করলেন। কিছুক্ষন পর হঠাৎ তর মনে হল এই ফলটি খাওয়া তার ঠিক হলো কি? এই ফলের মালিকতো তিনি নন। কোথা হতে এ ফল ভেসে এসেছে কে জানে। তার অনুমতিতো নেয়া হয়নি। তাহলে তিনি কি পরদ্রব্য ভক্ষনজনিত অপরাধ নিয়ে মহা বিচারকের সামনে হাজির হবেন? যে করেই হোক মালিকের ঠিকানা বের করে মাফ চেয়ে নিতে হবে। তাই তিনি স্রোতের বিপরীত দিকে বিষন্নচিত্তে আপেল ফলের বাগানের সন্ধান করতে লাগলেন এবং বাগানের ও বাগানের মালিকের সন্ধান পেলেন। বাগানের মালিক সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ সাউয়েমী রহঃ।
তিনিও একজন খোদাভীরু ধর্মপ্রাণ সাধক। আল্লাহপাকের মারেফতের সাগরে সর্বদা তিনি নিমজ্জিত থাকেন। তার কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে তার কাছে ক্ষমা চাইলেন যুবক আবু সালেহ। বিস্মিত হলেন বাগানের মালিক। এই যুবকের অন্তরে কি আল্লাহভীতি! একে তো হাত ছাড়া করা যায় না। তিনি বললেন, ‘আপেলেরতো অনেক মুল্য। কি এনেছ তার জন্য ?’ আবু সালেহ জবাব দিলেন,‘আমার কাছেতো কোন টাকাপয়সা নেই’ তবে গায়ে খেটে মুল্য পরিশোধ করতে চাই। আপনি যতদিন খুশী গায়ে খাটিয়ে নিতে পারেন।’হজরত সাউয়েমী রহঃ বললেন ওয়াদা করবার আগে ভাল করে ভেবে দেখ। আবু সালেহ বললেন আমি ওয়াদা পুর্ন করবো ইনশাআল্লাহ। সাউয়েমী রহঃ বললেন ‘তোমাকে পুরো এক বৎসর বাগানের দেখাশোনার কাজ করতে হবে উপরন্তু আমি যখন যে কাজের হুকুম দিব তাই করতে হবে।’ কোন কথা ছাড়াই সব শর্ত মেনে নিলেন আবু সালেহ। সময় শেষ হবার পর নুতন শর্ত যুক্ত করলেন সাউয়েমী রহঃ। তিনি বললেন ‘আমার একটি অন্ধ,বধির ও বোবা কন্যা আছে তাকে তোমার বিয়ে করতে হবে’। তাতেও রাজী হলেন আবু সালেহ। বিয়ের পর বাসর ঘরে ঢুকেই তাজ্জব বনে গেলেন আবু সালেহ। তার নব বধুতো সুস্থ্য মানুষ! অন্ধ,বধির বা বোবা কিছুই নন। উনি এঁর ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন হযরত সাউয়েমী রহঃ এঁর কাছে। তিনি বলেন,‘আমার এই কন্যা কোনদিন ঘরের বাইরে যায়নি, বাইরের কোন লোকের দিকে কখনো চোখ তুলে তাকায়নি এবং তার মুখে কখনও অশ্লীল বাক্য উচ্চারিত হয়নি। তাই তাকে আমি অন্ধ, বধির ও বোবা বলেছিলাম।
এমন পূণ্যবান পিতা ও মাতার মাধ্যমে পৃথিবীতে আগমন করেন হযরত বড় পীর রহঃ। আজ তাঁর ওফাত দিবস।
– আল্লাহ জাল্লাশানুহু কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন:-
وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚبَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ
যারা আল্লাহ্ পাকের রাস্তায় মৃত্যুবরন করেছেন (শহীদ হয়েছেন) তাদের কে তুমি মৃত মনে করো
না, বরং তারা তাঁদের নিজেদের রব এর নিকট জীবিত ও (রবের পক্ষ থেকে) রিজিক প্রাপ্ত।”(সুরা আলইমরান ১৬৯)
আল্লাহ তাবারাক্তায়ালা আরো এরশাদ করেন-
وَلاَ تَقُولُواْ لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاء وَلَكِن لاَّ تَشْعُرُونَ (سورة البقرة-154
“আল্লাহর পথে যারা শহীদ হয় তাদের তোমরা মৃত বল না। বরং তারা জীবিত। তবে তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।”
(সূরা বাকারা-১৫৪)
সুতরাং এমন মহান কির্তীমান ব্যক্তিত্বকে মৃত মনে করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার কোন সুযোগ ঈমানদার মুসলিমদের হাতে নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:৪৭