somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কেন চলে গেলে পিংকি?

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১০ সকাল ১০:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আপনি যে মেমোরি কার্ডটিতে পিংকির কথা রেকর্ড করে রেখেছিলেন, সেটা কোথায়? আপনার আর পিংকির প্রেমের সম্পর্ক আছে বলছেন, কেউ কি সেটা জানত? তারা পুলিশের সামনে বলবে না? প্রতিবেশী যে মহিলার ফোন থেকে পিংকি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করত বলে দাবি করছেন, সে নম্বরটা কত? তার নাম কী? ঘণ্টাব্যাপী তার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবেদকের প্রশ্নগুলোর আলাদা করে উত্তর দেয়নি মুরাদ। শুধু আউড়ে গেছে কয়েকটি বাক্য: ‘আমার সাথে পিংকির ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। এক থাপ্পড়ের কারণে ও নিজে মরে আমারেও মারল। আমি নিজেরে নির্দোষ প্রমাণ করব কেমন করে? আমার মতো গরিব ছেলের সাথে ওরা মেয়ের বিয়ে দিবেন না। ইতালি থাকে এক ছেলের সাথে পিংকির বিয়ে দিতে চাইছিল ওনারা। আল্লাহ যা করে এখন তা মাইনা নিতে হইব।’

পিংকির আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ২৩ জানুয়ারি গ্রেপ্তারের পর থেকে রিমান্ডের প্রথম দিন পর্যন্ত সে এই কথাগুলোই বলে গেছে। তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এ এস এম সায়েদ গত সোমবার সারা দিন প্রেমের এই দাবির প্রমাণ চাইলেও মুরাদ চুপ থেকেছে।
পিংকির চলে যাওয়া

‘দাদি, কাল স্কুলে পুরো ক্লাস শুরু হবে। নতুন পোশাক দর্জির দোকানে। তুমি ব্যাংকে গিয়ে টাকা নিয়ে এসো।’ পিংকির পরামর্শমতো দাদি ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে আনেন, ঠিক পরের দিন (২০ জানুয়ারি) স্কুলও খুলল। কিন্তু পিংকির স্কুলের নতুন পোশাক এখনো দর্জির দোকানে। পিংকি নেই, মারা গেছে।

মৃত্যুকালে কী ভেবেছিল ১৪ বছরের এই মেয়েটি। ওর কি মনে পড়েছিল, বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে যে বইগুলো দিয়েছেন সেগুলোর মলাটে নাম লেখা হয়নি। না কি হঠাত্ মনে পড়ে গিয়েছিল, বাবাকে আসতে বলেছি বিকেলে, এসে না দেখতে পেলে মন খারাপ করবে। না কি মঞ্চে আর নাচ করা হবে না বলে মন খারাপ হচ্ছিল।

১৯ জানুয়ারি সকালে শ্যামলী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্রী নাশফিয়া আখন্দ পিংকিকে ঘরের ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। শেষ মুহূর্তগুলোতে সে কী ভেবেছিল—আর কাউকে যেন এভাবে ঝুলতে না হয় সেই আশায় বুক বাঁধছিল কি না জানা যায়নি। ফুফাতো ভাই লিমান ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে যেটুকু বলতে পেরেছে, পরিবারের বড়দেরও সেটুকুই সম্বল। লিমান বলে, ‘আমরা শয়তানি করতে গিয়ে আপুর হাত কেটে গেল। আমরা তিনজনে ওসুধ নিতে নিচের দোকানে গেলাম, মুরাদ আপুরে থাপড় মারল। আমাদের বাসায় (পাশেই পিংকির ফুফু থাকেন) ঢুকিয়ে আপু দোতলায় উঠে গেল।’

তারপর? তারপর থেকে আর কোনো কিছুই নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। তারপর থেকে সবই অনুমান, সবই ‘হতে পারে’ শব্দ দুটিতে বন্দী।

মা-হীন জীবনের গল্প

২০০০ সালে পিংকি যখন মাত্র চার বছরের তখন তার মা মারা গেলেন। তখন ছোট ভাইটির বয়স নয় দিন। সে সময় থেকেই পিংকি তার বড় চাচার পরিবারে বেড়ে উঠছিল। বড় হতে থাকল চাচাতো বোন ইডেন কলেজে সম্মান চতুর্থ বর্ষের লাবণী আর দাদিকে ঘিরে জগত্ সাজিয়ে। কিন্তু কিশোর মন কী চাইছে, কোনো অসহায়ত্ব বোধ করছে কি না, রাস্তায় কেউ বিরক্ত করল কি না—এসব নিয়ে সে কারও সঙ্গে আলাপ করত না। এ সময় এটা করো না, এখন এটা করতে হবে এসব কিছুই মা-হারা পিংকিকে শেখায়নি কেউ। বাবা বিয়ে করে বনশ্রীতে বাসা নিয়ে পিংকিকে তাদের সঙ্গে যেতে বললেন। পিংকি বলেছিল, ‘বাবা, আমি এখানেই থাকি। দাদির সঙ্গেই আমি ভালো থাকব।’

ভালো ছাত্রী পিংকি

স্কুলে কখনো খারাপ ফল পায়নি ছোট্ট পিংকি। নবম শ্রেণীতে কমার্স বিভাগ নিয়েছিল।
পিংকির বাবা নজরুল ইসলাম আখন্দ বলেন, স্কুলের বন্ধুরা মিলে আলাপ করে ঠিক করে কমার্স পড়বে। কোথায় শুনেছে, এমবিএ করলে বড় চাকরি পাওয়া যায়। স্কুলে সবাই এককথায় বলে—পিংকি ভালো ছাত্রী ছিল। ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু জাহিদুল হাসানও জানত না পিংকির কোনো অস্থির সময় যাচ্ছিল কি
না। স্কুলে দ্বিতীয় হওয়ায় ৩০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তার হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেন। সহপাঠীরা পিংকির চলে যাওয়ার জন্য অভিযুক্ত যারা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়।
যখন থেকে মুরাদ।

অভিযুক্ত মুরাদ পিংকিদের বাসার দুটি বাসা পরে টিনের দোচালা একটি ঘরে মা-বাবা-ভাই-বোন নিয়ে বাস করতেন। এলাকায় চার বছর ধরে আছেন। পাড়ার এক বাসার ব্যক্তিগত গাড়িচালকের কাজ করতেন সে। প্রতিবেশীরা বলছেন, পিংকি আর মুরাদের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা ছিল। এটা নিয়ে পিংকির অভিভাবকেরা সব সময় চোখে চোখে রাখতেন তাকে। গাড়িচালকের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক মেনে নেননি কেউ। অনবরত অশান্তি নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন মুরাদও। মুরাদের পাশের ছয়টি ঘরের বাসিন্দারা জানিয়েছে, মুরাদের মা পিংকিদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। সে প্রস্তাব গৃহীত হয়নি, বরং পিংকির পরিবার মুরাদকে ডেকে হুমকি-ধমকিও দিয়েছে। পিংকির পরিবার বাদে আশপাশের অনেকের মুখে এই একই গল্প। সত্যা-মিথ্যা জানা যাবে তদন্তে।
পাড়ার লোকেরা তবু বিচার চান।

মৃত্যুর দিন থেকে প্রতিবেশীদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি দেখা গেছে। তারা পিংকি বা মুরাদ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতেও রাজি নন। আশপাশের অনেক বাড়িতে গিয়ে শোনা গেল, দুই-তিন মাস আগে থেকে মুরাদ সবাইকে বলতে শুরু করেন—‘এই মেয়েরে না পাইলে আমিও বাঁচুম না, হেরেও বাঁচপার দিম না।’ পিংকি যেন মুরাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে সে জন্য পরিবার থেকে তাকে জোর করা হতো। তবে যা-ই হোক, সত্য সামনে আসুক, সেটাই চান প্রতিবেশীরা। বয়োজ্যেষ্ঠ প্রতিবেশীদের একজন বলেন, ‘মুরাদ মারুক না-মারুক মেয়ে তো মরসে। সেটার সুরাহা হওয়া দরকার।’
মুরাদের কথা।

শনিবার সকাল সাড়ে সাতটায় গ্রেপ্তার হয়েছেন অভিযুক্ত মুরাদ। খুলনার খালিসপুর থেকে তাকে প্রেপ্তার করে ঢাকায় নিয়ে আসেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহেদ। থানা সূত্র জানিয়েছে, মুরাদের দাবি, পিংকির সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পিংকির পরিবার সেটা মেনে না নিয়ে তাকে হুমকি-ধমকি দিত। গ্রেপ্তারের পর তিনি প্রাথমিক যে জবানবন্দি দেন সেখানে জানিয়েছেন, ১৮ জানুয়ারি রাতে তিনি পিংকিকে জানিয়ে দেন তার চাচা আলী আশরাফ আখন্দের কারণে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। ঘটনার দিন সকালে পিংকি হাত কেটে মুরাদের সামনে গিয়ে তর্ক শুরু করে। একপর্যায়ে মুরাদ পিংকিকে থাপড় মারেন বলেও স্বীকার করেন। এরপর পিংকির হাতের চিকিত্সাও করান। সেখান থেকে বাড়িতে ঢুকে পড়ার পরের কোনো ঘটনা তিনি জানেন না। পিংকির সঙ্গে যে তার প্রেমের সম্পর্ক সেটার প্রমাণ হিসেবে মুঠোফোনের এসএমএস, পিংকির ছবি এবং কথোপকথন ধারণ করে (রেকর্ড) রাখা আছে বলেও তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন।
শেষ চিঠি ধাঁধা হয়ে রইল।

‘দাদি, আমি লিমান লিমিনের সাথে শয়তানি করতে গিয়ে হাত কাটছিলাম। এর জন্য মুরাদ সবার সামনে আমারে থাপড় মারছে, সবাই তা নিয়ে হাসাহাসি করতাছে। আমার জন্য যাতে তোমাদের মান-সম্মান না যায় তার জন্য আমি ফাঁসি দিলাম। আমার মৃত্যুর জন্য আমার পরিবারের কেউ দায়ী না।’ পিংকির পড়ার টেবিলে একটি খাতায় এই কয়টা লাইন লেখা। খাতাটি অক্ষত অবস্থায় খোলা পড়ে ছিল। যখন কেউ পিংকির মৃত্যুর কারণ আন্দাজ করতে পারছিল না, তখন পুলিশ এই খাতা খুঁজে পায়। কিন্তু শেষ লাইনের ‘আমার মৃত্যুর জন্য আমার পরিবারের কেউ দায়ী নয়’ বাক্যটির দিকে চোখ আটকে যায়। ‘পরিবারের কেউ দায়ী নয়’, তাহলে? পিংকি কাকে দায় দিয়ে বিদায় নিলো? এই সমাজকে, যারা তার সম্মান ক্ষুণ্ন করে হাসাহাসি করেছে তাদেরকে? নাকি আমাদের সবাইকে? পিংকি কেন চলে গেলে? আত্মহত্যাতো কোনো সমাধান নয়।

প্রথম আলো নারীমঞ্চ থেকে।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×