somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কেন মিছে নক্ষত্রেরা আসে?

১০ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ১০:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভিক্ষুককে ১০ টাকার নোটটা দেয়ার পর থেকেই হাসানের মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। যদিও ১০ টাকা দেয়ার পর সে নিজেকে খুব মহৎ ভেবে বেশ পুলক অনুভব করেছিলো, খানিকটা আড়চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিলো কেউ তার এই মহত্ম দেখে আশ্চর্য হয়েছে কিনা। কিন্তু ঢাকা শহরের মানুষ ইদানীং রোবট হয়ে গেছে....তারা কোন কিছুতেই আশ্চর্য হয়না। যে কথা বলছিলাম, ১০ টাকা গচ্চা যাওয়ার জন্য হাসানের মনটা খারাপ হয়নি। তার মনটা খারাপ হয়েছে কারণ সে যে টাকাটা দিয়েছে তা একটা ছেঁড়া টাকা ছিল। মাঝ বরাবর ছেঁড়া টাকা, কেউ একজন খুব সুচতুরভাবে স্কচ্‌টেপ দিয়ে জোড়া লাগিয়েছিলো। হাসান টাকাটা চালাতে পারবেনা তাই জেনেশুনেই ভিক্ষুককে ওটা দিয়েছিলো। সে নিজেকে যতটা কঠিন মনে করে আসলে তার হৃদয়টা তার চাইতে অনেক নরম। সে মনে মনে ঠিক করল আর কোনদিন যদি ভিক্ষুকটার সাথে তার দেখা হয়ে যায় তাহলে দুটা টাকা দিয়ে দিবে। আজ সারাদিন ফকিরের কথা ভাবছে বলে তার নিজের ওপরই একপ্রকার বিরক্ত লাগছে। অন্যের কথা ভেবে কি হবে, সে নিজেইতো একটা ফকির.....পুরোপুরি ফকির না হলেও ফকিরের কাছাকাছিই বলা যায়। ফকিরের যেমন অন্যের দ্বারে হাত পাতা লাগে তারও হাত পাতা লাগে। হাসান বড় হয়েছে তার মামা মামীর কাছে। মা তাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন বহু আগে তাকে এতটুকুন রেখে। আর বাবা......যখন থেকে হাসান বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই শুনে এসেছে তার বাবা বাহরাইন থাকেন। সব বাবারা দেশে আসে, তার বাবার সময় হয়না। হাসানের ধারনা তার বাবা হয়ত সেখানে বিয়েশাদি করে নতুন জীবন গড়েছেন। হয়ত হাসানের কথা তার মনে পড়েনা। হাসান মাঝে মাঝে ভাবে তার কি সৎভাইবোন আছে যাদের দেহে সেই একই রক্ত বইছে যে রক্ত বইছে তার দেহে?

হাসানের মামাতো ভাইরা তাকে অর্বাচীন গোছের কিছু একটা ভাবে। এতে সে কিছুই মনে করেনা কারণ তারাই দয়া করে হাসানকে তাদের একটা মুদি দোকানে কাজ দিয়েছে। হাসান নিজেকে সৎ ভাবেনা। হরহামেশাই সে ক্যাশ থেকে কিছু টাকা সরিয়ে নেয়.......হয়ত সে বড় বড় মানুষের মত পুকুরচুরি করতে পারেনা তাই তার মামাতো ভাইরা ব্যাপারটা ধরতে পারেনা। সে মাঝে মাঝে নিজের গুরুত্ব অনুধাবন করার চেষ্টা করে.....যেমন সে হঠাৎ করেই দু এক দিনের জন্য উধাও হয়ে যায়। কিন্তু প্রচন্ড হতাশা নিয়ে তাকে আবার ফিরে আসতে হয় কারণ তার মামা মামী বা তার মামতো ভাইরা তার খোঁজ নেয়না এমনকি ফিরে আসার পর জিজ্ঞেসও করেনা সে দুদিন কোথায় ছিল। তবুও সে তাদের ছেড়ে চলে যায়না। তারা তার মুখে অণ্য যুগিয়েছে.......সে মানুষ হিসেবে পুরোপুরি সৎ না হলেও তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়নি, কৃতজ্ঞতা মুখে প্রকাশ না করলেও সে জানে এই ঋণ শোধ করা যাবেনা।

আজ তেমনি একদিন। হাসানের উধাও হোয়ার খেলা। এই দুদিন সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে.....হরেকরকম মানুষ দেখবে.....ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে গাড়ির আসা যাওয়া দেখবে...ঘুম পেলে সেখানেই ঘুমাবে। পরিচিত কেউ দেখে ফেললেও তার ভয় নাই কারণ পরিচিতরা তাকে কখনোই চিনতে পারেনা। গুরুত্বহীন হবার অনেক মজা....পৃথিবীকে নিজের মত করে উপভোগ করা যায়....কেউ সেখানে হস্তক্ষেপ করতে আসেনা। আজ হাসান দাঁড়িয়ে আছে সিটি কলেজের সামনে। ছাত্র ছাত্রীদের আসা যাওয়া দেখতে তার ভালো লাগে। ছোট বেলায় তার মামাতোভাইদের দেখাদেখি তারও শখ ছিলো ডাক্তার হওয়া। কিন্তু লেখপড়াটা কখনোই সে মাথায় ঢুকাতে পারেনি।ম্যাট্রিক পার করতেই তার নাভিশ্বাস উঠেছিলো। এরপর তাকে আর পড়তে হয়নি। সে মনে মনে খুশিই হয়েছিলো যদিও মানুষের কাছে বলে বেড়ায় তার লেখপড়ার অনেক শখ কিন্তু সুযোগ পায়নি। পড়ার বই তার কাছে দলিলের ভাষার মতই কঠিন লেগেছে সবসময়। কলেজের ছাত্রছত্রীরা হাসিঠাট্টা করতে করতে আসছে যাচ্ছে.....হাসান তাদেরকে দেখছে। এদের জীবনটা তার চাইতে হয়ত অনক সুন্দর, এরা হয়ত তার চাইতে অনেক ভালো চিন্তা করে কিন্তু তার মত পুরোপুরি স্বাধীন এরা হতে পারেনি। এরা কখনও ট্রেনের ছাদে চড়ে কোথাও যায়নি....এরা কখনো দুইদিন লাপাত্তা হয়ে দেখেনি জীবন বলতে কি বুঝায়।
হঠাৎ হাসান তার কলারে হ্যাঁচকা টান অনুভব করে। কিছু বুঝে উঠার আগেই যে ছেলেটা তার কলার ধরেছিলো সে ভাষার অযোগ্য একটা গালি দিয়ে বলে উঠলো, "তুই পকেটে হাত দিলি ক্যান?"
হাসান নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, "আমি দেইনাই।" তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোন সুযোগ না দিয়েই তার উপর এলোপাতাড়ি কিল ঘুসি চলতে লাগলো। হাসানের শরীরটা ভোঁতা হয়ে আসে.....তার মনটা তার চেয়ে অনেক ভোঁতা হয়ে থাকে। সে জীবনে এত বেশি ব্যথা সয়েছে যে দশ পনেরোজন মানুষের দেয়া ব্যথা তার চামড়া ভেদ করে হৃদয়ে পৌঁছাতে পারেনা।

হাসানকে তার মামা ধানমন্ডি থানা থেকে ছাড়িয়ে আনেন। তার দেহ মন অসাড় হয়ে আছে। কোন কিছুতেই যেন কিছু এসে যায়না। ঘরে ফিরেই তার মামা তাকে বেরিয়ে যেতে বললেন। হাসান যেন বুঝতে পারেনি এমন ভেবে বলল, "বুঝিনাই।" তার মামা মা সম্পর্কিত একটা গালি দিয়ে বললেন, "তোরে পকেটমার বানানোর জন্য মুখে ভাত তুলে দিছি।" চালের ব্যাপারী মামার কাছ থেকে সে এর চেয়ে ভালো ব্যবহার কখনো পায়না। টু শব্দ না করে হাসান ঘর ছেড়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। তার জিনিসপত্র বলতে গেলে কিছুই নেই। তবুও যা আছে সে খুব ধীরে ধীরে গোছাতে থাকে আর অপেক্ষা করতে থাকে কখন তার অণ্যের যোগানদার মামা এসে বলবেন, "আর যাওনের কাম কি, যা দোকানে গিয়া বয়।" কিন্তু মামা আসেননা।

হাসান এখন মুক্ত স্বাধীন.....একা একা ঘুরে ফিরে। ভবঘুরে জীবন কেন তার এত ভালোলাগে সে জানেনা। পেটে যখন ক্ষুধা অনুভব করে তখন সে তার জমানো চুরি করা টাকার দিকে চোখ দেয়....যদিও মাঝে মাঝে অভক্তি লাগে। এভাবে কতদিন চলবে সে জানেনা।

হাসান আজ পার্কে শুয়ে আছে। পাশে অবহেলিতভাবে জন্মানো লতাগুল্ম। মাথার উপর বিস্তৃত মহাকাশ। সেই মহাকাশে নিভু নিভু নক্ষত্ররা অবাক হয়ে হাসানকে দেখে। সেই অবহেলিত গুল্মের সাথে হাসানকে পার্থক্য করা যায়না। তাদের জন্ম না হলে হয়ত পৃথিবীটা আরও অনেক সুন্দর হত......তারা না থাকলে হয়ত আরও আনন্দের হত পৃথিবীটা। তাদের কথা কেউ ভাবেনা....প্রকৃতি তাদেরকে লালন করে.....প্রকৃতিই তাদেরকে শোষন করে। তাদের জীবন সম্পর্কে দার্শনিকেরা অনেক উক্তি দেন। তাদের জীবনকে পুঁজি করে অনেক গল্প উপন্যাস তৈরী হয়....তাদের জীবনকে শীল্প করে অনেক আর্ট ফিল্ম তৈরী হয়....ফটোগ্রাফাররা তাদের মত ভবঘুরেদের ক্যামেরার ফোকাসে নিয়ে আসেন। তাদের সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর শৈল্পিকতা বৃদ্ধির জন্য। সৃষ্টিকর্তা মাঝে মাঝে তার সৃষ্টিজগত নিয়ে খেলায় মেতে উঠেন। নতুন হাটতে শেখা শিশুর মত খেলা। অনেকটা অর্থহীন দুর্বোধ্য খেলা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ১০:৩১
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×