somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে নয়ন জোড়া আজও অসহায়ত্বের প্রতীক (ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের সেই বালিকাটিকে খুঁজে পাওয়ার গল্প)

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আপনি কি কখনো সেই দৃষ্টি দেখেছেন যে দৃষ্টিতে একই সাথে রয়েছে অসহায়ত্ব, ঘৃণা, দুঃখ, হতাশা, অভিমান, ক্ষুধার জ্বালা, ভয়? সেই দৃষ্টি দিয়েই ১২ বছরের এই আফগান পশতু বালিকাটি সারা পৃথিবীর মানুষের দিকে তাকিয়ে ছিল। এই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করার সাহস কি কারো আছে? আমার নেই, হয়ত আরো অনেকেরই নেই।

মেয়েটির নাম শরবত গুলা। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ যার জীবনটা পাল্টে দিয়েছিল অন্য এক জীবনে। যুদ্ধে মারা গেলেন বাবা মা। তারপর দাদী আর ভাইবোনদের সাথে সেও বাধ্য হল নিজের ঘর বাড়ি দেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানের নাসিরবাগ শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে। সেখানেই ১৯৮০ সালে আনুমানিক ৮-১০ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় রহমত গুল এর সাথে।

১৯৮৪ সালের কোন এক দিন। সেই শরনার্থী শিবিরেরই মাদ্রাসার একজন সাধারন ছাত্রী ছিল শরবত। একদিন এক সাদা চামড়ার লোক এলেন শরনার্থী শিবিরে। হাতে ঢাউস সাইজের একটা ক্যামেরা। সে সময় আফগান সাধারন মেয়েদের মুখাবয়ব দেখতে পাওয়া রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার। হঠাৎ স্টিভ ম্যাককারীর চোখ আটকে গেল মেয়েটির দিকে। ধুলোয় ধূসরিত চুল মুখ কিন্তু তার মাঝে অপার্থীব এক জোড়া চোখ। মাথায় লাল ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেয়া। জ্বলজ্বলে সবুজ চোখগুলো তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তিনি এই সুযোগ হারাননি। সাথে সাথেই ক্লিক করে উঠলো তার ক্যামেরা।

১৯৮৫ সালের জুন সংখ্যায় সেই মেয়েটি উঠে এল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে। মেয়েটি যেন তার সমূদ্র-সবুজ চোখের দৃষ্টিতে সারা পৃথিবীর চুপ করে বসে থাকা মানুষকে ধিক্কার জানাচ্ছে। অজানা মেয়েটির নাম জানার কোন উপায় ছিলনা তাই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ছবির নাম হয়ে গেল "আফগান গার্ল"।
কিছুদিন ফটোগ্রাফি জগতে এই ছবি নিয়ে ভীষন তোলপাড় হল। তারপর সব নিশ্চুপ।

খুঁজে পাওয়ার গল্প:
শরবত গুলা, ১৭ বছর ধরে যে ছিল শুধুই একজন প্রচ্ছদ বালিকা যার নামটা পর্যন্ত স্টিভ ম্যাককারি জানতে পারেননি। যুদ্ধ শেষে তিনি কয়েকবার আফগানিস্তান গিয়েছেন মেয়েটিকে আরেকবার আবিষ্কার করার জন্য। কিন্তু হতাশা নিয়ে ফিরে এসেছেন বারবার।
২০০২ সালের জানুয়ারী মাসে ন্যাশনাল গিওগ্রাফিক টিম একটা বিশেষ উদ্যোগ নিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিখ্যাত ছবিগুলোর উৎস, স্থান ও পাত্র খুঁজে বের করা। সেটা ছিল অনেক কষ্টসাধ্য, ব্যায়বহুল এবং প্রচন্ড ধৈর্যের কাজ। সেই দলেই ছিলেন ম্যাককারি। তারা গেলেন সেই নাসিরবাগ ক্যাম্পে। সেখানেই একজন লোক জানাল সে শরবত গুলার ভাইকে চিনে। ভাইয়ের সূত্র ধরেই তারা এক দুর্গম গ্রামে যায়। সেখানে শরবতকে সনাক্ত করাই ছিল সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। ছবি দেখে অনেক মহিলা দাবী করল এটা তার ছবি। অনেক পুরুষ দাবী করল এটি তাদের স্ত্রীর ছবি। সেই স্ত্রীদের চেহারার সাথে ছবির মেয়েটিকে মিলিয়ে টিমের লোকজন অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা করে শেষ পর্যন্ত শরবত গুলাকে চিহ্নিত করল। কিন্তু তবুও যেন সন্দেহ যেতে চায়না। বিশেষ টিম "বায়োমেট্রিক টেকনোলজি" ব্যাবহার করে ছবির মেয়েটির চোখের আইরিস প্যাটার্ন আর চিহ্নিত মহিলার চোখের আইরিস প্যাটার্ন মিলিয়ে তবেই নিশ্চিত হল এই মহিলাই সেই মেয়ে। বয়স ৩০ এর কাছাকাছি। একাধিক সন্তানের মাতা। চোখের চাহনিতে সেই জ্বলজ্বলে ভাবটিও যেন কেমন মলিন হয়ে গেছে। দারিদ্রতা, অভাব দেখতে দেখতে যেন চোখও নিষ্প্রান হয়ে গেছে। মধ্যবয়সী শরবত গুলাকে আবার ফ্রেমবন্দী করলেন স্টিভ ম্যাককারি।
শরবতগুলা কখনো জানতনা সে ছোটবেলায় দেখতে কেমন ছিল। স্টিভ ম্যাককারির ক্যামেরায় তোলা ছবিটিই ছিল তার জীবনের প্রথম ও একমাত্র ছবি। তার হাতে যখন সেই ম্যাগাজিনটি ধরিয়ে দেয়া হল তখন সে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল। ছবির সেই শক্তিশালী চাহনির কোন অর্থই সে ধরতে পারলনা। যে ছবিটি আজও "Refugee Situation"এর প্রতীক সে ছবিটি যেন তার কাছে সেই মুহূর্তে কোন অর্থই বহন করেনা।


ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক টিম একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এল। আর স্টিভ ম্যাককারি তার ১৭ বছরের এক অজানা ভ্রমনের সুখ সমাপ্তি পেলেন।

খুঁজে পাওয়া শরবত গুলা আবারো প্রচ্ছদে উঠে আসে ম্যাগাজিনের এপ্রিল ২০০২ সংখ্যায়।
শরবত গুলাকে নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল "সার্চ ফর দ্যা আফগান গার্ল" নামে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করে যা ২০০২ সালের মার্চ মাসে চ্যানেলে দেখানো হয়।

১৯৮৫ সালের নাম না জানা পশতু বালিকাটি।

১৯৮৫ সালের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের জুন সংখ্যা।


একই ভঙ্গিমায় সেই শরবত গুলা আর এই শরবত গুলা।

রেফারেন্স:
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ১:১৭
১৯টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×