আমার বাসাটা দশ তলার উপর। সেখানে বারান্দায় বসে বিকেলে সূর্য অস্ত যাওয়া দেখলে অথবা রাতের ঢাকা শহরের রাস্তা গুলোর দিকে তাকালে গাড়ীর আলো দেখে মনে হয় এ যেনো অন্য কোন শহর। দূরে বড় বড় দালান গুলোর চোখ ধাঁধানো আলো আর রাস্তার নিয়ন বাতি গুলোর নিচে বড় বেশি অন্য রকম লাগে সব কিছু। আমি একটা চেয়ার পেতে বসে সেই অচেনা ঢাকা শহর দেখতে দেখতে চিন্তার রাজ্যে হারিয়ে যাই। গাড়ীর হর্ন, ট্রেনের শব্দ, মানুষের কোলাহল সব মিলিয়ে একটা নেশা ধরানো ভাব। মনের মাঝে কোথায় যেনো সূতোর টান পড়ে। চিন্তাগুলো ডালপালা মেলে হারিয়ে যায়, টেনে নিয়ে যায় অন্য কোথাও।
আকাশে মেঘ। অনেক অভিমান নিয়ে আনাচে কানাচে জমা হয়েছে। কখনো জল ঝরায় তো কখনো জল মুছে নিয়ে যায়। ঈদের দিনটা এমন হবার কথা ছিলনা। তবু হয়ে গেল। আমি চেয়ার পেতে বারান্দায় বসে আছি। মনের মাঝে বিষন্ন একাকীত্বটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি আর ভাবছি আজ কি আসলেই ঈদের দিন ছিল? তাহলে মনটা এমন মরা মরা লাগছে কেন? সবুজ ঘাসগুলো ধূসর লাগছে কেন? কেন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবকিছুই সিলিং ফ্যানের ঝুল কালি মাখা পাখার মত ক্রমাগত একঘেয়ে আওয়াজ তুলে তুলে একই আবর্তে ঘুরছে? আশ্চর্য! অথচ ছোট বেলার ঈদ গুলো কত রঙ্গীন ছিল! কি যেন নাম দোকান টার............ সাড়ে বার টাকার দোকান। আজব নামটা রাখার কারন গাউসিয়া মার্কেটের এই দোকানটাতে সব খেলনার দাম ছিল সাড়ে বার টাকা। মায়ের হাত ধরে অল্প অল্প আলোর মাঝে দোকানটায় ঢুকলে মনে হতো আমি যেন সারা দুনিয়ার মালিক বনে গেছি। ঈদের আগে আগে সেখানে একবার যাওয়া চাইই চাই। টিনের গাড়ী, প্লাস্টিকের বাঁশি, অথবা স্প্রিং এর চাবি দেয়া হেলিকপ্টার। এখন এগুলো পাওয়া যায় বলে মনে হয়না। আমার ছেলেটাকে দেখি সারাখন শুধু MADE IN CHINA লেখা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ী নিয়ে খেলছে। আর সেটাতে ক্লান্ত হয়ে গেলে কম্পিউটার। দিন বদলে গেছে বড্ড! আর হ্যাঁ, বাটার জূতো। নতুন জুতোর চামড়ার গন্ধটা এখনো নাকে লাগে। আর নতুন জামা প্যান্ট? সেগুলোরও কি গন্ধ ছিল? তা ছিল বৈকি। সারাটা রাত এসব পাশে নিয়েই ঘুমাতাম। আর ঈদের দিন কি কি করবো তা এক রাত আগেই স্বপ্নে দেখা শেষ! ঈদের দিনটায় পাড়ায় পাড়ায় চটপটির দোকান বসতো। এখনো সেগুলো আছে দেখি। চার আনা, আট আনায় আচার, ললিপপ কিংবা বেলুন। আর এক টাকায় সারা দুনিয়াটাই কেনা যেত মনে হয়! ওহহ...... বলতে তো ভুলেই গেছি, চাঁদ রাতের গল্পটা ছিল আরো মজার। দল বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম সবাই। সারাদিন হইচই করে ক্লান্ত; অন্য সময় হলে রাত আটটা বাজলেই ঘুম। কিন্তু ঈদের আগের রাতটায় এত উৎসাহ কোথাথেকে আসতো কে জানে! আতশ বাজী আর সোরগোলের মাঝে মাঝ রাত হয়ে যেত বড্ড তাড়াতাড়ি। তারপর বিছানায় জূতো, জামা আর খেলনা নিয়ে পরদিনের স্বপ্ন চোখে ঘুম।
চিন্তায় ছেদ পড়ল। একটা ট্রেন আসছে অনেক দূরে। গেইট ম্যান ব্যারিয়ারটা নামিয়ে দিয়েছে আগে আগেই। এত জলদি আটকানোর জন্য রাস্তায় ত্বারস্বরে চেঁচাচ্ছে একজন সি এন জি ড্রাইভার। আচ্ছা সি এন জ়ি-র রংটা এমন ধূসর লাগছে কেন? ওটার রঙ তো সবুজ হবার কথা। কেন মনে হচ্ছে এই ট্রেনটা চলে গেলে আরেকটা ট্রেন আসবে, তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা। ঘুরে ঘুরে আসতেই থাকবে। রাস্তার পিচগলা কালো শরীরটার উপর দিয়ে গাড়ী চলতেই থাকবে। আমিও ভাবতে থাকবো লাগামহীন আবোলতাবোল ভাবনা। আর হ্যাঁ, ঈদের খুশিটাও দিন দিন কমতে থাকবে। কমতে কমতে একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। তখনো আমি ভাবতে থাকবো কি অসম্ভব সুন্দর ছিল ঈদের দিন গুলো! খুব খুব ভালো ব্যাপারগুলো কেন এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়?
আকাশের আনাচে কানাচে মেঘগুলো বড্ড অভিমানী। কখনো জল ঝরায় তো কখনো জল মুছে দিয়ে যায়। ঝাপ্সা চোখের প্রতিসরণে রাস্তার নিয়ন আলো গুলো তরল দেখায়। মনে হয় চোখের জলগুলো সব কষ্টের আগুন হয়ে ঝরছে!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ১০:৩৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




