ব্লগার শামচুল হকের একটা লেখা: "কানাডার রেল স্টেশনে এক রাত" পড়ে মনে হলো, অনেকদিন আগে পড়া একটা লেখা আপনাদের সাথে শেয়ার করি। লেখাটা আমার নয়, তবে আমার খুব কাছের একজনের। তাকে জিজ্ঞেস করলাম লেখাটা ব্লগে দেবো কিনা। তিনি দিতে বললেন - তাই আপনাদের জন্য তার লেখাটা নীচে তুলে দিলাম:
১.
ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে পড়া একটা প্রশ্ন প্রায়ই মনে পড়ে—‘কোন পাখি বাসা বানাতে না পেরে পরের বাসায় ডিম পাড়ে?’
উত্তর ছিল কোকিল।
কাক খাবার সংগ্রহের পন্থায় প্রতিভাবান এবং প্রচেষ্টায় প্রাণান্তকর। হেথা-সেথা থেকে দিনমান যুদ্ধ করে জোগাড় করে আনা খাবার সে পরম মমতায় সদ্য ফোটা ছানাগুলোর লাল লাল মুখে তুলে দিচ্ছে, জানালা দিয়ে এ দৃশ্য বহুবার দেখেছি।
হয়তো তার মনে আশা ছিল এই ছানাগুলো বড় হলে উঁচু ইউক্যালিপ্টাস গাছ থেকে নেমে আসা বড় চিলটাকে আচ্ছা করে দাবড়ে দিতে পারবে, হয়তো ছিল না।
ছানাগুলো একটু বড় হলো—কোকিলের ছানাটাকে কাক আরও বেশি করে আদর করে—দেখতে অন্যগুলোর থেকে ভালো, গলাটাও যেন একটু মিষ্টি শোনায়। আরেকটু বড় হয়ে সেই ছানাটা চলে গেল বসন্তের দেশ খুঁজতে।
উড়ে যাওয়ার ধরন দেখে কাক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল—এটাও কোকিল ছিল!
২.
আমার স্ত্রী গর্ভবতী। দিনের পর দিন বমি আর অসুস্থতা। মুখ কালো করে বিছানায় শুয়ে থাকা—পড়াশোনাটা যে আবার বন্ধ হয়ে গেল। ওর কষ্ট দেখে অবাক হয়ে ভাবি—সব মা-ই কি এভাবে কষ্ট করে?
আমার মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা আমি পেটে থাকতে কি আপনার এমন কষ্ট হয়েছিল?’
—‘তুই পেটে থাকতে তো......’ গলার স্বর চোখের পানিতে স্তিমিত হয়ে আসে।
ননদ-দেবর পরিবেষ্টিত আর্থিক-পারিবারিক টানাপোড়েন আর মানসিক যন্ত্রণার সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়ায় নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে যাই, ঘর থেকে পালিয়ে বাঁচি।
আসলে সব মা-ই কি তাঁর সন্তানদের এভাবে ধারণ করেননি?
৩.
—এটা তোর, আর এটা তোর।
কলেজের কোনো এক অনুষ্ঠানের খেতে দেওয়া নাস্তার শিঙারা এখন আমার হাতে আর সন্দেশটা ভাইয়ের। আনন্দে নাচতে নাচতে খাবারটা গলাঃধকরণ করে আমরা নিজ খেলায় মনোনিবেশ করলাম।
জমে থাকা কাপড় ধুয়ে গোসল করে বেরিয়ে মা ঢুকে গেলেন রান্নাঘরে। সে নরক থেকে বেরিয়ে আমাদের পিছু নিলেন। আয় পড়তে বস। আসলে সব মা-ই কি তাঁর সন্তানদের এভাবে লালন করেননি?
৪.
—কাল থেকে ঘরে দুধ নেই, একটু দুধ এনে দিবি বাবা? এক কাপ চা খাব, মাথাটা খুব ধরেছে।
—কিন্তু মা, কাল যে আমার পরীক্ষা।
—তাহলে, থাক। ভালো করে পড়।
দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দে জননীর দীর্ঘশ্বাসটা চাপা পড়ে যায়।
৫.
আমার ছোটবেলার এক বন্ধু ফেসবুকে ওর সস্ত্রীক ছবি দিয়েছে। দেখে ভালোই লাগল। বসন্তের দেশে বোধকরি মানুষের চেহারায় আলাদা একটা জেল্লা আসে। সুখে থাকার জেল্লা। পঁচা দেশের মাটি-পানি-বাতাস থেকে মুক্তির জেল্লা। ওর মাকে আমি চিনতাম। তাঁর মাথার চুল কখনো দেখা যায়নি। তিনি তখন হয়তো ভাবেননি তাঁর ছেলে এমন আধুনিক বউ পাবে। বোধহয় বসন্তের দেশ তাকে হাতছানি দেয়নি।
আমার অনেকগুলো বন্ধু এখন বসন্তের দেশগুলোতে থাকে। তাদের প্রৌঢ় বাবা-মা একাকি থাকেন এই পঁচা দেশে। বাড়িতে গেলে বা চলতি পথে দেখা হলে এক অদ্ভুত কাতরতা নিয়ে বলেন, বাবা বাসায় এসো—ও তো নেই, তোমরা এলে খুব ভালো লাগে। আমি বলি, ‘ওকে দেশে আসতে বলেন না কেন?’
—‘না না দরকার নেই, যেমন আছে ভালো আছে, ও ভালো থাকুক।’ মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি লুকান।
হসপিটালের গেটে দাঁড়িয়ে এক বাবা দেখেন ছেঁড়া লুঙ্গি পরা এক বৃদ্ধ তাঁর ছেলের রিকশা থেকে নামল, তারপর ছেলের কাঁধে ভর করে ধীর পায়ে হসপিটালের দিকে এগোতে লাগল। উনার গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে উঠল—আজ আমাকে হাসপাতালে আনার লোক খুঁজে পেতে আধঘণ্টা ফোন করতে হয়েছে, অন্যের ছেলে অফিস ফেলে আমাকে দয়া করে নিয়ে এসেছে।
আর আমার ছেলেটা... অভিমান আর সন্তানের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা দ্বন্দ্ব করে গলার দলাটা আরও মোটা করে ফেলে।
৬.
রসূলুল্লাহ কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সবচেয়ে বড় পাপ কী? তিনি বললেন,
—আল্লাহর সাথে শির্ক। তারপর? —
পিতামাতার অবাধ্য হওয়া। আল্লাহ নির্দেশ দিলেন তোমার পিতামাতা যখন বার্ধক্যে উপনীত হবে তখন তাদের কোনো কথা বা কাজে বিরক্ত হলেও ‘উফ’ শব্দটি পর্যন্ত করো না।
যত বড় বড় পাপ আছে সবগুলোর শাস্তি পরকালে হবে। একটা বড় পাপ আছে যার শাস্তি পরকালে তো হবেই, ইহকালেও হবে—তা হলো বাবা-মার প্রতি অপরাধের শাস্তি। কেউ যদি নিজের বাবা-মাকে কষ্ট দেয় তবে আল্লাহও তাকে সেই কষ্টের স্বাদ পৃথিবীতে দিয়ে তারপর তুলে নেবেন। এর কোনো মাফ নেই; অবধারিতভাবে দেবেন, নিশ্চয়ই দেবেন।
বসন্তের দেশগুলোতে থাকা মানুষগুলো হয়তো ভাবে, আমি আমার বাবা-মায়ের আদেশের আওতায় নেই, অবাধ্য হওয়ারও তাই আর প্রশ্ন আসে না। তথাস্তু কোকিল ছানা, তোমার বিচার আল্লাহ করবেন।
৭.
—এই পোড়ার দেশে থেকে আমি কী করব?
—দেশে কারেন্ট-গ্যাস-পানি-নিরাপত্তা কিছুই নেই। রাস্তায় গাড়ি নড়ে না।
—আমি যা নিয়ে পড়াশোনা করেছি তার কোনো প্রয়োগ আমার দেশে নেই।
—আমার দেশে সৎভাবে বেঁচে থাকা যায় না। দেশের সরকার নষ্ট, সিস্টেম নষ্ট।
—এখানে ইসলাম পালনের স্বাধীনতা আছে। আমার দেশে নেই।
—দেশে কামলা খাটলে মানুষ কী বলবে, তার চেয়ে এখানেই কামলা খাটি।
—কেন আমি তো দেশে টাকা পাঠাই, প্রতিদিন ফোনে কথা বলি। যারা দেশে বাবা-মায়ের সাথে আছে তাদের চেয়ে আমি ছেলের দায়িত্ব বেশি পালন করি।
—এখানে লাইফটাকে অনেক এনজয় করা যায়, আমার দেশে যায় না।
এ রকম আরও বহু কথা শুনেছি, বহুবার শুনেছি—আমার প্রিয় বন্ধুদের মুখে, বড় ভাইদের মুখে শুনেছি। দুঃখজনক হলেও বেশিভাগ কথাই সত্য। কিন্তু তারপরেও কেন যেন বারবার মনে হয়েছে কথাগুলো নিজেদের প্রবোধ দেওয়ার জন্য বলা। অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার অনিচ্ছা থেকে বলা।
মুসলিম হয়েও এই জীবনকে প্রাধান্য দেওয়ার ছল থেকে বলা।
৮.
আল্লাহর রসূলের সেই সাহাবার কথা মনে পড়ে যায় যিনি পূর্ণ থালা খাবার দেখে আল্লাহর ভয়ে কাঁদতেন,
‘হে আল্লাহ! সব নেয়ামত কি এই পৃথিবীতেই দিয়ে দিলে আখিরাতে কি তবে আমি নিঃস্ব হব?’
আমার রসূলুল্লাহ -এর কথা মনে পড়ে যায়। যিনি বাদশাহ রসূল হওয়ার প্রস্তাব ঘুরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন আমি নিঃস্ব রসূল হব। একদিন খাব, খেয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা করব। অন্যদিন না খেয়ে থাকব, না খেয়ে ধৈর্য ধারণ করব।
আমি বিদেশে থাকবার বিরোধিতা করছি না, বাবা-মাকে অবহেলা করার বিরোধিতা করছি। নিজের সুখকে পিতামাতার সুখের চেয়ে বেশি মূল্য দেওয়ার বিরোধিতা করছি। পৃথিবীর মোহে পরকাল ভুলে থাকার প্রবণতাকে বিরোধিতা করছি। আমার একটা সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাট নাই-বা থাকল। নাই-বা থাকল একটা গাড়ি, একটা ৫২ ইঞ্চি এলসিডি টিভি।
আমার বাবার মনের ভিতরের দু‘আটা থাক আমার সাথে।
আমার মায়ের ভালোবাসাটা থাক।
বয়ষ্ক বাবা-মাকে পেয়েও যে তাদের সেবা করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি নিতে পারল না সে হতভাগা। আমি সে হতভাগা হতে চাই না। আমি ত্রিমাত্রিক থিয়েটারে মুভি দেখলাম না, লেটেস্ট গেম খেললাম না, রুনির গোল দেওয়া দেখলাম না—কী আসে যায়?
আমি স্কটিশ উপকূল দেখলাম না, ছবির মতো শহর ভ্যাংকুভার দেখলাম না, দেখলাম না গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ—কী যায় আসে?
আমি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেলে এগুলো সবই পাব, বহু গুণে পাব। আমি আমার এই দুনিয়ার বিনিময়ে পরকাল কিনতে চাই। আমি পৃথিবীতে কষ্ট করে থেকে, মুখ বুঁজে বাবা-মায়ের সেবা করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে চাই।
আল্লাহ তোমার দোহাই, বসন্তের দেশের নেশা যেন আমার চোখে না লাগে, আমি যেন কোকিল ছানা না হয়ে যাই।
তুমি আমাকে রক্ষা করো, প্লিজ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৮ রাত ১১:১০