বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে—“যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ।” এ প্রবাদটি ক্ষমতার স্বভাবগত রূপান্তর ও অপব্যবহারের বাস্তবতা তুলে ধরে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে দলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে, দুর্নীতি ও অপশাসনের চক্রে আবদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি—সব সরকারই কম-বেশি দুর্নীতির অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে। সর্বশেষ, শেখ হাসিনা সরকারের ১৬ বছরের শাসনে ব্যাপক দুর্নীতি ও অপশাসনের অভিযোগ উঠেছে, যার ফলস্বরূপ দেশের জনগণ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের চাপে শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হন।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের চ্যালেঞ্জ
দেশের জনগণ আশা করেছিল, অন্তবর্তীকালীন সরকার দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ শাসন নিশ্চিত করবে। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় এই প্রত্যাশা ভেঙে যাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে যে, কিছু ছাত্র সমন্বয়ক চাঁদাবাজি, তদবির, টেন্ডারবাজি এবং ঘুষ বানিজ্যের সঙ্গে জড়িত। বিএনপির সিনিয়র নেতা বরকত উল্লাহ বুলু দুইজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে বদলি বানিজ্যের মাধ্যমে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তুলেছেন। এ ধরনের অভিযোগ শুধু বর্তমান সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না, বরং ভবিষ্যতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকেও ভেঙে চুরমার করে দেয়।
দুর্নীতির কারণ ও এর প্রভাব
দুর্নীতি বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এর মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
১. ক্ষমতার অপব্যবহার: দীর্ঘদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ দুর্নীতির প্রধান কারণ। ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে।
2. দায়বদ্ধতার অভাব: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে দুর্নীতিবাজদের বিচার হয় না, ফলে তারা বারবার একই কাজ করার সুযোগ পায়।
3. দুর্বল আইন প্রয়োগ: দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থা কার্যত রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার হয়ে দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ।
4. রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা: ছাত্র সংগঠন ও অন্যান্য দলীয় কর্মীদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা।
এই দুর্নীতির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এটি কেবল রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ঘটায় না, বরং সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকারও ক্ষুণ্ণ করে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন—সব খাতে দুর্নীতির প্রভাব লক্ষ করা যায়।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার উপায়
দুর্নীতি দূর করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যদি কার্যকর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়—
স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ প্রশাসন: প্রশাসনের সব স্তরে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে এবং দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা: রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি থাকা প্রয়োজন।
স্বাধীন ও কার্যকর বিচার ব্যবস্থা: আদালতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের শক্তিশালী ভূমিকা: দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ গঠন করতে হবে, যারা সরকারের অপশাসন ও দুর্নীতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করবে।
রাজনৈতিক সংস্কার: ছাত্র সংগঠন ও দলীয় কর্মীদের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর ওপর প্রভাব কমিয়ে তাদের রাজনৈতিক দুর্নীতির হাত থেকে দূরে রাখতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্নীতি ও অপশাসন যেন একটি অবশ্যম্ভাবী চক্রে পরিণত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এক সরকারের পতন হলেও, নতুন সরকার যদি পুরনো পথ অনুসরণ করে, তাহলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বিফল হবে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের উচিত দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে তারা পূর্ববর্তী সরকারের মতো একই অভিযোগের সম্মুখীন না হয়। কেবলমাত্র সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনই দেশের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে পারে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


