somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিশোর গ্যাং: অপরাধের বেড়াজালে তরুণ প্রজন্ম

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ভোর ৬:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি ভয়ংকরভাবে বিস্তার লাভ করেছে। ছিনতাই, জমি দখল, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, খুনসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে উঠছে কিশোররা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এদের দৌরাত্ম্য ক্রমশ বেড়েই চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ও গ্রেপ্তার সত্ত্বেও পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে না।

কিশোর গ্যাং-এর উত্থান ও বিস্তার

রাজধানীর মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা, আদাবরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট গ্যাং তৈরি হয়েছে, যারা ‘পাটালি গ্রুপ’, ‘গোল্ডেন গ্যাং’, ‘ডাইল্লা গ্রুপ’, ‘এলেক্স গ্রুপ’, ‘কব্জি কাটা আনোয়ার গ্রুপ’, ‘জনি গ্রুপ’ ও ‘ডিবি সুমন গ্রুপ’-এর মতো ভয়ংকর নাম নিয়ে সক্রিয়। সাধারণত ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোররা বেশি থাকলেও ১৮ বছরের বেশি বয়সীরাও এসব গ্রুপে যুক্ত রয়েছে।

অপরাধের ধরন

কিশোর গ্যাং সদস্যদের অপরাধের ধরন দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। তারা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে মহড়া দেয়, নারীদের উত্ত্যক্ত করে, মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশের ওপর পর্যন্ত হামলা চালায়। মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার বোর্ডঘাট এলাকায় পুলিশ অভিযান চালাতে গেলে ‘পাটালি গ্রুপ’ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়, এতে চার পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন।

কিশোর গ্যাং সদস্যরা শুধু নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়ায় না, তারা সাধারণ মানুষের জীবনও বিপদগ্রস্ত করে তুলছে। যেমন, পহেলা ফেব্রুয়ারি হাতিরঝিল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে এক পথচারী গুলিবিদ্ধ হন। আদাবর এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় বাধা দিলে মো. সুমন শেখ নামে এক যুবকের হাতের কব্জি কেটে ফেলা হয়।

কিশোর গ্যাং বিস্তারের কারণ

অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, কিশোর গ্যাংয়ের বাড়বাড়ন্তের পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে:

১. মাদকের সহজলভ্যতা: অনেক কিশোর গ্যাং মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, যা তাদের অপরাধপ্রবণ করে তোলে।
২. অর্থ ও ক্ষমতার লোভ: অনেক সময় রাজনৈতিক ব্যক্তি বা প্রভাবশালী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে কিশোরদের ব্যবহার করে, যা তাদের অপরাধে জড়িয়ে ফেলে।
৩. আইনের তোয়াক্কা না করা: অনেক ক্ষেত্রে কিশোর অপরাধীরা গ্রেপ্তার হলেও দ্রুত জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
৪. হিরোইজম ও গ্যাং কালচার: কিশোররা নিজেদের এলাকার ‘ডন’ হয়ে উঠতে চায়, ভিডিও বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় এবং নিজেদের অপরাধী জীবনকে গৌরবান্বিত করে তোলে।
৫. পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়: অভিভাবকদের অবহেলা, দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব ও কর্মসংস্থানের সংকটও কিশোরদের অপরাধে প্রলুব্ধ করে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ

পুলিশের পক্ষ থেকে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। গত এক মাসে শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশেষত মোহাম্মদপুর, আদাবর, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় বড় আকারে অভিযান পরিচালিত হয়েছে। সম্প্রতি সেনাবাহিনী মোহাম্মদপুর উদ্যান এলাকায় অভিযান চালিয়ে ‘গোল্ডেন গ্যাং’ গ্রুপের ১৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরও নতুন করে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি করে দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে।

সমাধানের পথ

১. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি: কিশোরদের মধ্যে অপরাধের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং তাদের জন্য দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
২. অভিভাবকদের ভূমিকা: পরিবারের উচিত সন্তানের গতিবিধি সম্পর্কে সচেতন থাকা, সময় দেওয়া এবং তাদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া।
৩. আইনের কঠোর প্রয়োগ: কিশোর অপরাধীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে।
৪. কমিউনিটি পুলিশিং ও সামাজিক উদ্যোগ: স্থানীয়ভাবে কিশোরদের সঠিক পথে আনতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কার্যক্রম বাড়ানো দরকার।
৫. মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান: মাদকের উৎস বন্ধ করতে হবে এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

কিশোর গ্যাং সমস্যাটি শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। এটি একটি সামাজিক সমস্যা, যার সমাধান পরিবারের ভূমিকা, শিক্ষা ব্যবস্থা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে সম্ভব। কিশোরদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে না পারলে ভবিষ্যতে এ সমস্যাটি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। এখনই সময়, কিশোরদের সঠিক পথে ফেরানোর এবং তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ভোর ৬:৪৩
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৫

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

ছবি, এআই জেনারেটেড।

ইহা আর মানিয়া নেওয়া যাইতেছে না। একের পর এক মামলায় তাহাকে সাজা দেওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন রাজনীতি কে কবে দেখেছে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২০


জেনজিরা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামল দেখেছে। মোটামুটি বীতশ্রদ্ধ তারা। হওয়াটাও স্বাভাবিক। এক দল আর কত? টানা ১৬ বছর এক জিনিস দেখতে কার ভালো লাগে? ভালো জিনিসও একসময় বিরক্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন নারী শিক্ষিকা কীভাবে কন্যা শিশুর সবচেয়ে অসহায় মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করতে পারেন?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৩


বাংলাদেশে মাঝে মাঝে এমন সব মানুষ রূপী শয়তানের সন্ধান মেলে যাদের দেখে আসল শয়তানেরও নিজের উপর হতাশ হওয়ার কথা। এমন সব প্রজাতির মানুষ বাংলাদেশে বসবাস করেন যাদের মস্তিষ্ক খুলে দেখার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মানুষ মানুষকে কীভাবে এত অপদস্ত করে এই ব্লগে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৪

আমি তো কারও সাতেও নাই পাঁচেও নাই। এত সময়ও নাই মানুষকে ঘাঁটার। ব্লগের ব্লগারদের সম্পর্কেও তেমন কিছু জানি না। তবে পোস্ট পড়ে কিছুটা আন্দাজ করা যায় -কে কী রকম। আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×