somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হিন্দু ধর্মে বলি প্রথার আদ্যোপান্ত

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেক নিরামিষাশী ঘাসফুস-জীবী হিন্দু দাবি করেন, ওই বলি-টলির ব্যাপার তাঁদের সনাতন ধর্মে নেইকো, ওসব পরবর্তীকালের তন্ত্রের আমদানি। কিন্তু সে কথা পুরোই ঘাপলা। ঋগবেদ, যা বেদের মধ্যে প্রাচীনতম বলে ধরা হয়, তাতেও বলির উল্লেখ আছে। আর যজুর্বেদকে তো একরকম বলির হ্যান্ডবুকই বলা চলে। কোন দেবতার উদ্দেশ্যে কোন প্রাণী বলি দিতে হবে, এসব বিস্তারিত বলা আছে সেখানে। চাষের আগে অমুক দেবতাকে তুষ্ট করে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য অমুক প্রাণী বলি, খরার সময় বৃষ্টির দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য অমুক প্রাণী বলি, ইত্যাদি ইত্যাদি। বৈদিক যুগে আর্যরা বেশ টপাটপই বলি লাগাতেন। তারপর ধরুন গিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা, যা বড় বড় রাজারা নিজেদের রাজচক্রবর্তী প্রমাণ করার জন্য করে থাকতেন – যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন, যে ঘোড়ার পাহারাদার হয়েছিলেন অর্জুন। যজ্ঞের শেষে যখন সেই সারা ভারত ট্যুর করে আসা ঘোড়াটিকে বলি দেওয়া হল, তখন তার মাংস দেখভালের দায় পড়েছিল দ্রৌপদীর উপর। সনাতন ধর্মের যাগযজ্ঞে এই একটা ভাল ব্যাপার ছিল, স্ত্রীকে স্বামীর সহধর্মিনী, অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে যজ্ঞে সাথেসাথে থাকতে হত আর অনেক দায়দায়িত্বও পালন করতে হত, স্ত্রী পাশে না থাকলে সেই যজ্ঞের ফল ঠিকমত মিলত না।

কোরবানির সঙ্গে বলির মূল তফাত হল, বলি যেখানে-সেখানে দেওয়া যায় না। মন্ত্র পড়ে ‘প্রতিষ্ঠা’ করা স্থানে, যথাযথভাবে ‘স্থাপিত’ হাঁড়িকাঠেই (এর ভদ্র নাম যূপকাষ্ঠ, বৌদ্ধশাস্ত্রে নাম পাই ধর্মগণ্ডিকা, যাতে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কটা আরো স্পষ্ট) কেবল বলি দিলে তা দেবতাদের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়। বড় বড় রাজা বা ভূস্বামী (জমিদার) যখন যজ্ঞ করাতেন, তখন তাঁদের যজ্ঞভূমিতেই বলির ব্যবস্থা করা হত। নয়ত মন্দির-প্রাঙ্গণে পুরুতকে দিয়ে কোনো যজ্ঞ করাবার সময় গৃহস্থরা সেখানের স্থায়ী হাঁড়িকাঠে বলি দেওয়াতে পারত। গৃহস্থদের বাড়িতে পৈতে (উপনয়ন) ইত্যাদি ছোটখাট যে সব যজ্ঞ-অনুষ্ঠান হয় তাতে বলির প্রয়োজন পড়ে না। যারা ধরেন কোনো কামনায় জোড়া পাঁঠা মানত করত, তারাও সচরাচর মন্দিরে গিয়েই সে পাঁঠা বলি দিইয়ে আসত। তবে বিশেষ সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে বড় করে কালীপুজো করাচ্ছে, এমন হলে অন্য কথা।

বলির কয়েকরকম পদ্ধতি থাকলেও সচরাচর হাঁড়িকাঠে ফেলে এক কোপে বলি, অর্থাৎ ঝটকা বলিই প্রচলিত। তাতে এক কোপে প্রাণীর গলা কেটে ফেলতে না পারলে বলি অশুদ্ধ হয়ে যায়। এদিকে আবার যত বড় প্রাণী তত বেশি পুণ্য, তাই মহিষ ইত্যাদি বড়সড় প্রাণী বলি দিতে শক্তসমর্থ কামারের খুব চাহিদা। কামারদের বলির জন্য তুলে রাখা আলাদা বিশেষ বড় খাঁড়া থাকত সেজন্য।

শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘লালু’ গল্পে এমন এক পাঁঠাবলির নিখুঁত বিবরণ দিয়েছেন:
সময় নেই — তাড়াতাড়ি পাঁঠা উৎসর্গিত হয়ে কপালে সিঁদুর, গলায় জবার মালা পরে হাড়িকাঠে পড়লো, বাড়িসুদ্ধ সকলের ‘মা’ ‘মা’ রবের প্রচণ্ড চিৎকারে নিরুপায় নিরীহ জীবের শেষ আর্তকণ্ঠ কোথায় ডুবে গেল, লালুর হাতের খড়গ নিমিষে ঊর্ধ্বোত্থিত হয়েই সজোরে নামলো, তার পরে বলির ছিন্নকণ্ঠ থেকে রক্তের ফোয়ারা কালো মাটি রাঙ্গা করে দিলে। লালু ক্ষণকাল চোখ বুজে রইল। ক্রমশঃ ঢাক ঢোল কাঁসির সংমিশ্রণে বলির বিরাট বাজনা থেমে এলো। যে পাঁঠাটা অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল আবার তার কপালে চড়লো সিঁদুর, গলায় দুললো রাঙ্গা মালা, আবার সেই হাড়িকাঠ, সেই ভয়ঙ্কর অন্তিম আবেদন, সেই বহুকণ্ঠের সম্মিলিত ‘মা’ ‘মা’ ধ্বনি। আবার লালুর রক্তমাখা খাঁড়া উপরে উঠে চক্ষের পলকে নীচে নেমে এলো,—পশুর দ্বিখণ্ডিত দেহটা ভূমিতলে বার-কয়েক হাত-পা আছড়ে কি জানি কাকে শেষ নালিশ জানিয়ে স্থির হ’লো; তার কাটা-গলার রক্তধারা রাঙ্গামাটি আরও খানিকটা রাঙ্গিয়ে দিলে।
সনাতন ধর্মে বলির ব্যাপক প্রচলন থাকলেও পরবর্তীতে শৈব বৈষ্ণব ইত্যাদি হিন্দুধর্মের অধিকাংশ ধারাতেই বলির চল উঠে যায়। শাক্ত অর্থাৎ কালী বা চণ্ডীদেবীর উপাসকদের মধ্যেই কেবল বলির রমরমা চলতে থাকে। এই শাক্ত ধারা ক্রমে তন্ত্র নামে প্রসিদ্ধি পায়, যার অনেককিছু বৌদ্ধদের বজ্রযান শাখায় ঢুকে পড়ে। অনুমান করা হয়, কৃষ্ণাঙ্গ কালী মূলে অনার্য দেবতা, অনার্য উপজাতিদের বৈদিক ধর্মে আত্তীকরণ করে নেবার সময় তাদের দেবীকেও স্বীকৃতি দিয়ে শক্তির প্রতিরূপ হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। আর উপজাতি-প্রধান বঙ্গে তাই কালীর উপাসনার চল বেশি, সেই সঙ্গে বলিরও চল বেশি। অন্তত, বেশি ছিল। এখন তো আইন করে প্রকাশ্যে বলি নিষিদ্ধ, তবুও ধর্মের নামে এদিক-ওদিক দিব্যি চলে বইকি।

আগেকার সময় অনেক নিষ্ঠাবান হিন্দু কালীবাড়ির বলি হওয়া পাঁঠার মাংস ছাড়া খেতেন না। যদিও বৈদিক যুগে প্রায়শই গরু বলি দেওয়া হত, ব্রিটিশ যুগে দয়ানন্দ সরস্বতীর হিন্দু রিফর্মিস্ট আন্দোলনের সময় থেকে নব্য-হিন্দুধর্মে গরুর প্রতি প্রবল ভক্তিভাব চালু হয়ে পড়ে। (কিছু মর্কট জঙ্গি-হিন্দু ভারতের ম্যাকডোনাল্ডস দোকানে ভাংচুর করেছিল, কেন তারা আমেরিকায় বীফ বেচে তাদের দোকানে!) আবার প্রাণী বলিতে আপত্তি বা শাস্ত্রীয় সমস্যা থাকলে পরিবর্তে সবজি যেমন কুমড়ো চালকুমড়ো ইত্যাদি বলি দেওয়ারও রেওয়াজ আছে।

তবে যেখানে তন্ত্র নৃশংসতাকেও ছাপিয়ে যায়, তা হচ্ছে নরবলি। নরবলি দিলে নাকি অন্য সব বলির তুলনায় সর্বাধিক পুণ্য লাভ হয়। গল্পে শুনে থাকবেন, ডাকাতেরা বড়সড় ডাকাতি করার আগে নিয়মিতই জঙ্গলের মধ্যে কালীর মন্দিরে নরবলি দিয়ে যেত। ব্রিটিশ আমলে এসে সে প্রথা বন্ধ হয়। এখনও মাঝে মাঝে খবরে আসে, অমুক গ্রামের তমুক তান্ত্রিক কোন শিশুকে বলি দিয়েছে (কারণ শিশুদের তুলে আনা এবং বলি দেওয়া সোজা) নিজের বা তার মক্কেলের বিশেষ কল্যাণ লাভের আশায়।

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের হাস্যকর, বস্তুত ঘৃণ্য রীতিনীতি এবং ভণ্ডামির উপর চমৎকার স্যাটায়ার লিখতেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, তাঁর ডমরুচরিত ইত্যাদি অনেক গল্পে। একটি গল্পে তিনি একজন অত্যন্ত ধার্মিক নিষ্ঠাবান হেঁদু ব্রাহ্মণ ‘শ্রীল শ্রীযুক্ত গোলোক চক্রবর্তী’ মহাশয়ের পাঁঠা ব্যবসার মর্মস্পর্শী ছবি এঁকেছেন। ঠাকুরমশায়ের ব্যবসা হল পাঁঠার খোঁয়াড় চালানো, এবং ধর্মমতে পাঁঠা বলি দিয়ে তার ‘শাস্ত্রসম্মত’ মাংস নিষ্ঠাবান খাদকদের কাছে জোগান দেওয়া, আর চামড়া-টামড়া বিক্রি করে উপরি আয়।
পাঁঠাকে ফেলিয়া ঠাকুর মহাশয় তাহাকে সেই খোঁটায় বাঁধিলেন। তাহার পর তাহার মুখদেশ নিজের পা দিয়া মাড়াইয়া জীয়ন্ত অবস্থাতেই মুণ্ডদিক হইতে ছাল ছাড়াইতে আরম্ভ করিলেন। পাঁঠার মুখ গুরুদেব মাড়াইয়া আছেন, সুতরাং সে চীৎকার করিয়া ডাকিতে পারিল না। কিন্তু তথাপি তাহার কণ্ঠ হইতে মাঝে মাঝে এরূপ বেদনাসূচক কাতরধ্বনি নির্গত হইতে লাগিল যে, তাহাতে আমার বুক যেন ফাটিয়া যাইতে লাগিল। তাহার পর তাহার চক্ষু দুইটি! আহা! আহা! সে চক্ষু দুইটির দুঃখ আক্ষেপ ও ভর্ৎসনাসূচক ভাব দেখিয়া আমি যেন জ্ঞান-গোচরশূন্য হইয়া পড়িলাম। সে চক্ষু দুইটির ভাব এখনও মনে হইলে আমার শরীর রোমাঞ্চ হইয়া উঠে। আমি আর থাকিতে পারিলাম না। আমি বলিয়া উঠিলাম— ‘ঠাকুর মহাশয়! ঠাকুর মহাশয়! করেন কি? উহার গলাটা প্রথমে কাটিয়া ফেলুন। প্রথম উহাকে বধ করিয়া তাহার পর উহার চর্ম্ম উত্তোলন করুন।’
ঠাকুর মহাশয় উত্তর করিলেন—‘চুপ! চুপ! বাহিরের লোক শুনিতে পাইবে। জীয়ন্ত অবস্থায় ছাল ছাড়াইলে ঘোর যাতনায় ইহার শরীরের ভিতরে ভিতরে অল্প অল্প কাঁপিতে থাকে। ঘন ঘন কম্পনে ইহার চর্ম্মে একপ্রকার সরু সরু সুন্দর রেখা অঙ্কিত হইয়া যায়। এরূপ চর্ম্ম দুই আনা অধিক মূল্যে বিক্রীত হয়। প্রথম বধ করিয়া তাহার পর ছাল ছাড়াইলে সে চামড়া দুই আনা কম মূল্যে বিক্রীত হয়। জীয়ন্ত অবস্থায় পাঁঠার ছাল ছাড়াইলে আমার দুই আনা পয়সা লাভ হয়। ব্যবসা করিতে আসিয়াছি, বাবা! দয়ামায়া করিতে গেলে আর ব্যবসা চলে না।’

লিখেছেন কৌস্তুভ
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৮
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×