চতুর্থ বারের মত টিউশনি থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরছে রাকিব, এই নিয়ে চারবার ছাত্রের মায়ের কাছে বেতন চেয়ে ও খালি হাতে ফিরছে সে, মাসের আজ ১৫ তারিখ, ৪-৫ দিন পর ঈদ, ২ মাসের বেতন বাকি পড়েছে তার, প্রথমে ঈশারা ইঙ্গিতে চেয়ে লাভ না হয়ে আজ নির্লজ্জের মত কথাটা বলেই ফেলল সে ছাত্রের মা কে...
-অ্যান্টি একটু কথা ছিল
-বল বাবা,
- ইয়ে মানে, মাসের টাকা টা...
- পাবে বাবা পাবে, এত টাকা টাকা করে পাগল হচ্ছ কেন, তোমার সাথে তো
আমরা ব্যবসা করছি না,
ছাত্রের মায়ের হটাত উগ্র মূর্তিতে বেশ দমে গেল সে...
-ইয়ে অ্যান্টি ২ মাসের বাকি পড়েছে তো, সামনে ঈদ, বোঝেন ই তো,
- তুমি বরং আমাদের টা বোঝো বাবা, আমরা তো চাকুরীজীবী না, টাকার গাছ নিয়ে বসে নেই, একটু সবুর কর, টাকা পেয়ে যাবে, তোমার টাকা দিয়ে আমরা ইলিশ মাছ কিনে খাব না,
-জি অ্যান্টি,
- শিহাব এর কাছে ও শুনেছি তুমি নাকি ওর কাছেও টাকার কথা বলেছ, ছাত্রের কাছে এসব কথা বলবে না, সে বাচ্চা মানুষ এসব শুনে সে কষ্ট পাবে, মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া হবে,
রাকিব বেশ লজ্জাই পেয়ে গেল, শিহাব তাহলে বলেছে ব্যাপারটা, অবশ্য শিহাব কে না বলেও উপায় ছিল না, তার মা কেন যেন তাকে ৭-৮ দিন ধরে এড়িয়ে চলছেন, শিহাব ও এত ছোট না, যে ছেলে এইচএসসি এক্সাম দেবে তাকে নিশ্চয়ই ছোট বলা যায় না,
- জি অ্যান্টি আর বলব না,
-ভাল, ঈদের আগে আর আসতে হবে না আমরা ঈদের পর কক্সবাজার যাচ্ছি তো বেড়াতে, তাই ঈদের পরেও ৭ দিন আসার প্রয়োজন নেই,
- জি অ্যান্টি,
হতাশ হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েছিল সে, এ হতাশা যে তার বহু দিনের সঙ্গী...
(২)
-বাবা এসেছিস?
-জি বাবা,
- পয়সা দিয়েছে রে বাবা,
- না বাবা আজ ও দেয় নি,
ছেলের কথা শুনে বিরস বদনে জানালা দিয়ে দূরে চেয়ে রইলেন আফসার সাহেব, বেসরকারী একটা অফিসে উনি ও একটা ছোট চাকুরী করেন, মালিক পক্ষের সাথে ঝামেলা হওয়ায় গত কয়েক মাস ধরে তাদের ও বেতন বন্ধ, মেস ভাড়া বাকি পড়েছে অনেক দিনের, কি যে হবে, আল্লাহ ই ভরসা,
- বাবা তোমাকে চা করে দেই?
ছেলের কণ্ঠে সম্বিত ফিরল তার...
-দে,
-চিনি হবেনা বাবা, ঘরে চিনি শেষ,
-চিনি লাগবে না রে, বয়স হয়েছে মিষ্টি খাওয়া উচিত হবে না, তুই ও খাস না, বেশী চিনি খেলে ডায়বেটিস এ ধরবে, শেষ বুড়ো বয়সে এসে বিপদে পড়বি,
-ঠিক ই বলেছ বাবা,
- হ্যারে রাকিব, তোর পরনের শার্ট টা যে বগলের দিকে ছেড়া রে,
- ও কিছুনা বাবা, আমি মোটা হয়েছি তো ছিঁড়ে গেছে তাই,
ছেলের নির্জলা মিথ্যে শুনে চুপ করে ছেলের মলিন শার্ট টার দিকে এক পলকে চেয়ে রইলেন তিনি, ইচ্ছা করল, ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে কাদেন, কতদিন ছেলেটাকে কিছু কিনে দেয়া হয়নি, ছেড়া শার্ট পড়ে ঘুরছে, একটা বার কিছু বলেও নি, ভার্সিটিতে নিশ্চয়ই বন্ধুরা এ নিয়ে হাসে, ছেলেটা হয়ত তাদের এড়িয়ে ও চলে, আফসার সাহেব ভাবলেন ৭ জনমের পুন্যের ফসল, এমন পিতা ভক্ত ছেলে পেয়েছেন, আর তাছাড়া হবেই তো, মা মরার পর উনি ই তো ওকে খেয়ে না খেয়ে মানুষ করেছেন,
তিনি কিছু বললেন না মন খারাপ করে চুপ চাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন,
(৩)
আফসার সাহেব প্রথমে গেলেন গুলিস্তানে, তার বহুদিনের পুরনো মোবাইল টা ১২০০ টাকায় বিক্রি করলেন, ব্যাটা ১২০০ টাকা দিতেই চাচ্ছিল না, বহু দরাদরি তে বিক্রি করলেন,
এরপর গেলেন নিউ মার্কেট এ, দোতলায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে সুন্দর দেখে ২ টা শার্ট আর একটা প্যান্ট কিনলেন, ফেরার সময় বুকে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি বোধ করলেন,
বাড়ি ফিরেই দেখেন রাকিব দরজার মুখে বসে আছে,
- বাবা তুমি চা না খেয়ে কোথায় গিয়েছিলে?
- এইতো রে একটু বাইরে গিয়েছিলাম,
- চা গরম দেই আবার, তুমি হাত মুখ ধুয়ে এসো?
- আচ্ছা
- তোমার হাতে ওটা কিসের প্যাকেট?
- কিছু না রে, বাবা তুই যাতো, চা গরম দে,
রাকিব বাধ্য ছেলের মত চলে গেল, আফসার সাহেব ভাবলেন এই সুযোগ, যা করার করতে হবে, ছেলে ফিরে আসতে আসতে তিনি দ্রুত বিছানায় শার্ট প্যান্ট সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলেন এবং চুপ চাপ এক কোনে দাড়িয়ে রইলেন ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখার জন্যে।
নতুন কাপড় হাতে রাকিব বসে আছে, সে প্রচণ্ড অবাক হয়েছে, অবাকের ২ টা ভাগ আছে, একটা অতি আনন্দে অবাক আরেকটা অতি কষ্টে অবাক, সে এখন অতি আনন্দে অবাক, তার চোখে পানি মুক্তার মত ঝিক ঝিক করছে, মনে হচ্ছে কিছুক্ষনের মাঝেই বৃষ্টি ঝরাবে,
আফসার সাহেব একটু পাশ থেকে ছেলেকে দেখছেন, তার চোখেও পানি, বৃদ্ধ বয়সের এ এক দোষ, সব ব্যাপারেই চোখে পানি এসে পড়ে, আবেগ আর কন্ট্রোল এ থাকেনা,
নিজেকে এখন তার পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তিনি তাকিয়ে আছেন ঝলমলে স্নেহ মাখা এক দৃষ্টি নিয়ে।
সত্যি, বাবারা মাঝে মাঝে যা পাগলামি করে না...।