somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ নৈশূন্য

০১ লা নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কালো পিচের রাস্তাটাকে দন্তহীন মুখে চুমু খেতে খেতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে তিনটে কালো টায়ার। ঠিক যে সামনে এগুচ্ছে সেটাও বলা যাচ্ছে না। কারণ টায়ারের কাছে সামনে-পেছনে বলে কিছু নেই। এরা শুধু ঘুরে আর চুমু খায়। চুমু খেতে খেতে কোথায় যায় এরা জানে না। কেন ঘুরে সেটাও জানে না। পেট ভর্তি এদের উষ্ণ হাওয়া। যখন খিদে লাগে কে যেন এসে আবার পেট ভর্তি করে দিয়ে যায়। এদের কথা ভাবে না রিকশার সিটের উপর বসে থাকা শায়ান। রিকশার টায়ার নিয়ে কেউ কখনো ভাবে নাকি! শুধু শায়ান কেন, কোন যাত্রীই কোনদিন ভাবেনি এদের কথা। ভাবে শুধু রিকশার চালক আনিছ মিয়া।

রাস্তাটা ভাঙ্গা। একটু পরপরই ছোট ছোট গর্ত। বেশ ঝাঁকুনি টের পাচ্ছে শায়ান। ঝাঁকুনির জন্যে মনে কোন বিরক্তির উদ্রেগ হয় না তাঁর। হওয়ার কথা। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে পুরো ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে এক ধরণের কসমিক বিরক্তি ভর করে আছে শায়ানের মনে। এইসব ঝাঁকুনি-ফাকুনিতে আর কি হবে! তবে বিরক্তির উদ্রেগ না হলেও কিছু একটা হয়। ঝাঁকুনিতে নড়তে থাকে শায়ানের সমতল স্তনের দুই বোঁটা। শায়ান টের পায়, একটা অদ্ভুত ব্যথাতুর অনুভূতি জেগেছে সারা শরীরে। মনে একটা ভাবনা উঁকি মারে – পুরুষের সমতল স্তনেই এই অনুভূতি, আর যদি নারী হয় তাহলে সেটা কেমন হবে! হঠাৎ নারী হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে শায়ানের। ইচ্ছে করে নারীত্বের অনুভূতি পেতে। এই মুহূর্তে নারীত্বের তৃষ্ণায় আর্তনাদ করে উঠে তাঁর পুরো অস্তিত্ব। নারী হয়ে উঠার ইচ্ছা যে শায়ানের শুধু এই মুহূর্তেই জেগেছে তা নয়। আগেও বহুবার এমন হয়েছে। পুরুষ হয়ে জন্মানোর জন্য তাঁর কোন আক্ষেপ নেই, তবে নারীত্বের স্বাদ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র। নারীকে তাঁর জলের মতই রহস্যময় আর স্পর্শকাতর মনে হয়। নারীর অস্তিত্বে যেন অকারণেই সারাক্ষণ ঢেউ উঠে, ঢেউ নামে। নারীর শরীরের প্রতিটা ইঞ্চি যেন নিজ নিজ সুরে গান গেয়ে যায় সর্বদা। নারী দেহের উর্বরতার স্বাদ পেতে তাঁর আত্মায় কাঁপন ধরে। সেই কাঁপুনি ঝাঁকুনির সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়।

রিকশা এগুচ্ছে। আনিছ মিয়ার পিঠে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে শায়ান। লোকটা প্যাডেল চাপছে। পিঠটা উঠানামা করছে। শায়ানের ভেতরে একটা অপরাধ বোধ জেগে উঠে। রিকশায় চড়লে মাঝেই মাঝেই এমন অপরাধ বোধ জাগে। একজন প্যাডেল মারছে, আর আরেকজন আরাম করে পেছনে বসে আছে ব্যপারটা ক্ষণিকের জন্য কুৎসিত লাগে তাঁর। কিন্তু রিকশায় চড়ার ইচ্ছাটা কখনই মরে না। এই অপরাধ বোধ বরং রিকশায় চড়ার আকাঙ্ক্ষাটা আরও বাড়িয়ে দেয়। এই মুহূর্তে শায়ানের রিকশাওয়ালা হতে ইচ্ছে করছে। প্যাডেল চাপতে চাপতে অশিক্ষিত মস্তিষ্কে কি ধরণের খেলা চলে সেটা অনুভব করতে ইচ্ছে করছে। সেখানে কি কোন হীনমন্যতা কাজ করছে? অস্তিত্বের দেয়া ইনটেলিজেন্স কি সেখানে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করছে? নাকি প্রশান্তির ভঙ্গিতে আভ্যন্তরীণ কর্মহীনতা উপভোগ করছে? কে জানে কি হচ্ছে আনিছ মিয়ার মস্তিষ্কে? শায়ান শত চেষ্টা করেও আঁচ করতে পারে না কিছুই। তাঁর যন্ত্রণা হয়। যন্ত্রণা হয় নারী হতে না পারার। যন্ত্রণা হয় আনিছ মিয়া হতে না পারার। যন্ত্রণা হয় অস্তিত্বের সবগুলো ডাইমেনশনে প্রবেশাধিকার না পাওয়ার। লেকের পাড়ে ভাঙ্গা রাস্তায় চলন্ত রিকশায় শায়ানের গায়ের উপর সকালের উজ্জ্বল রোদ এসে হাত বুলায়। এতে শায়ানের যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়। বহুগুনে বেড়ে যায়।

এই যন্ত্রণার অনুভূতিতেও শায়ানের ভেতর অপরাধ বোধ জন্মায়। যেন এটা অনুভব করার অধিকার তাঁর নেই। সুখানুভূতিতেও শায়ান অপরাধী। ছুটির দিনে দিন ভর ঘুমনোর সময়ও তাঁর নিজেকে অপরাধী লাগে। ইদানিং এই অনুভূতির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় মনে বিরক্তির উদ্রেগ হয়েছে। বিরক্তিটা মাঝে মাঝে রূপ নেয় ভয়ে। একটা গভীর ভয় কুণ্ডলী পাকায় শায়ানের বুকের ঠিক মাঝখানটায়। সে অসহায় বোধ করে, নিঃসঙ্গ বোধ করে।

রিকশা কাছাকাছি চলে এসেছে। একটু পরেই নামতে হবে। নামতে ইচ্ছা করে না শায়ানের। রিকশায় উঠে কোনদিনই তাঁর নামতে ইচ্ছা করেনি। কেন এটা অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে না!

রিকশা থেকে নেমে অগত্যা ভাড়া মিটায় সে। এই সময় আনিছ মিয়ার মুখের দিকে তাকায় না। ভাড়া দেয়া শেষ হলে হাঁটা শুরু করে শহুরে ফুটপাত ধরে। হাঁটার সময় শায়ানের মনে হয় রাস্তা এগুচ্ছে না। ব্যপারটা তাঁর ভালো লাগে নাকি খারাপ লাগে সেটা সে ধরতে পারে না। তবে হাঁটতে থাকে। প্রতিদিনই এই একই ফুটপাত ধরে একই সময়ে তাকে হাঁটতে হয়। গত মাস দুয়েক ধরে ফুটপাতের পাশে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলছে। কয়েকদিন দিন হল বিশাল আকৃতির একটা ক্যাটারপিলার গাড়ি এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আজকেও দাঁড়িয়ে আছে। শায়ানের চোখ আটকে যায় ক্যাটারপিলারের মুখে কাঁথা মুরি দিয়ে শুয়ে থাকা এক মহিলার উপর। মহিলাটা ঘুমোচ্ছে। বেশ শান্তিতেই ঘুমুচ্ছে। গায়ের কাঁথাটা নোংরা। মাথার নিচে বালিশ হিসেবে কি দিয়েছে সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ক্যাটারপিলারের মুখে একটা মানুষ এমন শান্তিতে ঘুমাতে পারে দেখে শায়ানের হিংসে হয়। নিশ্চয়ই এই মহিলাকে তার মত ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয় না। তার মত যন্ত্রনাও হয় না। জগতের সকল অশিক্ষিত আর দরিদ্র মানুষগুলোকে তার হিংসে হয় এই মুহূর্তে। শায়ানের এখন অশিক্ষিত হতে ইচ্ছে করে, দরিদ্র হতে ইচ্ছে করে। জীবনে একটাও কবিতা না পড়ে, আলবার্ট ক্যামুর অ্যাবসারডিটি না পড়ে, নিৎশের দর্শন না পড়ে, গল্প, উপন্যাস আর অস্তিত্বের অর্থহীনতার খবর না জেনে একটা মানুষ কিভাবে দিব্যি জীবন পার করে দিতে পারে সেটা ভেবে শায়ান শিহরিত হয়। এইসব না পড়া জীবনও তো জীবন! তার এখন মায়ের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তার মাও অশিক্ষিত, যে জীবনে কোনদিন কবিতা পড়েনি, ঠিক মত মন দিয়ে একটা গানও শুনেনি। এই মুহূর্তে মাকেও হিংসে হয় শায়ানের।
রাস্তা দিয়ে সাঁই সাঁই করে গাড়ি যাচ্ছে। শায়ান গাড়িগুলো দেখে। কার, মাইক্রো, মোটরসাইকেল, বাস, সিএনজি সবকিছু দৌড়াচ্ছে দ্রুতগতিতে। এত দৌড় কেন মানুষের! কোথায় যায় মানুষ এত তাড়াহুড়া করে! আদৌ কি কোথাও যায়? মানুষ কি জানে না তার কোথাও যাওয়ার নেই? জানে না বোধয়। না জানাই ভালো। জানলে যন্ত্রনা হয়। গাছেরা কোথাও যায় না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়। শায়ানের ছোট বেলার এক আম গাছের কথা মনে পড়ে। সেই গাছে উঠে সে প্রায়ই বসে থাকত। তার এখন আম গাছে হতে ইচ্ছে করছে কিনা সেটা সে বুঝতে পারছে না।

একটা জেব্রা ক্রসিং এর সামনে এসে শায়ান দাঁড়িয়ে পড়ে। রাস্তা পার হবে। পাশে আরও দুই একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর আরও কয়েকজন আসল। সিগন্যালে গাড়িগুলো থামে। সবাই রাস্তা পার হচ্ছে। শায়ানও পার হবে। কিন্তু তার পা নড়ে না। সে কিছুতেই সামনে কদম ফেলতে পারছে না। শরীরের সর্বশক্তি দিয়েও না। শায়ান খেয়াল করে দেখে তার পায়ে শিকড় গজাচ্ছে। মাটি ভেদ করে গভীরে চলে যাচ্ছে শিকড়গুলো। হাতের কাছ দিয়ে ডালপালা গজাচ্ছে। শরীরের জামাকাপড় ফোঁড়ে বেড়িয়ে আসছে গাছের চামড়া। উচ্চতা বাড়ছে দ্রুত গতিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে শায়ান টের পেল সে একটা বিকট গাছে পরিণত হয়েছে।

বৃক্ষ শায়ান দেখতে পেল তার একটা শাখায় ঝুলে আছে তিনটা রিকশার টায়ার। টের পেল বৃক্ষ হয়েও তার হৃদপিণ্ড আছে। ধুঁক ধুঁক করছে। ধুঁক ধুঁক, ধুঁক ধুঁক। বৃক্ষের চোখে শায়ান দেখতে পেল পুরো শহর জুরে ছড়িয়ে আছে একটা নৈশূন্যতা।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৩৩
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×