১''
-স্যার রোসা, আপনার খাবার সময় হয়েছে। খাবার দেবো?
- আমি খাবো না। তুমি যাও।
- স্যার, আপনাকে আপনার প্রয়োজন মত খাবার খেতেই হবে। নইলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
আমি আমার লেখা থেকে চোখ না তুলেই শান্ত গলায় ওকে বললাম,
-আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও। বিরক্ত করো না।
- স্যার তাহলে কি আমি আপনাকে শক্তি উৎপাদক ভ্যাক্সিন দেব?
-লাগবে না।
-অবশ্যই লাগবে স্যার রোসা।কারন প্রতিদিন আপনি যে হারে আপনার শক্তি ব্যয় করেন সে হারে যদি শক্তি উৎপাদন না করেন তাহলে আপনার কর্ম দক্ষতা হ্রাস পাবে।তাছাড়া......
এবার আমি ওর যান্ত্রিক চোখ দুটির দিকে তাকালাম।ওর নাম কিৎ।আমার সাহায্যকারী রোবট।তবে ওকে ঠিক রোবট বলা যায় না।অন্তত আমি বলব না।কারন কিছু দিন আগে আমি ওর পাওয়ার পয়েন্টে একটা পরীক্ষামূলক অস্ত্রপাচার করেছি।আমি ওর মধ্যে কিছু মানবিক সত্ত্বা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।ওর কিছু কাজে আমার মনে হয় আমি কিছুটা সফল হয়েছি।সেদিন দেখি ও আমার টেবিলের উপর রাখা একটা গোলাপের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।এই বিষয় গুলোই লিখতে বসেছিলাম এখন।কিন্তু কিৎ এর ডাকাডাকিতে লেখায় আর মনো্যোগ দিতে পারলাম না।কিৎ কিছু যুক্তি দেখাল আমাকে।যুক্তি অথবা ক্ষুধা কোন একটির কাছে হেরে গিয়েই আমি খাওয়ার জন্য উঠলাম।
খাবার আহামরি কিছু না--সবুজাভ হলুদ রঙের পানীয় আর খয়েরী রঙের কিছু শুকনো রুটি।খুবই অল্প খাবার।তবুও খেয়ে তৃপ্তি পেলাম।শরীরে শক্তিও এসেছে।কিৎ কে বলে দিলাম রাতে আর খাব না।আমাকে যেন রাতের মধ্যে আর বিরক্ত না করা হয়।তারপর আমি নতুন উদ্দ্যমে কাজ করার জন্য আমার ঘরে চলে এলাম।
২''
রাত তখন কটা বাজে ঠিক বলতে পারবনা।তবে খুব বেশি রাত না।আমি আমার গবেষনায় পূর্নরুপে মনো্যোগ দিয়েছি।এমন সময় কিৎ এসে দরজায় কড়া নাড়ল।
-কি হল কিৎ?
-স্যার রোসা,আমাদের বাড়ির দরজায় বসে একটি শিশু কাঁদছে।
-তো?
-তাকে কি করব?তাকে কি ভেতরে নিয়ে আসব?
শিশুদের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু কিৎ-এর উদ্বিগ্ন যান্ত্রিক গলায় হয়তো কিছু ছিল যা শুনে আমি টেবিল ছেড়ে উঠে দরজা খুললাম। কিৎ-এর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে গেছে। সে আমার হাত ধরে নিয়ে দরজা খুলে আমাকে বাচ্চাটির সামনে দাঁড় করালো। শিশুটি সত্যিই এতোক্ষন কাঁদছিল। কিন্তু আমাদের দেখে কান্না থামিয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। সেই চোখ আমার উপর কোনো প্রভাব ফেলল না। কিন্তু তারপরও কিৎ-কে বললাম ওকে ঘরে নিয়ে আসতে। কিৎ শিশুটিকে ঘরে এনে একটি চেয়ারে রেখে ভিতরে চলে গেল। আমি বসে রইলাম ওর সামনে। কয়েক মিনিট পর কিৎ ফিরে এলো কিছু খাবার নিয়ে। এই ব্যাপারটি আমাকে অবাক করল। কারন অন্যান্য সময় কিৎ আমার আদেশের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু আজ সে এসবের কোনো তোয়াক্কাই করল না। আমি নিরাপত্তাকর্মীদের খবরটা দেয়ার কথা বলে আমার ঘরে চলে এলাম।
৩"
আমার পূর্ন বিশ্বাস ছিল কিৎ নিরাপত্তা কর্মীদের কাছে বাচ্চাটির কথা বলবে। কিন্তু কিৎ মনে হয় তা করে নি। আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা খুবই সচেতন। তাদের এ ব্যাপারে জানালে তারা অবশ্যই সব খোঁজ দিতে পারতো। প্রতিটি প্রাণীর যাবতীয় তথ্যই তো মূল তথ্যকেন্দ্রে জমা থাকে। সেখান থেকে অবশ্যই শিশুটির সম্পর্কে সব জানা যেত। কিন্তু কিৎ তা করে নি। কিৎ নিজেই শিশুটির ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ছে। বাচ্চাটিও মনে হয় কিৎ-এর তত্বাবধানে বেশ ভালোই আছে।
বাচ্চাটির উপর আমারও কিছুটা মায়া পড়ে গেছে। কিৎ যখন বাইরে থাকে অথবা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে সে তখন আমার ঘরে চলে আসে। অন্য কোনো বাচ্চার ক্ষেত্রে আমি কড়া করে ধমকে দিতাম। কিন্তু ওকে তা আমি করতে পারি না। বরং ও কখন আমার ঘরে আসবে আমি সেই অপেক্ষায় থাকি।
সেদিন শুনলাম বাচ্চাটির নাম তুয়িফ। এ বাচ্চাটির নাম কি সত্যিই তুয়িফ নাকি কিৎ এই নাম দিয়েছে তা আমি জানি না। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কিৎ-এর কাছে তা জানতে চাইনি।
৪''
প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেছে তুয়িফ আমাদের সাথে আছে।তুয়িফ এখন আমার খুব কাছের একজন।কিৎ-এর সাথে এখন আমার কথা হয় খুবই কম।কারণ আমি আমার গবেষনা নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।আর যতক্ষন অবসর পাচ্ছি ততক্ষন থাকছি তুয়িফ কে নিয়ে।মনে হয় আমার সাথে তুয়িফের এত মিশে যাওয়া দেখে কিৎ-এর খুব ভাল লাগছে না।সে তুয়িফকে আমার কাছে তেমন আসতে দেয় না।খাওয়ার সময় যেন তুয়িফের সাথে আমার দেখা না হয় সে জন্যে সে তুয়িফকে আগেই খাইয়ে দিচ্ছে।এই ব্যাপারটি আমার ভালও লাগছে আবার খারাপও লাগছে।ভাল লাগছে এই জন্য যে কিৎ-এর মধ্যে আরেকটি মানবিক সত্ত্বার উদ্ভব হচ্ছে।সেটা হল হিংসা।আর খারাপ লাগছে এই জন্য যে,তুয়িফ কে নিয়ে তো হিংসা করার কিছু নেই।আমি তো আর সারা জীবনই একটা রোবটকে নিয়ে থাকব না !
"গবেষনা এবং একটি শিশুর মৃত্যু" (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১১ সকাল ১১:৪৬