somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

A Postmartem Report of "বাঙ্গালির চারিত্রিক গুনাবলি(!)

০৭ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১১:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাঙ্গালী না বাংলাদেশী” ... এই প্রশ্ন সচারচর শোনা যায়। আমার কাছে বাঙ্গালী মানে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের সকল বাংলা ভাষাভাষী, আর বাংলাদেশী মানে বাংলাদেশের নাগরিক রা যারা এই দেশের সীমানায় জন্মগ্রহণ এবং বসবাস করছে।যদিও আমার আলোচনা সমগ্র বাঙ্গালী জাতিকে নিয়ে তবু তার প্রধান অংশ জুড়ে থাকবে পূর্ব বঙ্গ তথা আজকের গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত বাঙ্গালী ও তার সমস্যা এবং আমরা আলোচনা শুরুও করব এখানকার বাঙ্গালীকে নিয়েই। কারণ আমার সমগ্র আলোচনার মূল প্রেক্ষিত আজকের বাংলাদেশ। আমরা বাংলাদেশের আজকের সঙ্কটের উৎস খুঁজে বের করতে পারলে যেমন খুঁজে পাব সমগ্র বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটের উৎস তেমন এখানে সঙ্কটের প্রতিকার পেলে পাব সমস্ত বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটেরও প্রতিকার। এখন বাংলাদেশের কথা দিয়েই আলোচনা শুরু করি। গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্রটি দাঁড়িয়ে আছে তার সঙ্কটের পরিমাপ বা গুরুত্বের কথা বোঝাতে গেলে যে ভাষা ব্যবহার করা যায় সেটা এই রকম হলে বোধহয় এখন আর বেশী বলা হবে না যে, এই রাষ্ট্র যেন নিজের ভারে নিজেই ভেঙ্গে পড়তে যাচ্ছে। তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, সামাজিক সঙ্কট আজ এমনই সর্বাত্মক, গভীর এবং প্রচণ্ড। আসলে রাষ্ট্রটা এখন পর্যন্ত টিকে আছে বিদেশের ঋণ ও সাহায্যের উপর। এই রাষ্ট্রে অনেক আগেই ব্যাপক বিপর্যয় ও ধ্বংস ঘটত যদি ঋণ এবং বিশেষত ভিক্ষার আকারে এত ব্যাপক আয়তনে বৈদেশিক অর্থ না আসত। অনুদান নামক ভিক্ষার পরিমাণ এখন এমনই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে এই ভিক্ষার উপরও রাষ্ট্রের নির্ভরতা এমনই বৃদ্ধি পেয়েছে যে বস্তুত রাষ্ট্রটিকে একটি ভিক্ষুক রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করাই এখন সঠিক।

সাধারণভাবে দুর্নীতি কিংবা নীতিহীনতার এক অবাধ রাজত্ব আজ সমাজ ও জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এমনইভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জাতীয় ও সামাজিক সঙ্কটকে সার্বিক ও প্রচণ্ড করে তুলেছে। কিন্তু এর জন্য দায়ী কারা? আপনি রাজনীতিবিদ, প্রশাসন, আইন বিচার বিভাগ ইত্যাদির দোষ দিতে পারেন। কিন্তু আসল দোষী আমরা নিজেরাই। আমারাই আমাদের দুর্দশার জন্য দায়ী। দায়ী আমাদের চিন্তা চেতনা, মূল্যবোধ, স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা, লোভ, আইন মেনে না চলার মনোভাব, ভণ্ডামি, সুবিধাবাদিতা ইত্যাদি। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন ইংরেজ প্রশাসক বাঙ্গালী সমাজ ও চরিত্র বৈশিষ্ট্যের উপর তাদের প্রতিবেদনে বাঙ্গালীর হীনমন্যতা, অতিলোভ, নিদারুণ অসততা, পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যাচার, স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, সুবিধা আদায়ের জন্য সবলের পায়ে পড়া স্বভাব এবং দুর্বলের উপর নিষ্ঠুরতার কথা বলেছেন। তাদের বিবরণ অনুযায়ী এগুলিই হল বাঙ্গালীর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অন্তত এই বঙ্গে বাঙ্গালীর এই সকল বৈশিষ্ট্য আজও তার চরিত্রের প্রধান দিক হয়েই রয়েছে । আমাদের চরিত্রের এসব বিশেষ দিক নিয়েই আলোচনা করব। তুলে ধরব বাঙ্গালীর বিভিন্ন চরিত্র, নৈতিকতার বিভিন্ন দিক, নিজের এবং অন্যান্যদের কিছু উক্তির মাধ্যমে।

প্রথমেই আসি বাঙ্গালির এক অনন্যসাধারণ চরিত্র বা গুণ (?!) “পরশ্রীকাতরতা “ নিয়ে। এক ইউনিক গুন ( !!) যা উপমহাদেশ এবং বিশেষ করে বাঙ্গালীর মধ্যে বিদ্যমান। পৃথিবীর আর কোন জাতীর মধ্যে এটা তেমন একটা দেখা যায়না। বঙ্গবন্ধু এজন্যই বলেছিলেন “পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায় এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে পরশ্রীকাতর বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুসি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।“ বাঙ্গালীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, বিভাজনের বীজ খুবই সুকৌশলে বপন করে গেছে ব্রিটিশ শাসকরাই। আর তাতে তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল “ পরশ্রীকাতরতা” এই পরশ্রীকাতরতা গুনটি ব্যবহার করেই ইংরেজরা মীর জাফর কে নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে প্ররোচিত করেছিল। বিদ্যাসাগর তার সতীদাহ প্রথা বিলুপ্তির আন্দোলনে অন্যতম বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাঙ্গালীর এই গুনটি। তিনি বলেছেন যাদিও এই আন্দোলন নারীদের সুফলের জন্য তবুও সতীদাহ প্রথা বিলুপ্তির বিপক্ষে যেসব মহিলারা সরব ছিল তাদের বেশীরভাগই ছিল এমন যাদের মেয়ে বা আত্মীয়দের মধ্যে কোন মেয়ের এই প্রথায় জীবননাশ হয়েছিল। অর্থাৎ সেই পরশ্রীকাতরতা, অপরের ভাল সহ্য করতে না পারা। তিনি একটা কথা বলে গেছেন বাঙ্গালী নারীর প্রধান শত্রু আরেক বাঙ্গালী নারী, আর এর পেছনে একটাই কারণ পরশ্রীকাতরতা। “ নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ “ প্রবাদগুলো শুধু বাংলা ভাষাতেই পাওয়া যায়। এই গুনটি ব্যবহার করেই তারা ভারত পাকিস্থান নামক ২ টা দেশে বিভক্ত করে গিয়েছিল। তারা জানতো এই গুনটির কারনে এরা একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে মেতে থাকবে এবং তারা এটাই চেয়েছিল। তারা চায়নি অবিভক্ত উপমহাদেশ কারণ তারা জানত যদি সবাই একসাথে থাকে তাহলে এই উপমহাদেশই হবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র, নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্র যেমনটা আজ আমেরিকা।

ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন ইংরেজ প্রশাসক বাঙ্গালী সমাজ ও চরিত্র বৈশিষ্ট্যের উপর তাদের প্রতিবেদনে বাঙ্গালীর হীনমন্যতা, অতিলোভ, নিদারুণ অসততা, পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যাচার, স্বার্থêপরতা, নিষ্ঠুরতা, সুবিধা আদায়ের জন্য সবলের পায়ে পড়া স্বভাব এবং দুর্বলের উপর নিষ্ঠুরতার কথা বলেছেন। তাদের বিবরণ অনুযায়ী এগুলিই হল বাঙ্গালীর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অন্তত এই বঙ্গে বাঙ্গালীর এই সকল বৈশিষ্ট্য আজও তার চরিত্রের প্রধান দিক হয়েই রয়েছে ।

কিন্তু এই বাঙ্গালীর নিষ্ঠুরতাও সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী এবং সুদৃঢ় নয়। কারণ দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনও অস্বাভাবিক প্রবণতাকে রক্ষা করতে যে প্রবল মানসিক শক্তি ও শ্রম দরকার সেটাই তার ছিল না বা নেই। তাই বাঙ্গালী প্রতিহিংসা বা ঘৃণাও খুব বেশীদিন পুষে রাখতে পারে না। আসলেই তো সব সহজ পথে চাওয়া এবং পাওয়াই হচ্ছে এই সহজিয়া বাঙ্গালীর চিরদিনের স্বপ্ন।

এই বাঙ্গালীর আনুগত্য বা সমর্থনও তাই অনিশ্চিত ও পরিবর্তনশীল। সে কখন তার আনুগত্য সরাবে এটা অনেক সময়ই আগে থেকে বোঝা যায় না। যতদিন শক্তির ভারসাম্য পক্ষে থেকেছে সাধারণত ততদিনই বাঙ্গালীর আনুগত্য থেকেছে আর যখন শক্তির ভারসাম্য বিপক্ষে চলে গেছে তখন দ্রুত তার সমর্থন ও আনুগত্যও চলে গেছে। ব্যক্তি, নীতি কিংবা আদর্শ যেটাই তার কাছে ক্ষমতাহীন মনে হয় বা মনে হয় না আশু লাভজনক তার পক্ষে এই বাঙ্গালী থাকে নি।

চেষ্টা অর্থাৎ শ্রম দ্বারা কোনও কিছু অর্জন করার মত মন তার তেমনভাবে নেই। তার সাধারণ প্রবণতা হল আত্মসাতের, চুরির। সে চুরি করতেই বেশী পছন্দ করে। ফাঁকি দিয়ে পাওয়াতেই তার আনন্দ। এতে সে লজ্জার কিছু দেখে না। শুধু ধরা না পড়লে বা বিপদে না পড়লে হল। তার মেলা লোককথায় চুরি, ঠকামি ও প্রবঞ্চনাকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে। নীতিহীন ও নির্বিবেক অনেক সফল নিষ্ঠুরতা ও শঠতাকে বাঙ্গালী তার লোককথায় জনপ্রিয় করেছে। শুধু শিয়াল পণ্ডিতের কাহিনী নয় আরও অনেক কাহিনীতে এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাবে। বাঙ্গালীর একটি প্রিয় প্রবাদবাক্য হল এইটি, “চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা। এই সহজিয়া বাঙ্গালী ফাঁকিবাজ কিংবা চোর এবং ঠক। সে প্রকাশ্য দস্যু বা প্রকাশ্য লুণ্ঠনকারী কম হয়েছে তার সে সাহস নেই বলে।

এই বাঙ্গালীর চরিত্রে দৃঢ়তা নেই, অথচ লোভ আছে; ত্যাগ নেই, আছে ভোগবাদ। সুতরাং তার ভীরু স্বার্থপরতা ও নিষ্ঠুরতা তার চরিত্রে যে বৈশিষ্ট্য দিয়েছে তার সঙ্গে অন্তত কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট মিল আছে বিষধর সাপের। এই বাঙ্গালী সিংহ কিংবা বাঘের মত সাহসী নয়। বরং সাপের মত ভীরু কিন্তু হিংস্রতায় পরিপূর্ণ। তাই সে সাপের মত হঠাৎ করে ছোবল দেয়। কিন্তু এটা সব সময় পরিকল্পিত নয়। অনেক সময়ই সে এটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে করে। তারপর এই বাঙ্গালী পালায় সাপের মত। সর্প চরিত্রের সঙ্গে এই ধরনের বাঙ্গালী চরিত্রের এত মিল বলেই হয়ত এই সেদিন পর্যন্ত সর্পদেবতা মনসা ছিল শুধু নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুর নয়,উপরন্তু সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালীরও মান্য ও প্রিয় দেবতা। সাপের প্রতি যেমন তার ভীতি তেমন ভক্তি ও আকর্ষণও । আজও সাপের কাহিনী যুক্ত সিনেমা বা চলচ্চিত্র এই বাঙ্গালীর খুব প্রিয়।

বাঙ্গালীর চরিত্রের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ঠ ধরতে পেরে ইংরেজরা আবিস্কার করেছিল বাঙ্গালীদের অধিনস্ত করে রাখার এক অভিনব পদ্ধতি। ২০০ বছর শাসন করে গেছে তারা এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে। আর এখন বহির্বিশ্বের শক্তিরা এবং আমাদের রাজনীতিবিদরা একই পদ্ধতি প্রয়োগ করে আমাদের শাসন করে যাচ্ছে, নিজের স্বার্থ আদায় করে যাচ্ছে। আগে অন্য দেশের লোকদের হাতে শোষিত হত বাংলাদেশ আর এখন নিজ দেশের লোকদের দ্বারা শোষিত হয়। পদ্ধতি একটাই। শুধুমাত্র ভিন্ন তার প্রয়োগ...... স্থান,কাল,পাত্র ভেদে। এক অভিনব পদ্ধতি, “ Devide and Rule” । বিভাজন সৃষ্টি কর, একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখ আর মজা নাও সাথে শাসন কর। এরা কিছুই বুঝতে পারবে না। এরা যে গাধা, এরা পরশ্রীকাতর, এরা অতি আবেগি। নাহলে পৃথিবীতে আর কোন জাতী আছে যারা নিজেরা একে অপরের সাথে ঝগড়া করে, বিরুদ্ধে থেকে অন্যের দাসত্ব মেনে নেয়?

এ দেশে সৎ কে? বামপন্থী রাজনীতিকরা বলবে জনগণ হচ্ছে সৎ আর ধনীরা অসৎ। এটা ঠিক যে, সততার সঙ্গে শ্রমের সম্পর্ক আছে। শ্রম দ্বারা উপার্জনই সততা আর শ্রম ছাড়া এবং ফাঁকির মাধ্যমে উপার্জন অসততা। শ্রমজীবী জনগণ তো শ্রমী। সুতরাং তারা সৎ।কিন্তু তাদের এই শ্রমে থাকে না আনন্দ এবং এটা তারা করে নেহায়েৎ বাধ্য হয়ে। কিভাবে ফাঁকি দেয়া যায় সেই চেষ্টায় থাকে তারা। তাই এই শ্রমজীবীরাও চরিত্রের বিচারে সৎ থাকেনা। তখন সৎ ব্যাপারটা সুযোগের অভাবের ব্যাপার হয় মাত্র। এমন অবস্থায় একজন সাধারণ শ্রমিক কিংবা কৃষক সুযোগ পেলে খুব বেশী হলে তা-ই হতে পারে যা হয়েছে আজ এ দেশের ক্ষমতাধর আমলা কিংবা ধনিক। যে ভণ্ডামি, ফাঁকি ও প্রতারণা এ দেশের সাধারণ মানুষের অন্তরে সাধারণভাবে লালিত হয় তারই কি প্রতিফলন ঘটে না এ দেশের সফল নেতাদের মধ্যে? এ দেশের সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালীর চরিত্রের প্রকাশ ঘটে না কি তাদের এক সময়ের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবে? জিয়া কিংবা এরশাদ কি সেই দুর্নীতিপরায়ণ ও নীতিহীন ক্ষমতা কিংবা অর্থলিপ্সু মানুষের প্রতিনিধি নয়?

সাধারণত এদেশের মানুষ আকৃষ্ট হয় সহজ প্রাপ্তির দিকে। অর্থাৎ কষ্ট করে কোনও কিছু পেতে চায় না। পেতে চায় সহজে, অনায়াসে কিংবা অল্পায়াসে। এই প্রবণতা থেকে তারা এমন পথ অনুসরণ করে যে পথ তৈরী করতে হয় না, বরং তৈরী পাওয়া যায়। সুতরাং প্রবণতাটা হয়ে ওঠে তৈরী জিনিস সহজে পাবার বা আত্মসাতের। সৃষ্টির নয়। কারণ সৃষ্টিতে আছে কষ্ট, শ্রম। কোনও কিছু সৃষ্টি বা গঠনের জন্য কষ্ট করতে বা শ্রম করতে না চাইবার ফলে এরা শুধু পরের দিকে অর্থাৎ বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাঙ্গালী শুধু যে দৈহিক শ্রমকেই ভয় করে তাও না, ভয় করে মানসিক শ্রমকেও। অর্থাৎ এ দেশের সাধারণ জনমানসে দৈহিক শ্রম ও মানসিক শ্রম উভয়ের প্রতিই থাকে একটা অনীহা ও অপছন্দ। শুধু তাই নয় তাদের মাঝে কেউ এই মানসিক শ্রমে লিপ্ত হলে তাকেও নিরুৎসাহিত করে এরা বা তাকে ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করতে থাকে। তারা ধরা বাঁধা চিন্তা চেতনার বাহিরে যেতে চায় না। বিভিন্ন দিক থেকে চিন্তার শ্রম তাদের কাছে অপ্রিয়। তাদের মধ্যে প্রখ্যাত বা বিখ্যাত কোন চিন্তাবিদ বা বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য তারা অন্ধের মত ফলো করে। নিজের ইচ্ছেতেই করে। কারন গভীর ভাবে ভাবার কষ্ট করবে কে। “Intellectual” শব্দটিকে অন্যান্য দেশে যেখানে সম্মান, প্রশংসা বুঝাতে ব্যবহৃত হয় তার বাংলা প্রতিশব্দ “আঁতেল” এখানে ব্যবহৃত হয় ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে। এইজন্য বৃহৎ আবিষ্কার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র সাধনা কিংবা চিন্তার ক্ষেত্রে গভীর সাধনা এই জনগোষ্ঠীর ভিতর তেমন একটা দেখা যায় না। বেঁচে থাকতে হলে কিছু দৈহিক শ্রম করতেই হয়। অন্তত শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষকে। সেটুকু বাধ্য হয়েই করে। কিন্তু উন্নত জীবন গঠনের জন্য যে মানসিক শ্রম করতে হয় সেটুকুর প্রতি অনীহা তীব্র। গভীর ও জটিল চিন্তার জন্য যে মানসিক শ্রম দিতে হয়, ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে লেগে থাকতে হয় তার প্রতি এই মানুষের কোনও আকর্ষণ নেই, বরং আছে বিকর্ষণ ও অনীহা।

বাঙ্গালী চরিত্রে তার প্রকৃতির বন্যা বা জোয়ার-ভাটার প্রভাব দেখা যায় খুব বেশী রকম। বন্যা যখন আসে তখন চারদিক ডুবিয়ে, ভাসিয়ে আসে। বাঙ্গালী যখন কোনও কিছুতে মাতে তখন তার অবস্থাও হয় এই রকম চারদিক প্লাবিত করা বন্যা বা জোয়ারের মত। কিন্তু বন্যার জোয়ার তো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একসময় জল নেমে যায়। বাঙ্গালীর চিত্তেও স্বল্পস্থায়ী আবেগের জোয়ারের পর যখন ভাটার টান ধরে তখন তাও হয় সমান অপ্রতিরোধ্য। এই জোয়ার-ভাটার প্রভাব বাঙ্গালীকে করেছে যেমন পরিবর্তনশীল তেমন অস্থির। সে যে-ই হোক বিজয়ী হলে তার মত এত সমাদর আর কোনও দেশে জোটে কি না সন্দেহ। তবে বেশীদিন সে কারও উপর তুষ্ট থাকে না। কারণ তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে উপর বা বাহির থেকে কেউ আসে না। আর বাস্তবিক তাকে তুষ্ট করে বেশী দিন চলাও কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সে সব শাসনই নীরবে মানতে পছন্দ করে যদি শাসকের সেই রকম ক্ষমতা থাকে। তা না থাকলে তার সবচেয়ে পছন্দ বিশৃঙ্খলা বা তার ক্ষুদ্র জীবনের স্বাধীনতা।এই বাঙ্গালীর কি বীরত্ব আছে? তার হিংস্রতা এবং সহিংসতা আছে, কিন্তু বীরত্ব নয়। শুধু যে কষ্টকে সে ভয় পায় তা-ই নয় মরতেও তার নিদারুণ ভয়।

ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন ইংরেজ প্রশাসক বাঙ্গালী সমাজ ও চরিত্র বৈশিষ্ট্যের উপর তাদের প্রতিবেদনে বাঙ্গালীর হীনমন্যতা, অতিলোভ, নিদারুণ অসততা, পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যাচার, স্বার্থêপরতা, নিষ্ঠুরতা, সুবিধা আদায়ের জন্য সবলের পায়ে পড়া স্বভাব এবং দুর্বলের উপর নিষ্ঠুরতার কথা বলেছেন। তাদের বিবরণ অনুযায়ী এগুলিই হল বাঙ্গালীর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অন্তত এই বঙ্গে বাঙ্গালীর এই সকল বৈশিষ্ট্য আজও তার চরিত্রের প্রধান দিক হয়েই রয়েছে

বাংলাদেশের মানুষের একটা বড় সঙ্কট হল নীতির সঙ্কট। এটা আজকের নয়, বরং হাজার হাজার বছরের। অর্থাৎ সুদীর্ঘ কাল ধরে এখানে গোষ্ঠী ও বৃহত্তর সমাজ গঠনই ভালভাবে করা যায় নি। বিভিন্ন লেখক, প্রবন্ধকার তাদের লিখায় বাঙ্গালীর নৈতিকতার বিচিত্র এবং দ্বৈত রূপটি তুলে ধরেছেন বিভিন্ন ভাবে। যেমনঃ

##‘বাঙালী সমাজে উৎপীড়িত এবং নিন্দিত না হইয়া থাকিবার দুইটি মাত্র উপায় আছে; ১ম, অন্য সকল বাঙালীর মত হইয়া নিজের চরিত্র সম্বন্ধে অজ্ঞ হওয়া; ২য়, চরিত্রধর্মে বিভিন্ন হইলেও সাধারণ বাঙালী চরিত্র মনে রাখিয়া অতি সাবধানে চলা, অর্থাৎ সামাজিক আচরণে সম্পূর্ণভাবে কপট হওয়া, বনবিড়াল হইলেও ভিজে-বেড়াল হইয়া থাকা। বাঙালী চরিত্রে বহু অসাধারণ গুণ আছে, তেমনই অসাধারণ দোষও আছে। তবে কোনটাই দৃঢ়বদ্ধ নয়। একটি মাত্র মানসিক ধর্ম স্থায়ী উহা অস্থিরচিত্ততা।’

দুর্বলতা হইতেই বাঙালীর ভীরুতা আসিয়াছে। এই ভীরুতা কিন্তু যে- দোষ বাঙালীর উপর অন্য সকলে আরোপ করিয়াছে, অর্থাৎ কাপুরুষতা অধিকাংশ বাঙালীই দেখায়, উহা অস্বীকার করিব না। তবে উহা হইতে বাঙালী জাতির চরম অনিষ্ট হয় নাই, হইয়াছে অন্য ব্যাপারে ভীরুতা হইতে।’...(নীরদচন্দ্র চৌধুরী শতবার্ষিকী সংকলন ৬৮০)

### আমি বাঙালীর এই মনোবৃত্তি সম্বন্ধে পরিহাস করিয়া বলি--বাঙালী যদি দেখে যে তাহার বাগানে বাঘ আসিয়াছে, তখন সে বলে, ওটা বেড়াল মাত্র। উটপাখি সম্বন্ধে কিংবদন্তী আছে যে ভয়ের কারণ দেখিলে সে বালিতে মুখ লুকায়। বাঙালী চক্ষু বিস্ফারিত রাখিয়াই উহা অগ্রাহ্য করে।’ (নীরদচন্দ্র চৌধুরী শতবার্ষিকী সংকলন পৃষ্ঠা ৬৯১)

### ‘বাঙালী ভোগলিপ্সু কিন্তু কর্মকুণ্ঠ। বৈরাগ্য-প্রবণ জৈন-বৌদ্ধ-বৈষ্ণব মতবাদ বাঙালী চিত্তে কর্মকুণ্ঠা আরো প্রবল করেছে। এমন মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি বা চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করে। বাঙালীচরিত্রে যে একদিকে মিথ্যাভাষণ, প্রবঞ্চনা, চৌর্য, ছদ্মবৈরাগ্যভাব, চাতুর্য, সুবিধাবাদ এবং সুযোগসন্ধান, তোয়াজ ও তদ্বির-প্রবণতা প্রভৃতির প্রাবল্য এবং আত্মসমমানবোধের অভাব, অন্যদিকে জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে যে দেবানুগ্রহজীবিতা রয়েছে, তা ঐ কর্মকুণ্ঠারই প্রসূন।’ (বাঙলা ও বাঙালী, আহমদ শরীফ, পৃষ্ঠা ২১)

## বাঙ্গালীর মধ্যে আছে একটা শ্রমবমুখিতা, পলায়নী মনোবৃত্তি, আছে ভাগ্যবাদ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব, দায়িত্বশীলতার অভাব। শ্রমবিমুখতা কিন্তু ভোগবাদ থেকে অনেক ক্ষেত্রে এসেছে অবিশ্বাস্য রকম নীতিহীনতা, অসততা, ধূর্ততা ও ঠকামি। সে এখন শ্রম করছে বটে, কিন্তু সেটা অবস্থার চাপে পড়ে। জনসংখ্যার চাপে এবং সামাজিক কারণেও। কিন্তু তার হাজার বৎসরের অন্তর্গত প্রেরণা বিনা শ্রমে বা অল্প শ্রমে ভোগপরায়ণ।

###‘বাঙালি গুছিয়ে কথা বলে না; এক কথা বারবার বলে; কথায় কথায় অতিশয়োক্তি প্রয়োগ করে। সাধারণ মানুষের বাক্যের ভাণ্ডার বেশ সীমাবদ্ধ; কিন্তু তারা ওই সীমাবদ্ধ ভাণ্ডারকে বারবার ব্যবহার ক’রে প্রায় অসীম ক’রে তোলে। বাঙালি মনে করে এক কথা বারবার বললে তা গ্রহযোগ্য হয়, তাতে ফল ফলে। এটা হয়তো মিথ্যে নয়, কিন্তু এতে কথার তাৎপর্য কমে, মূল্য বাড়ে পৌনঃপৌনিকতার। সাধারণ মানুষকে যদি ছেড়ে দিই, ধরি যদি মঞ্চের মানুষদের, বিচিত্র কথা বলা যাদের পেশা, তারাও একই কথা বারবার বলে। বাঙালি নতুনত্ব চায় না, বিশ্বাস করে পুনরাবৃত্তিতে। পুনরাবৃত্তিতে বাঙালির প্রতিভা কি তুলনাহীন? বাঙালির স্বভাবে রয়েছে অতিশয়োক্তি, সে কোনো আবেগ ও সত্য প্রকাশ করতে পারে না অতিশয়োক্তি ছাড়া। অতিশয়োক্তি ভাষাকে জীর্ণ করে, নিরর্থক করে, যার পরিচয় পাওয়া যায় বাঙালির ভাষিক আচরণে ও লিপিবদ্ধ ভাষায়। ‘দারুণ পছন্দ করি’, ‘ভীষণ ভালোবাসি’, ’শ্রেষ্ঠতম কবির’ মতো অতিশয়োক্তিতে বাঙালির ভাষা পূর্ণ। অতিশয়োক্তি লঘুতার লক্ষণ; এতে প্রকাশ পায় পরিমাপবোধের অভাব। বাঙালি লঘু, পরিমাপবোধহীন। বাঙালি সাধারণত কারো আন্তর গুরুত্ব নিজে উপলব্ধি করতে পারে না; অন্য কারো কাছ থেকে তার জানতে হয় এটা; এবং একবার অন্যের কাছে থেকে জেনে গেলে, বিচার না ক’রে, সে তাতে বিশ্বাস করে। বাঙালি ভাষাকে এক ধরনের অস্ত্ররূপেও ব্যবহার করে। কলহে বাঙালির প্রধান অস্ত্র ‘ভাষা-আগ্নেয়াস্ত্রে’র মতো বাঙালি ভাষা প্রয়োগ ক’রে থাকে।’

### ‘বাঙালি স্বভাবত ভদ্র নয়। সুবিধা আদায়ের সময় বাঙালি অনুনয়-বিনয়ের শেষ সীমায় যেতে পারে, কিন্তু সাধারণত অন্যদের সাথে ভদ্র আচরণ করে না। বাঙালি প্রতিটি অচেনা মানুষকে মনে করে নিজের থেকে ছোটো, আগন্তুক মাত্রকেই মনে করে ভিখিরি। কেউ এলে বাঙালি প্রশ্ন করে, ‘কী চাই?’ অপেক্ষা করার জন্যে বলে, ‘দাঁড়ান’। কোনো কর্মস্থলে গেলে বাঙালির অভদ্রতার পরিচয় চমৎকারভাবে পাওয়া যায়। যিনি কোনো আসনে ব’সে আছেন কোনো কর্মস্থলে, তাঁর কাছে কোনো অচেনা মানুষ গেলে তিনি সুব্যবহার পাবেন না, এটা বাঙালি সমাজে নিশ্চয়ই। অসীম কর্মকর্তা, তিনি যতো নিম্নস্তরেই থাকুন-না-কোনো, তিনি আগন্তকের দিকে মুখ তুলেও তাকাবেন না; তাকালে মুখটি দেখে নিয়েই নানা অকাজে মন দেবেন। তিনি হয়তো পান খাবেন, অপ্রয়োজনে টেলিফোন করবেন, পাশের টেবিলে কাউকে ডেকে বাজে কথা বলবেন, আগন্তুকের দিকে মনোযোগ দেবেন না। সামনে কোনো আসন থাকলেও আগন্তুককে বসতে বলবেন না। বাঙালি অন্যকে অপমান ক’রে নিজেকে সম্মানিত করে।’

### ‘বাঙালি কি সুন্দর, বাঙালি কি নিজেকে মনে করে রূপমণ্ডিত? বাঙালির অহমিকা আছে, তাই নিজেকে রূপের আধার মনে করে নিশ্চয়ই কিন্তু বাঙালির চোখে সৌন্দর্যের দেবতা অন্যরা। একটু ফরশা হ’লে বাঙালি তাকে বলে ‘সাহেবের মতো সুন্দর’; একটু বড়োসড়ো হ’লে বাঙালি তার তুলনা করে, বা কিছুদিন আগেও তুলনা করতো, পাঠানের সাথে। বাঙালি সাধারণত খর্বকায়, তবে সবাই খর্ব নয়; বাঙালির রঙ ময়লা, তবে সবাই ময়লা নয়, কেউ কেউ ফরশা।’ (হুমায়ুন আজাদ নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃষ্ঠা ২৫৭)

###‘বাঙালি ধর্মের কথা বলে অন্যদিকে ধর্মবিরোধী কাজ করে, প্রগতির কথা আওড়ায় আবার প্রগতিবিরোধী কাজ করে; মহত্ত্ব দেখাবার চেষ্টা করে আসল সময় পরিচয় পাওয়া যায় ক্ষুদ্রতার। বাঙালির বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যেও প্রচুর গরমিল, মুখে যা বলে, যা সে প্রকাশ করে, কখনো তা আচার-আচরণের সাথে মেলে না; বাঙালি শক্তিমানকে পিছনে নিন্দা করলেও মুখোমুখি হলে তাকেই তোষামোদ করে। বাঙালি শক্তিমানদের ত্রুটি সাধারণত দেখে না, তাদের অন্যায়কে অন্যায় মনে করে না। দুর্বলের অন্যায়কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। বাঙালি খুব পরনিন্দা প্রিয়, পরনিন্দায় বাঙালি আত্মতৃপ্তি পায়। আবার শক্তিমানকে পূজা দেয়, সমমান করে, ভক্তি-শ্রদ্ধা করে।’

‘বাঙালি খুবই স্বৈরাচারী; দেখতে এতোটুকু, কিন্তু সবাই ছোটোখাটো চেঙ্গিশ খাঁ। প্রতিটি পরিবারকে যদি একটি ছোটো রাষ্ট্র হিশেবে দেখি, তাহলে ওই রাষ্ট্রের একনায়ক পিতাটি। পল্লীসমাজে পিতার একনায়কত্ব খুবই প্রবল ও প্রচণ্ড; শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে কিছুটা কম। পিতার শাসন স্বৈরাচারে পরিবারটি সন্ত্রস্ত থাকে সারাক্ষণ; মা-টি হয় সবচেয়ে পীড়িত ও পর্যুদস্ত, সন্তানেরাও তাই। পিতার স্বৈরাচারের পরিচয় পরিবারের সদস্যদের সম্বোধন রীতিতে ধরা পড়ে। আগে, সম্ভবত এখনো, সন্তানেরা পিতাকে সম্বোধন করতো বা করে ‘আপনি’ ব’লে, কিন্তু মাকে সম্বোধন করতো বা করে ‘তুমি’ বলে।’ (হুমায়ুন আজাদ নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃষ্ঠা ২৫৯)

## ‘বাঙালির প্রিয় দর্শন হচ্ছে বেশি বড় হোয়ো না ঝড়ে ভেঙে পড়বে, বেশি ছোটো হোয়ো না ছাগলে খেয়ে ফেলবে; তাই বাঙালি হ’তে চায় ছাগলের সীমার থেকে একটু উচ্চ,-- নিম্নমাঝারি। বাঙালির এ-প্রবচনটিতে তার জীবনাদর্শ বিশুদ্ধরূপে ধরে পড়ে। এতে নিষেধ করা হয়েছে অতি-বড়ো হওয়াকে, কেননা তাতে ঝড়ে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা, আর নিষেধ করা হয়েছে খুব ছোটো হওয়াকে, কেননা তাহলে সহজেই বিপন্ন হওয়ার সম্ভবনা। তাই মাঝারি হ’তে চায় বাঙালি; বাঙালি মাঝারি হওয়ার সাধক। মাঝারি হ’তে চাইলে হওয়া সম্ভব নিম্নমাঝারি; এবং বাঙালির সব কিছুতেই পরিচয় পাওয়া যায় নিম্নমাঝারিত্বের।

##বাঙালি উদ্ভাবক নয়, তাত্ত্বিকও নয়। সম্ভবত কোনো কিছুই উদ্ভাবন করে নি বাঙালি, এবং বিশ্বের আধুনিক উদ্ভবগুলোতে বাঙালির সমস্ত ঋণ করা। আধুনিক বাঙালির জীবনে যে-সমস্ত তত্ত্ব কাজ করে, তার একশোভাগই ঋণ করা। বাঙালি সাধারণ সূত্র রচনা করতে পারে না, আন্তর শৃঙ্খলা উদঘাটন করতে পারে না; পারে শুধু বর্ণনা করতে। ... বাঙালি গণতান্ত্রিক নয়, যদিও গণতন্ত্রের জন্যে প্রাণ দেয়। বাঙালি সুবিধাবাদী; সুবিধার জন্যে সব করতে পারে। বাঙালি পুজো করতে পছন্দ করে; প্রতিমা বা লাশ পূজোতেই বাঙালির সুখ। বাঙালি লাশের গলায় মালা দেয়, তবে জীবিতকে লাশে পরিণত করে।’ (হুমায়ুন আজাদ নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃষ্ঠা ২৬৩-২৬৪)

##বাঙ্গালীর সমস্যা হলো তারা প্রশংসা সহ্য করতে পারেনা, একটু প্রশংসা করলেই তারা লাফ দিয়ে মাথা ওঠে যায়|
--- হুমায়ূন আহমেদ

###বাঙ্গালীর বাহুতে যদি একটি ফোঁড়া থাকে তবে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়না। কারন, ফোঁড়া দেখিয়ে ভিক্ষাও পাওয়া যায়, আবার চুলকায়ে মজাও পাওয়া যায়।"
------বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় ।

##বাঙ্গালীর চরিত্রের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ঠ ধরতে পেরে ইংরেজরা আবিস্কার করেছিল বাঙ্গালীদের অধিনস্ত করে রাখার এক অভিনব পদ্ধতি। ২০০ বছর শাসন করে গেছে তারা এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে। আর এখন বহির্বিশ্বের শক্তিরা এবং আমাদের রাজনীতিবিদরা একই পদ্ধতি প্রয়োগ করে আমাদের শাসন করে যাচ্ছে, নিজের স্বার্থ আদায় করে যাচ্ছে। আগে অন্য দেশের লোকদের হাতে শোষিত হত বাংলাদেশ আর এখন নিজ দেশের লোকদের দ্বারা শোষিত হয়। পদ্ধতি একটাই। শুধুমাত্র ভিন্ন তার প্রয়োগ...... স্থান,কাল,পাত্র ভেদে। এক অভিনব পদ্ধতি, “ Devide and Rule” । বিভাজন সৃষ্টি কর, একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখ আর মজা নাও সাথে শাসন কর। এরা কিছুই বুঝতে পারবে না। এরা যে গাধা, এরা পরশ্রীকাতর, এরা অতি আবেগি। নাহলে পৃথিবীতে আর কোন জাতী আছে যারা নিজেরা একে অপরের সাথে ঝগড়া করে, বিরুদ্ধে থেকে অন্যের দাসত্ব মেনে নেয়?

###বাঙ্গালীরা আদিকাল থেকেই শোষিত হয়ে আসছে। বাঙ্গালীর অতীত ইতিহাস শোষণ আর দাসত্বের। কখনো পরদেশী আবার কখনো স্বদেশী লোকদের দ্বারা। তাই বাঙ্গালীর মন মানসিকতাও দাসদের মত। অসহায়ত্ব, নিরুপায়, মাথা নিচু করে মেনে নেয়া, প্রভুভক্তি, প্রভু ভীতি, দাসত্ব ইত্যাদি আমাদের রক্তের সাথে মিশে আছে। আমরা নৌকা বা ধানের শীষের বাহিরে কিছু ভাবতে শিখিনী এখনো। মুখে আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি, সরকার বলে সে জনগণের সেবক। কিন্তু সরকারকে আমরা বলি শাসক/রাজাধিরাজ।আমরা বুক ফুলিয়ে বলি জনগণই সকল ক্ষমতার অধিকারী কিন্তু কোন দাবীর কথা সরকারকে আমরা বলি ভয়ে ভয়ে, অনুনয় বিনয়ের সাথে আবেদন করি। নির্দেশ দেই না। মালিক তো কখনো সেবককে আবেদন অনুরধ করে না। তাহলে আমরা কেন করি। কারন আমাদের মন মানসিকতাই দাসত্বের শিকলে বন্ধী।

### উপদেশ প্রদান বাঙ্গালীর সার্বক্ষনিক পেশা।
বাঙ্গালী মোটা মানুষকে চিকন হবার উপদেশ দেয়,
আবার চিকন মানুষকে মোটা হবার উপদেশ দেয়!
খারাপ মানুষকে ভালো হবার উপদেশ দেয়,
আবার কখনো কখনো ভালো মানুষকে খারাপ হবার উপদেশ দেয়!!

### বাঙ্গালীর চরিত্রে উচ্ছ্বাস অতিমাত্রায় প্রবল। সে যখন কাঁদে, তখন দু-কূল ছাপিয়ে কাঁদে। তার বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় স্রোত ভেঙ্গে পড়ে। আর সে যখন হাসে, তখন দাঁত কেলিয়েই থাকে। বাঙ্গালীর আবেগ প্রচন্ড হওয়ায় তার ব্যাপ্তিটা ছোট। যত তাড়াতাড়ি সে ক্রোধে উন্মত্ত হতে পারে, তত দীর্ঘক্ষন ব্যাপী তার সে ক্রোধ সে ধারন করে রাখতে পারে না।

##অধিকাংশ মানুষের দুইটা হাত, ডান আর বাম হাত। বাঙ্গালীর অবশ্য একটা তৃতীয় হাত আছে, তার নাম অজুহাত।

শেষ কথা > মনোবিজ্ঞানীর চোখ দেয়া দরকার এদিকে, যেমন চোখ দেয়া দরকার সমাজবিজ্ঞানীর। বাঙালির রুগ্নতা আর লুকিয়ে রাখা চলে না, ক্ষতস্থলকে ময়লা কাপড়ে মুড়ে রাখলে ক্ষত শুকোয় না তাতে পচন ধরে। পচন ধরেছে এর মাঝেই। বাঙালির চিকিৎসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; একটি জনগোষ্ঠি কি রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হ’তে হ’তে লুপ্ত হয়ে যাবে?’ (হুমায়ুন আজাদ নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃষ্ঠা ২৫৬)
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×