somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লক ডাউনঃ ০২

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সকালে ঘুম ভাঙ্গলো বেলা করে । নিজেকে বিছানাতে আবিস্কার করলাম। গত রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলাম। যতটুকু মনে পড়ছে আমি গ্যাসের চুলা বন্ধ করে রুমে ফিরতেছিলাম তখন ফাতেমা খালা বলল, আমারে এতো জালাতন করেন ক্যান ! আমি পেছনে ফিরে দেখলাম ফাতেমা খালার কপালে একটা লাল টিপ আগুনের গোল্লার মতো জ্বলজ্বল করছে। আর কিছুই মনে নেই।

আমি দুই এ দুই এ চার মেলানোর চেষ্টা করলাম। যেহেতু আমি একা একা থাকি , পুরো বিল্ডিং এ কেউ নাই সেহেতু একটা অবচেতন ভয় আমার ভেতর এই কয়দিন কাজ করছিলো। কিন্তু আমি সেই ভয়কে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো থাকছিলাম। এর ভেতর শুনলাম ফাতেমা খালা মারা গেছে। মানুষটাকে আমি পছন্দ করতাম। শুনে খুব ই শকড হয়েছিলাম। সারাক্ষন মাথার ভেতর ছিলো ফাতেমা খালা। তারপর আসলো বৃষ্টি। বৃষ্টি আসলে কোনদিন ফাতেমা খালাকে বলতে হয় নি যে আজকে খিচুরি খাবো। উনি খিচুরি রান্না করে , আমাকে ফোন দিতো। বলতো, আপনার স্বশুর বাড়ির খাবার রেডি, কিচেনে গাওয়া ঘি আছে আর পিয়াজ , মরিচ কেটে দিয়ে গেছি, ডিম ভেজে খায়েন। এখন ডিম ভাজলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। খেয়ে মজা পাবেন না।
এইসব সারাদিন মাথার ভেতর ঘুরছিলো। অথচ আমি খিচুরি রান্না করি নাই সেদিন। মনের ভেতর খিচুরির জন্য হাহাকার ছিলো । অনেকবার ভেবেছি, আজকে খালা থাকলে রান্না করে দিতো। আর রাতে দেখছিলাম , ভুতের মুভী। সুতরাং ফাতেমা খালার অবির্ভাব সম্পুর্ণ কাল্পনিক। অবদমিত ভয় , ফাতেমা খালার মৃত্য, বৃষ্টি, একা থাকা, খিচুরি এইগুলার সমন্বয় ই হলো গত রাতে ফাতেমা খালাকে দেখা। এতো সহজে উপসংহারে পৌছাতে পেরে খুসিতে হেসে দিলাম। যাক বাবা বাচা গেলো। কে হায়! ভূতের হাতের রান্না খাইতে চাই !

সারা সকাল জুড়ে ভোনা খিচুরির গন্ধে ফ্ল্যাট ভরে থাকলো। মানুষের একটু বিবেকও নাই। এইদিকে একটা মানুষের খিচুরির দুঃখে, ভয় পেয়ে মরে যাচ্ছে , অন্যদিকে পাশের বিল্ডিং শুরু হয়েছে , "মাষ্টার শেফঃ বাংলাদেশ" প্রতিযোগিতা। সকালে যদি পায় খিচুরীর গন্ধ, দুপুরে পায় গরুর মাংসের, রাতে পায় বিরানীর। পু্রাই অত্যাচার। কিন্তু আমি এইবার এইটাকে অত্যাচার হিসাবে নিলাম না। ভাবলাম , ঘ্রানে অর্ধেক ভোজন। ডাক্তার বলেছেন, এই কোয়ারিন্টিনের দিনগুলিতে পজিটিভ থিংকিং করতে। কারন, পজিটিভ থিংকিং ইমিউনি সিস্টেমকে বুস্ট করে।

রাতের দিকে মাথার ভেতর ঝিমঝিম করা শুরু করলো। তারপর একটানা ঝিঝি পোকার ডাক। পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে ফোন দিলাম, বললো, প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে থেকো। ঘুমানোর আগে এক গ্লাস দুধ খেয়ে নিও। দুধ কই পাবো? দুধ না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকাল দেখি গা ভর্তি জ্বর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে । বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। কোন রকম শরীরটা টানতে টানতে রান্নাঘরে গেলাম। গিয়ে দেখি রান্নাঘর ঝা চকচক করছে। ফিল্টার থেকে পানি ঢালার সময় দেখলাম পাশের কড়াই থেকে ধোয়া বের হচ্ছে, টমেটো দিয়ে রুই মাছ ভোনা। আমি কোনরকম ঢকঢক করে পানি খেয়ে বিছানাই নিজেকে ছুড়ে দিলাম। কিছুই ভাবতে পারছি না। কে রান্না করলো ! ফ্ল্যাটের চাবি আমার কাছে ছাড়া আছে মুস্তাফিজ ভাই এর কাছে। উনি তো চাঁদপুর। ফাতেমা খালা মারা গেছে, আমি নতুন বুয়া এখনো নিই নাই। কে রান্না করলো ?? মাথার ভেতর সবকিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে গেলাম নাকি জ্ঞ্যান হারালাম , কিছুই বুঝলাম না। যখন উঠলাম , তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে । জানালার গ্রিল বেয়ে একফালি মরা আলো আমার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আবার সকালের মতো গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ঢোক গিলতে যেয়ে আমার সারা শরীর কেপে উঠলো।
আমি ঢোক গিলতে পারছি না। গলাই প্রচন্ড ব্যাথা । ফোনটা আতিপাতি করে খুজে আমি ইমার্জেন্সিতে ফোন দিলাম। কেউ ফোন ধরছে না। তিন বারের মাথায় একজন ফোন ধরলো। আমি বললাম , আমার প্রচন্ড জ্বর , গলাতে ব্যাথা । আমাকে নিয়ে যান। ওপাশের মানুষটা কিছুক্ষন চুপ থাকলো। তারপর বিরষ কন্ঠে বললো, কাশি আছে নাকি ! আমি বললাম না। বিদেশ থেকে এসেছেন? আমি বললাম, না । তাইলে , দুইবেলা নাপা খান। ঠিক হয়ে যাবে। বাসা থেকে বেরোয়েন না। খট করে টেলোফোন রেখে দিলো।

শরীরে এক বিন্দু শক্তি নাই। কয়েকবার উঠতে গিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। এদিকে মনে হচ্ছে পানি না খেলে আমি মারা যাবো। জলাতংক রোগীর যেমন পানি পিপাসা লাগে তেমন পানি পিপাসা লেগেছে । আমি হাটু আর দুই হাতের উপর ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কিচেনে গেলাম। দেখলাম, একটা ঝকঝকে কাচের গ্লাসে পানি রাখা , পানির ভেতর আদা। এতো ভাবার সময় আমার নাই। আমি ঢকঢক করে পানি খেয়ে ফেললাম। লবন, আদা দেয়া গরম পানি।
আমার বুক হাপরের মতো উঠানামা করছে। মাথার ভেতর পাক খাচ্ছে নানা চিন্তা। ড্রয়ারের ভেতর পচিশ হাজার টাকা আছে। ফাতেমা খালার টাকা। বাড়িতে রাখতে সাহস পাই না। আমার কাছে রাখে। এই টাকা উনার স্বামীকে বুঝিয়ে দিতে হবে। আমার টেবিলের পেছনে কাগজে মোড়ানো একটা পোট্রেট আছে, বাধাই করা। আমি গভীর রাতে গোপনে সেই ছবি দেখি। পৃথিবীর সব রুপ সেই ছয় ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্ছি পেইন্টিং-এ। এই পেইন্টিং আমাকে জোহরাকে দিতে হবে। জোহরার খুসিতে ঝলমলে চোখ বিদ্যুৎ চমকের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মা বলেছিলো, একটা বউ এর খুব শখ আমার, এনে দিবি ?! বলেছিলাম , করোনা যাক।
আমার হাজার কাজ বাকি অথচ আমি মরে যাচ্ছি। একা, নিঃসঙ্গ ।
আমি আতিপাতি করে ফোন খুজি। মাকে ফোন দিতে হবে। এমনভাবে আমি মরবো না। শুধু একবার বলবো, মাগো আমি মরে যাচ্ছি। মা দুনিয়ার সমস্ত বাধা কে তুচ্ছ করে ঢাকা চলে আসবে। আমি কোনভাবেই একা মরবো না। ফোন খুজে পাচ্ছি না। বালিসের পাশে, টেবিলে , ড্রয়ারে, তোষকের নিচে, কোথাও ফোন নেই।
আমার হু হু করে কান্না আসে। আমি জগৎ বিদীর্ন করে কাদি। চিৎকার করে বলি, আমার ফোন কই, ফোন কই।
নোনা পানিতে চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। হঠাৎ দরজার দিকে চোখ গেলো , দেখি একটা ছায়ামুর্তি। আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো, এই নেন আপনার ফোন , রান্নাঘরে ফেলে আসছিলেন । আপনি যে বেভুলা মানুষ!
আমি ফোন হাতে নিয়ে স্থবির হয় বসে থাকি। ফাতেমা খালা মুখ টিপে হাসে। পানের রসে তার ঠোট রক্ত লাল।।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ২:২৮
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্বাসীকে লজিকের কথা বলার দরকার কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:১৭




হনুমান দেবতা এবং বোরাকে কি লজিক আছে? ধর্ম প্রচারক বলেছেন, বিশ্বাসী বিশ্বাস করেছেন ঘটনা এ পর্যন্ত। তাহলে সবাই অবিশ্বাসী হচ্ছে না কেন? কারণ অবিশ্বাসী বিশ্বাস করার মত কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের শাহেদ জামাল- ৭১

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:৫৪



শাহেদ জামাল আমার বন্ধু।
খুব ভালো বন্ধু। কাছের বন্ধু। আমরা একসাথেই স্কুল আর কলেজে লেখাপড়া করেছি। ঢাকা শহরে শাহেদের মতো সহজ সরল ভালো ছেলে আর একটা খুজে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভাবছিলাম ২ লক্ষ ব্লগ হিট উপলক্ষে ব্লগে একটু ফান করব আড্ডা দিব, কিন্তু এক কুৎসিত অপব্লগার সেটা হতে দিলোনা।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:০৫



এটি ব্লগে আমার ২৬০ তম পোস্ট। এবং আজকে আমার ব্লগের মোট হিট ২০০০০০ পূর্ণ হয়েছে। আমি আনন্দিত।এই ছোট ছোট বিষয় গুলো সেলিব্রেট করা হয়তো ছেলে মানুষী। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শয়তান বন্দি থাকলে শয়তানি করে কে?

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:২০



রমজানে নাকি শয়তানকে বেধে রাখা হয়,তাহলে শয়তানি করে কে?

বহুদিন পর পর ব্লগে আসি এটা এখন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বেশ কিছু বয়স্ক, মুরুব্বি, সম বয়সি,অল্প বয়সি একটিভ কিছু ব্লগার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কট বাঙালি

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:২৪



কদিন পরপরই আমাদের দেশে বয়কটের ঢল নামে । অবশ্য তাতে খুব একটা কাজ হয় না । বাঙালির জোশ বেশি দিন থাকে না । কোন কিছু নিয়েই বাঙালি কখনই একমত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×