আজ রাতে একটি খুন করতে যাচ্ছি। খুন করাটা আমার জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। ১২ ইঞ্চি বাই ২ ইঞ্চি ছোরাটা বারবার পরখ করে দেখছি। রাতের আধারে চাঁদের আলোয় কেমন চিকচিক করছে। মনের ভেতর ভয়ংকর পশুটা বারবার আমাকে উত্তেজিত করে তুলছে। ধৈর্য্য ধরতে অসহ্য লাগছে। প্রচন্ড শীতেও বারবার ঘেমে যাচ্ছি। মাঝে মধ্যে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি। না! আমাকে তো এভাবে নার্ভাস হলে চলবে না, আমার যে রক্ত চাই! রক্তের নেশা আমাকে বুদ করে রেখেছে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একসাথে দুটি সিগারেট খুব সন্তর্পনে জ্বালালাম। আজ একটি নয় দুটি সিগারেট পান করবো। ধুমপান আমি তেমন একটা করি না, কিন্তু আজ ধুমপান না করলে যে, মাথা ঠিক থাকবে না। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে সিগারেট টানতে টানতে আশপাশে ধোয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে ফেললাম। এইতো এখন কাজে দিচ্ছে, মাথাটা এখন একটু হিংস্রতা ফিরে পাচ্ছে। খুশিতে চোখ দুটি চক চক করে উঠলো। ধীরে ধীরে রাতটা গভীর হচ্ছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে চারদিকে কেমন একটা ছমছম অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ভাল হয়েছে, আমার নড়াচড়ার আওয়াজ কেউ লক্ষ্য করতে পারবে না। লোকটা অনেক জ্বালিয়েছে। আজ তার জীবনের আর কয়েক মুহূর্ত বাকি আছে। তারপর শেষ, সব শেষ, একেবারে ফিনিস।
লোকটার নাম আনু মোহাম্মদ, গ্রামের বড় মসজিদটার ইমাম সাহেব। বড় বেশি নীতিবান। নীতি আছে তোমার থাকবে তাতে আমার কি, তুমি কেন আমার কাজে বাধার সৃষ্টি কর, আমার ধান্ধার পেছনে কেন লেগে থাক। এবার বুঝবা মৃত্যুর কত যন্ত্রণা, ধীরে ধীরে তুমি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে আসছো। একটা পৈশাচিক হাসি ভেতর থেকে বের হয়ে আসলো। আমি টাকা কামাই করি, যেভাবে পারি সেভাবে করি, হারাম হালাল, বৈধ-অবৈধ এসব দেখে আমি কি করব। আমার দরকার টাকা। টাকা ছাড়া এই পৃথিবীতে কোন কিছু করা যায় না, টাকা ছাড়া মানুষের কোন দাম নেই। টাকা ছাড়া পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কত যে কষ্টকর সেটা আমি ছাড়া আর কে বেশি বুঝে। মনে পড়ে কৃষক আব্দুল গফুরের ধানি জমিটার কথা। কত ছলে বলে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম এবং তাকে অস্ত্র দেখিয়ে ধমক দিয়েছিলাম, যদি জমি নিয়ে কোন রকম বাড়াবাড়ি বা কেস-মামলা করে তাহলে তাকে ভয়ংকর পরিণতি ভোগ করতে হবে। আমার হুমকি কাজে লেগেছিল। কৃষক আব্দুল গফুর ভয়ে কোন মামলা বা বিচার শালিশ করেনি, শুধু নীরবে কেঁদেছিল। আমিও একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলাম কোন রকম বাধা বা ঝামেলা ছাড়াই জমিটা দখল করতে পেরে। কিন্তু আমার জমি দখলের মাঝখানে বাধা হয়ে দাড়াল আমার দুশমন সেই মসজিদের ইমাম আনু মোহাম্মদ। সে কৃষক আব্দুল গফুরকে অনেক বুঝিয়ে বলেছে, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করতে, তোমার জমি তোমার অধিকার, তুমি কেন সেই বদমাশটার কাছে আত্মসমর্পণ করেছো? তুমি তোমার জমির জন্য লড়াই করে যাও। কিন্তু কৃষক আব্দুল গফুর বলেছিল, হুজুর আমি কিভাবে তার সাথে লড়াই করবো, সেতো খারাপ লোক, মারামারি, খুন খারাবিতে ওস্তাদ। শুনেছি পুলিশও নাকি তার কাছ থেকে মাসে মাসে অনেক টাকা পায়, তাই পুলিশ তার কথায় ওঠে আর বসে। আমি যদি তার বিরুদ্ধে মামলা করতে যাই, তাহলে তো পুলিশ মামলা নেবে না উল্টো আমাকে কোন মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে, আর হুজুর আপনি তো জানেন, চেয়ারম্যানের কাছে বিচার চেয়ে কোন লাভ নেই, কারণ চেয়ারম্যানের সব অবৈধ কাজের সহযোগী সে বদমাশ লোকটা। তখন হুজুর তাকে ভরসা দিয়ে বললেন, তুমি ভয় পেওনা আব্দুল গফুর, আমি তোমার সাথে আছি, আমি তোমাকে সব রকম সহযোগিতা করবো। আমার চোখের সামনে এত বড় অন্যায় ঘটে যাবে আর আমি চুপ করে দেখবো তাতো হয় না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটাও আমার নৈতিক দায়িত্ব। আমার সামনে এত বড় অন্যায় হচ্ছে, আমি যদি এর প্রতিবাদ না করি বা বাধা না দেই তাহলে পরকালে আল্লাহ্র সামনে কিভাবে দাড়াবো, যখন এই অন্যায়ের বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করা হবে, তখন আমি কি জবাব দিবো। তুমি হিম্মতহারা হয়োনা আব্দুল গফুর, যার কেউ নেই তার আল্লাহ্ আছে। মসজিদের ইমাম আনু মোহাম্মদকে কাছে পেয়ে, তার কথা শুনে কৃষক আব্দুল গফুর যেন সাহসী এবং প্রতিবাদী হয়ে উঠলো এবং আমার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে লাগলো তার জমিটুকু ফেরত পাবার জন্য। আমি তাকে অনেক শাসিয়েছি কিন্তু সে দমবার পাত্র নয়। ইমাম সাহেবকে নিয়ে সে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, থানা, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নিকট ধর্ণা দিয়েছে, সে তার জমি ফিরে পেতে চায়। ইমাম সাহেব মানুষকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে, আমার বিরুদ্ধে পুরো গ্রামবাসী অবস্থান নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমার দখল করা সেই জমিটুকু আর দখলে রাখতে পারিনি। সেই দুঃখটা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই ইমামের জন্য আমার মাদক ব্যবসা পর্যন্ত গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে, মাদক গ্রহণ করে নাকি এলাকার যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এরকম প্রচারনা করে সে মানুষকে সাথে নিয়ে এমনকি আমি যার হয়ে এতদিন কাজ করেছি সেই চেয়ারম্যান পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং মাদক ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য করেছিল। এই মাদক ব্যবসা থেকে আমার সিংহভাগ আয় হতো। এই টাকা দিয়ে উপর মহলকে খুশি রেখে যা ইচ্ছা তাই করতে পারতাম। কিন্তু মাদক বিক্রি বন্ধ হওয়ার কারণে আমি আজ প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। আমার যত ক্ষতি হয়েছে তার মূলে রয়েছে মসজিদের ইমাম আনু মোহাম্মদ।
আমি অপেক্ষা করছি আনু মোহাম্মদের জন্য কখন সে এই রাস্তাা দিয়ে আসবে আর কখন তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে তার শরীরটাকে ছিন্নভিন্ন করে দেব। আজ আমার এই ছোরাটা দিয়ে, মনের খায়েশ মিটিয়ে, শরীরের যত রাগ আছে সব আজ মিটিয়ে দেবো। হঠাৎ দেখলাম মানুষের মৃদু কণ্ঠস্বর, কেউ আসছে। আমি গাছের আরেকটু আড়ালে লুকালাম। সে কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে, আমি বুঝার চেষ্টা করলাম, কে আসছে। আস্তে আস্তে সে কণ্ঠস্বর আরও কাছাকাছি চলে আসলো। দেখলাম চেয়ারম্যান এবং তার চামচা, দুজনে কথা বলতে বলতে আসছে। নিজেকে আরও আড়ালে লুকিয়ে রাখলাম, আমি খুন করতে চাই কিন্তু কোন স্বাক্ষী রাখতে চাই না, কেউ যেন জানতে না পারে এই খুন আমি করেছি। খুনটা ঠান্ডা মাথায় করতে পারলে, আমার পথের কাটা দুর হবে আর আমার ব্যবসা আবার আগের মত জমজমাট হয়ে উঠবে। আমি আবার আগের মত দুর্দান্ত প্রতাপশালী হয়ে উঠবো। মানুষ আমার নাম শুনলে ভয়ে কেপে উঠবে, চেয়ারম্যান আমার কথায় উঠবে আর বসবে, থানা পুলিশ আবার আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। ভাবতেই মনের ভিতরে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। আস্তে আস্তে চেয়ারম্যান এবং তার চামচা কাছাকাছি চলে আসলো। এবার তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। চেয়ারম্যান সাহেব বলছেন, বুঝলি বিজয় আমি আগে না বুঝে অনেক পাপ করেছি, অনেক মানুষকে ঠকিয়েছি, মানুষের রিলিফ মেরে দিয়েছি, এখন আমার ভুল ভেঙ্গেছে, আমি যে অনেক বড় পাপী তা বুঝতে পারছি। মানুষ আমাকে ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান বানিয়েছে তাদের সুখ দুঃখের সময় পাশে পাবার জন্য, তাদের অভাব অভিযোগ আমাকে বলার জন্য আর আমি যতটুকু পারবো তাদের সমস্যার সমাধান করে দিবো। কিন্তু এতদিন আমি সত্যিকার অর্থে মানুষের কোন সেবা করিনি, তাদের ধারে কাছেও যাইনি। চেয়ারম্যানের কথা শুনে তার চামচা বিজয় বলে উঠলো ঠিকই বলেছেন হুজুর, আপনার পরিবর্তন দেখে আমার ভিতরেও পরিবর্তন এসেছে। আমিও আর কোন অন্যায় করবো না হুজুর, এই যে আপনার সামনে কান ধরে বলছি এই বলে চামচা বিজয় তার কান ধরে চেয়ারম্যানকে দেখায়। চেয়ারম্যান সাব আসলে আনু মোহাম্মদ হুজুর একজন ভাল মানুষ, তিনি গ্রামটাকে কেমন বদলে দিয়েছেন, মানুষের উপকারে লোকটা যেন নিবেদিতপ্রাণ। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন হুম, বিজয় ঠিকই বলেছিস। হুজুরকে দেখে আসলে আমার নিজেরই লজ্জা হয়, আমি চেয়ারম্যান হয়ে যা করা দরকার ছিল, সেটা আনু মোহাম্মদ হুজুর করে দেখাচ্ছে। আমি তো অন্ধের মত সেই কালু বজ্জাতটারে দিনে দিনে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছিলাম। ওই ফাজিলটা অনেক মানুষরে কষ্ট দিয়েছে। আনু মোহাম্মদ হুজুর যদি মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিতেন তাহলে যুব সমাজের অবস্থা খারাপ হয়ে যেতরে বিজয়। একটা দীর্ঘশ্বাস সারলেন চেয়ারম্যান সাহেব। বিজয় বললো ঠিক বলেছেন চেয়ারম্যান সাব, আনু মোহাম্মদ হুজুরের প্রচারোনায় আপনি ভুলটা বুঝতে পেরেছেন এবং হুজুরের সাথে একজোট হয়ে মাদকের হাট উচ্ছেদ করেছেন এবং কালুকে একঘর করেছেন। কালুকে যদি থামানো না যেত হুজুর একদিন সেই কালুই আপনার গলায় ছুরি ধরতো। চেয়ারম্যান বললেন হুম, ঠিক বলেছিস। হঠাৎ চেয়ারম্যান বললেন বিজয় দেখতো গাছের আড়ালে কিসের যেন নড়ার শব্দ পেলাম।
চেয়ারম্যানের কথা শুনে আমি আৎকে উঠলাম। চেয়ারম্যান সাব কি আমাকে দেখে ফেললো নাকি? যদি দেখে ফেলে তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি আস্তে আস্তে সন্তর্পণে পিছনে সরে যেতে লাগলাম, যতটা পারা যায় আড়াল হওয়ার চেষ্টা করলাম। চেয়ারম্যানের চামচা বিজয় টর্চলাইটের আলো জ্বেলে খোজার চেষ্টা করছে কোথা থেকে খসখস আওয়াজ আসলো। সে ধীরে ধীরে আলো জ্বেলে আমার সন্নিকটে চলে আসছে, ধরা পড়ার ভয়ে পুরো শরীর ঘেমে যেতে লাগলো, চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম, আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়লাম এই ভেবে যে, চেয়ারম্যান সাহেবও ভাল মানুষের দলে নাম লিখিয়েছে। চামচা বিজয় এবার গাছের আগায় টর্চ লাইটের আলো মেরে দেখলো মগডালে একটি হুতুম পেঁচা বসে আছে। চামচা বিজয় এবার একটু মৃদু হাসলো সে চেয়ারম্যানকে বললো, চেয়ারম্যান সাব এখানে কিছু নেই, গাছের উপরে হুতুম পেঁচা বসে আছে, সম্ভবত আমরা সেটার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। চেয়ারম্যান বললেন ‘ঠিক আছে, চলে আয়’। আমি হাফ সেরে বাঁচলাম, ঘাম দিয়ে যেন জ্বর সারলো, যাক বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। চেয়ারম্যান সাহেব চামচা বিজয়কে বলছে, বুঝলি বিজয় আমার মনটার ভিতর কেমন যেন অস্থির লাগছে, কিছু ভাল লাগছে না, মনে হচ্ছে কারও জন্য কোন বিপদ অপেক্ষা করছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে দেখিস না আকাশটা কেমন গুমোট বেধে আছে, বাতাসও থমকে আছে, পরিবেশটা কেমন যেন ভয়ানক ভয়ানক লাগছে। বিজয় বললো কি যে বলেন চেয়ারম্যান সাব, আপনি অহেতুক চিন্তা করছেন, কই আমি তো কিছু অনুভব করতে পারছি না। সব হলো আপনার মনের খেয়াল। এতসব চিন্তা করলে হবে, চলেন বাসায় চলেন। খালাজান আপনার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। খেতে হবে না? আমারও ক্ষুদায় পেটটা চৌ চৌ করছে। চেয়ারম্যান বললেন চল। চামচা বিজয়ও বললো, চেয়ারম্যান সাব আপনি যখন থেকে নামায পড়া শুরু করেছেন, সেদিন থেকে খালাজান যে কত খুশি হয়েছে, তা উনার চেহারার দিকে তাকালেই বুঝা যায়। হুম ঠিক বলেছিস। এভাবে তারা দুজন কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে আমার চোখের আড়ালে চলে যায়। মগডালের পেঁচা গুতুম গুতুম করে ডেকে উঠলো, দুরে শেয়ালের ডাক শুনা যাচ্ছে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া, চারদিক নীরব, কোন শব্দ নেই, পীনপতন নীরবতা, চাঁদের আলোটা ধীরে ধীরে মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে, গাছের পাতাগুলো নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে, শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। আমার ভিতরের অসুরটা আবার জেগে উঠে, জেগে উঠে আমার ভিতরের হিংস্র মানবটা। আমি নতুন উদ্যামে আবার প্রস্তুতি নেই একটি খুনের জন্য। আমার যে খুন করাটা বড় জরুরী।