১.
বরাবরের মতোই আমি ফোনে কথা বলতে বেশ বিব্রত বোধ করি। পরিচিতজন ছাড়া অন্য কারো সাথেই ফোনে কথা হয় না। তারপরও অনিচ্ছা সত্ত্বেও কলটা রিসিভ করলাম। ওপাশের কন্ঠটা বেশ পরিচিত মনে হলো। পরিচয় জিজ্ঞেস করায় বলল, ‘আমি এহসান’। এতটুকু পরিচয় দিয়েই থেমে গেলো। এহসান নামে বহু মানুষকে আমি চিনি। তার মধ্যে অন্যতম এহসান মোহাম্মদ নামের একজন ক্রিড়া সাংবাদিক, আরেকজন হলো এহসান জুয়েল, উনিও টিভি রিপোর্টার! এদের মধ্যে কেউই আমাকে কল করবে না ; কারন আমি কোন বিখ্যাত মানুষ না।
হঠাৎ পানির ঝটকায় শরীর শিউরে উঠার মতো করে আমার মাথায় আসলো আরেকটা নাম- এহসান বিন আবদুল্লাহ!
কলেজ জীবনের বন্ধু এহসান। কলেজে পড়াকালীন সময়ের অনেক ক্লাস মেটের নামই ভুলে গিয়েছি। মাঝে মধ্যে দেখা হলে নতুন করে আবার নাম টা জেনে নিই৷ নাম মনে রাখা আমার কাছে একটা দুরূহ ব্যাপার হলেও এহসানের নামটা মনে আছে। হয়তো ওর পুরো নামটার জন্যই মনে আছে- ‘এহসান বিন আবদুল্লাহ’। দেশে এ ধরণের নাম সচরাচর দেখা যায় না। আরব দেশে এ ধরণের নাম এখনো প্রচলিত। পিতা-পুত্রের নামের মধ্যে যোগসূত্র ‘বিন’ শব্দটি।
বেশ ইন্টারেস্টিং। তবে মাতা-কণ্যার নামের ক্ষেত্রে এমন নিয়ম প্রচলিত আছে কিনা জানি না। থাকলে বেশ ভালো হতো।
যাইহোক আসল কথা বলি। এহসান বিন আব্দুল্লাহ নামক আমার সেই বন্ধু তার বিয়ের দাওয়াত দেওয়ার জন্যই কল করেছিল। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই ওর বিয়ে। আর বিয়ের অন্তত এক সপ্তাহ আগে আমাকে সেখানে থাকতে হবে। প্রথমে আমি অনাপত্তি জানালেও, পরে যখন শুনলাম বিয়ের অনুষ্ঠান হবে ওদের চট্রগ্রামের বাড়িতে তখন আর না করতে পারলাম না।
পাহাড়ি এলাকা আমার খুবই ভালো লাগে। তাছাড়া বিয়ের দাওয়াতের সুযোগে পাহাড়ে চড়ে আসা যাবে- ভাবতেই ভালো লাগছে। তো আমি যাচ্ছি- এক সপ্তাহ আগেই যাচ্ছি।
যথারীতি বিয়ের প্রায় সাত দিন আগেই চলে গেলাম চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায় বন্ধুর পৈত্রিক বাড়িতে। পরিচিত তেমন কেউ না থাকায় কিছু একঘেয়ে দিন কাটছিলো। কেন জানি মনের মধ্যে এক প্রকার শূন্যতা অনুভব করছিলাম। আনন্দের বদলে বেদনার নিকষ কালো অন্ধকার ঘিরে ধরলো আমাকে। তবে হ্যাঁ, এহসান আর তার পরিবারের কেউ আমার যত্নের কোন ক্রুটি হতে দেয় নি।
কয়েকটা দিন যেতেই অন্যান্য বন্ধুবান্ধবরা আসতে শুরু করলো। এহসানের কাজিনরাও আসলো। ওদের সাথে পরিচিত হওয়ার পর বেশ ভালোই সময় কাটছিলো। তবে, আমার মনের মধ্যে চাপা পড়ে থাকা পাহাড়ে চড়ার ইচ্ছাটা পূরণ হলো না। এতে অবশ্য এহসানের কোন দোষ নেই। বিয়ে বাড়িতে অনেক কাজের ঝামেলা। এসবের মধ্যে বাড়ি থেকে বের হওয়াটা ওর পক্ষে কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে।
২.
সবাই গায়ে হলুদের স্টেজ সাজাচ্ছে। আমি এক কোনে মুখ ভার করে বসে আছি আর অযথা মোবাইল স্ক্রল করছি। একটু পরে সমবয়সী একটি মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে একটি চেয়ার নিয়ে খুব সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসলো। যেন আমাকে অনেকদিন আগে থেকেই চেনে।
আমার নাম জানতে চাওয়ায়, শুকনো মুখে নিজের নামটা বলেই খ্যান্ত থাকলাম।
কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর মেয়েটি নিজে থেকেই বললো,
‘আমার নাম নিতু।’
‘ওহ!’
‘আপনি কি করেন?’
‘আপাতত মোবাইলে গেম খেলছি। তাছাড়া তেমন কিছু করি না! আর কিছু বলবেন?’
‘আগামীকাল বিকালে পাহাড় দেখতে যাবেন? ’
এবার পুলকিত স্বরে আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়লাম। আর মেয়েটা সেটা দেখে হাঁসতে হাঁসতে চলে গেলো।
প্রথমে অমন আচরণ করাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। ভালো ভাবে দু-একটা কথা বললেও পারতাম। তবে মেয়েটার ভাবভঙ্গি খুবই সাবলীল আর বেশ চঞ্চলও। লাল শাড়িতে ওকে বেশ ভালোই লাগছিলো।
পরদিন বিকেলে বাড়ির কাউকে কিছু না বলেই নিতু আর আমি পাহাড় দেখতে রাঙামাটি চলে এলাম। পাহাড়ি পথে হাটতে বেশ ভালোই লাগছিলো। অবশ্য বাঙালিদের নাকি এমনিতেও পাহাড় দেখলে খুব আনন্দ হয়- সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর একটা প্রবন্ধে এমনটাই পড়েছিলাম।
দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এখন বাড়ি যাওয়ার পালা। কয়েক ঘন্টার আলাপচারিতায় ওকে বেশ ভালোই লাগলো। হঠাৎ করেই নিতু বলে উঠলো,
‘সত্যি করে একটা কথা বলুন তো।’
‘কি কথা?’
‘এতক্ষন আপনার সাথে ঘুরলাম। আপনাকে পাহাড় দেখালাম। এক মুহূর্তের জন্য কি আমাকে ছুঁতে ইচ্ছে করেনি আপনার?’
‘না তো!’
‘ইচ্ছে করে নি, নাকি সাহস পান নি?’
‘আমি অত্যন্ত সাহসী ছেলে’ - এই বলে নিতুর হাতটা ধরতে গেলেই ও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। এক মুহূর্তের জন্য সব কিছু অন্ধকার দেখলাম। অন্ধকার কাটতেই দেখি নিতুর চোখদুটো কোটরাগত হয়ে আছে। সেই চোখে কোন মনি নেই। শুধুই সাদা দুটো চোখ ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
এলোমেলো চুলের মাঝে মুখটাতে কেমন যেন একটা অবিশ্রান্ত হাঁসি হাঁসছে।
‘কি? ভয় পেয়ে গেলেন? হাঁ হাঁ হাঁ!!!’
এ দৃশ্য দেখার পর আমি এক মুহূর্ত দাড়ানোর সাহস পাই নি। দৌড়ে বাড়িতে চলে যাই আর কাউকে কিছুই বলি না।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে এহসানের পরিবারের সবার ওদের ফ্যামিলি এলবাম দেখছিলাম। ওই মেয়েটার একটা ছবি দেখতে পাই এলবামে। মেয়েটা সম্পর্কে এহসানের কাছে জানতে চাওয়ায় সে বলে,
‘ওর নাম নিতু। আমার চাচাতো বোন। গত পাঁচ বছর আগে পাহাড়ী রাস্তায় এক্সিডেন্টে সপরিবারে মারা যায়। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওর লাশ টা পাওয়া যায় নি!’
৩.
এহসানের বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে আগত কারো নামই এখন আর মনে নেই। তবে একটা নাম এখনো মনের মধ্যে দাগ কেটে আছে- ‘নিতু’
এখনো তাকে মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নের মধ্যে ছুঁতে গেলেই হাঁসতে হাঁসতে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সে। যেন তার কাছে আমি পরাজিত!
➖➖➖➖
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:১১