চলমান জ্বালানি সংকট কাটাতে সরকার ইতোমধ্যে নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছ। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশব্যাপী প্রতিদিন ১-২ ঘন্টা লোডশেডিং এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তবে চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কম হওয়ায় লোডশেডিং এর সময়সীমা কোন কোন জেলায় ৬-৭ ঘন্টায় গিয়ে পৌঁছেছে। যাতে করে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশের কৃষি ও শিল্প খাত।
লোডশেডিং এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। [1]
এই শিল্পে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব না হলে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেন। এবং, একবার স্টক লটের শিকার হলে (অর্ডারের পণ্য ক্রেতারা না নিলে) সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তার ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
লোডশেডিং এর ফলে যথাসময়ে পণ্য তৈরি এবং বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে ব্র্যান্ড ক্রেতারা পোশাকের দরের ক্ষেত্রে এক সেন্টকেও অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। কিন্তু, লোডশেডিং এর ফলে কারখানাগুলোকে দিনে ২ ঘন্টারও বেশি সময় ডিজেলচালিত জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। যার ফলে উৎপাদন ব্যয় ১১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। [2] আর উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান থেকে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, করোনা মহামারী ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন দেশ রেকর্ডকালের মূদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি হয়েছে। যেসব দেশে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ বেশি সেসব দেশের ভোক্তাদের খাদ্যের পেছনেই আয়ের বড় অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে পোশাকের মতো পণ্যের চাহিদা কমে আসা স্বাভাবিক। এর মধ্যে লোডশেডিং এর কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে পোশাক খাতকে বড় বিপদে পড়তে হবে। এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যার প্রভাব পড়তে পারে।
লোডশেডিং এর ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেচের পানি সময় মতো পাওয়া যাচ্ছে না। যার ফলে পানি সংকটে পড়েছে সাধারণ কৃষকরা।
দেশে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৪ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে ৫৯ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে রোপা আমন চাষ হয়। জুলাই-আগস্ট মাস আমন ধান রোপণের মৌসুম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই শেষ হতে চললেও মাত্র ৩ লাখ ৮৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে রোপণ হয়েছে। [3]
লোডশেডিং দীর্ঘায়িত হলে চলতি মৌসুমে সারাদেশেই আমন ধানের ক্ষেত হুমকির মুখে পড়ে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রে খরচ বেশি হওয়ায় কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
লোডশেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন পোলট্রি ও হ্যাচারি খামারিরা। পল্লী বিদ্যুতের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে মারা যাচ্ছে মুরগি। বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা পরিষদের (বিপিকেআরজেপি) এর তথ্যমতে অতিরিক্ত তাপমাত্রা এবং লোডশেডিং এর কারণে বাতাস না পাওয়ায় খামারের মুরগি স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে।
লোডশেডিং এর কারণে দেশের কৃষিখাত এবং প্রধান রপ্তানি পণ্যসমূহের উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।
এছাড়া, গত অর্থবছরের ১১ মাসে দেশের আমদানি ব্যয় সাড়ে ৭ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা তার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি৷ [4]
আবার জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
সুতরাং, বুঝা যাচ্ছে দেশের অর্থনীতিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং লোডশেডিং তাতে নতুন মাত্রা যোগ করছে।
ডিজেল সাশ্রয়ের জন্য সরকার কর্তৃক ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। যার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে।
কিন্তু, এর ফলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে জেনারেটরে ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে।
দেশের শিল্প কারখানা, বিপনী বিতান, বাসাবাড়িতে লোডশেডিং এর সময় ডিজেলচালিত জেনারেটর চালানো হচ্ছে। যার ডিজেলের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এর কর্মকর্তারা জানিয়েছে, ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকলে বছরে ১ লাখ ৪০ হাজার টনের মতো ডিজেল সাশ্রয় হবে। এদিকে, দেশে বাসাবাড়ি এবং বাণিজ্যিক খাতে মোট চাহিদার পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার টন। লোডশেডিং যত বাড়বে, এ খাতে ডিজেলের ব্যবহার তত বাড়তে থাকবে।
এছাড়া, ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখলেও সেগুলোর পেছনে সরকারের খরচ কমছে না। কারণ বেসরকারি খাতের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ নামে একটি মাশুল দিতে হয়। গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিদ্যুৎ না কিনেও সরকারকে গুনতে হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
সুতরাং, লোডশেডিং এর ফলে জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্য কতটুকু বাস্তবায়িত হবে তা এখনো প্রায় অনিশ্চিত। উপরন্তু, দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যসমূহের উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। যার ফলে রপ্তানি আয় কমতে শুরু করবে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে।
Rreferences:
1. Click This Link
2. Click This Link
3. https://cutt.ly/sZtgrOo
4. Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২২ দুপুর ১:৫৮