মানব জাতির ইতিহাস আসলে ধর্মের ইতিহাস – বলেছিলেন ম্যাক্সমুলার । কিন্তু ভারতবর্ষের ঐতিহাসিকদের দেখি ধর্ম সম্পর্কিত জ্ঞান এতটাই সীমিত যে তাঁদের চিন্তা ভাবনা ইতিহাসকেই দুর্বল করে তোলে ।
আপনাদের মনে হতে পারে , হঠাৎ এই কথা বললাম কেন ?আসলে ভারতের ইতিহাসের সেই অংশ টা পরছিলাম যেখানে ভারতবর্ষে ইসলামের বিস্তার সম্পর্কিত বিষয় রয়েছে । বর্তমান ভারতে আমরা দেখি সূফী সন্তদের প্রতি সকলেই শ্রদ্ধায় নত হয় । হিন্দুরা মোটের উপর মুসলিম দের তেমন পছন্দ না করলেও সূফী সন্তরা কিন্তু হিন্দুদের কাছেও শ্রদ্ধার পাত্র । কিন্তু কেন ? এই বিষয়টা বোঝার চেষ্টাতেই পড়াশুনা করতে শুরু করেছিলাম । ভারতবর্ষের ইতিহাসে সূফী দের ভূমিকা কি ? কোন জাদুমন্ত্রে তারা এত লোক কে ইসলামে আনতে পেরেছিল ? উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারে অত্যাচারিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সূফীদের সাম্যের বানীতে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহন করেছিলেন । কিন্তু, উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও তাঁদের শ্রদ্ধা করে কেন ?
এই সব বুঝতে গেলে একেবারে শুরু থেকে শুরু করা বাঞ্ছনীয় । প্রথমে আমরা জানব সূফী বলতে ঠিক কাদের বোঝায় ? আসলে ‘সূফী’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে অনেকগুলি মত প্রচলিত আছে। যেমন , সূফী শব্দটি সুফ থেকে এসেছে , যার অর্থ হল পশম । অর্থাৎ সেই সময় লোকে রেশম কিম্বা কার্পাস নির্মিত পোশাক পড়তো । কিন্তু তপস্যারত একদল সংসারত্যাগী মানুষের দেখা মিলত মদিনায় । তাদের পোশাক হত পশম নির্মিত । যা তারা কৃচ্ছসধনার জন্য পড়তো । এদের সাধারণ মানুষেরা সূফী বলতো । কেউ কেউ মনে করেন যে সাফ থেকে এই শব্দটির উৎপত্তি । কেননা এরা অন্তর কে সাফ রাখার কথা বলতেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন , তাসাউফ বা সত্য-বস্তুর উপলব্ধি থেকে এই সূফী শব্দ টির উৎপত্তি । সূফীরা আত্ম-উপলব্ধি ও আল্লাহ কে উপলব্ধির মাধ্যমে আল্লাহ কে পেতে চান ।
ইসলামী বই গুলোতে বলা হয় , হযরত মুহাম্মদ ছিলেন সর্বপ্রথম সূফী । তার জীবনে ও আচরণে সূফী ভাবের প্রাধান্যই দেখা যেত । তাই তাকেই সূফীদের আদিই গুরু হিসাবে চিহ্নিত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় । কিন্তু এটা নিতান্তই অপপ্রচার । যে ব্যক্তির সারা জীবন একের পর এক যুদ্ধাভিযানে এবং যৌন সম্ভোগে কেটেছে , এমনকি যে ব্যক্তি তার মৃত্যুর মুহূর্তেও এমন একজন বালিকার বিছানায় ছিলেন যে তার থেকে বয়সে ৪৫ বছরের ছোট, তাকে সংসার ত্যাগী, নির্লোভ , পবিত্রাত্মা সূফীর আখ্যা দেওয়া নিতান্তই হাস্যকর ; উদ্দেশ্য প্রণোদিত মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয় । তাছাড়া হজরত মোহাম্মদ সূফীদের আদি গুরু হলে ইসলাম আর সূফীবাদ সমার্থক রূপে গণ্য হত।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, প্রথম সূফী কে বা কারা ? আসলে মোহম্মদের মদিনা জয়ের পরবর্তী সময়ে মদিনায় একদল মানুষ কে মদিনায় মসজিদ ই লবভি-র বারান্দায় দেখা যেত ,যারা আধ্যাত্মিকতাকে নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করতে চাইতেন , চাইতেন আরবী সমাজ জীবনে আধ্যাত্মিকতার প্রসার । এরা মসজিদের বারান্দা ছেড়ে তেমন জেতেন না । , এবং প্রয়োজন ছাড়া অন্যের সাথে তেমন কথা বলতেন না । সম্ভবত এরাই ইতিহাসের প্রথম সূফী দল । তারপর এদের হাত ধরেই প্রচারিত হতে থাকে ইসলামী আধ্যাত্মিকতা । তবে তখনো একটি বিশেষ মতবাদ হিসাবে সূফীবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় নি। মোহম্মদের মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে হাসান বসরী নামে এক ব্যক্তিকে দেখা যায় প্রথম ইসলামী পঞ্চস্তম্ভ কে দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখ্যান করতে । এবং তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই তাকে ও তার অনুগামীদের লক্ষ্য করে সূফী শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে মানুষদের মধ্যে । এরপর একের পর এক মহান সূফীর আবির্ভাব ঘটতে থাকে । সুফীবাদের যতই প্রচার ও প্রসার হয় , ততই তার সঙ্গে মিসে যেতে থাকে নতুন নতুন জায়গার সংস্কৃতি । ফলে এদের মধ্যেও বিভিন্ন উপসম্প্রদায় তৈরি হয় । এবং তিন শো বছর অব্যাহত থাকে এই প্রসারের ধারা । ভাবতে পারেন , কেন মাত্র তিনশো বছর বললাম, সুলতানি আমল , মুঘল আমল এমন কি এখন ও তো সূফী প্রচার চলছে এই উপমহাদেশে ! এই প্রশ্নেরও সমাধান থকবে এই প্রবন্ধে ।
আসলে প্রথমদিকে সুফীবাদের চরিত্র ছিল অন্যরকম । এই সুফীবাদের উদ্ভব মোহম্মদের মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেই । এইসময় সূফীদের শিক্ষা ছিল মোহম্মদের শিক্ষার অর্থাৎ ইসলামের সম্পূর্ণ বিরোধী । কিন্তু এরা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাননি । এর কারণ বিস্তারিত আলচনা করব তবে আপাতত বলে রাখি , এই ধর্মে মান্যতা প্রাপ্ত স্রষ্টা আল্লাহ সূফীদের ও পরিচিত ছিল । এই আল্লাহ-র বিরোধী তারা ছিলেন না । তাই ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ’ থেকে তারা সরে আসেন নি । কিন্তু মোহাম্মাদ কে তারা পছন্দ করতেন না ।
আমরা বর্তমান কালের সূফীদের গ্রন্থ গুলিতে দেখি , সূফীদের আদি গুরু মোহাম্মাদ । কিন্তু একথা সর্বৈব মিথ্যা । এটা কেন ও কোন উদ্দেশ্যে করা হয় তাতে পরে আলোকপাত করব ।আগে বলে নিই , সূফী দর্শনের ইতিহাস কে মুলত দুটি ভাগে ভাগ করে নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে । প্রথম পর্যায় (৯৫০ খ্রী: পর্যন্ত) ও দ্বিতীয় পর্যায় ( অদ্যাবধি) । প্রথম পর্যায়ে সুফিরা ইসলামের মধ্যে থেকেই ইসলামের অন্য ব্যাখ্যা দানের মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন ইসলামকে বদলাতে এবং মোহম্মদর নবিত্বকে চেয়েছেন খর্ব করতে । এদের মধ্যে প্রধান কয়েকজন ব্যক্তির মত উল্লেখ করলে বিষয় টি পরিষ্কার হবে --
১) হাসান আলী বসরি কে সুফিবাদের জনক বলতে বিতর্কের অবকাশ অতি সামান্যই থাকে । তিনি ইসলামের প্রচলিত রীতি ছেড়ে দিয়েছিলেন । তিনি সারাদিন সাধন ভজনে ব্যস্ত থাকতেন । এমন কি তিনি নামাজ ও পরতেন না সময়ে । তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবেই বলতেন “আমি সাধনায় ব্যস্ত। আমার সাধনা নামাজ রোজার থেকেও উত্তম”।
২) বিখ্যাত সূফী সাধিকা রাবেয়ার নাম অনেকেই শুনে থাকবে । তিনি প্রথম ইসলামে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সফল হয়েছিলেন , যা আজও চলে আসছে। আর সেটি হল তিনি আল্লাহ কে সীমাহীন ভাবে প্রেম করতে বলেছিলেন । কোরআনের শিক্ষা অনুসারে আল্লাহ –র প্রতি বান্দাদের ভয় মেশানো শ্রদ্ধা থাকা উচিত । যেখানে ভয় থাকে সেখানে প্রেম থাকতে পারে কি ? মহান রাবেয়া প্রায়োগিক ভাবেই ইসলামে কোরআনের শিক্ষাকে গৌণ করে তুলেছিলেন। রাবেয়া একবার বলেছিলেন, “ আল্লাহ-র প্রেমে আমার হৃদয় এমন পরিপূর্ণ , যে সেখানে মোহাম্মদের কোনও স্থান নেই ।” এরা আল্লাহ্ কে জগত থেকে আলাদা করে ভাবতেন না। এরা ভাবতেন জগতের প্রতিটি বস্তুর সাথে আল্লাহ অন্তরঙ্গ হয়ে আছেন । প্রতিটি বস্তুই তাই আল্লাহ-র ই প্রকাশ । এই মতবাদই সর্বেশ্বর বাদ নামে পরিচিত , যা ইসলামের একেশ্বরবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত ।
৩) তাইফুরিয়া শাখার জনক বায়েজিদ বিস্তামী ।তার শিক্ষাও ছিল ইসলাম বিরোধী । তিনি সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ত্যাগ করে আল্লাহকে ইবাদত করার কথা বলতেন । নামাজ রোজা , বিবাহ এর তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না । ইনিই প্রথম ফণা ও বক্কা-র কথা বলেন । যা তিনি পেয়েছিলেন তার শিক্ষক আবু আলী সিন্দি-র কাছ থেকে , the wonder that was india vol.2 এর রচয়িতা রিজভী মনে করেন , সিন্দি ভারত থেকে গিয়েছিলেন। এই হিন্দু –বৌদ্ধ অতীন্দ্রিয় বাদের জীবন্মুক্তি(নির্বাণ) ও বিদেহ-মুক্তি বিষয়টি তিনি ইসলামে যোগ করেছিলেন বলা যায় । বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা উপার্জন ও অর্থ সঞ্চয়েরও তিনি বিরোধিতা করেছেন । তিনি খুব দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন , “ আমার পতাকা মোহম্মদের থেকেও বড় । ” অর্থাৎ তার অনুগামীর সংখ্যা মোহম্মদের অনুগামী দের চাইতেও অনেক বেশি ।
৪) আবু সাইয়িদ খাজরাজ , যিনি খজরাজি ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন । তিনি ছিলেন অসামান্য জ্ঞানী ব্যক্তি । তার লেখা ‘কিতাব উস শির’ নামক গ্রন্থ লেখার জন্য তাকে মুসলিম রা কাফের অভিধায় অভিহিত করে অত্যাচার করতে ছাড়েন নি । তিনি তার বইতে ইসলামবিরোধী অনেক গুপ্ত কথা বলেছিলেন । তিনি বিস্তামীর ফণা ও বক্কা –র ধারণার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ।
৫) সমসাময়িক সূফী আল হাল্লাজ জিক্র ও ইবাদতের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে মত্ত হয়ে থাকতেন । তিনি ইসলামের মত অগ্রাহ্য করে বলেছিলেন উপনিষদের মহাবাক্য ‘আনল হক’ অর্থাৎ (আমিই সত্য বা আমিই ঈশ্বর) । [প্রসঙ্গত এই সময়ে ভারতে শঙ্করাচার্য্য এই বাক্যের ই পুনঃপ্রতিষ্ঠায় রত ছিলেন ।] এজন্য তাকে কারাবরন করতে হয় । কারাগারে বসেই হাল্লাজ লিখে ফেললেন তার শয়তান বিষয়ক অবিস্মরণীয় গ্রন্থ “ত সীন অল–অজল” । এখানে তিনি একেশ্বরবাদ কে তিনি চরম আঘাত করেছেন । তিনি সিদ্ধান্ত করেছেন, একেশ্বরবাদ শয়তানের ধর্ম , ইবলিশের একেশ্বরবাদই তাকে আদমের প্রতি সিজদা( মাথা নত) করতে দেয়নি , এই একেশ্বরবাদের জন্যই ইবলিশ আল্লাহ-র নির্দেশ অমান্য করেছিল । এই বক্তব্যের ফলস্বরূপ নয় বছর কারাগারে বন্দী থাকার পরও তাকে অকথ্য অত্যাচার করে তারপর ফাঁসী দেওয়া হয় ।
৬) সাহলিয়াহ ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা সাহল বিন আবদ-আল্লাহ তস্তরী । তিনি তার নিজস্ব রীতিতে ৭০ দিন পর্যন্ত রোজা রাখতেন । নিরজনে তপস্যার প্রতি জোর দিতেন ।
৭) জুন্নুন মিশরী র মতে সূফীরা আল্লাহ-র বন্ধু । তারাই আল্লাহ-র যথার্থ জ্ঞান লাভ করেন । যদিও এর আগের সূফীরা গুরুবাদী ছিল । তবে তত্ত্বের আকারে গুরুবার উপথাপিত হয়নি । তিনিই প্রথম বলেন যে , গুরুর নির্দেশ কে আল্লাহ-র নির্দেশের সমান গুরুত্ব দিতে হবে । গুরুর নির্দেশের প্রতি এতটা সম্মান আমরা আগে দেখেছি একমাত্র ভারতীয় পরম্পরায়
৮) সূফী আবুল হাসান নুরী , যাকে সূফী সম্প্রদায়ের চাঁদ বলা হয় , তিনি নিজে সমস্ত কামনা ত্যাগ করেছিলেন । তিনি নামাজ , যাকাত ও রোজা ত্যাগ করেছিলেন । এরপর তিনি মারিফতের জ্ঞান ও শক্তি অর্জন করেছিলেন ।
আরও অনেক ব্যক্তির উল্লেখ করা যায়। কিন্তু অযথা বাহুল্য বর্জন করে কাজের দিকে চোখ ফেরানোই শ্রেয় ।
প্রথম পর্যায়ের এই সব সূফীদের মতবাদ এর সাথে মূল ইসলামের কতটা পার্থক্য তা বোঝানোর জন্য একটা মোটামুটি পার্থক্য করে দেখান জেতে পারে । সেগুলি হল—
১) সৃষ্টিবাদী ধর্মগুলির কেন্দ্রে থাকে স্রষ্টা বা ঈশ্বরের ধারণা । প্রথাগত ইসলামের ঈস্বরতত্ত্বকে একেশ্বরবাদ বলা হয় । কারণ ইসলামে স্রষ্টা একজন সর্বশক্তিমান ব্যক্তিবিশেষ , যার শ্রেষ্ঠ নাম আল্লাহ । তিনি আমাদের জগত –বহিঃস্থ।তার গুণ অসংখ্য হলেও, তিনি রূপের দিক থেকে জ্যোতিস্বরূপ । কিন্তু সূফী বাদ অনুসারে আল্লাহ জগত বহিঃস্থ নয় বরং জগতের অন্তঃস্থিত শক্তি বিশেষ । তিনি গুনের দিক থেকে যেমন অসংখ্য গুনের অধিকারী ঠিক তেমনি রূপের দিক থেকেও অসংখ্য রূপের অধিকারী ।
২) স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্কের দিক থেকে বলা যায় , ইসলামী একেশ্বরবাদ অনুসারে আল্লাহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা । তিনি শূন্য থেকে জগত কে আপন ইচ্ছা অনুসারে সৃষ্টি করেছেন । কিন্তু সুফিবাদ অনুসারে সৃষ্টি ও স্রষ্টা বলে কিছুই নেই । কেননা কিছুই সৃষ্ট নয় । আল্লাহ এই বৈচিত্র্যময় জগতে নিজেকে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ করে চলেছেন । সমস্ত বস্তুই আসলে আল্লাহ । সবই আল্লাহ , আল্লাহ-ই সব ।
৩) মূলধারার ইসলামে আল্লাহ এক অদৃশ্য ব্যক্তিত্ব । যাকে কোরআনের ছত্রে ছত্রে ভয় মেশানো শ্রদ্ধা করতে বলা হয়েছে । তা না করলে বা তার নির্দেশ অমান্য করলেই শাস্তির ভয় দেখান হয়েছে । কিন্তু সুফিবাদ আল্লাহকে প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে জিতে নিতে চায় । আল্লাহর সাথে নামগান ও ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে নিজেকে ত্যাগ করে আল্লাহকে আপন করে নিয়ে আল্লাহ-র সাথে মিলিত হতে চায় ।
৪) মূল ধারার ইসলামে নৃত্য সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয়েছে । তাদের পথ ভ্রষ্ট মনে করে তাদের জন্য নরকের আগুন বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্যদিকে সূফীবাদে নৃত্য সঙ্গীতকেই আল্লাহর সাথে মিশে যাওয়ার পথ হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে ।
৫) মূলধারার ইসলামে আল্লাহ-র সাথে মানুষের সম্পর্ক মালিক-ক্রীতদাসের। এখানে বান্দা বা দাসদের কোনও অধিকার নেই আল্লাহ-র সাথে মিলিত হওয়ার । কিন্তু সূফীবাদ অনুসারে, আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক অংশী ও অংশের সম্পর্ক । মানুষ এবং জগতের সব কিছুই আল্লাহ-র অংশ । তার অধিকার আছে আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার । এবং মানুষের লক্ষ্য এইটাই হওয়া উচিত ।
৬) মূলধারার ইসলাম শুধু ভোগবাদী নৈতিকতায় বিশ্বাসী । এখানে আল্লাহ কে পাওয়ার পথ হল জেহাদের মাধ্যমে রাজ্যজয় । সেখানকার স্ত্রী এবং শিশুদেরকে নিজেদের ভোগসামগ্রী বানানো । অবশ্য হারলেও ক্ষতি নেই , কেননা জেহাদে মৃত্যুবরণ করলে সোজা জান্নাতে স্থান । এবং সেখানে প্রচুর শিশু ও অপূর্ব সুন্দরী নারী বরাদ্দ থাকবে ভোগের জন্য ।এখানে পুণ্য কাজ করার উদ্দেশ্যই হল জান্নাতে ভোগের আশা । অন্যদিকে সূফীবাদে জান্নাত কে উদ্দেশ্য করা হয়নি । সেখানে কৃচ্ছ সাধন এবং নিস্কাম,নিস্কলঙ্ক প্রেমের দ্বারা আল্লাহ-কে পাওয়ার কথাই বলা হয়েছে ।
আরও অনেক পার্থক্য আছে । তবে বাহুল্য বর্জনের জন্য কেবল মূল পার্থক্য গুলিই দেওয়া হল ।
প্রশ্ন উঠতে পারে , এই দর্শন তারা পেয়েছিল কথা থেকে ? উত্তরে বলা যায় যে, ভারতের সাথে আরবের সম্পর্ক ইসলামের থেকেও অনেক অনেক প্রাচীন । প্রাক ইসলামী আরবের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্কের হাত ধরেই ভারতে ইসলামের আগমন । প্রাক- ইসলামী আরবের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক শুধু ভারতেরই ছিল না , ছিল রোম এবং গ্রীসেরও ।আর এই তিনটি সভ্যতায় সর্বেশ্বরবাদী মানসিকতা প্রবল ছিল । ফল স্বরূপ , প্রাক ইসলামী আরবে যে প্রতিমা পূজা ও সর্বেশ্বরবাদী চিন্তা প্রবেশ করেছিল এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল , সেকথা বলাই বাহুল্য । মনে রাখতে হবে যে আরব এবং আসেপাসের স্থানগুলিতে ইসলামের প্রবেশ কোনও বিবর্তনের মাধ্যমে হয় নি , হয়েছিল বিপ্লবের মাধ্যমে । সেখানকার মানুষদের একটা বড় অংশ বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল । তাই বাধ্য হয়ে তারা বাহ্যিক ভাবে যতই ইসলাম গ্রহণ করে থাকুক না কেন , মনে মনে তারা সর্বেশ্বরবাদীই থেকে গিয়েছিল । এমন সময় মুহাম্মদের মৃত্যু হল । আর তার পরেই শুরু হল নবীর উত্তরাধিকার নিয়ে চরম অশান্তি । নতুন ধর্মের এই কুফল সাধারণ মানুষের চোখ এড়িয়ে যায় নি । আর এ থেকেই সূফীদের আবির্ভাব । এই সূফী সন্ত রা চেয়েছিলেন ইসলামী জানালাবিহীন সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের মধ্যে আবার সর্বেশ্বর-বাদ কে পুন-স্থাপন করতে । তাই বলা যায়, এই মতবাদ মূলত নতুন ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মৃদু বিদ্রোহ, যাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল সূফী রা ।
এখন প্রশ্ন হল , এরা যদি বিদ্রোহই করবে ইসলামের বিরুদ্ধে , তাহলে ইসলাম ধর্ম থেকেই বের হয়ে এলেন না কেন ? তারা ইসলামের ভিতরেই থেকে গেলেন কেন ?
আসলে এর একাধিক কারন আছে । প্রথমত , অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি ইসলামের নির্দেশ কতটা কঠোর ছিল তা তারা খুব ভাল ভাবেই জানতো । তারা জানতো যে , ইসলাম থেকে বেরিয়ে আসার অর্থ মৃত্যু । দ্বিতীয়ত , ইসলাম যে আল্লাহকে স্রষ্টা হিসাবে মানে , সেই আল্লাহ-র সাথে তাদের পরিচিতি ছিল । তারাও আল্লাহ কে মানত । কিন্তু তেমন ভাবে নয় , যেমন ভাবে কোরআনে বলা হয়েছে । তৃতীয়ত, তাদের সকল আপত্তি ছিল মোহম্মদের উপর । তাই তাদের মধ্যে মোহম্মদের বিরোধিতা-ই প্রাধান্য পেয়েছিল। ইসলামের বিরোধিতা সেভাবে নয় । চতুর্থত, তারা তখনো সংগঠিত ছিল না যে তারা বিদ্রোহ ও জয়লাভ করতে পারে । এবং সর্বোপরি , সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিমা পূজার পথে ফিরে যেতে পারত না , কেননা তাদের সমস্ত প্রতিমা বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল , কেবলমাত্র আল্লাহ-র কাবাকে ধ্বংস করা হয়নি । তাই তারা ধর্ম ত্যাগ করেনি । সবচেয়ে মজার কথা , এত ধ্বংসলীলার পরেও বাকি সমস্ত মন্দির ধ্বংস করে দেওয়ার পরেও কাবার ধ্বংস না করা বা কাবা ধ্বংস না হওয়াটা সাধারণ মানুষের মনে আল্লাহ-র প্রতি বিশ্বাস কে আরও প্রবল করে তোলে ।
সে যাই হোক , তারা যে মতবাদ ব্যক্তিগত বা ক্ষুদ্র দলগত ভাবে শুরু করেছিল , তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল । হিংসা কে সমর্থন করা মোহম্মদের মতের বিরোধিতা, আল্লাহ কে ভয় না করে তাকে আপন করে নিয়ে তার সাথে প্রেমের সম্বন্ধের মাধ্যমে তাকে পাওয়ার কথা বলা , সূফীদের সহজ জীবনযাপন ও তাদের মধ্যেকার প্রেম ও সেবার মানসিকতা মানুষ কে এই মতের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে । এক শতাব্দীতেই সূফী অনুগামীর সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যায় । তারপর তা আরও আরও গতি লাভ করতে থাকে । সূফীরা আরও শক্তিশালী হয়ে মুহাম্মদ বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু বৌদ্ধ তত্ত্ব গুলিকে যোগ করতে থাকেন সেখানে । ফলে মানুষ সূফীদের আরও কাছাকাছি চলে আস্তে থাকে। এরা শরিয়ত মানতেন না । এরা ইসলামের মূল স্তম্ভস্বরূপ নামাজ , যাকাত ও রোজা সম্পর্কিত রীতিনীতি গুলি মানতেন না । নাচ গান ইসলামে নিষিদ্ধ ছিল, তারা নাচ গানের মাধ্যমকেই আল্লাহ কে পাওয়ার মাধ্যম হিসাবে মনে করত । তারা আল্লাহ-র নামে নাচ গানে মত্ত হয়ে থাকতো । এভাবেই তাদের মধ্যে অতীন্দ্রিয় অনুভূতি জাগত । বায়া-জিদ বিষতামী বলে উঠেছিলেন যে , “আমার মহিমা ব্যাপ্ত হোক । কি মহান আমার গৌরব !” বায়া-জিদ আরও বলেছিলেন , “আমার পতাকা মুহাম্মদের থেকেও বড় ।” অর্থাৎ , তার সমর্থকের সংখ্যা মোহাম্মদের সমর্থকের থেকেও বেশি । এখানেই বোঝা যায় যে তারা কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন এই সময় (৮৬০-৮৭৫)। এদের প্রকাশভঙ্গী ছিল বাধা- বন্ধন হীন , যা সুক্র্ নামে খ্যাত হয় ইসলামে । সুন্নিরা ভীত হয়ে উঠেছিলেন । এর ঠিক পরবর্তী সময়ে আল হাল্লাজ অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি থেকে বলে উঠলেন , “ আনল হক্ ” । অর্থাৎ আমিই সত্য বা আমিই ঈশ্বর । গোঁড়াপন্থি সুন্নি পরিচালিত রাষ্ট্রশক্তি আতঙ্কিত হয়ে তাকে কারারুদ্ধ করেছিল । তখনো যে তিনি থামেন নি । তিনি একেশ্বর বাদকে ভ্রান্ত, দুষ্ট এবং শয়তানের ধর্ম বলে প্রচার করেছিলেন, গ্রন্থ লিখেছিলেন ।আর সেই কারণে তার কি পরিণতি হয়েছিল তা আগেই আমরা জেনেছি। খালি হাল্লাজ নয় , অনেক সূফী কেই সেই সময়ে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল । কিন্তু তাদের থামান যায়নি , বরং তাদের সাহস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল ।
প্রসঙ্গত, বলে রাখা ভাল যে সেই সময় অর্থোডক্স ইসলামের বিরুদ্ধে শুধু সুফিরাই বিদ্রোহ করেনি, মুতাজিলা নামক একটি দার্শনিক সম্প্রদায় ইসলামের মূল বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে চলেছিল । এমতের আবির্ভাব যেন সূফী দের সাহায্যার্থেই । প্রথম সূফী বসরী –র শিষ্য ছিলেন ওয়াসীল বিন আতা(মৃত্যু ৭৪৮ খ্রীঃ) , যিনি মুতাজিলা মতের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় । মুতাজিলারা আক্রমণ করে একাদেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত ইসলামী সমাজকে , যা মোটেই তাচ্ছিল্য করা যায়নি । কেননা মুতাজিলারা সংখ্যায় কম হলেও ইসলামী দর্শনের মুলে একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছিল। এরা ছিল প্রবল যুক্তিবাদী । এককথায় বলে যায় মুতাজিলারা ইসলামের বৌদ্ধিক জগতে আঘাত করেছিল , সমাজ জীবনে আঘাত হেনেছিল সূফীরা । এই দুই-তরফে দুটি পৃথক আক্রমণ অর্থোডক্স (সুন্নি) ইসলামে ভাঙ্গন ধরিয়েছিল । সুন্নিরা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল দুটি শাখায় । হানাফি ও মালেকী । এই সময় আবির্ভাব ইমাম শাফেয়ীর(৭৬৭-৮২০ খ্রীঃ) । তিনি এই দুটি মতবাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে তাকে আরও অর্থোডক্স করে তুলতে চাইছিলেন । কিম্বা বলা যায় আরও মূলের দিকে নিয়ে যেতে চাইলেন । এই শাফেয়ী ঘরানার দর্শনের ধরনটাই এমন যে এই দর্শনের অনুগামীরা আস্তে আস্তে আরও গোঁড়া হয়ে পড়বে । হয়েছিলও তাই । এই ঘরানা থেকে বেরিয়ে এল ইমাম হাম্বল(৭৮৬-৮৫৫)। তার মত ইসলামের সবচেয়ে গোঁড়া মত হিসাবে খ্যাত । মূল আরবে এখনও হাম্বলি ঘরানার প্রাধান্য লক্ষণীয় । এই ঘরানা প্রসব করেছিল আরও এক ভয়ঙ্কর দানবকে , যে ইসলামের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল । ইমাম গাজ্জালী(১০৮০-১১১১ খ্রীঃ)। এই প্রসঙ্গে পড়ে আসছি ।
যাই হোক , সেই সময় মুতাজিলা দের ধ্বংস করেছিল আল আশারী (৮৭৩-৯৩৫)এক জন প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন । মুতাজিলাদের যুক্তি পদ্ধতি ও হাম্বলি সিদ্ধান্ত কে হাতিয়ার করে তিনি এবং তার মুষ্টিমেয় কিছু (হাম্বলি) অনুগামী মুতাজিলাদের তীব্র সমালোচনা শুরু করলেন। এবং রাজানুগ্রহ লাভ করে ফুলে ফেঁপে উঠলেন । রুদ্ধ হল ইসলামের অগ্রগতির দ্বার । হাম্বলি দের সাথে যৌথভাবে তিনি ধ্বংস করেছিলেন মুতাজিলা দের । পরবর্তীকালে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেই হাম্বলি রা যুক্তিবাদ কে ইসলামের ধারে কাছে আস্তে দেয় নি ।
কিন্তু এই পদ্ধতি সূফীদের থামাতে পারছিল না । কেননা , সূফীদের মূল শক্তি ছিল তাদের সঙ্গীত । কেননা একাদেমিক জ্ঞান যে শ্রেণীর মানুষদের কাছে পৌছতে পারে না, তাদের কাছে শুধু নয় , খুব সহজেই তাদের হৃদয়ের মর্মস্থলে পৌঁছে যায় সঙ্গীত । একে আটকানো এতটা সহজ নয় । এ অনুভূতির বস্তু । একে যুক্তি দিয়ে রোধ করার চেষ্টা করলে ব্যর্থ হতেই হবে ।
ইসলাম পন্থী রা বুঝলেন যে , এক আধজনকে হত্যা করে লাভ কিছুই হবে না । যেভাবে সূফীরা দিন দিন বাড়ছে , তাতে ইসলামের আকাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে বাধ্য । তাছাড়া তারা আস্তে আস্তে এত সংগঠিত হয়ে উঠছে যে তাদের উপেক্ষা করা যায় না , তারা যেহেতু ইসলামের বাইরে যায়নি , রাজনৈতিক ক্ষমতা ও দাবী করেনি কখনো , তাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাও মুশকিল । তাহলে এখন কি উপায় ?
ইসলামের ইতিহাস মূলত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব , বিশ্বাসঘাতকতা আর অন্তর্ঘাতের ইতিহাস । তাই তারা খুব সহজ উপায় গ্রহণ করেছিল । আর তা হল অনুপ্রবেশ ও অন্তর্ঘাতের ষড়যন্ত্র । গোঁড়াপন্থি দের অনেক কে অনুপ্রবিষ্ট করা হয়েছিল সূফী সন্ত দের শিষ্য করে। এবং এর ফলশ্রুতি – একশ বছরের মধ্যেই লক্ষ্য করা গেল সূফীরা বিভিন্ন দল ও উপদলে ভাগ হয়ে গেল ।
ইতিহাসে এই সময়টাকে (৯০০ – ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) সূফী মতবাদের দ্রুত বিকাশের সময় হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। খালি উপদল ও গোষ্ঠীতে বিভাজন ই নয়। বরং প্রতিটি শাখা নিজেদের মত এবং পথের কথা নিয়ে অনেক অনেক গ্রন্থ রচনা করতে থাকে। ছরিয়ে পরতে থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে । কিন্তু আসলে এই সময়টা বলা যায় , নিভে যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো জ্বলে ওঠার সময়। প্রকৃত পক্ষে এই টা দ্রুত বিভাজন , মতানৈক্য এবং দুর্বল হয়ে যাওয়ার সূচক । তাছাড়া এই সময়ে মুতাজিলাদের পতন ঘটায় সূফীরা একটা বড় সমর্থন হারায় ।
এই সময়কার সূফীদের দুটি ভাগে ভাগ করা হয় , “সুক্র্” -- যারা যাদের বক্তব্য ছিল অবাধ ও নির্ভয় । আর “শ”—যারা খুব সংযত ভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করতেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা আদি পর্যায়ের সূফীদের বিরুদ্ধ মত পোষণ করতেন , যদিও বাহ্যিক আচরণে সূফী সাজতেন ।
এই সময়(৯৫০ খ্রীঃ নাগাদ) হঠাৎ অদ্ভুত ভাবে একটি অতি সন্দেহজনক সূফী শাখার আবির্ভাব ঘটে , খফিকী শাখা । এই শাখার মতাদর্শে আশারিয় দর্শনের প্রভাব প্রবল । সূফী দের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কাশফ-উল- মাহজুব’ নামক গ্রন্থে লেখক হযরত দাতা গঞ্জ বক্শ্ এই শাখার কথা উল্লেখ করেছেন , যাদের গুরুশিষ্যের তালিকা পাওয়া যায় না। এদের মতবাদ তিনি তার গ্রন্থে সংযুক্ত করলেও , কেন এদের সঠিক বিবরণ লেখেন নি , বা তথ্যহীনতা সত্ত্বেও লেখক কেন এই শাখা কে সন্দেহ করেন নি , টা নিয়ে যথাসময়ে আলোচনা করা হবে । এই সূফীরা অন্যান্য সূফী দের মতো জীবনাচরণে বিশ্বাসী ছিলেন না।বরং শরিয়তি সমস্ত নিয়ম মানতেন । নামাজ রোজা ও যাকাত নিয়ে এযাবতকাল পর্যন্ত সূফীদের পরনে থাকতো চটের পোশাক , যা আগে কোনও সূফী ব্যাবহার করেন নি । আর একটি বিশয়ে অন্যান্য সূফী দের সাথে তাদের মতপার্থক্য ছিল । সেটা হল তারা নিজেকে আল্লাহ-র বন্ধু না বলে আল্লাহ-র দাস বলে ভাবতেন । সহজেই এই সিদ্ধান্ত করা চলে যে সূফীদের ইতিহাসে এটি একটি বিশ্বাস ঘাতক শাখা , এবং এরা একা ছিল না । আরও কয়েকটি শাখা নিশ্চয়ই ছিল , যাদের কথা জানা যায় না । তবে তারা সকলেই “শ” ছিল।
এভাবে সূফী আন্দোলন দুর্বলতর হতে শুরু করলো । সাধারণ লোকের সূফীদের প্রতি বিশ্বাস কমে যেতে শুরু করলো । এই সময়ে আবির্ভুত হলেন হযরত দাতা গঞ্জ বক্স ও আল গাজ্জালি । মহান সূফী হিসাবে খ্যাত দাতা গঞ্জ বক্স “কাসফ উল মাহজাব” গ্রন্থ লেখেন , যা বর্তমানে সূফীদের মধ্যে সর্বাগ্রে স্থান পায় , তাতে সূফীদের নিন্দা করা হল এবং শরিয়ত মেনে চলার আদেশ দেওয়া হল । এর পর আবির্ভাব হয় মহাদানব আল গাজ্জালি-র । তিনি প্রথম জীবনে শাফেয়ী সুন্নি ছিলেন । তিনি মূলধারার ইসলামের পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন । আশারিয় মত ও যুক্তিপদ্ধতি সম্পরকে ছিল তার অগাধ জ্ঞান । মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি নিজামিয়া বিস্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদ পেয়েছিলেন । রাজানুগ্রহে দিন তার ভালই কাটছিল , আচমকা কোনও এক অজ্ঞাত কারনে তিনি সূফী মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন । তিনি যে উচ্চাভিলাষী ছিলেন সে কথা স্যর সৈয়দ আমির আলি তার দি স্পিরিট অফ ইসলাম গ্রন্থে স্বীকার করে নিয়েছেন । রাজ নির্দেশে তিনি এ কাজ করেছিলেন কিনা জানা যায় না , তবে ইঙ্গিত একটা পাওয়া যায় । তিনি নিজেকে সর্বদায় শাফেয়ী মাযহাবের বলে দাবী করতেন। কখনই সূফী বলতেন না । “ইবনে খাল্লিকান যথার্থই বলেন যে আল গাজ্জালি শাফেয়ী মতবাদের পণ্ডিত ছিলেন । “জীবনের শেষ দিকে শাফেয়ী মাযহাবের ভেতর তার সাথে তুলনা করার মতো কেউ ছিল না ।”—দি স্পিরিট অফ ইসলাম , স্যর আমির আলী । তিনি সেইসময়কার সূফীদের সাক্ষাত পেয়েছিলেন খানকায় , অর্থাৎ পউত্তলিকদের মতো মঠ বা আশ্রমে । তারপর তিনি সূফী ও মুতাজিলাদের মতের বিরুদ্ধে একটি বই লিখলেন, “তহাফুত উল ফালসিফা” অর্থাৎ দার্শনিকদের বিনাশ । সেখানে তিনি সূফীদের “বেশারা” বা নিয়ম বহির্ভুত বলে ফতওা দিলেন । গোঁড়া ইসলামী মতকে সমর্থন করে বললেন মানুষের চিন্তার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে । একেরপর এক গ্রন্থ লিখে তিনি সূফী মতবাদের উপর আঘাতের পর আঘাত করে চললেন । বন্ধ করে দিলেন ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন করার সকল পথ। ফলে সূফীদের বিরুদ্ধে গোঁড়া ইসলামের বিজয় হয় । “বিকাশশীল সমাজের ভিত নড়ে যায় এবং প্রগতিবাদের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়”-ইসলামের ইতিহাস, সৈয়দ আব্দুল হালিম । এসব সত্ত্বেও তিনি কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে মোহম্মদের পর আবির্ভূত জ্ঞানী হিসাবে অভিহিত হন । তার প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে ঐতিহাসিক ফিলিপ কে হিটটি ও মনে করেছেন যে আশারি ও গাজ্জালির জন্যই ইসলামী বিস্ব এখনো নিশ্চল অবস্থায় দারিয়ে রয়েছে। তিনি তার সারা জীবনে ৭০ এর থেকেও বেশি গ্রন্থ লিখে সূফী মতবাদকে গোঁড়াপন্থি ইসলামী মতে রুপান্তরিত করেন । এই সময় থেকে আস্তে আস্তে সূফীবাদ ইসলামের বিরুদ্ধ পথ থেকে সরে গিয়ে ইসলাম প্রচারের মেশিনে পরিনত হয় ।
সে যাই হোক , সূফীরা তাদের মতবাদ নিয়ে ছড়িয়ে পরেন দেশে দেশে ।এবং নিজে নিজের মত প্রচার করতে লাগলেন । তাদের মধ্যে অনেকে ভারতবর্ষেও আসেন । তবে ভারতবর্ষে যারা মতপ্রচার তারা প্রত্যেকেই শ সম্প্রদায়ভুক্ত । এরা সুফিবাদ প্রচার করতে আসেন নি । এসেছিলেন ইসলাম এর প্রচার করতে । কারন, ভারত হল ইসলামের আদি পিতা আদম এর জন্মস্থান । আর সেখানেই মূর্তিপূজা সর্বাধিক প্রচলিত । এখাঙ্কার ভুমি পুন্যভুমি । এখাঙ্কার মানুষ জ্ঞানী । তাই ইসলামকে পৌত্তলিকতা মুক্ত রাখতে গেলে ভারতবর্ষকে দখল না করে তা করা যাবে না । ভারতে আগমনকারী সূফী দের প্রধান সম্প্রদায়গুলি আমরা দেখে নেব । এবং এরই মধ্যে আমরা বিচার করে দেখে নেব যে , এদের মধ্যে আদি পর্যায়ের সূফী দের বৈশিষ্ট্য ছিল কিনা ।
প্রশ্ন হতে পারে , এখানে কি সুক্র্ সূফী একজন ও আসেন নি নিজ মত প্রচারে ? হয়ত এসেছিলেন । কিন্তু ইসলামী শাসকদের অনুগ্রহ তারা পান নি বলেই তারা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যান । বাকিরা ইসলামী শাসকদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতেন ভারত কে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ।
ভারতে যে কয়টি সূফী সম্প্রদায় এসে নিজ নিজ মতের প্রচার চালায় , তারা ঠিক কতটা নিজ মতের প্রচার চালায় তা আমরা পরে আলচনা করব । ভারতে মোট প্রচার কাড়ি মোট আট টি সম্প্রদায় এর কথা সবিস্তার জানা যায় । এদের মধ্যে চার টি খুব বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল । সেগুলি হল—
১)চিসতী শাখা :- ভারতবর্ষে এই শাখা সর্ব প্রথম আসে আনুমানিক ১১৯০ খ্রিস্টাব্দে খ্বাজা মইনুদ্দিন চিশতী –র হাত ধরে । এই শাখার সবচেয়ে বিখ্যাত দুইজন সূফী হলেন তিনি নিজে এবং নিজামুদ্দিন আউলিয়া । খ্বাজা মইনুদ্দিন চিশতী হিন্দু ধর্ম কে গভীর ঘৃণা করতেন । আজমীর এসে তিনি অনেকগুলি দেব মন্দির দেখতে পান । এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ওগুলি ধ্বংস করার অঙ্গীকার করেন । তার রীতিমত সেনাদল ছিল । তিনি প্রতিদিন একটি বিখ্যাত মন্দিরের সামনে হিন্দুদের পুবিত্র মনে করা গরু জবাই করতেন ও এবং তার কাবাব বানিয়ে খেতেন । এটি তিনি করতেন শুধুমাত্র হিন্দুদের প্রতি গভীর ঘৃণা প্রদর্শনের জন্য । তিনি হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র দুটি হ্রদ আনাসাগর ও পান্সেলা শুকিয়ে দিয়েছিলেন চক্রান্ত করে । দয়ালু হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান এতবার মোহম্মদ ঘরি কে ক্ষমা করে ছেড়ে দিয়েছিলেন , তার বিরুদ্ধে ঘরী র বিশ্বাসঘাতী যুদ্ধে তিনি ঘরী-র সাথে হাত মিলিয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন । পৃথ্বীরাজ চৌহান পরাজিত হলে তিনি তার জেহাদী উদ্দিপনায় এই বিজয়ের গৌরব নিজের কাঁধে নিয়ে বলেন , “আমরা পৃথ্বীরাজ কে জীবন্ত আটক করে ইসলামের বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছিলাম” । নিজামুদ্দিন আউলিয়াও মইনুদ্দিনের পথেই হেঁটেছিলেন । তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে একাধিক সুলতানের অভিজানে অংশ গ্রহন করেছিলেন । তিনি নিয়মিত হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিশদ্গার করেছেন । সুলতান আলাউদ্দিনের জিহাদে তার সঙ্গ দেওয়ার জন্য প্রাপ্য গনিমতের প্রচুর উপহার তিনি গ্রহন করতেন এবং গরব ভরে দেখাতেন সকল কে । তিনি বাংলার সিলেটের রাজা গৌরগোবিন্দের বিরুদ্ধে জেহাদে অংশ গ্রহন করার জন্য বাংলার শ্রেষ্ঠ সূফী শাহজালাল কে ৩৬০ জন ভক্তসেনা সহ প্রেরন করেন । তারা পিছন থেকে হানাদারী কারমন চালিয়ে গৌরগোবিন্দ কে পরাজিত করে ।সঙ্গে সঙ্গে চলে কয়েক হাজার হিন্দু নাগরিক হত্যা ও বাকিদের তলোয়ারের ডগায় ধর্মান্তরন । নিজামুদ্দিনের শীশ্য আমির খসরু সর্বদায় তার কবিতায় হিন্দুদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতেন । খিজির খাঁ চিতর বিজয়ের পর যে তিরিশ হাজার হিন্দুর শিরচ্ছেদ করেছিলেন ,তার জন্য তিনি আল্লাহ্ কে ধন্যবাদ দিয়েছেন । মালিক কাফুর যখন দক্ষিন ভারতের কেতি মন্দির ধ্বংস করে সেখানকার ব্রাহ্মণদের নৃসংশ ভাবে হত্যা করেছিলেন, তখন তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লিখেছিলেন , “মোহম্মদের ধর্মের বিজয়ের জন্য আল্লাহ্ কে ধন্যবাদ । কোনও সন্দেহ নেই , যে পাথর কে গাওয়ার রা পুজ করে , তা তাদের কোনও কাজে আসে নি , তারা পরপারে গেল শুধু পূজার অরথহীনতার সাক্ষ্য বহন করে”। এরকম অনেক নৃশংসতার তিনি আনন্দের সাথে কাব্যিক বর্ণনা দিয়েছেন , অনুশোচনার নাম গন্ধ কখনই তার কাব্যে প্রকাশ হয়নি ।
সুহরাওয়ার্দী :- এই শাখা এসেছিল একাদশ শতকের মধ্যভাগে । তবে এই শাখার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ইসলামী পণ্ডিত শেখ মোবারক গজ্নবি । তিনি অমুস্লিমদের প্রতি প্রচন্দ ঘ্রীনা প্রকাশ করতেন । তিনি বলতেন “হিন্দু ও বৌদ্ধদের নাস্তিকতা ও মূর্তিপূজা উচ্ছেদ না করলে আল্লাহ্ ও নবীর বিরুদ্ধাচার করা হবে । ওদের সংখ্যাধিক্যের কারনে যদি সম্পূর্ণ বিলোপ না ও করা যায় , তাহলে তাদের প্রতিনিয়ত অসম্মান ও অমর্যাদা করতে হবে । এরা আল্লাহ্ ও নবীর নিকৃষ্টতম শত্রু”।
এই শাখার এক সূফী দিল্লীর শেখ রুকন্-উদ্-দিন তুলনামুলক ভাবে অনেক উদার ছিলেন । উগ্র মুসলিম শাসক ফিরজ শাহ তুঘলক তার আত্মিজবনী তে বলেছেন যে , “রুকন্-উদ –দিন নিজেকে আল্লাহ-র প্রতিনিধি মেহদী বলে ঘোষণা করেছিলেন (সুন্নি মতবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে ), তাই তিনি তাকে বন্দী করেন” । পরে জনগন তাকে ও তার ভক্তদের হত্যা করে এই শাসকের উস্কানিতে তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ও তার হাড় গুলোকে খণ্ড খণ্ড করে দেয়। এ থেকেই বোঝা যায় শাসকদের সহায়তা ছাড়া ভারতে সূফী দের মত প্রচারের কোনও অধিকারই ছিল না ।
এরপর দিল্লীতে এই শাখায় সৈয়দ জালালুদ্দিন বুখারী নামক এক সূফীর আবির্ভাব ঘটে , তিনি মকদুম্-ই-জাহানিয়া নামে বিখ্যাত ছিলেন ।হিন্দুদের তো তিনি চরম ঘৃনা করতেনই , এমনকি মুসলমানদের মধ্যে জমে ওঠা হিন্দু সংস্কারগুলির (যেমন সব-এ বরাত , যা দীপাবলির অনুকরন ছাড়া বাস্তবে আর কিছুই নয়) বিরুদ্ধে তিনি প্রচার চালাতেন। তিনি ফিরোজ শাহ তুঘলকের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে হিন্দুদের ধরমান্তরিত করতেন । গুজরাতে বহু সম্ভ্রান্ত হিন্দু কে তিনি বাধ্য করেছিলেন ইসলাম গ্রহন করতে । তার পুত্র ও পৌত্র একই কাজ করে গেছেন বংশ পরম্পরায় ।
ফেরদৌসীয়া :- এই শাখার উদ্ভব হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে । এদের মধ্যে হিন্দু বৌদ্ধ সংস্কৃতির তীব্র প্রভাব ছিল । এই শাখার সবচেয়ে বিশিষ্ট সূফী ছিলেন শেখ শরাফুদ্দিন আহমেদ বিন ইয়াহিয়া মনাইরী । তিনি প্রথম জীবনে অরন্যে কঠিন সাধনায় রত ছিলেন । তার পত্রাবলী থেকে জানা যায় তিনি শিক্ষক ও আধ্যাত্মিক গুরু হিসাবে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন । কিন্তু তিনি গোঁড়া মুসলিমদের নজরে পরেন । শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলক গোঁড়া মুসলিমদের দিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে থাকেন ও তার একাধিক বন্ধু ও সমগোত্রীয় সুফিকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেন । শেখ শরাফুদ্দিন তার পত্রে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন , সে শহরে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে , তা কিভাবে আল্লাহ্র হাতে ধ্বংস না হয়ে টিকে থাকতে পারে ! তিনিও নিহত হতেন , কিন্তু মখদুম -ই- জাহানিয়া এর হস্তক্ষেপের ফলে তিনি বেঁচে যান । এরপর সারা জীবন তিনি চুপ থাকেন ।
নক্সবন্দী শাখা :- এই শাখার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খ্বাজা আহমেদ আতা ইয়েসবী । ১১০০ খ্রীস্তাব্দের আসেপাসেই তিনি এই শাখার প্রতিষ্ঠা করেন । এরাও হিন্দু –বৌদ্ধ মতাদর্শের দ্বারা চুরান্ত ভাবে প্রবাবিত হয়েছিল । এই শাখার একাধিক বিখ্যাত সূফী ছিলেন যারা আদ্যাত্মিক সিক্ষক হিসাবে আদর্শ ছিলেন । কিন্তু তা সত্ত্বেও এই মোট জনপ্রিয় হয় নি । কারণটা বুঝতে পেরেছিলেন সূফী আশ্রাফ জাহাঙ্গীর সামনানী । তিনি বুঝেছিলেন এই শাখা শরিয়ত না মানার জন্যই জনপ্রিয় হচ্ছে না । রাজানুগ্রহ পাচ্ছে না ।ফলে তিনি নরম শরিয়তি পন্থা গরহন করেছিলেন । তাতেও কাজ দেয়নি । প্রায় ২০০ বছর পর খ্বাজা বাকী বিল্লাহ সমস্ত ‘ঘৃন্য’ পউত্তলিক আচার আচরণকে বর্জন করেছিলেন ।এর পর স্বাভাবিক ভাবেই রাজানুগ্রহ এবং জনপ্রিয়তা আসে ।
এই নিয়ে আরও বিস্তারিত আলচনা না করে আমরা মূল বক্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারি । আমরা দেখলাম , জেসব সূফী ঘরানা ভারতে তাদের মত প্রচার করেছিলেন তারা প্রত্যেকেই হিন্দু- বৌদ্ধ দের ঘৃণার চখে দেখতেন । তাদের ধরমান্তরিত হতে বাধ্য করতেন ,কখনো লোভ কখনো ভয় দেখিয়ে। এবং এই একই ফরমুলাতে তারা রাজানুগ্রহ ও জনপ্রিয়তা লাভ করতেন । এবং জেসব সূফীরা তা না করতেন , তাদের তা করাতে বাধ্য করা হত । নয়ত তাদের বিলুপ্তি ঘটতো ।
ভারতে এইসব প্রচারক শ্রেনীর বৈশিষ্ট্য গুলি আমরা দেখে নেব । বোঝার চেষ্টা করব এদের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের সূফীদের বৈশিষ্ট্য কতটা ছিল ।
প্রথমত , প্রথম পর্যায়ের সূফীরা ইসলামের মূলধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন । কিন্তু এরা কখনই তা করেন নি । নিজামুদ্দিন আউলিয়া বলেছেন, “ উলেমারা যে কাজ করতে চান বক্তৃতা দ্বারা , আমরা তা করে দেখাই আচরন দ্বারা”।
দ্বিতীয়ত , প্রথম পর্যায়ের সূফীরা শাসকশ্রেণীর নেক নজরে কোনোদিনই ছিলেন না । কিন্তু এরা শাসক শ্রেনীর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতেন ভারত কে ইসলামী রুপ দিতে ।
তৃতীয়ত, প্রথম পর্যায়ের সূফীরা কখনই রাজনীতি তে মন দেন নি । কিন্তু এরা সর্বদায় প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন ।
চতুর্থত, প্রথম পর্যায়ের সূফীরা ছিলেন মুলত শাসক শ্রেনী । কিন্তু এদের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী ছিল । এবং ইসলামী শাসকদের তারা সাহায্য করতেন অমুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ।
পঞ্চমত, প্রথম পর্যায়ের সূফীদের বিষয়বাসনা ছিল না । তারা ঘৃনাভরে সেসব প্রত্যাখ্যান করতেন । কিন্তু এরা যুদ্ধজয়ের পর ইসলামী শাসকদের কাছ থেকে গনিমতের প্রচুর সম্পদ গ্রহন করতেন ।
সর্বোপরি , প্রথম পর্যায়ের সূফীরা ইসলামের মূল ধারায় চলে আসা মুসলিমদের নিজ মতে দীক্ষিত করে মূল ধারা থেকে সরিয়ে আনতে চাইতেন । কিন্তু ভারতের সূফী রা নিজ মতে দীক্ষিত না করে অমুসলিমদের ইসলামে দীক্ষিত করতেন ।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি , এদের আচরন প্রথম পর্যায়ের সূফীদের ঠিক উল্টো । সূফী মত মূলধারার ইসলামের ষড়যন্ত্রের ফলে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়েছিল । ইসলামের ভেতরের বিদ্রোহী গোষ্ঠী পরিনত হয়েছিল ইসলাম প্রচারের মেশিনে ।
তারা যে ভারতে নিজেদের অনুগামীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই । এই বিষয়ে আধুনিক কালের সমস্ত ঐতিহাসিক প্রায়ই ঐক্যমত পোষণ করেন । এই বিষয়ে এম এ খান এর ‘ইসলামিক জিহাদ’ গ্রন্থে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
(কাজের চাপে লেখার দিকে তেমন জোর দিতে পারছি না , তাই ভাশার কিছু ত্রুটি থেকে যেতে পারে , ত্রুটি মার্জনীয় ।)
(ক্রমশ)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


