যে মানুষটি অনেক দুরের ছিল, সে যে আমার কত কাছের ছিল আমি বুঝিনি। এত নির্বিকার, শান্ত-সমাহিত, ধৈর্য্যের প্রতিমূর্তি (আমার দেখামতে) মানুষটাকে আমরা কেউ চিনতে পারিনি। যখন বুঝতে পেরেছি বলে ভাবছি, তিনি তখন দুর আকাশের গায়ে তারার মতো হয়ে গেছেন। ধরা যাবেনা, ছোয়া যাবেনা, বলা যাবেনা কথা। একটা অনতিক্রম্য দুরত্ব আগেও ছিল। এখন সেটা কত ব্যপক তা বোঝাতে পারবোনা।
আমার দেখা মতে, আমার আব্বা ছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। কি তার গড়ণ, গঠণ, রং। শরীরের প্রতিটি অংশ যেন যত্নে তৈরী একটি পুতুলের এক একটি টুকরো। এত সুন্দর মানুষটি আমার আব্বা এটা আমাদের এক গর্বের বিষয় ছিল। ছোট বেলায় আব্বাকে যখন নামাজ পড়তে দেখতাম, কোরান শরীফ পড়তে দেখতাম, তার সেই সমাহিত রূপটি এখনও চোখে ভাসে।
কত কথা মনে পড়ে! আমরা ছিলাম অনেকগুলো ভাই-বোন। আমি সবার ছোট। মাঝে মাঝে আমরা ঠাট্টা করে বলতাম একটা পুরো ফুটবল টিম (বাবা-মা সহ)। ফুটবলের কথায় মনে পড়লো আমার বাবা সম্পর্কে আমার এক চাচার কথা। তখন বাংলাদেশে এশিয়ান যুব ফুটবল চলছে। আমাদের একটা সাদা কালো টিভি ছিল। আমার আব্বা যিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে মসজিদে পড়েন সেই আব্বাকে দেখি এক সন্ধ্যায় এশা-র নামাজ বারান্দায় পড়ছেন। আমরা তো অবাক কি ব্যাপার! আম্মা বললেন, 'আজকে মনে হয় খেলা আছে বাংলাদেশের তাই ঘরেই নামাজ পড়ছেন'। সন্ধ্যায় আমার সেই চাচা এলেন, তার ছেলেরা এলো, আমার দুই বন্ধু এলো, ভাইরা, বোনরা তো আছেই। মা ব্যস্ত চা নাস্তা নিয়ে। আব্বা আর চাচা চেয়ারে, আমি বসেছি আব্বার পায়ের কাছে। চাচা বল্লেন, 'তোর বাপের পায়ের কাছ থেকে সর। নইলে কোন সময়ে লাথি খেয়ে শেষ হয়ে যাবি বলা যায়না'। আব্বা হাসেন, চাচা হাসেন, আমরা সবাই হাসি। আব্বা নাকি একসময় ভাল ফুটবলার ছিলেন এবং ছিলেন রণভাগের খেলোয়াড়।
আমার দেখামতে, আব্বার পড়াশোনার কোন সাবজেক্ট ছিলনা। বুভুক্ষুর মতো সামনে যা পড়তো তাই পড়তেন। শুনেছিলাম আব্বা লেখাপড়ার প্রতি বেশী আগ্রহী ছিলেন। দাদাভাইয়ের জীবিতাবস্থায় বাপের ব্যবসার হাল ধরেছিলেন কলেজে পড়াকালীন। তাঁর বড়ভাই রাজনীতি করতেন, ফেনীর প্রথম মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। তিনি অস্বীকার করেছিলেন বাপের ব্যবসার হাল ধরতে। অগত্যা কলেজ ফেলে আমার বাবাকেই হাল ধরতে হয়েছিল বাপের জোরাজুরিতে। কিন্তু কোনদিন কোন কমপ্লেন শুনিনি আব্বার কাছ থেকে এজন্য। পড়ার অভাবটা আউট বই আর পত্র পত্রিকা পড়েই মিটিয়েছিলেন। ইত্তেফাক থেকে কিশোর পত্রিকা, মাসুদ রানা, কুয়াশা, দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরাম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জুলভার্ন, সমরেশ বসু, হুমায়ুন আহমেদ, এমনকি আরজ আলী মাতুব্বর, কোন কিছুই বাদ নাই। আমাদের পড়ার অভ্যাসটা তৈরী করে দিয়েছিলেনও তিনি। স্কুলে আমার নামই হয়ে গিয়েছিল 'কুয়াশা'।
আব্বাকে আমরা ভয়ই পেতাম। আমার মনে আছে, শুধু আমরা কেন আমাদের আশেপাশে আমাদের যত আত্মীয়-স্বজন থাকতেন তারা সবাই আব্বা কাছাকাছি থাকলে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠতেন। একটু আগের আমাদের চিৎকার, চেঁচামেচি বন্ধ, 'মেয়েরা করেছে চুপ' টাইপ অবস্থা হতো আব্বা বাইরে থেকে ঘরে এলে। কিন্তু কেউ কখনো তাঁকে ঘরে বা বাইরে চিৎকার, চেঁচামেচি, গালাগালি, ইত্যাদি করেছেন বলতে পারবেনা। তাঁর মৌণ ব্যাক্তিত্বই তাঁর আশপাশকে কন্ট্রোল করতো। অসাধারণ তার সেই ব্যাক্তিত্ব। আমি তার রাগ দেখেছি, ব্যাক্তিত্ব দেখেছি।
লেখাপড়ায় আমরা কোন ভাই বা বোনই তেমন কিছু ছিলাম না, শুধু আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইটি ছাড়া। সে ভাল ছাত্র ছিল নি:সন্দেহে। ছোটবেলায় আব্বার কাছাকাছি যাওয়ার 'হেডম' ছিল আমাদের ছোট তিন ভাই-বোনের। একটু বেশী বয়সের সন্তান বলেই কিনা কে জানে। হঠাৎ কখনো কোন একটি অঙ্ক পারছিনা, ইংরেজী সেন্টেন্স হচ্ছেনা, এজন্য তার কাছে যেতাম, তিনি সমাধান করে দিতেন। কিন্তু তা হতো কদাচিৎ। অন্যদের এই সাহসও ছিলনা।
আব্বার সাথে মসজিদে যাওয়া, বাজারে যাওয়া ইত্যাদিতে আমি প্রায়শ: থাকতাম। বাজারে যাওয়ার সময় আব্বা বলতেন '... চলো'। আমি সাথে সাথে আম্মার কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে রওনা। বাজারে বেশ মজা হতো, যেমন- কোন মাছ কিনতে আব্বা দোকানীকে বলতেন কত করে? সে আমাকে বলতো ছোট মিয়া বাজারের ব্যাগ খোলো। এমন দিনও গিয়েছে আব্বার পকেটে টাকা নেই কিন্তু বস্তাভর্তি বাজার বাসায় নিয়ে এসেছেন।
মনে আছে একদিন আমাদের বাসায় একটা 'মানিঅর্ডার' এলো। আম্মা-আব্বাকে বলছেন টাকা না নিতে। আমরা অবাক হয়ে শুনছি। ঘটনা হলো, এক ভদ্রলোক আব্বার কাছ থেকে সম্ভবত ৩০০ টাকা নিয়েছিলেন তার বিয়ের সময়ে ধার হিসেবে। তিনি তখন সে এলাকার 'ডিআইও' ছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা, তায় বন্ধুত্ব । ধার নেয়ার পর প্রায় ৩০ বছর (ঠিক মনে নেই) পর তিনি এ টাকা মানিঅর্ডার করে পাঠিয়েছেন। আমরা ক্ষিপ্ত, কেন তিনি ৩০০ টাকা পাঠিয়ে ভাবলেন সব ঠিক আছে? তখনকার ৩০০ টাকার মূল্যমান এখনকার মতে কত? তিনি একবার আসতেন, দেখে যেতেন আপনাকে তাহলেই তো হতো, ইত্যাদি ইত্যাদি। আব্বা বললেন, 'মানুষটার মনটাকে দেখো। সে অন্তত: ভেবেছে তার ঋণের কথা। ফেরত দিয়ে হালকা হতে চেয়েছে। না দিলেই বা কি হতো!' সেই মানিঅর্ডার-র কপি এখনও আমার কাছে আছে।
প্রায় ২০-২৫ বছর আগে আব্বার কাছে সকাল বেলায় এক ভদ্রলোক এসে বসে আসে। শুনলাম তিনি ছাগলনাইয়ার চেয়ারম্যান। সাথে আরেকজন জবুথবু মানুষ। ঘটনা হলো, ঐ জবুথবু মানুষটি আমার আব্বার কাছ থেকে সম্ভবত ১০০০০ টাকা ধার নিয়েছিলেন তারও ৭/৮ বছর আগে ব্যবসা করার জন্য। ব্যবসা ফেল মেরেছে। আব্বার টাকা ফেরত দিতে পারছেনা। টাকা চাওয়াতে সে আব্বার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কোর্ট রায় দিয়েছে আব্বার পক্ষে ভিটেমাটি ক্রোকের। পাওনা টাকা ও কোর্টের খরচসহ টাকা উদ্ধারের জন্য। ডিক্রিজারী করার জন্য কোর্টের লোকজন এলাকায় উপস্থিত। ঢোল শহরত হবে। আশেপাশে প্রচুর লোকজন মজা দেখছে। এসময় ঐ ভদ্রলোকের ছোট ছেলে এসে আব্বাকে বললো, 'চাচা আমার দাদী আপনাকে ডাকে।' আব্বা গেলেন, ছেলেটার দাদী আব্বাকে বললেন 'দেখেন বাবা, এ ছেলেটার গায়ে একটা জামাও নেই, আমরা না খেয়ে, আধাপেট খেয়ে থাকি। আপনি যদি সব জমি নিয়ে নেন আমাদের মরা ছাড়া আর গতি নেই'। আমার বাবা ঢোল শহরত, লোকজন ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আর আজ এলাকার চেয়ারম্যান এসেছে, টাকার জামিনদার হতে। তিনি বললেন, শুধু মূল টাকাটার (১০০০০/-) জামিন নিচ্ছেন অন্য টাকা যেন আল্লার ওয়াস্তে আব্বা মাফ করে দেন। সেকি হাত ধরাধরির বহর। আশ্চর্য্য, আমার বেকুব (!) আব্বা তাতেই রাজি হলেন। আমরা সবাই ক্ষেপে গেলাম, শুধু আমার আম্মা রইলেন নিশ্চুপ। জানিনা আব্বা টাকা পেয়েছিলেন কিনা? তবে আমরা পেয়েছিলাম একটা শিক্ষা। বদান্যতার, মমত্ববোধের, ত্যাগের।
সারাজীবন নিজের কাজটি নিজে করেছেন। আয় করেছেন, বাজার করেছেন, নিজের কাপড়-চোপড় নিয়ে পরিস্কার করেছেন। নিজের নয়টি ছেলেমেয়ের সাথে নিকট আত্মীয়স্বজনের ছেলেমেয়েদের নিজের বাসায় রেখেছেন লেখাপড়ায় সহায়তার জন্য। নিজের জন্য চাহিদা এত কম ছিল যে বলার মতো না। আমি জীবনের প্রথম বিদেশে চাকরী করতে গিয়েছি। সেখানে প্রতিবছর সেরা কর্মীদের সার্টিফিকেট এবং গিফট দেয়ার নিয়ম ছিল। চাকরীর প্রথম বছর ঘুরতেই আমার মতে ’বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেড়া’র মতো আমার ভাগ্যে তা জুটলো। ঠিক করেছিলাম জীবনের প্রথম পাওয়া পুরস্কার আব্বাকে দেবো। একটা ঘড়ি, সোনালী ঘড়ি। দেশে ফিরে আব্বাকে দিলাম ঘড়িটা। মুখ দেখে বুঝলাম ভীষণ খুশি হয়েছেন কিন্তু বললেন, ’ঘড়ি হাতে দিতে চাই না, মিথ্যা কথা বলা লাগে।’ চুরি যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঘড়িটা উনি ব্যবহার করেছিলেন। কাঁচ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তাই পরতেন। কেন কে জানে! কোন কিছুতে বাহুল্য ছিলনা, ফ্যাশনেবল ছিলেননা। তাঁর যাবতীয় চাহিদা আম্মা কেমন করে যেন জেনে ফেলতেন। আম্মা কখনো কখনো বলতেন তোর আব্বার এটা সেটা লাগবে। এ জুটিটা যে কেমন ছিলেন বলা সম্ভব না। পরস্পরকে কখনও ’তুমি’ সম্বোধন করেননি ’আপনি’ ছাড়া। আম্মা রেগে গেলেও (প্রচন্ড রাগী ছিলেন আমাদের মা) আপনি বলেই কথা শুনিয়েছেন। আর আব্বাতো কথাই বলতেন না আম্মার রাগের সময়। আম্মা বেশী ক্ষেপে গেলে কখনো কখনো বলতেন 'হ্যাঁ আপনি জানেন!' আম্মার অবর্তমানে আব্বাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতাম 'আব্বা আপনার কিছু লাগবে?' সব সময়েই একই উত্তর 'না কিছু লাগবেনা'। একবার বেশী চাপাচাপি করায় বললেন 'ঠিক আছে, তুমিই বলো কি লাগবে!' আমি লা-জবাব।
গত বছরের ৫ জুলাই হঠাৎ পড়ে গিয়ে আব্বার উরুর হাড় ভেঙ্গে গেল। আব্বা ফেনীতে, আমরা ঢাকায়। আমার মেঝভাই গেলেন ফেনীতে । ৬ তারিখে আব্বাকে উনি ঢাকায় নিয়ে আসলেন রাত তখন ১২টা। আমরা চারভাই মিলে আব্বাকে মেঝভাই-র বাসায় চারতলায় তুললাম। আব্বার অসাধারণ সহ্যশক্তি আমি আবার সেদিন দেখেছি। মুখে ব্যথার কোন প্রকাশ নেই। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন। হয়তো লজ্জিত শেষ বয়সে ছেলেদের কোলে চড়তে। বললেন তোমাদের 'কষ্ট হয়ে গেল'। পরদিন ৭ জুলাই আমরা আব্বাকে নিয়ে গেলাম ট্রমা সেন্টারে। সেখানে ডাক্তার দেখলেন, বললেন অপারেশন করতে হবে। ডাক্তার বললেন রক্ত লাগবে, শরীরে রক্ত কম। আমরা সবাই রক্তের ব্যবস্থা করার জন্য ব্যস্ত হলাম। আমার দুই ভাই বোন প্রস্তুত হলো। ওদের রক্তের গ্র“প এবং আব্বার গ্র“প একই। ট্র্যাকশন দেয়া হলো আব্বাকে। আব্বা অস্থির। বললেন সব খুলে দাও। রাত এগারোটায় মেঝভাই ও ভাবী বাদে আমরা সবাই যে যার বাসায় ফিরেছি। কাল আব্বার অপারেশন হবে। সারারাত প্রায় অঘুম। ৮ জুলাই সকাল ৭টায় মেঝভাইকে টেলিফোন করলাম আব্বা কেমন আছে? বললেন ’রাতে একটু অস্থির ছিলেন, এখন ঘুমুচ্ছে।’ আমি বললাম তাহলে আমি অফিস হয়ে আসছি। 'নিচে নামলাম ৮টায় । মেঝোভাইয়ের ফোন 'আব্বা কেমন যেন করছেন, তুমি তাড়াতাড়ি আসো।'। একটু পরে ভাতিঝির ফোন, 'চাচু তুমি দেরী করছো কেন?' কোন ট্যাক্সী, রিক্সা শ্যামলী যাবেনা। আমি দৌড়াচ্ছি রাস্তায়, আমার স্ত্রীর ফোন, 'তুমি কোথায়! তুমি দাঁড়াও, আমি আসছি'। ও এলো , আমাকে নিয়ে চললো ট্রমা সেন্টারে।
রাস্তায় আবার মেঝো ভাইয়ের ফোন, 'সব শেষ.................'।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




