মানুষের বয়স বাড়লে কি জমা হয় তার। লক্ষ কোটি স্মৃতি ছাড়া? জীবন যাপনের প্রতি পলে। প্রতি সেকেন্ডে এত যে সচেতন থাকি আমরা। নিজের ইগোর গোড়ায় এত যে পানি ঢালি। আদতে কী হয়? এই যে সময়টাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে তা হয়তো স্রেফ হারিয়েই যায়। স্রেফ হারিয়ে যাবার জন্যই একে হয়তো বেশ গুরুত্ব সহকারে যাপন করতে হয়। 2004-এর 14 অক্টোবর হয়তো খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। হয়তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ দিন নয়ও। কিন্তু আমার জীবনের একটা দিনই তো। কিন্তু কী বিস্ময়কর! এই দিনটার প্রতিটি মুহূর্ত আমি সচেতনভাবেই তো কাটিয়েছি, এর অন্যথা ঘটার কথা নয়। অথচ, ফরিদউদ্দিন আত্তার যখন বললেন, জিজ্ঞাসা করলেন, মনে করিয়ে দিতে চাইলেন ওই বিশেষ দিনটাকে কী করছিলাম তখন একটা কথাও মনে পড়লো না। এখন সূত্র ধরে ধরে দিনটাকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছি। অবাক হচ্ছি এই প্রক্রিয়ায় যেতে যেতে। কারণ দিন হিসাবে আপাতত ভুলে যাওয়া 14 অক্টোবরে বিশেষ কিছু ঘটেছিল। কালবেলার 15 অক্টোবর সংখ্যাটা ঝেড়ে মুছে টেবিলে রেখেছি। রাতে বাসায় ফিরে সেটার দিকে বার কয়েকক্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছি। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ে দেখার চেষ্টা করেছি। কী করছিলাম ওই দিন, মনে করার চেষ্টা করেছি। ওই সময় এবং এখনও সংবাদপ্রত্রে কাজ করার সুবাদে আমার ঘুম ভাঙে 10টা কিংবা সাড়ে দশটায়। অনুমান করছি সেদিনও তাই ঘটেছিল। কিন্তু স্পষ্ট করে বুঝতে পারছি না বিশেষ কোনো ঘটনায় এক ঘণ্টা আগে বা পরে ঘুম ভেঙেছিল কিনা। গোসল খাওয়া দাওয়া সেরে অফিসে যাওয়ার কথা। অস্পষ্টভাবে মনে পড়ছে অফিসে যাওয়ার পথে তখন 12টা বা সাড়ে বারোটা বাজে হঠাৎ একটা ফোন এসেছিল। নাকি ফোনটা অফিসে পেঁৗছাবার পর এসেছিল? আমার তখনকার বস রাজ্জাক ভাই ফোন করে বলেছিলেন দুপুর দুইটার মধ্যে আমাকে ফরিদউদ্দিন আত্তারের বাসায় পেঁৗছাতে হবে। রাজ্জাক ভাই ভাল টিম লিডার ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলো নিজে ঠিক করে আমাদের নির্দেশনা দিতেন। নিশ্চয়ই ফরিদউদ্দিন জানেন আমি কোন বিষয়ে কথা বলতে যাচ্ছি। এখন আমার জানাটাই বাকি। রাজ্জাকভাই বললেন, রতন টাটার সঙ্গে সাইফুর রহামনের চুক্তি বিষয়ে কথা বলবেন। ফরিদ সাহেব এককালে বাণিজ্য সচিব ছিলেন প্লাস ভারতে কিছু দিনের জন্য আম্বাসেডরও ছিলেন। ফোন কেটে দিলেন রাজ্জাক ভাই। দিনের পত্রিকাটা সকালবেলা পড়লে হয়তো বুঝতে পারতাম সেদিনকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরটা কী? কালবেলার এডিটরিয়াল পেজের ধারা অনুসারে দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কারো কমেন্ট বা পোস্ট নেয়া হতো। কমেন্ট বা পোস্টগুলো যাতে দ্রুত হাতে আসে এজন্য আমরা নিজেরা গিয়ে নোট নিতাম বা ডিকটেশন নিয়ে লিখে আনতাম। পত্রিকার রেগুলার কলামিস্টরা নিজে থেকেই লিখতেন বা লেখার আগে আমাদের সাথে কথা বলে নিতেন। ডিকটেশন নেয়ার জন্য সাধারণত বেছে নেয়া হতো বয়স্ক রিসোর্স পারসনদের। যারা সাধারণত ব্যস্ত থাকেন, লেখার সময় পান না বা লেখার অভ্যাসটা খুবই কম। ফরিদউদ্দিন আত্তার থাকেন গুলশানে। রোড ও বাসা নাম্বার ভুলে গিয়েছি। বাসার দৃশ্যটা মোটামুটি মনে আছে।
কাওরান বাজার থেকে গুলশান রওয়ানা হওয়ার আগে দিনের একটা পেপার কিনে নিলাম। টাটার বিনিয়োগ বিষয়ে চলতি কিছু কথা জানা ছিল। সেদিনের খবরটা নিজেকে খানিকটা আপডেট করে নিলাম। টাটাগ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের প্রাথমিক সমঝোতা চুক্তি ছিল সেটা। টাটাগ্রুপ বাংলাদেশে 2 বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখাচ্ছিল। বাংলাদেশে কোনো বিদেশি শিল্পগ্রুপের ক্ষেত্রে এটা ছিল সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব। তারা বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল জ্বালানি স্টিল ও ফার্টিলাইজার খাতে। কিন্তু বিনিয়োগ নিয়ে দেশে জোর বিতর্কও শুরু হয়েছিল। এই বিতর্কের সাধারণ কারণ ভারতবিরোধী জনমত। বিশেষ কারণ টাটার কিছু অন্যায্য আবদার ও সে আবদারগুলো পূরণে সরকারের উদ্যোগ। খুব ক্রিটিকাল ইসু্য।
ফার্মগেট থেকে প্রধানমন্ত্রীর অফিস পর্যন্ত দুপুরবেলার জ্যাম মাড়িয়ে গুলশান পেঁৗছাতে পৌনে দুইটা বেজে গিয়েছিল। ফরিদউদ্দিন ফ্লাট বাড়িতে থাকেন। দুই তলায়। গেটের সিকিউরিটি ইন্টারকমে অনুমতি নেয়ার পর আমাকে যেতে দেয়া হলো। দরজা খুলেছিলেন ফরিদউদ্দিন নিজে। হালকা পলকা শরীরের বেটে লোক। পরনে একটা ফতুয়া আর লুঙ্গি।
আপনার নামই কি মাহবুব।
হঁ্যা।
রাজ্জাক কিন্তু আপনার চুল লম্বা এটা বলেনি।
তাহলে কি আপনি ভাবছেন আমি মাহবুব নই?
ততোক্ষণে আমি স্যান্ডেল খুলে ভেতরে ঢুকে পড়েছি।
না, ঠিক তা বলতে চাইনি।
এসব ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখা ঠিক নয়। চট করে পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করে তাকে দেখিয়ে নিমিষেই আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। ঘটনায় খুব অবাক হলেন তিনি। হাসতে হাসতে ঘাড়ে হাত রেখে সার সার ঘরের মাঝখানের লম্বা প্যাসেজ দিয়ে প্যাসেজের শেষ মাথার ওভাল শেপের একটা ঘরে নিয়ে গেলে ন আমাকে। যেতে যেতে দেখলাম তিন চারটা ঘরে তালা লাগানো। আলো জ্বলছে শুধু ওভাল ঘরটিতেই। প্যাসেজটাও মোটামুটি অন্ধকার। আমাকে বসতে দিয়ে উধাও হয়ে গেলেন ফরিদউদ্দিন আত্তার।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



