কখনও স্মৃতি পাহারা দেবার সময় আসে
মাহবুব মোর্শেদ
‘চোখের দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হয়ে আছে স্থির’ জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ থেকে ডায়েরিতে প্রিয় কিছু লাইন, কিছু স্তবক টুকে রেখেছেন আনোয়ার পাশা। একের পর এক লাইনগুলো পড়ে যেতে থাকিÑ ‘এই পৃথিবীর ভালো প্রিয় রোদের মতোন তোমার শরীর’। দিনক্ষণ লেখা নেই, বাঁকা নদীর মতো নীল অর জাদুঘরের স্বচ্ছ কাচের সংগ্রহের ভেতর থেকে কথা বলে। হয়তো কোথাও লেখা আছেÑ বাংলার মুখ আমি আমি দেখিয়াছি...। কিংবা তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাওÑ আমি এই বাংলার পারে / রয়ে যাব; তিনি রয়ে গিয়েছিলেন, বাংলায়, ঢাকায়। ‘রাইফেল রোটি আওরাতে’র লেখক তার স্বপ্নের স্বাধীনতার সাধ ঢাকায় বসেই কি পেতে চেয়েছিলেন? কেন দেশান্তরি হননি, বেছে নেননি প্রবাসের উদ্বাস্তু জীবন? তিনি তো স্পষ্ট জানতেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে আর এ জন্য মূল্য পরিশোধ করতে হবে রক্ত দিয়ে। তিনিই তো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উত্থানকে বিজয়েরই বার্তা বলে নিজেরই উপন্যাসে উল্লেখ করেছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন কেন তাকে মারবে পাকিস্তানিরা। তিনি তো আর যুদ্ধে যাননি!
কেন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে শাসক-শোষকরা? কেন লোরকাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মাথায় গুলি করে করে পথের ধূলায় লুটিয়ে দেয় ফ্রাঙ্কোর গুণ্ডরা, ব্লাক স্কোয়াড যাদের সরকারি নাম। স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের সময় ফ্যাসিস্টরা আওয়াজ তোলেÑ বুদ্ধিজীবীদের খতম করো। পঁচিশে মার্চের প্রথম আঘাতের অন্যতম লক্ষ্য ছিল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স লাউঞ্জ, শিক্ষকদের বাসা, সংবাদপত্রের অফিস। তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছিল লেখক-শিল্পীদের। গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ম্ময় গুহঠাকুরতা, মেহেরুন্নেসা, এএনএম মুনীরুজ্জামান প্রথম রাতেই ঘাতকের বুলেটে লুটিয়ে পড়েন। টিচার্স লাউঞ্জের রক্তাক্ত কার্পেট জাতীয় জাদুঘরের আলো-আঁধারির মধ্যে এখনও সেই রক্তাক্ত রাতের কথা বলছে। আমরা কি প্রস্তুত সে কথা শুনতে? আমরা না জানি, সেই রক্তস্নাত স্মৃতিচিহ্নগুলো স্পষ্ট জানে কেন খুন হন বুদ্ধিজীবীরা। জাদুঘরে সংরক্ষিত বস্তুগুলো আমাদের সরাসরি ইতিহাসের মখোমুখি দাঁড় করায়। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর লিখিত ইতিহাসে যে বিকৃতির, সত্যের অপলাপের সম্ভাবনা থাকে তা এই বস্তুগত ইতিহাসে ঘটানো কঠিন। তাই শুধু স্মৃতিচিহ্ন নয়, অতীতকে পাঠ করার ক্ষেত্র এই বস্তুগুলো অমূল্য।
হয়তো জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহ সামান্য। একে সমৃদ্ধ করার অনেক সুযোগ আছে। কিন্তু যা আছে তা কি চেতনায় শিহরণ বইয়ে দেয়ার মতো যথেষ্ট নয়?
জ্যোতির্ম্ময় গুহঠাকুরতার ঘড়ির কাঁটা পঁচিশে মার্চের রাত দশটা একচল্লিশ মিনিটে স্থগিত হয়ে আছে। তার ক্যাসিকাল মিথস ইন দ্য প্লে’স অব সুইনবার্নের পাশে রাখা টাই। আর রাতে খাওয়ার জন্য কেনা এক প্যাকেট ক্যাপেস্টান।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদের কলম, পাইপ, চশমা, গানের খাতা, হারমোনিয়াম। গানের খাতায় চোখ স্থির হয়ে পড়েÑ ওগো টুনটুনি/ ও মোর খঞ্জনি/ তুমি আমার জানের জান/ ও প্রাণ, শুধু একটু হাসো না।
লেখক শামসুন্নাহার মাহমুদের ছেলে মামুন মাহমুদ। শিশুকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখেছিলেন। ১৯৩৪ সালে। বড় হয়ে হয়েছিলেন পুলিশ অফিসার। তাকে রাজশাহীতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ২৬ মার্চ তারিখে। তার সেই চিঠি, কচিকাঁচার আসরে প্রকাশিত লেখা সাজানো রয়েছে ঘন কাচের আড়ালে।
যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের সংবাদ বাইরের মিডিয়ায় পাঠাবার অপরাধে ৬ আগস্ট গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে পাঠানো হয় সাংবাদিক সৈয়দ নজমুল হককে, কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরেন নভেম্বরে। কিন্তু ১১ ডিসেম্বর আবার তাকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। তখন রাত সাড়ে তিনটা। এই সাংবাদিকের লাশও ফেরত দেয়নি ঘাতকরা। নজমুল হকের পাইপ, তামাকের কৌটা, স্ট্যাপলার, নেমপ্লেট ( চিফ রিপোর্টার, পিপিআই), ডায়েরি, ব্র্রিফকেস পর পর সাজানো। সেই সময়ের একজন সাংবাদিকের দৈনন্দিন জীবনের চিত্র মুহূর্তেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মুনির চৌধুরীর স্মৃতিচিহ্ন অপটিমা মুনির। সাহিত্যের অধ্যাপকের আবিষ্কারÑ প্রথম বাংলা টাইপ রাইটার। পাশে ইস্ট পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ও মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের হুমকি পত্রÑ ‘ইউ উইল নট ইনডালজ ইন দ্য এন্টি-স্টেট অ্যাকটিভিটিজ ইন ফিউচার।’ ১৪ ডিসেম্বর কিছুক্ষণের জন্য তাকে ডেকে নিয়ে যায় আল বদর কমান্ডার। লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি গায়, মাথায় না আঁচড়ানো চুল নিয়ে বাসার বাইরে যান তিনি। কিছুণের জন্য বাইরে বের হলেন, কিন্তু ফিরে এলেন না আজও। জ্যোতির্ম্ময় গুহঠাকুরতার ঘড়ির ১০টা একচল্লিশের মতো স্থির হয়ে আছে ওই কিছু সময়। ওই কিছুক্ষণের ভেতর দিয়ে চলে গেছে ৩৪টি দীর্ঘ বৎসর।
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীর স্মৃতিলিপির পাশে সাজানো তার চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, অনুবীণ যন্ত্র। অধ্যাপকের কলম, কবির ডায়েরি, ভূতত্ত্ববিদের গবেষণাগ্রন্থ সবই স্থির গেছে ১৪ ডিসেম্বরে।
আমরা লাশ খুঁজছি। বাংলাদেশ জুড়ে আমরা আজও খুঁজে ফিরছি শহীদদের লাশ। রায়ের বাজার বধ্যভূমি, মিরপুর বধ্যভূমি আরও অসংখ্য জানা-অজানা বধ্যভূমিতে। হঠাৎ একদিন পেয়ে যাই ডা. ফজলে রাব্বির চোখবাঁধা, পচা গলা লাশ। পেয়ে যাই জহির রায়হানের কংকাল।
জাদুঘরে রাখা আছে শহীদের কংকাল। ছবিতে করোটির চোখে চোখ রেখে ভাবতে চাই, বুঝতে চাই এটাই মুনীর চৌধুরীর করোটি কি না। যেখানে প্রথম জন্ম হয়েছিল কবর নাটকের?
ঘাতক স্পষ্ট জানে লিস্ট করে কাদের এক এক করে বাসা থেকে বের করে আনা হবে। কাদের পাঠিয়ে দিতে হবে অনন্ত নিরুদ্দেশের উদ্দেশে। কে কে নিখোঁজ হবেন চিরদিনের মতো। কার লাশও আর পাওয়া যাবে না। আমাদের যুদ্ধের এই এক সত্য যে, হত্যার মচ্ছব শুরু হয় বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে শেষও হয় সেই বুদ্ধিজীবীদের দিয়েই।
যুদ্ধ যে কত রকমের হতে পারে! যে প্রজন্ম সর্বব্যাপী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি তাদের পে বোঝাও কঠিন। গৃহিনীর যুদ্ধ সম্মুখ সমরের যোদ্ধার মতো নয়, লেখকের যুদ্ধ কৃষকের মতো নয়, শ্রমিকের মতো নয় কিশোরের যুদ্ধ। তবু একটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, সর্বব্যাপী মুক্তির লড়াই তখনই মুক্তিযুদ্ধ হয়ে ওঠে যখন এতে যুক্ত হন সকলে। সে জনযুদ্ধে লেখক লিখে, চিকিৎসক চিকিৎসা করে, অধ্যাপক গবেষণা করে অংশ নেন। কলম হয়ে ওঠে স্টেনগান, স্থেটিস্কোপ রূপান্তরিত হয়ে যায় এসএমজিতে। অতএব অস্ত্র যে হাতে নিয়েছে তাকে শত্র“র অস্ত্রের মুখে দাঁড়াতেই হবে একদিন। অস্ত্র অসম হলে প্রাণও দিতে হবে। ‘নিরীহ বুদ্ধিজীবীদের শাহাদৎ’ কোনো কাজের কথা নয়। সশস্ত্র বুদ্ধিজীবীদের চেহারা যারা দেখেছেন তাদের সেটা মনে করিয়ে দিতে হয় না। কে বলে সংশপ্তকের লেখক, স্টপ জেনোসাইডের পরিচালক, কবরের নাট্যকার সশস্ত্র ছিলেন না? হয়তো তাদের মৃত্যুভয় ছিল না। হয়তো তারা দেশত্যাগ করতে চাননি। ঢাকায় বসে পাহারা দিতে চেয়েছিলেন মৃত্যুময় বিভীষিকাগুলো। আবারও ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কথা। লোরকা জানতেন ফ্রাঙ্কো আর তার গুণ্ডা বাহিনীর চক্ষুশূল তিনি। তার নাটক, গাথা আর কবিতাকে বড় ভয় তাদের। যে কোনো মুহূর্তে তাকে মুখোমুখি হতে হবে ঘাতকের। তবু ফিরেছিলেন প্রিয় শহর গ্রানাদায়। না ঘাতকরা ভুল করেনি। ঠিকই তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে চিরনিরুদ্দেশের পথে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরের মর্মভেদী রাতে কতটা শীত পড়েছিল বাংলাদেশে? রাতে কি কুয়াশা ছিল? পথ কি অন্ধকার ছিল নাকি মৃদু জ্যোৎস্না মুখ বাড়াবার চেষ্টা করছিল? শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদক সেলিনা পারভীন কী একবার শীতে কেঁপে উঠেছিলেন। তার পত্রিকার জ্বলজ্বলে প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করি। এক শীতের সকালে কোথায় নীরবে কাঁপছিল প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের লাশ? আগের সন্ধ্যায় ঘাতকরা তাকে জিজ্ঞেস করছে, আপনি কি শহীদুল্লা কায়সার? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। তার আত্মপরিচয়ের এই দৃঢ়তায় কি ভয় পেয়ে গিয়েছিল ঘাতকদের কেউ?
শহীদদের স্মৃতিলিপিতে কার কথা না লিখে পারা যায়? রণদাপ্রাসাদ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, নূতন চন্দ্র সিংহ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুহম্মদ আখতার, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বাংলা একাডেমীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে পাই মাত্র ১৭৫ জনের বিবরণ। কিন্তু একটি জাতির চিন্তাকে হত্যা করার জন্য এই সংখ্যাটিই যথেষ্ট। ঘাতকরা আরও রক্ত চেয়েছিল। অনেককে যথাস্থানে খুঁজে পায়নি। আমরাও খোঁজ করতে ব্যর্থ হয়েছি অনেকের লাশ। স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের সময় যোদ্ধারা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আমরা শহীদদের স্মৃতিকে পাহারা দিয়ে রাখব। পৃথিবীতে কোনো সময় এমন নির্মম হয়ে আসে যখন স্মৃতিকেও সতর্ক পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু আমরা কি স্মৃতি পাহারা দিতেও ব্যর্থ হচ্ছি? আমাদের অনেক শহীদেরই স্মৃতিচিহ্ন নেই। জাদুঘরের স্বল্পায়তনে অনেকেরই স্থান হয়নি। বাংলা একাডেমী একবার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিচিহ্নের প্রদর্শনী করেছিল। কিন্তু ওই প্রদর্শনীর কোনো কিছুই সংরিক্ষত হয়নি। কে জানে কোথায় আছে শংসপ্তক বা রাইফেল রোটি আওরাতের পাণ্ডুলিপি, আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠে গাওয়া গানের রেকর্ড। কে খুঁজে বের করবে? রাষ্ট্র কি কেবল ডাকটিকেট ছাপিয়েই দায়িত্বে ইস্তফা দিতে চায়? আমরা বিস্মৃতির অতলে ডুবে যাচ্ছি ক্রমশ। কিন্তু ঘাতক আজও তার উদ্যত অস্ত্র বাড়িয়ে রেখেছে। হত্যার তালিকাটি পূর্ণ করার জন্য প্রস্তুত তারা। হুমায়ুন আজাদের রক্তাক্ত মুখ কি সেকথাই মনে করিয়ে দিল না?
নতুন বাংলাদেশের চিন্তাচর্চাকে খুন করতে চেয়েছিল ঘাতকরা। কিন্তু চিন্তা তো অজেয়। মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়। লোরকার মৃত্যুর পরও তার অট্টহাসি থেকে রেহাই পায়নি ফ্যাসিস্টরা। বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টরাও বাঁচতে পারেনি চিন্তার আক্রমণ থেকে। শহীদের চিন্তা বরং আরও তাজা। চিরজাগ্রত। লোরকার মৃত্যুর পর কবি রাফায়েল আলবের্তি লিখেছেন : ‘‘রাইনার মারিয়া রিলকে লিখেছেন যে, ‘কিছু মানুষ অন্যের মৃত্যুবরণ করে, তাদের যা প্রাপ্য মৃত্যু তা তাদের ঘটে না।’ তোমার মৃত্যু হওয়া উচিত ছিল আমার। অথচ তোমাকে হত্যা করা হল। আমি পালাতে পেরেছিলাম। কিন্তু তোমার রক্ত এখনও তাজা। অনেকদিন তোমার রক্ত তাজা থাকবে।’’ শহীদদের রক্ত তাজা থাকবে। আর যারা রক্ত দিয়ে চিন্তা করেছেন তাদের চিন্তার চির জাগরণকে হত্যা করবে এমন ক্ষমতা কার?
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৬:০৪