somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মাহফুজ
আমি হচ্ছি কানা কলসির মতো। যতোই পানি ঢালা হোক পরিপূর্ণ হয় না। জীবনে যা যা চেয়েছি তার সবই পেয়েছি বললে ভুল হবে না কিন্তু কিছুই ধরে রাখতে পারিনি। পেয়ে হারানোর তীব্র যন্ত্রণা আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে।

একজন জাহানারা চৌধুরী ও মরফিন সালফেটের গল্প।

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




আমরা অনেক সময় আমাদের কোনো আপনজন কিংবা পরিচিত মানুষের স্মৃতিশক্তি বা অনুভূতি শক্তি নিয়ে আলোচনা করি। আসলে আলোচনা বলতে প্রশংসা বলতে চাইছি।

আমাদের আলোচনা হয়ে থাকে সাধারণত এরকম যে, অমুকের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর, সহজে কিছু ভুলেনা কিংবা জানেন অমুকের তো অনুভূতি খুব তীক্ষ্ণ, চটজলদি সব বুঝে ফেলে অথবা অমুক তো খুব মেধাবী, ব্রেইন খুব সার্প ইত্যাদি ইত্যাদি।

কখনো কি এমন শুনেছেন যে, ঐ রকম কোনো মানুষের বা আপনজনের যার ব্রেইনের প্রশংসায় আমরা পঞ্চমুখ ছিলাম অথবা তার ব্রেইনের কার্যকলাপ গর্বের সাথে আলোচনা করতাম সেই মানুষের মস্তিষ্কের তীক্ষ্ণ কার্যকলাপ বন্ধ বা ধ্বংস করে দিতে উদ্যোগ নিতে হয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে?

নাহ, আমি কোনো বাংলা সিনেমা অথবা সায়েন্স ফিকশন নিয়ে কথা বলছিনা যেখানে স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কারো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে ঘৃণ্য কোনো সাইন্টিফিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।

আমি বলছি সাত সন্তানের জননী বয়োবৃদ্ধা একজন জাহানারা চৌধুরীর শেষ জীবনের কথা। যিনি শুধু সাত সন্তানকে পেটেই ধরেননি একজন সফল গৃহিনীর ভূমিকায় সংসারটাকে আঁকড়ে ধরে প্রতিটা সন্তানকেই লালন পালন করে মানুষ করেছেন।

তার পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়েদের দুইজন তারই মতো আগাগোড়া গৃহিনী। বাকিদের একজন বিয়ে করে লন্ডন আর দুজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা। বড় ছেলে ডেন্টিস্ট আর ছোট ছেলে স্বপরিবারে আমেরিকা থাকে।

জাহানারা চৌধুরীর স্বামী সালাম চৌধুরী জীবদ্দশায় একটি ব্রিটিশ মালিকানাধীন টি গার্ডেনের হ্যাড ক্লার্ক ছিলেন। সাত সন্তানের মধ্যে ছয় সন্তানের বিয়েসাদী করিয়ে নাতি নাতিনদের মুখ দেখে দুরারোগ্য ক্যান্সারের সাথে কিছুদিন লড়ে মারা যান সালাম সাহেব।

সেই থেকে জাহানারা বেগম ছোট ছেলের সংসারেই ছিলেন। পরবর্তীতে ছোট ছেলের বিয়েসাদীর পর স্বপরিবারে আমেরিকা চলে গেলে জাহানারা বেগম কিছুটা ছন্নছাড়া হয়ে পড়েন কিন্তু আদরযত্নের অভাব হয়নি তার। কখনো বড় ছেলে কখনো সেজ মেয়ের সংসারে থেকে তাদের সন্তানাদি দেখাশুনা করেছেন। আগাগোড়া ধার্মিক মানুষটির অবসর কাটতো ইবাদত বন্দেগী আর বিভিন্ন বইপত্র পড়ে। সামান্য অবসর পেলেই হাতে নিয়ে বসে যেতেন সামনে যা পান তাই নিয়ে। হুমায়ুন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার কিংবা রবীন্দ্রনাথ কোনো বাচবিছার ছিলোনা। পড়ার যোগ্য কিছু পেলেই হলো। ভালোই কাটছিলো তার জীবন। তার কোনো অযত্ন বা অবহেলা হতে দেয়নি সন্তানেরা। বৃদ্ধ বয়সের যেসকল চাহিদা কোনো মহিলার থাকতে পারে সেসবের কমতি ছিলোনা। সমস্যা যেটি ছিলো তা হলো সন্তানেরা নিজেদের কাজকর্মের কারণে বাবার ভিটেতে নিয়মিত থাকা হবেনা বলে ভিটে বিক্রী করে দিয়েছিলো তাই শেষ সময়গুলো জীবনের এখানে ওখানে কাটাতে হয়েছে জাহানারা চৌধুরীর।

জাহানারা চৌধুরীর একটি বিশেষ গুণ ছিলো, তিনি পুরনো দিনের অনেক সুন্দর সুন্দর ছড়া- কবিতা মুখস্থ বলতে পারতেন। শুধু ছড়া- কবিতা নয় নানারকম প্রবাদ, খনার বচন, শিক্ষনীয় গল্পও তার মুখস্থ ছিলো। সুযোগ পেলেই ছড়া-কবিতা বিড়বিড় করে বলতেন, গল্প শুনাতেন। অনেক কিছু মুখস্ত থেকে অবসর সময়ে লিখেও রাখতেন।

জাহানারা চৌধুরী পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন এবং গল্পের মানুষ পেলেই পুরনো দিনের গল্প করতে ভালোবাসতেন। বাবা মা কেমন ছিলেন, পরিবার কিরকম ছিলো, ভাই বোনেরা কে কাকে কেমন আদর করতো ইত্যাদি গল্প শুনাতে শুনাতে তিনি নিজের অজান্তেই কেঁদে দিতেন। এমনভাবে গল্পগুলো বলতেন তিনি যে, মনে হতো গল্পের চরিত্রগুলো তার চোখের সামনে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে।

এই জাহানারা চৌধুরী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার শরীরে দানা বাঁধলো স্বামীর মতো মরণ ব্যাধি ক্যান্সারের জীবাণু। ক্যান্সার যখন মোটামুটি শক্ত অবস্থান তৈরী করে নিয়েছে তখন তা জানা গিয়েছিলো। সাথেসাথেই ছেলেমেয়েরা বিশেষ করে আমেরিকা প্রবাসী ছেলে আর লন্ডনপ্রবাসী মেয়ে ও তার স্বামীর তত্বাবধানে শুরু হলো উন্নত চিকিৎসা কিন্তু রোগ যেখানে ক্যান্সার আর রোগিনী যখন সত্তর পেরিয়ে ছুটছেন জীবনের উল্টো গতি পথে তখন খুব বেশী কিছু করার ছিলোনা কারো। শুধু চেষ্টা করে তাকে কিছুটা শারীরিক আরাম দেয়া ছাড়া। দেদারসে পয়সা খরচ করা হলো কিন্তু অবস্থার অবনতি থামলোনা। সময়ের সাথে বাড়তে থাকলো চিকিৎসার খরচ আর তার শারীরিক যন্ত্রণা কিন্তু আরাম তিনি পাচ্ছিলেননা। সারা শরীরে যন্ত্রণা বাড়তে থাকলো আর তাকেও বাসায় এবং ক্লিনিকে নিয়ে আসা যাওয়া চলতে লাগলো। শারীরিকভাবে পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেলেও তার মস্তিষ্কের কার্যকলাপ আগের মতোই রইলো। তিনি পুরনো দিনের কথা বেশী বেশী ভাবতে শুরু করলেন। কল্পনায় কখনো বাবা কখনো মা আবার কখনো ভাইবোনদের কথা ভেবে ভেবে কাঁদতেন আবার হাসতেনও কখনো শয্যাশায়ী দিনগুলোতে। তার শারীরিক যন্ত্রণা কারো সহ্য হচ্ছিলোনা তাই পরামর্শের জন্য স্পেশালিস্ট ডাক্তারদের শরণাপন্ন হলেন যারা ইতোমধ্যে জাহানারা চৌধুরীর চিকিৎসার সাথে জড়িত ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে।

আসলে জাহানারা চৌধুরীর ক্যান্সার তখন সমস্ত শরীর দখল করে নিয়েছে তাই একমাত্র মৃত্যু ছাড়া এই যন্ত্রণামুক্তির উপায় ছিলোনা। ডাক্তাররা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানালেন এই রোগীর অতিরিক্ত যন্ত্রণার পেছনে দায়ী তার অনুভূতি এবং প্রখর স্মৃতিশক্তি। তার সারা শরীর প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলেও মস্তিষ্ক পুরো স্বচল ছিলো। তাকে যন্ত্রণা থেকে জীবনের শেষ কিছুদিন মুক্ত রাখতে হলে তার মস্তিষ্ককে অকেজো করে দিতে হবে। তাহলে তিনি থাকবেন ব্যথামুক্ত এবং সহজলভ্য চিকিৎসাধীন। তা না করলে অর্থাৎ মস্তিস্ক সচল রাখলে দিনের পর দিন তার যন্ত্রণার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে এবং সীমাহীন কষ্ট পেতে পেতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন।

ডাক্তারের এমন পরামর্শ মেনে নিতে কষ্ট হলো জাহানারা চৌধুরীর ছেলে মেয়েদের। এটা কিভাবে সম্ভব! একটা মানুষ যে এতো অসহ্য যন্ত্রণার মাঝেও একটু স্থির হলেই বড় ছেলে খেয়েছে কি না খবর নিচ্ছেন, ছোট মেয়েটার বাচ্চারা পরিক্ষা কেমন দিচ্ছে জিজ্ঞেস করছেন, বড় মেয়ে নামাজ পড়েছে কিনা জানতে চাইছেন, আমেরিকা থেকে আসা ছোট ছেলের চোখের সমস্যা এখন কেমন জিজ্ঞেস করছেন, লন্ডন থেকে আসা মেয়ের স্বামীর শরীরের খবর নিচ্ছেন, সেজ মেয়ের স্কুলের ঈদের ছুটি কবে শেষ হবে তাও জানতে চাইছেন এবং মোবাইল বেজে উঠলেই কে ফোন করেছে জিজ্ঞেস করছেন সেই মানুষের চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা বা অনুভূতি শক্তিকে ঔষধ দিয়ে নিস্ক্রিয় করে দেয়া হবে ভাবতেই তো নিজেদের অপরাধী মনে হচ্ছে। অর্থাৎ একটা মানুষকে জেনেশুনে জ্যান্ত লাশ বানিয়ে বিছানায় ফেলে রাখা হবে! সে কাউকে কোনো প্রশ্ন করবেনা, তার পাশে মোবাইল বেজে উঠলে জিজ্ঞেস করবেনা কার ফোন, বাসার কোন সদস্য খেয়েছে কে খায়নি সেসব কিছুই জানতে চাইবেননা এমনকি নিজেরই কোনো ক্ষুধা, রাগ-দুঃখ, মান-অভিমান হবেনা। তিনি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবেন। কারো সাথে চোখাচোখি হলেও সে চোখের চাহনিতে কোনো ভাষা বা অনুভূতি থাকবেনা অথচ এই মানুষটাই তো সবার জন্য আজীবন নিরলসভাবে, বিনা অভিযোগে এবং নিঃস্বার্থভাবে খেটে গেছেন। কেউ মুখে তার কী চাহিদা বলার আগেই তা পূরণে সর্বাত্মক চেষ্টা করে গেছেন। একটা বিরাট সংসারের হাল একা সামলেছেন, স্বামীর মৃত্যু অবধি পাশে থেকে প্রতিটা আদেশ পালন করেছেন, নাতি-নাতিনদের জন্য অবসর সময়টাও শ্রম দিয়েছেন কোনো অভিযোগ এবং মোটা অংকের পারিশ্রমিক ছাড়াই। আজ তাকেই জীবন্ত লাশ বানাতে তাই কারো মন সায় দিচ্ছিলোনা কিন্তু মন সায় না দিলে উপায়ই বা কী? তিনি তো আর কোনোদিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেননা ডাক্তাররা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। রান্নাঘরে গিয়ে কাজের মানুষদের কি রান্না হবে কিনা সে নির্দেশও আর কোনোদিন দিতে পারবেননা। সকালে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা তৈরী করে টেবিলে সাজিয়ে কাউকে ঘুম থেকেও ডাকতে পারবেননা। কারো টাকাপয়সার প্রয়োজন শুনে কাছে ডেকে শ'দুয়েক কিংবা পাঁচশত টাকার নোট গুজে দিয়ে বলতে পারবেননা, এই নাও ধরো, কাজে লাগবে। তার ফোনটা বেজে উঠতেই রিসিভ করে জিজ্ঞেস করতে পারবেননা হ্যালো কে? তার ব্যথাই শুধু বাড়তে থাকবে আর তাকে প্রতিনিয়ত ভয়ানক যন্ত্রণায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখবে৷ তার কথা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা ভেবে, ইচ্ছে অনিচ্ছে মিলিয়ে পরিস্থিতি সবাইকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করলো ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে মস্তিস্ককে নিস্ক্রিয় করে দিতে যাতে তার আর ব্যথা অনুভূত না হয়, কোনো কিছু নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে না হয়। যে ক’দিন বেঁচে থাকবেন সম্পুর্ণ ব্যথামুক্ত থাকবেন। তার যন্ত্রণা তার নিজেকে এবং অন্য কাউকেও অনুভব করে কষ্ট পেতে হবেনা।

প্রথম যেদিন জাহানারা চৌধুরীকে মরফিন সালফেট (অনুভূতি শক্তিকে নিস্ক্রিয় করার ঔষধ) প্রয়োগ করা হলো সেদিন তার খুব ব্যথা হচ্ছিলো। তিনি ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে নতুন ঔষধ দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, "এটা আবার কী ঔষধ, আগে তো দেখিনি। নতুন ঔষধ কোন ডাক্তার দিলো"?
সেসব প্রশ্নের উত্তরে তার সবচাইতে আদরের বড় ছেলেটি অনেক কষ্টের কান্না চেপে কণ্ঠটা স্বাভাবিক রেখে বলেছিলো-নতুন ঔষধ তাই আগে দেখনি। আজ থেকে প্রতিদিন এই ঔষধ খেতে হবে তাহলে তোমার আর ব্যথা থাকবেনা। ব্যথার তীব্রতায় রাতে বারবার ঘুমও ভাঙ্গবেনা।

জাহানারা চৌধুরী তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন, তাই নাকি, ঔষধ তো আর কম খেলামনা এই কয়েক মাসে। কোনো ঔষধই তো আমাকে ব্যথামুক্ত করতে পারলোনা স্থায়ীভাবে।

বড় ছেলেটির ভেতরে তখন ঝড় উঠেছে মায়ের কথা শুনে। মনেমনে সে হয়তো বলছিলো, মাগো আর ব্যথায় তুমি কষ্ট পাবেনা। আমরা সবাই মিলে তোমার ব্যথা দূর করার জন্য এর চাইতে ভালো কোনো উপায় বের করতে পারিনি। তোমার অসহ্য ব্যথার যন্ত্রণা সহ্য করা যেমন আমাদের পক্ষেও অসহ্য যন্ত্রণার তেমনি দিনের পর দিন অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠা চিকিৎসার খরচ বহন করাও বেশ কষ্টসাধ্য। শুধু কী তাই তোমার অসুস্থতার জন্য সবার সব কাজকর্ম ফেলে সারাক্ষণ তোমার ধারেকাছে থাকতে হয়। এই কর্মব্যস্ত যুগের কঠিন সময়ে বলো কতোদিন সম্ভব আয় উপার্জন সব ফেলে বসে থাকা? তাই তোমার যন্ত্রণার মুক্তি আর আমাদের দুনিয়াদারির টান উভয়দিক রক্ষার বিকল্প কোনো উপায় ছিলোনা গো মা।

★★★
একদিন সকাল প্রায় এগারোটা। জাহানারা চৌধুরীর নিথর দেহ বিছনায় পড়ে আছে। তার পাশে বাবার মোবাইল নিয়ে খেলা করছে জাহানারা চৌধুরীর বড় মেয়ের তিন বছর বয়সী নাতি। মাঝেমধ্যেই জাহানারা বেগমের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট ভাষায় কি জানি বলছে সে। জাহানারা বেগম শুধু তাকিয়ে আছেন বাচ্চাটার দিকে। তিনি এভাবে নিথর হয়ে প্রায় পনেরো দিন হলো বিছানায় পড়ে আছেন। মরফিন সালফেটে নিয়মিত দেয়া হচ্ছে তাকে যাতে তিনি শরীরে কোনো ব্যথা উপলব্ধি না করেন।
হঠাৎ করেই বেজে উঠলো পিচ্ছিটার হাতের মোবাইলে। " আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে? কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে"
জাহানারা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে মনে হলো তিনি খুব মনোযোগ সহকারে শুনছেন কবিতাটা। এমন সময় বড়মেয়ে নাতিকে নিতে মায়ের ঘরে আসতেই দেখলো জাহানারা চৌধুরীর মুখ বিড়বিড় করছেন। বড় মেয়ের মনে হলো তিনি মোবাইলে বাজতে থাকা কবিতাটার সাথে ঠোঁট মিলাচ্ছেন! অর্থাৎ তিনি এখন পুরোটাই জাগ্রত এবং সবকিছু বুঝতে পারছেন এমনকি কবিতাটা তার মুখস্থ এবং চিনতেও পেরেছেন। তা না হলে ঠোঁট মেলানোর কথা না। এমন তো হবার কথা না। এই সময়টাতে জাহানারা চৌধুরী অবচেতন থাকেন। অবচেতন ভাবটা কেটে উঠতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। বড় মেয়ে নীচু হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলেন "আম্মা তোমার কি কষ্ট হচ্ছে"?

জাহানারা বেগম দু’তিন সেকেন্ডের জন্য বড় মেয়ের চোখে চোখ রেখে যেন কল্পনার জগতে হারিয়ে গেলেন তারপর চোখের পাতা বন্ধ করে ফেললেন। বড় মেয়ে দেখলেন চোখ বন্ধ অবস্থায় মায়ের মুখে কখনো হাসি ফুটে উঠছে কখনো আবার কপাল কুঁচকে যাচ্ছে। ঘাবড়ে গেলেন তিনি। মায়ের মাথায় হাত রেখে আলতো করে ডাকলেন " আম্মা, আম্মাগো কি হয়েছে তোমার?" কপালে স্পর্শ পেয়েই জাহানারা চোখ মেলে চাইলেন। আবারো চোখাচোখি হলো মেয়ের সাথে। চেয়েই রইলেন এবার চোখ বন্ধ না করেই। মনে হলো তিনি ভাবছেন, এই বড় মেয়েটা তার জীবনের শেষ সময়গুলিতে প্রায় ছায়ার মতোই সাথে সাথে আছে। আহার-নিদ্রা সব জলাঞ্জলি দিয়ে মায়ের সেবা করে যাচ্ছে। চাইতে চাইতে তার মুখে খুব ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠলো এবং পরক্ষণেই আবার চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে এলো। জলটুকু বেরিয়ে আসতেই জাহানারা বেগমের শরীরটা একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠলো এবং তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বড় মেয়ে ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে গেলেন। মায়ের নিঃশ্বাস চলছে কিনা পরিক্ষা করতে গিয়ে দেখলেন স্তব্ধতা সবকিছু ঘিরে ধরেছে। তিনি আম্মাগো আম্মাগো বলে চিৎকার দিয়েই মূর্ছা গেলেন মায়ের বুকের উপর। তার নাতি তাই দেখে নানুর চুল ধরে টানতে লাগলো। চিৎকার শুনে ঘরের অন্যান্যরা ছুটে আসছেন জাহানারা চৌধুরীর রুমে। আসলে মৃত্যুর পূর্বে প্রতিটা মানুষ টের পায়। টের পায় বলেই হয়তো জাহানারা চৌধুরীকে মরফিন সালফেট পর্যন্ত অবচেতন রাখতে পারেনি। তার শরীরের সব স্মায়ু জেগে উঠেছিলো, তিনি আশেপাশের পরিবেশ অনুভব করতে পারছিলেন। বড় মেয়ের দিকে খুব কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়েই তিনি শেষবারের মতো চোখ বুঝে নিয়েছিলেন। এভাবেই নীরবে নিভৃতে একজন জাহানারা চৌধুরী নশ্বর দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে অবিনশ্বর দুনিয়ায় রওয়ানা হলেন। নিজে মুক্তি নিয়ে মুক্ত করে দিলেন সবাইকে। পেছনে পড়ে থাকলো প্রায় এক শতাব্দীর স্মৃতির পাহাড় আর কিছু মরফিন সালফেটের নীরবতা। এরকম নিঃস্বার্থভাবে অস্থিরতার মাঝে জীবন কাটানো জাহানারা চৌধুরীদের সৃষ্টিকর্তা যেনো ওপারে ভালো রাখেন, শান্তিতে রাখেন।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ৮:২৪
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×