আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে বা বলতে গেলে দেশের সাধারণ নাগরিক/ছাত্রসমাজ ও প্রজন্মের পর প্রজন্মকে চিন্তা করতে হয় কোনটা লিখে বা বলে কার মন রক্ষা করবো? কোথায় কোনোটা বললে কিভাবে লাভবান হবো? কোন বিষয় উল্লেখ না করলে আর কোন বিষয় জোরালোভাবে উল্লেখ করলে কারো প্রিয়ভাজন বা বিরাগবাজন হবো? এরচাইতে লজ্জার কিছু কী হতে পারে যেখানে কেউ জেনেশুনে মিথ্যা ইতিহাসের কথা বলে আবার কেউ জেনেশুনে সত্য এড়িয়ে যায়।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সর্বেসর্বা বলে সর্বত্র সমাদৃত হন ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি এবং শুনেছি। বইপত্র, পাঠ্যপুস্তকে জিয়াকেই সকল কৃতিত্ব দিতে দেখা গেছে বিএনপি সরকারের সময়। তখনকার সময়ে ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন পরিক্ষায় আমি নিজেও জিয়াউর রহমানকে ক্রেডিট দিয়ে লিখেছি কারণ আমি যা জেনেছিলাম তখন তাই তো লিখেছিলাম।
পরবর্তীতে আওয়ামিলীগ ক্ষমতায় এলে প্রেক্ষাপট পাল্টে যেতে দেখলাম। বঙ্গবন্ধুকে করা হলো মুক্তিযুদ্ধের ওয়ান ম্যান আর্মি। তখন জেনারেল জিয়াকে তো মুক্তিযোদ্ধা বলতেও রাজি হননা অনেক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তি যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ অতি সাম্প্রতিক সময়েই ঘটেছে এবং আগেও ঘটেছিল। ক্ষমতার পালাবদলে আমিও লেখার পট-পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এলাম সামনের কাতারে অথচ কিছুদিন আগেও আমার জানামতে হয়তো জিয়াউর রহমানই ছিলেন সব। বিএনপি আমলে শুনেছি "বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছাড়া কী আছে মুক্তিযুদ্ধে? শুধমাত্র ভাষণ দিয়ে দেশ কী স্বাধীন হয়েছিলো না-কি সম্ভব" ইত্যাদি প্রশ্ন তুলে বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্বকে চরমভাবে অস্বীকার করতে। শুধু তাই নয় এমন প্রকাশ্য সমালোচনাও আমরা পত্রপত্রিকা এবং জাতীয় টেলিভিশনের বিভন্ন চ্যানেলে দেখেছি ও শুনেছি যে "গোটা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু পরিবার বা বর্তমান আওয়ামিলীগের কয়জন রণাঙ্গনে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন সেটাই নাকি প্রশ্নবিদ্ধ!
অতঃপর কালেকালে এই বর্তমান সময়ে জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের খেতাবই প্রায় বিলীন হতে দেখছি। এখন এইযে একই ইতিহাসের আলাদা এবং ভিন্নভিন্ন গল্প সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকেও দ্বিধাদ্বন্দে ফেলা হলো তার সমাধান কী আদৌ কখনো সম্ভব?
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে শেষ হলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সময়ে সময়ে বিকৃত এবং স্বার্থহাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে। অন্তত আমি মনে করিনা গোটা বাংলাদেশের ইতিহাস নির্লজ্জ মিথ্যাচারে যেভাবে বিকৃত ও বিতর্কিত করা হয়েছে কালে কালে তা আর কেয়ামতপর্যন্ত কখনো সর্বজনস্বীকৃত হবে।
#মহান_মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে কিংবা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেও মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সঠিক স্বীকৃতি পাননি অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করে গেছে কিংবা এখনো করছে এমন হতভাগ্য মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও অসংখ্য।
অন্যদিকে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন করা তো দূর এমনকি যুদ্ধ চলাকালীন পুরোটা সময় নিরাপদ জায়গায় ঘাপটি মেরে থেকে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা সেজে সুবিধাভোগীর সংখ্যাটাও বিরাট।
শুধু কী তাই? ১৯৭১ সালে জন্ম না নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা এবং বাপদাদা কেউ যুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান হিসেবে নানারকম অবৈধ সুযোগসুবিধা ছিনিয়ে নিচ্ছে এমন বাটপারও আছে অগনিত।
আমার প্রশ্ন হলো নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের অবসান হলোনা কেন? ক্ষমতার পালা বদলের সাথে দেশের ইতিহাস কিভাবে পাল্টে যায়? এই স্বাধীন বাংলাদেশ কী কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের বা কোনো ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিগত এসেট যে সময়ে সময়ে তা পাল্টে যাবে? মুক্তিযুদ্ধ তো একবারই সংগঠিত হয়েছিলো তাহলে ইতিহাস কেন নানাজনের নানা অভিমত আর আদর্শের সমন্বয়ে তৈরী হবে?
আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাস আসলে শুধুমাত্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিকৃত হয়নি সেই সাথে মিথ্যাচারও হয়েছে ধাপেধাপে । সবচাইতে বিতর্কিত ও বিভক্তি সৃষ্টিকারী দুটো বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করে লেখাটা শেষ করবো। হ্যাঁ আমি জানি আমার মতো মানুষের ইতিহাস নিয়ে এতো আলোচনা-সমালোচনা করা মানায়না। এইলেখা হয়তো অনলাইনের কোথাও আরো অসংখ্য লেখার মতো পরে থাকবে লোকচক্ষুর আড়ালে কারণ আমি কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্ব নই যার লেখা বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। তবে এই যে লিখলাম এবং মনের মাঝে জমিয়ে রাখা প্রশ্নগুলো ও চিন্তাভাবনাটা প্রকাশ করতে পারলাম সেটাতেই আমার সন্তুষ্টি। -
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০২১ ভোর ৫:৪০