উৎসর্গ - কথা দিয়েছিলাম পরবর্তী গল্পটি তাকে উৎসর্গ করব । উনিও বলেছিলেন উৎসর্গ না করলে খেলুম না!! আমি খেলার ব্যবস্থা রাখলাম । তবে মূল কারণ কিন্তু এটা নয় ।
গল্পের প্রতি তার অসামান্য ভালবাসা , নিবেদিত মনোভাব আমাকে খুব , খুব মুগ্ধ করেছে । এমন করে পরিশ্রম করে কজনে ! আমি অনেক আনন্দ অনুভব করছি তাকে উৎসর্গ করতে পেরে । একদিন তার লিখা জয় করুক
পুরো বাংলাদেশ , পুরো বিশ্ব এই কামনা রেখেই উৎসর্গপাঠ - গল্পপ্রেমিক লেজকাটা বান্দর ওরফে সালেহ তিয়াস ।
রাজার শোভা মুকুটে , এলাকার শোভা নাকি পাগলে । আচ্ছা , কোন এলাকায় কোন পাগল কখন আসে , কিভাবে আসে -কখন যায় তা কি কেউ বলতে পারে ? সমাজের কেউ ত কাউকে দায়িত্ব দিয়ে রাখেনি যে এর হিসেব রাখবে !
আমাদের পাড়ার হোসেন পাগলা মারা গেল - সপ্তাও হয়নি এর মধ্যে পাগল আমদানি - কোথা হতে জুটল - এক পাগলি , যুবতী ! বয়স কত হবে ২৫- ২৬ ? কি অদ্ভুত ! আসল আর না জেনেই হোসেন মিয়ার জায়গা নিয়ে নিল ! ( নাকি জানে ?)
স্কুল মাঠের কোনায় সেই জায়গাটায় তাকে প্রথম দেখলাম যেখানে হোসেন মিয়াও প্রায় বসে থাকত । ( হোসেন মিয়ার জায়গা সে চিনল কিভাবে ! )
বসে বসে সে ভেঙচি কাটছে , বাতাসে খামচি মারছে আর স্কুলের কিছু দুষ্টু ছেলে পুলে দূর থেকে তাকে বালু ছিটাচ্ছে ।
আমি দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিলাম ।
' দেখছেন কেমন বাইন মাছের মত ফিগার ! যদি এইটা পাগলি না হইত তাইলে ত ...............
না তাকিয়েই আনাস ভাইয়ের গলা বুঝতে পারলাম । উনি উনার ছেলেকে স্কুল হতে নিতে এসেছেন । ডিশ সংযোগ এর ব্যবসা করেন।এর বাইরেও উনার আরেকটা পরিচয় পাড়ার সবাই জানে ।
মেয়েদের ফিগার বিষয়ে উনি পিএইচডি । চোখের রাডারে ধরা সব মেয়েকেই উনি খুটিয়ে দেখেন ।
আনাস ভাইয়ের কথা শুনে আবার মেয়েটির দিকে তাকালাম ।
ঠিকই , মাথা ঠিক থাকলে এর পিছনে কত ছেলে ঘুরত তার হিসেব থাকত না ।
এই পাগলি কোথা হতে আসল ? - আনাস ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম ।
হাহাহা , আমি কি জানি ! তোমার কি ধারণা পাগলি এটা আমাকে বলেছে ! গতকাল থেকেই দেখছি ওকে এখানে । - আনাস ভাই বললেন ।
আসলেই । পাগলদের কোন ঠিকানা থাকে না । ঠিকানা থাকলেও না । পৃথিবী ও মহাশুন্যের সবকিছু যেমন কোন লক্ষ্য , কোন ঠিকানা ছাড়াই ঘুরছে , খালি ঘুরছে ,ওরা ঘুরছে বলেই আমরা স্থির আছি , আমাদের লক্ষ্য আছে ,আমাদের ভালবাসা , আমাদের হিংসা - বিদ্বেষ - ক্রোধ , আমাদের সবকিছুর লক্ষ্য আছে , ওই পাগল ! সে ত হতচ্ছাড়া পৃথিবীর মতই । তার কিছু নেই , সেও কারো নয় । জীবন আছে বলেই যেমন বুঝতে পারি আমরা মাটিতে আছি , আমরা পৃথিবীতে আছি , তেমনি পাগল দেখলেই আমরা আশ্বস্ত হই আমরা ভাল আছি , আমরা সুস্থ আছি । আমরা ওদের মত নই । ওরা ঠিকানাবিহীন , আর আমাদের , সুস্থ মানুষের ঠিকানা আছে , আমাদের অস্তিত্ব আছে ।
এরপর হতে , পাড়ার এখানে - ওখানে , পাগলিকে দেখি । কখনো আনমনে কখনো উচ্চস্বরে গান গায় , গালি দেয় , হাসে -কাঁদে , হাপায় - ঘুমায় । কখনো ওকে কটকটি , কখনো চটপটি চেটে - পুটে খেতে দেখি ।
গ্রীষ্ম - বর্ষা , শরত - শীতে , যে সময়ের যে ফল - কিছু না কিছু ওর হাতে দেখি । ভাত - বিরানি তাও দেখি । আল্লাহ কাউকে না খাইয়ে রাখেন না , এ অদ্ভুত মিরাকেলে কথাটা কেবল পাগলিকে দেখেই বিশ্বাস হয় । স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা আর তাদের মায়েরাও কিছু না কিছু খেতে দেবে । সব পাগলের মত তার ও কোন কোন সময় ' মাথায় গরম ' উঠে , তখন রাস্তা ধরে ভোঁ - দৌড় ! রাস্তার ধারের দোকানিগুলোর চোখ হয় দেখার মত , ভয়ে কারো চোখ বন্ধ , কারো গোল! এই বুঝি পাগলি হামলে পড়ে দোকানের উপর !
একদিন আপাও বলে বসল , তুই পাগলিকে আম কিনে দিস ত !
আমি বললাম , কেন ?
'' আরে পাগলদের দেখলে আল্লাহ ও খুশি হয় ।
হাহাহা , আল্লাহ কাউকে পাগল বানিয়ে খুশি হয় , আবার তাকে দেখলে তাও খুশি হয় ।
আপা ত বলেই খালাস , পাগলদের কিছু দেয়া কি এত সোজা ! যদি কিছু করে বসে ! তারপরও সাহস করে ৩ টা আম কিনে ,মাঝ বরাবর কেটে পাগলির সামনে গেলাম । সেই প্রথম এবং সেই শেষ পাগলির সামনে যাওয়া ।
সেই প্রথম এবং সেই শেষ পাগলির মুখের নকশার দিকে প্রখরভাবে চেয়ে থাকা ।
এলোমেলো , রুক্ষ চুল ও চেহারার ময়লা আবরণের পর্দা সরিয়ে পাগলির মুখের অদ্ভুত অপরূপ যে সৌন্দর্য আমি দেখতে পেলাম তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না ।
চোখটায় জড়ো হয়ে আছে পৃথিবীর সব মায়া । আমার কেবল একটা কথাই মনে হল , এমন সুন্দর মেয়ে পাগল কেন ! বিধাতার খেয়াল যখন পাগল বানানো তখন কেন মুখের মাঝে রুপের ছটা মেরে দেয়া ? কার জন্য ? কেন পৃথিবীর একঝাক পশুর ভিড়ে রুপের নহর বইয়ে দিয়ে বিপদের সম্ভাবনা চুড়ান্তরুপে বাড়িয়ে দেয়া ? আচ্ছা রাতে ও কোথায় ঘুমায় ? ও কি গোসল করে ? করলে কে করিয়ে দেয় ? ওর শাড়িটা মাঝে মাঝে কে পালটিয়ে দেয় ? জানি না ত !
হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে পাগলিকে বললাম -
- নে আম খা ।
বলামাত্রই কেমন সাবলীলভাবে সব আম আমার কাছ হতে নিয়ে নিল ! ওর পাওনা আম আর কি ! মুড ভাল থাকায় দাঁত বের করে একটা নিস্পাপ সুন্দর হাসি সে আমার দিকে ছুড়ে দিল । খা , খা! - বলে আমি ও একটু হাসলাম ।
এক অদ্ভুত ভাললাগায় আমার মন আচ্ছন্ন হল ।
এভাবেই যাচ্ছিল ক্যালান্ডারের দিন । একদিন পাগলির পেটটা ভয়াবহ উঁচু দেখতে পেলাম । স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে , পেটে বাচ্চা । কে করেছে এমন কাজ ? পুরুষ নামের কোন পশু ? পশুর সাথে কেন তুলনা দিব ?
এমন লোকের চাইতে পশু কি মহৎ ও পবিত্র নয় ?
- দেখছেন , এমন কাজ ও কেউ করতে পারে ! -
আনাস ভাইয়ের চোখটা ভেজা ।
তারপর বুকফাটা প্রখর রোদেলাময় এক দিনে পাগলির কোলে এক ছোট বাচ্চা দেখতে পেলাম । কৌতূহলী অনেকেই বাচ্চাকে দেখার জন্য চেষ্টা করছে। আর তাতে ভয় পেয়ে পাগলি সবার দিকে তাকিয়ে হিস হিস করে
উঠছে , যা ! যা! বলছ্বে , বাচ্চাটাকে হাত দিয়ে চেপে বুকের কাছে ঠেসে ধরছে । বাচ্চাটা কিছুক্ষন পর পর কাদছেও , আমিও সবার মত একপলক বাচ্চাকে দেখে নিলাম । মুখটায় মায়ের আদল , চোখটাও পাগলির মত মায়াময় , মায়াময় জারজ সন্তান ! এতটূকু বাছার কি বুদ্ধি! জারজ বলে বাবার আদল তাই লুকিয়ে ফেলল ! জারজ বাবাকে বাঁচাবার বুদ্ধি শুরুতেই বের করে ফেলল !
মনে একটা প্রশ্ন আসল , আচ্ছা পাগলির ডেলিভারি করাল কে ? জানি না ত !
দুই দিন পর ।
স্কুলের মাঠ টায় জটলা দেখতে পেলাম । কি হল ?
পাগলি তার বাচ্চাকে নিয়ে বসে আছে হোসেন মিয়ার বসার জায়গাটায় ।তাকে ঘিরে আছে একঝাক সুস্থ মানুষ । কিছু মহিলা পাগলির দিকে এগুনোর চেষ্টা করলেই পাগলি বাঘের মত হিংস্র গর্জন ছাড়ছে ।
চোখজোড়া ইটখোলার মত জ্বলছে । আর কোলের বাচ্চাটাকে সযত্নে , মমতায় চেপে ধরে আছে । আজ পাগলিকে মনে হচ্ছে অন্য পৃথিবীর , অন্য কেউ । সে আজ আমাদের নয় ।
ব্যাপারটা কি বুঝতে পারলাম না । পাশের লোককে জিজ্ঞেস করলাম ।
- কি হয়েছে ?
তিনি নিরুত্তর ।
এক মহিলা বলে উঠল , বাচ্চাটা মইরা গেছে ।
ফের বাচ্চাটার দিকে তাকালাম । তাই ত ! বাচ্চাটার মুখের কাছে কয়েকটা মাছি ঘুরঘুর করছে । রুক্ষ চরের মত হয়ে আছে বাচ্চাটার মুখ , এ মুখের কাছে মাছি কি চায় ? কচি ফুলের মত মুখটা কি জারজ বলে পৃথিবীর কাছে হেরে গেল ! কচি মুখটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অল্প কিছু চিৎকার করে বিবেকহীন আদালতে নালিশ দিয়ে রায় না নিয়েই চলে গেল ! নাকি জারজের আজন্ম পাপ কড়ায় - ক্রান্তিতে শোধ করে গেল ?
ভালই হল । যে পাগল নয় , যার ঠিকানা ও নেই , তাকে মরতে হয় ।
- পাগল ত , বাচ্চাকে কেমনে দুধ খাওয়াতে হয় জানত না । আহারে ! খুব খারাপ লাগতাছে ! - আরেক মহিলা বলে উঠল ।
পাগলির ভেজা ব্লাউজ দুধের গন্ধ বিলাচ্ছে ।
হায়রে দুধ ! কাজেই যদি না লাগল তবে কেন এই অপ্রয়োজনীয় তরলে স্তন ভরতি হওয়া !
নগ্ন , নির্মম কিছু লেপ্টে গেছে পাগলীর দিকে চেয়ে থাকা অজস্র চোখে । ঝলসানো রোদমাখা তীর প্রখর নিষ্ঠুরতায় বিদ্ধ করে দিচ্ছে চারপাশ ।
এইটারে ত কবর দিতে হইব ! - এক মহিলা বলে উঠল ।
হ্যা , কবর দিতে হবে । এটাকে এটার ঠিকানায় পৌঁছে দিতে হবে ।
স্কুলের ছাঁদে বসে আছে অজস্র কাক , বিরক্তিকর কর্কশ একগেয়ে গলায় ওরা ডেকে যাচ্ছে ।
বিশ্রী , বড্ড বিশ্রী এ আওয়াজ ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৫