নদীসিক্ত অপরূপ বাংলাদেশের যে কোন জেলার মত চট্টগ্রামের ও রয়েছে সমৃদ্ধ, গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।অন্তরঙ্গ-বহিরঙ্গ দুভাবেই এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক প্রকাশ উচ্চ,প্রকট, জোরদার, আন্তরিক ও অহংময়। যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গে তার প্রবলতর উপস্থিতি খুব সহজেই অন্য অঞ্চলের মানুষের চোখে পরে।
চট্টগ্রামের কথা বলতে গেলে সবার আগে ভাষার কথা বলতে হয়।বাইরের অঞ্চলের মানুষ এ অঞ্চলে এসে প্রথম যে বিস্ময়ের মুখোমুখি হোন তা হল চাটগাইয়া ভাষা।লোকের মুখে চাটগাইয়া বুলি শুনে তার অবাক নেত্রে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোন গতি থাকে না।উপায় ওবা কি! অনেক আগেই প্রমথ চৌধুরী বলে গেছেন ‘বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে।’আক্ষরিক অর্থেও কিন্তু তাই। অনেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষার তকমা লাগাতে চাইলেও প্রকৃতপক্ষে এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা।এ ভাষার উচ্চারণ ও শব্দার্থ বৈচিত্র্য,শব্দযোজন রীতি,স্বরধ্বনি বহুলতা স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী।কবি বুদ্ধদেব বসুর কথাতে তারই আচ পাওয়া যায়- ‘আর কোথাও শুনিনি ঐ ডাক, ঐ ভাষা, ঐ উচ্চারণের ভঙ্গি।বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের ভাষা বৈশিষ্ট্য বিস্ময়কর। চাটগাঁর যেটা খাঁটি ভাষা, তাকে তো বাংলাই বলা যায় না’।
চট্টগ্রামের মানুষের অতিথিপরায়ণতার কথা সুবিদিত।আর অতিথি আপ্যায়নের কথা আসলে অবধারিতভাবে মেজবানের কথা চলে আসে।মেজবান যেন চট্টলার মানুষের বিশাল কলিজার পরিচয় দেয়।কোন উপলক্ষকে সামনে রেখে গরীব দুখি,পাড়া পড়শি ,আত্মীয়, বন্ধুদের জন্য যে ভোজের আয়োজনকরা হয় তার নাম মেজবান।গরুর গোস্ত আর সাদা ভাত হল মেজবানির মুল খাবার। সাথে ছোলার ডাল,গরুর হাড় দিয়ে ঝোলের রান্না।কখনো কখনো লাউয়ের সাথে ঝোল সমেত গরুর নলা পরিবেশন। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিয়ে কিংবা যেকোন সামাজিক অনুষ্ঠানে সাধারণত একবারের বেশি দেয়া না হলেও মেজবানে অতিথির চাহিদা অনুযায়ী খাবার পরিবেশন করা হয়।অর্থাৎ ইচ্ছেমত মাংস কিংবা আহার গ্রহণে মেজবানের তুলনা হয় না। বিশেষ কায়দায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাবুর্চিরা মেজমানের গরুর মাংস রান্না করেন।দেশী-বিদেশী মসলার পাশাপাশি স্থানীয় হাটহাজারী অঞ্চলের বিশেষ ধরনের শুকনো লাল মরিচ ব্যবহারের ফলে মেজবানের মাংসের স্বাদ অতুলনীয় যে কোন ভোজন রসিকের কাছে।মেজবানের রান্নায় হাটহাজারী উপজেলায় উৎপাদিত টকটকে লাল মরিচ ব্যবহার হয়ে থাকে যা দেখতে টকটকে লাল হলেও কম ঝাঁলের এ মরিচের দাম দেশের অন্যান্য মরিচের চেয়ে বেশি থাকে। প্রিয়জনের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে আয়োজিত ভোজ বা ফাতেহা কিংবা জিয়াফত চট্টগ্রামে মেজবান হিসাবে প্রচলিত হয়ে এসেছে। গত কয়েক দশক ধরে জন্মদিন, বিভিন্ন দিবস, পারিবারিক সাফল্য, নতুন কারবার শুরু, বিদেশে গমন, নতুন বাড়িতে প্রবেশ, পরিবারে আকাঙ্খিত শিশুর জন্ম, বিয়ে, আকিকা ও সুন্নতে খৎনা, মেয়েদের কান ছেদন, রাজনৈতিক সাফল্য, নবজাতকের নাম রাখাসহ নানান ধর্মীয় উৎসবের সময়ে মেজবানির আয়োজন করে থাকে এখানকার বাসিন্দারা। মেজবানির দাওয়াত সকলের জন্য উম্মুক্ত থাকে।
বিশেষভাবে রান্না করা গরুর মাংসই মেজবানের মূল আকর্ষণ।এ মাংসের জন্য সাধারণত দ্য ক্যাটল অফ চিটাগাং জাতের গরু ব্যবহার করা হয় যার প্রাপ্তিস্থান চট্টগামের বাশখালি,আনোয়ারা,চন্দনাইশ সহ সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে।আকারে ছোট হলেও এ গরুর মাংস সুস্বাদু, পুষ্টিকর।
একসময় মেজবান চটগ্রামের সামাজিক গণ্ডিতে সীমিত থাকলেও হালে দেশের নানা প্রান্তে মেজবান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ঢাকাস্থ চটগ্রাম সমিতি প্রতিবছর মেজবানের আয়োজন করে আসছে।ব্যবসায়ীদের কল্যাণে মেজবানের ব্র্যান্ড ইমেজ ও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বৈকি! চট্টগ্রামে ভালো মানের হোটেল রেস্টুরেন্টে ‘’মেজবানির মাংস ‘’ ‘মেজবানির ডাল’ নামে আলাদা খাবার বিক্রির প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠছে।সম্প্রতি চালু হওয়া চট্টগ্রামের প্রথম পাঁচ তারকা হোটেল র্যাডিসনে সবচেয়ে বড় খাবারের হলটির নাম রাখা হয়েছে ''মেজবান হল''।ব্যবসায়ীদের এহেন কর্মকাণ্ড চট্টগ্রামের মানুষের প্রবল মেজবান আসক্তিকে নির্দেশ করে।
বলিখেলা চট্টগ্রামের সংস্কৃতির আরেকটি বলিষ্ঠ অনুষঙ্গ। বলীখেলা নামটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নাম। এর আভিধানিক নাম হলো মল্লযুদ্ধ বা কুস্তি প্রতিযোগিতা।বলিখেলায় চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন কালের। এ অঞ্চলে মল্ল নামে খ্যাত বহু প্রাচীন পরিবার দেখা যায়।চট্টগ্রামে সর্বমোট ২২টি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। একসময় চট্টগ্রাম অঞ্চলরে প্রায় প্রতিটা গ্রামে বলিখেলার প্রচলন থাকলেও র্বতমানে উল্লখেযোগ্য দু একটি স্থান ছাড়া বাকিগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলা চলে। তবে চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকন্দ্রে লাল ময়দানে অনুষ্ঠতি জব্বারের বলিখেলা এখনো আপন মহিমায় টিকে আছে। দেশের অন্যান্য স্থানের বলীখেলা কিংবা লোকজ মেলার সাথে জব্বারের বলীখেলার বিশেষ পার্থক্য রয়ছে। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ও ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে বাঙালি যুব স¤প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা মাধ্যমে মনোবল বাড়ানোর উদ্দশ্যেে ১৯১০ সালে বন্দর শহর চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার আবদুল জব্বার সওদাগর ১২ বৈশাখ তারিখে লালদীঘির ময়দানে সর্বপ্রথম বলীখেলার আয়োজন করেন।একসময় দেশ বিদেশের নানা বিখ্যাত বলী জব্বারের বলিখেলায় অংশগ্রহণ করছেন।এ বলীখেলা আর্কষণ করছেে পাশ্চত্যকেও।১৯৬২ সালে দুজন ফরাসী মল্লবীর আবদুল জব্বারের বলীখেলায় অংশগ্রহণ করেছিন। ব্রিটিশ ফিল্ম ডিভিশন একবার ডকুমেন্টারি ফিল্ম হিসাবে আবদুল জব্বারের বলীখেলার ছবি সংগ্রহ করেছিল, যা লন্ডরের ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে।
নামকরা বলির অভাবে বর্তমানে বলির আকর্ষণ কিছুটা স্লান হয়ে গেলেও একে কেন্দ্র করে যে লোকজ মেলার আসর বসে তার আবেদন বিন্দুমাত্র কমেনি।সারা বছরের গেরস্থালি পণ্য কেনার জন্য অনেকেই এই মেলার প্রতীক্ষায় থাকেন।মেলা চলাকালীন সময়ে সমগ্র আন্দরকিল্লা নিউমার্কেট (র্বতমান), কোতোয়ালী মোর, কেসিদে রোদ, হজরত আমানত শাহ (রহ.)-এর মাজার ছাড়িয়ে জেলরোড,দক্ষিণে বাংলাদশে ব্যাংক,শহীদ মিনার এলাকাসহ প্রায় ২ বর্গমিটার এলাকা মেলায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। মেলায় হাতপাখা, শীতল পাটি, মাটির কলস, চুড়ি ফিতা, হাতরে কাঁকন,মাটির ব্যাংক, খেলনা, কুড়াল, পিড়ি,হাড়ি পাতিল,মোড়া, মাছ ধরার চাই,ঢোল, বাঁশ,বাশ ও বেতের নানা উপকরণ, নানা আসবাব ও গৃহ উপকরণ,মাটির তৈরি তৈজসপত্র,শিশুদের জন্য কাঠের পুতুল, মাটির তৈরি নানান ধরণের খেলনা সামগ্রী, ঘর সাজানোর উপকরণ প্রভৃতি গেরস্থালী উপকরণ সুলভ মুল্যে পাওয়া যায়। এছাড়াও গ্রাম বাংলার নানা সুপরিচিত ঐতিহ্যবাহী খাবারের দেখা মেলে এ মেলায়।
বলী খেলাকে কেন্দ্র করে শতাব্দী প্রাচীন এ মেলাটি বর্তমানে মহাসমারোহে টিকে থাকলেও বলী খেলার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা হ্রাসের ব্যাপারটি দুঃখজনক।অথচ নতুনভাবে এর ব্র্যান্ডিং ইমেজ পূর্ণনির্মাণের মাধ্যমে নতুন প্রজম্মের কাছে একে আগের মত জনপ্রিয় করানো যেত।
ওরে সাম্পান ওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা – এই গানটি শুনেন নি এমন লোক বোধ হয় খুব কম আছেন।সাম্পান আর কর্ণফুলী নদী যেন এক সুত্রে গাথা।সাম্পান প্রথম সৃষ্টি হয় র্কণফুলী নদীতে। প্রচলন আছে, র্কণফুলী নদীতে একসময় যাত্রীবাহী জাহাজ ও স্টিমার চলাচল করতো। জাহাজ থেকে নেমে যাত্রীরা নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে কূলেওঠার জন্য সাম্পানের সৃষ্টি। সাম্পান বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। ছোট আকারের একটি সাম্পানরে দৈর্ঘ্য আনুমানিক২০ ফুট এবং প্রস্থ কমপক্ষে সাড়ে ৪ ফুট। এ ধরণের একটি সাম্পানে ১৫ থেকে ১৮ জন যাত্রীধারণ হয়। এ সাইজের চেয়েও আরো বড় সাম্পান রয়ছে। চট্টগ্রামবাসীদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য অঙ্গনে সাম্পানের রয়েছে এক বিরাট ভূমিকা। সাম্পানরে বৃহত্তর রূপ হলো কাঠের তৈরি জাহাজ। এ গুলোতে আট-দশ হাজার মণ মালামাল নিয়ে সাগরে পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থকেে মালামাল পরবিহন করতো। চট্টগ্রামের নৌশিল্পের ঐতিহ্য প্রায় ১২ শ’ বছরের।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সপ্তদশ শতকে তুরস্কের সুলতানের নৌবহরের অধিকাংশ জাহাজ নির্মিত হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। একবার এক আদেশে সুলতান চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১৩টি জাহাজ ক্রয় করেছিলেন। ব্রিটিশ নৌবহরেও চট্টগ্রামে নির্মিত জাহাজের প্রাধান্য ছিল।
১৯২৪ সালে কলকাতা বন্দরে ১১টি ব্রিটিশ জাহাজের মধ্যে ৮ টি ই ছিল চট্টগ্রামের তৈরি। ১৯০০ শতকে চট্টগ্রামে এক হাজার টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ তৈরি হত। সিজার ফ্রেড্রারিক লিখেছেন, চট্টগ্রাম থেকে ২৫ থকেে ৩০টি জাহাজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। এখানকার নির্মিত জাহাজ গুণে মানে আলেকজান্দ্রিয়ায় তৈরি জাহাজের চেয়ে উন্নত ছিল। জার্মানির ব্রেমার হ্যাভেন জাদুঘরে এখনও চট্টগ্রামের তৈরি জাহাজ প্রর্দশনীর জন্য সংরক্ষিত আছে।কালের স্রোতে সাম্পানের আগের সেই জোরালো অবস্থান না থাকলেও ঐতিয্যের অনুষঙ্গ হিসেবে কর্ণফুলীর বুকে বেঁচে আছে আজো।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীনদী ও সাগরের পাড়ের মন মাতানো গন্ধে সৃষ্ট চট্টগ্রামবাসীর আরেকটি প্রিয় জিনিস শুটকি।মূলত মৎস্য সংরক্ষণের প্রয়োজনে এ শিল্পটি গড়ে উঠেছে। শুকানো শুটকি সুন্দর ও সুস্বাদু একটু কম হয়। সাগর পাড়ে শুকানো শুটকির স্বাদ ভালো হয়। কারণ লোনা পানির মাছ ও লোনা বাতাসে শুকানো শুটকির স্বাদ-গন্ধ আলাদা। আর র্কণফুলী পাড়ে শুকানো মাছে লবণ মিশিয়ে শুকাতে হয়। এছাড়াও র্কণফুলী পাড়ের বাতাস র্আদ্রতামিশ্রিত।এ কারণে অন্য শুটকির চেয়ে এখানকার শুটকির স্বাদ-গন্ধ একটু আলাদা।ফলে চট্টগ্রামের শুটকির খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পরেছে।
শুস্ক ও হাল্কা খাদ্য প্রস্তুতকারক শিল্পেও চট্টগ্রামের রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য।চট্টগ্রামের বিখ্যাত গণি বেকারী, বজল বেকারী,মাস্টার বেকারীর নাম আজো সুবিদিত।মিষ্টান্ন শিল্পেও পুরোনো বোস ব্রাদার্স হতে শুরু করে বর্তমানের মধুবন, ফুলকলি,পূরবীর নাম পুরো দেশে সমুজ্জল।
বিস্কুটের কথা আসলে বেলা বিস্কূটের কথা বলতেই হবে। বড় সাইজের শক্ত এ বিস্কুটের কদর একসময় চট্টগ্রামবাসীর ঘরে ঘরে ছিল।সকালের নাস্তায়, স্কুলের টিফিনে,বিকালের হাল্কা নাস্তায় চায়ের সাথে বেলা বিস্কুট ছাড়া চট্টগ্রামবাসীকে ভাবা যেত না।কালের ছোঁয়ায় খাদ্যাভাসের পরিবর্তনে বেলা বিস্কুটের আগের অবস্থান না থাকলেও এখনো বিশেষ একটি অবস্থান ধরে রেখেছে।
বিশ্বায়নের এই যুগে যেখানে সব প্রকার স্বতন্ত্র চিহ্ন এক দেহে লীন হয়ে পরছে সেখানে নানা ধরণের সংযোজন –বিয়োজন সত্ত্বেও চট্টগ্রামবাসীর তাদের মূল সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবোধ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১২:০২