অনেকবছর পর একটা ফোন, একটা কন্ঠস্বর এতটা আনন্দ দিতে পারে জানা ছিল না আমার। কিছুটা অভিভূত, কিছুটা বিস্মিত আমি।। এমনিতেই আবেগপ্রবণ মানুষ আমি। সায়রা বানুর ফোনটা আমাকে ভীষণ আবেগপ্রবণ করে দিল আমাকে। বরিশালের প্রত্যান্ত অঞ্ছলের অসহায় এক দম্পতি সায়রা বানু আর মজু মিয়া। প্রকৃতির নির্মমতায় সর্বস্ব হারানো একটি পরিবার। দুই ছেলে বাবা মাকে ফেলে বউ বাচ্ছা নিয়ে ঢাকায় থাকেন ।। ছেলেরা বাবা মায়ের খোজ নেই নি কোনকালে। থাকার একছালা ঘরটায় বৃষ্টি হলে বসার উপায় ছিলনা। খেয়ে না খেয়ে তাদের দিনকাল। এত কষ্টের মাঝেও সায়রা বানু তার একমাত্র মেয়েকে পড়াশুনা করানোর ব্যাপারটা আশ্চর্য ছিল। একটা সময় ছিল আমি উন্নয়ন কর্মী হিসাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্ছলে ঘুরেছি। অসংখ্য মানুষের সাথে আমার পরিচয়। আমি মানুষের কান্না দেখেছি, ভেসে যাওয়া স্বপ্ন দেখেছি, নতুন উদ্যমে মানুষের স্বপ্ন গড়া দেখেছি। সায়রা বানুর সাথে আমার পরিচয় তখনকার কোন এক সময়ে। বেশ কয়েকবার গিয়েছি সায়রা বানুর কুড়ে ঘরে। একখানা ভাঙা চেয়ার। তাদের সবচেয়ে পরিস্কার কাপড়টা দিয়ে মুছে আমাকে বসতে দিত। কখনো খালিমুখে আসতে পারিনি সায়রা বানুর বাড়ি গিয়ে।। কখনো ওদের গাছের পেয়েরা, কখনো পেপে । ইচ্ছে না থাকলেও আমাকে খেতে হয়েছে এইসব। তা না হলে ওদের ভালবাসার অপমান করা হবে। এই কৃত্রিমতার যুগে মানুষের এমন ভালবাসা অবহেলা করার সাহস আমার নেই।।আমাদের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট থেকে সায়রা বানুকে একটা নার্সারী করার অনুদান দেয়া হয়।। দুইজন বৃদ্ধ মানুষের এই স্বপ্ন গড়া চির অস্লান হয়ে থাকবে আমার স্মৃতির পাতায়।। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে বৃদ্ধ দস্পতির ভাগ্যর চাকা কতটুকু ঘুরেছে তা জানি না। তবে ওদের মেয়েটা এখন এইচ এসসি পাস করেছে।। নাসার্রীটা অনেক বড় হয়েছে। বড় হয়েছে ওদের ঘরটা । ঘরের চাল বেয়ে এখন আর পানি পড়েনা।।মেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন সায়রা বানু। কিভাবে মেয়ের বিয়ে দেবেন? ওরা মরে গেলে মেয়েকে দেখার কেও থাকবে না। এখনো মনে পড়ে সায়রা বানুর ছলছল করা সেই চোখ, কষ্টমিশ্রিত সেই হাসি। একদিন সায়রা বানুকে দুষ্টুমি করে বলেছিলাম, আপনার মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত দিবেনতো আমাকে? ছলছল চোখে আমাকে কথা দিয়েছিল অবশ্যই দাওয়াত দিবে আমাকে। আমার নাম্বারটা ছোট্র একটা কাগজে লিখে দিয়েছিলাম সায়রা বানুকে। সায়রা বানু ভুলেনি তার দেয়া কথা। ওর মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে আমাকে ফোন করেছে আজ।। সার , আপনারে আসতে হইব আমাগো মাইয়র বিয়াত।কাপা কাপা কন্ঠে সায়রা বানু বলে- আইবেন তো সার? আমার কন্ঠরোধ হয়ে আসে। মনে পড়ে সায়রা বানুর সেই দুই খানা জীর্ণ হাতের ছোয়া , অনেক বড় হও বাবা। আল্লা তোমাগো অনেক বড় করবো। আমরা বড় হতে পারিনি এখনো। সায়রা বানুরাই বড় থেকে যায় যুগে যুগে। এই ভালবাসা কোটি টাকায় কেনা যাবে না। কেউ কথা রাখে না--- কথাটা ঠিক না । এখনো সায়রা বানুরা কথা দিয়ে কথা রাখে। আর আমরা?
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:০৩