টানাপোড়েন
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
নদীর পাড়ে মাটিতে বসে একটি নারকেল গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে হাফিজ। নদীর ঢেউ পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে। প্রতি বছর জমিতে পদ্মার পলি জমে তার জমিকে করেছে উর্বর। প্রতি বছর ফসল ফলিয়ে সংসার চালায় সে। একটি মাত্র ছেলে তার। গাঁযের দস্যি ছেলেদের সাথে চলাফেরা করে লেখা পড়া করা হয়নি একমাত্র ছেলের। তাতে তার কোন ক্ষোভ নেই। জমি চাষ করে দিনতো ভালোই যাচ্ছে তাই বলে
কখনো আফসোস করেনি হাফিজ। এর মধ্যে বিয়েও করে ফেলেছে। তাই তার আর কোন দুশ্চিন্তা নেই তার। অভাব অনটন না থাকলে দুশ্চিন্তা কিসের। পদ্মা তাই অনেক প্রিয় চাষী হাফিজের। সূর্যের আলো পদ্মা জলে পড়ে চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে সোনায় মিশে গেছে জল। সারা জীবন পদ্মার এ চাকচিক্য ভালো লাগলেও আজ তার কিছুতেই ভালো লাগছেনা পদ্মার জল খেলা।
ভালো না লাগার অন্যতম কারন হলো পদ্মা আজ তাকে নি:শ্ব করে দিয়েছে। উচ্চাবিলাস কিংবা আভিজাত্য তার কখনো প্রত্যাশা না থাকলেও দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা ছিল তার সাধ্যের মধ্যে। তবু বিধি বাম। পাকা ধানে মই দিল পদ্মা। রাক্ষুসী পদ্মা কেড়ে নিল হাফিজের নগন্য অবলম্বনটুকু। তাই পদ্মার পাড়ে বসে স্মৃতিমন্থন করছে সে। নিজে কি করবে ছেলে, ছেলে বৌকে কি খাওয়াবে, কই থাকবে সে ভাবনায় কিনারা পায়না সে। অনেকটা গভীর সমুদ্রের তলদেশ খুজে না পাওয়ার মতো।
শ্বশুর বাড়ী নদী গর্ভে চলে যাওয়ার মাথ গোজার অভাবে বাপের বাড়ি চলে গেছে ছেলে বৌ নাজমা। বৌয়ের সাথে শ্বশুর বাড়ী ঘাটি জমিয়েছে হোসেন। কাজ কর্ম না থাকায় বেশ কিছুদিন অর্ধহারে অনাহারে এ-দুয়ার ও-দুয়ার ঘুরে দিন যাচ্ছে হাফিজের। না খেয়ে না খেয়ে খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। উপায় না পেয়ে বিয়াই বাড়ী আশ্রয় নিয়েছে হাফিজ।
মধ্যাংক
দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে সাময়িক সময় কাটলেও এখন দিনে দিনে দূর্বিসহ হয়ে উঠছে হাফিজের জীবন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে সে। এই শরীরখানা আজ তার কাছে ভার হয়ে পড়েছে। কিছুতেই বয়ে বেড়াতে পারছেনা। জীবনাকাশের পশ্চিম কোনে হেলে পড়েছে সূর্যিখানা। সংগ্রামী জীবনের পড়ন্ত বেলায় পরাজিত সৈনিকের মতো অসহায় হয়ে পড়েছে হাফিজ। নিজের শরীরে বল না থাকায় কাজ করতে পারেনা। একমাত্র ছেলে কাজের অভাবে শ্বশুর বাড়ী ঘর জামাই হয়ে বৌ এর কথায় উঠে বসে। অদৃশ্য শেকলে বাধা তার পা। প্রতিনিয়ত জন্মদাতার সাথে বাগদাত্তার অমন অসময় আচরন দেখেও চোখ বুঝে সহ্য করতে হয়। বাবার অমন অসহায়ত্বে কোন ভূমিকা রাখতে না পারায় নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত সে। আবার বাবার উপরও কিছুটা বিরক্ত হয়। যখন তার সোনালী সুদিন ছিল তখন কেন বাবা পদ্মা থেকে দুরের বিলে কেন এক খন্ড জমি কিনেনি। কেন কিছু টাকা ব্যাংকে জমা রাখেনি। তবেইতো আজ এ দু:সময় পার করতে হতো না। আবার নিজের উপর বিরক্ত হয় নিজে কেন লেখা পড়া করলো না। কিছুটা লেখা পড়া জানা থাকলে অন্তত শহরে গিয়ে কাজ করে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থানতো করতে পারতো। প্রচন্ড বিরক্তিতে নিজের চুল টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে তার।
বৃদ্ধ হাফিজ বাড়ীর বাইরে পথের ধারে করে বাচ্চাদের মতো কুকিয়ে কাঁদছে। কাজের সন্ধান শেষে বাড়ী ফেরার পথে দেখা বাবাকে দেখে দাড়িয়ে পড়ে হোসেন। বেশ কিছুদিন বাবার সামনে পড়ে না সে। বাবাকে দেখনে চোরের মতো লুকিয়ে থাকে। নিজের অসহায়ত্বের কাছে পরাজিত হয়ে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে হোসেন। বাবার চোখে জল আর সহ্য হয়না এই অত্যাচার। বাবার পাশে বসতেই আবেগি হয়ে পড়ে হাফিজ। হাউ মাউ করে কেদে উঠে সে। হাফিজ বলছে আমি আর পারতাছিনা বাজান। আমারে হয় মাইরা ফালা না হয় একটু ভালো কইরা খাইতে দে। চোখের জল ধরে রাখতে পারেনা হোসেন। কিন্তু সে নিরুপায়। নিজেই বেঁচে আছে শ্বশুর বাড়ীর দয়ায়।
আজ ও খেতে দেয়নি হাফিজকে তার ছেলে বৌ। আজ তিন দিন হলো খাবার বন্ধ করে দিয়েছে। এর আগে বেশ কয়েক মাস এক বেলা দু’বেলা সল্প পরিমানে খেতে দিত। যে পরিমান খাবার প্রয়োজন তার তুলনায় নগন্য হওয়ায় প্রতিদিনই ক্ষুদার জ্বালায় কাতরাত হাফিজ। ছেলের কাছে বলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। হাফিজের মতে সাড়া দিলো না নিজের ঐরশের সন্তান। কিন্তু বাবাকে লুকিয়ে খাবার চেষ্ট করেছেও সে। দু’এক বার মিশন সফল হলেও বেশির ভাগ মিশন ব্যর্থ হয়ে শাশিÍ স্বরূপ নিজকেই উপোস থাকতে হয়েছে। বাবার কষ্টে নিরবে কেঁদেছেও হোসেন। কিন্তু নিজের উপার্যন ক্ষমতায় না থাকায় অসহায়ত্বের কারনে আত্মসমর্পন করেছে হোসেন।
জমি চাষ ছাড়া অন্যকোন কাজ জানা নেই তার। গ্রামে জমি চাষ ছাড়া তেমন কাজও নেই, শহর অনেক ধরনের কাজ থাকে। রঙ্গীন শহরের সাথে তার পরিচয় নেই।
হাফিজের পৃথিবী অত্যন্ত ছোট। এই ছোট পৃথিবীর আলোও দিনে দিনে কমে আসছে। এখনি নামবে বুঝি অন্ধকার।
শেশাংক
নাজমাদের বাড়ীতে পুলিশ। বাড়ীর চারপাশে উৎসুক গ্রামবাসীর অসংখ্য চোখ বাড়িটির দিকে। এক নজর দেখার জন্য। পুলিশি ব্যারিকেডের কারনে বাড়ীতে প্রবেশ করতে পারছেনা পড়শিরা। ভেতরে কি হচ্ছে তা জানতে জানতে উৎসাহী মানুষের কৌতুহল যেন বেড়েই চলছে। ভেতরে কি হচ্ছে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। অস্পষ্ট আওয়াজ খরগোসের মতো কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে।
নাজমাদের ঘর থেকে একজন একজন করে বের হচ্ছে পুলিশ। রহস্যের পরিসমাপ্তি ঘটার পথে। পুলিশ এসে কৌতুহলি গ্রামবাসীদের মধ্য থেকে স্বাস্থ্যবান চারজনকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। এরমধ্যে কিছুটা সময় গত হয়েছে। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। অবশ্য গ্রামের মানুষের তেমন কাজ কর্ম নেই, তাই ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে বায়োস্কোপ দেখার মতো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাজমাদের ঘরের দিকে। পুলিশের বের হতে দেরি দেখে ভেতরে গিয়ে দেখতে চায় আসলে কি হুয়েছে। কিন্তু বাধা আছে। পুলিশ হলুদ প্লাস্টিকের ফিতা লাগিয়ে দিয়েছে। যাতে লেখা ডোন্ট ক্রস দিস এরিয়া।
এই মাত্র কিছু একটা কাধে দিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে পুলিশ। হোগলা পাতার পাটিতে মুড়িয়ে ঘর থেকে কি বের করছে পুলিশ গ্রামের এই সাধারন মানুষের বুঝার কথাও নয়। কারন তারা থানা পুলিশ কিংবা আইনি পরিস্থিতে তেমন অভ্যস্থ নয়। সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে কি করে হলো তা জানতে। এই মাত্র আমজাদ এসে হাজির হলো তার বাড়ী। বাড়ীর উপর এতো মানুষ, পুলিশ। ঠিক বুঝতে পারছেনা কেন এ অবস্থা। আমজাদ ভীড় ঠেলে এগিয়ে যায় সামনের দিকটায়। পুলিশের কাছে জানতে চায় কি হয়েছে? ঘটনা শুনে আমজাদ জানতে চায় ,ঘরে কাউকে পাওয়া গেছে। পুলিশ না সূচক মাথা নাড়ে। একমাত্র স্বাক্ষী হয়ে আর্ভিভাব ঘটে আমজাদের।
পুলিশের প্রাথমিক তথ্য বিবরনীতে রিপোর্ট লেখা হয়, ক্ষুদার তারনায় আত্মহত্যা করেছে হাফিজ।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?
অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।

১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন
১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন
=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?
যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!
যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।