: ‘বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ হচ্ছে'- আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের এমন বক্তব্যে সর্বমহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী দল আওয়ামী লীগ মনোনীত টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীর মন্তব্যে বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ষড়যন্ত্রের সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখতে পাচ্ছে। মেয়াদের এক বছর যেতে না যেতেই একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর এ ধরনের বিতর্কিত বক্তব্য সরকারের উদ্দেশ্য ও তথাকথিত গণতন্ত্র চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল প্রতিবেশী ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই বহাল থাকলেও মহাজোট সরকার কেন বাংলাদেশে বন্ধ করতে চায় তা গোটা জাতির কৌতূহলের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেশী একটা দেশের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ ও ইসলামের প্রতি বৈরী মনোভাবই আওয়ামী সরকারকে এ পথে ঠেলে দিয়েছে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রশ্নবিদ্ধ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবিশ্বাস্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে। নির্বাচনী অঙ্গীকার ভঙ্গের মহড়া ও পাহাড়সম ব্যর্থতায় সরকারের এক বছর পূর্তির প্রাক্কালে গত সোমবার ‘টেকনোক্র্যাট' আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের এক বক্তব্যে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। তিনি সচিবালয়ে তার দফতরে সাংবাদিকদের বলেন, পঞ্চম সংশোধনীর ব্যাপারে হাইকোর্টের দেয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হওয়ায় বাহাত্তরের সংবিধান আপনাআপনিই বলবৎ হচ্ছে। ওই সংবিধানের আলোকে চার মূলনীতির ভিত্তিতে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হচ্ছে। কেননা ১৯৭২ এর সংবিধানের মূলনীতির আলোকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার কোন সুযোগ নেই। তার এই বক্তব্যে সরকারের প্রতিপক্ষ ঘায়েলের দুরভিসন্ধিমূলক মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করলে তা হবে সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। প্রতিবেশী একটি দেশের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ ও ইসলামের প্রতি বৈরী মনোভাবই আওয়ামী সরকারকে এ পথে ঠেলে দিয়েছে। স্বাধীনতার ৩৮ বছরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভাজনের পর তা হবে জাতিকে দ্বিধা বিভক্তির আরেকটি অপপ্রয়াস মাত্র। স্বল্প মেয়াদে মহাজোট নেতাকর্মী, সমর্থকদের সস্তা বাহবা পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে তা হবে জাতীয় সমৃদ্ধি, এমনকি ‘ভিশন-২০২১' অর্জনের পথে বিশাল প্রাচীর। বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ঐতিহ্যগতভাবে এ ভূখন্ডে ইসলামী রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিকাশমান গণতান্ত্রিক ও উদার মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ায় এখানে বিশেষ করে ১৯৭০ এর দশকের শেষ পাদ থেকে জাতীয়তাবাদী-অজাতীয়তাবাদী, ইসলামী-অ ইসলামীক রাজনৈতিক দলের জন্ম হতে থাকে এবং নির্বিঘ্নে তারা কার্যক্রম পরিচালিত করে আসছে। বর্তমানে সক্রিয় জাতীয়তাবাদী-ইসলামী দলগুলোর বেশ ক'টির জন্ম স্বাধীনতার আগেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, আওয়ামী লীগ এ দেশে কেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চায় তার সপক্ষে কোন গ্রহণযোগ্য যুক্তি দাঁড় করাতে পারবে না। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলনসহ প্রায় এক ডজন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সক্রিয় রয়েছে। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে নানা কারণে ভয় করে। জামায়াতে ইসলামীকে স্তব্ধ করার জন্যই কি এ উদ্যোগ? তুরস্কে দীর্ঘদিন ইসলামী দল একে পার্টিকে নিষিদ্ধ করে রাখা হলেও এক পর্যায়ে তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিবেশী দেশ ভারতে কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)সহ বেশ কয়েকটি দল ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে। আমেরিকা-ইউরোপেও খৃস্টান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এর মধ্যে জার্মানীর ক্রিশিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন', অস্ট্রেলিয়ার ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি', বেলারুশের ‘কনজারভেটিভ ক্রিশ্চিয়ান পার্টি', বেলজিয়ামের ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেট এন্ড ফ্লেষিশ পার্টি', কানাডার ‘ক্রিশ্চিয়ান হেরিটেজ পার্টি', রাশিয়ার ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটস', মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্রিশ্চিয়ান কোয়ালিশন', ‘ক্রিশ্চিয়ান কোয়ালিশন অব ফ্লোরিডা' এবং ‘ক্রিশ্চিয়ান ক্যালেঙ্গিস্ট পার্টি অব আমেরিকা'সহ কমপক্ষে ৫০টি রাজনৈতিক দলকে বেশ দাপটের সঙ্গে ময়দানে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
মহজোট সরকারের নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতিহারে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ পায়নি। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের পাঁচটি বিষয়সহ ২৩ দফার ‘দিনবদলের ইশতিহারে' এ ধরনের গন্ধ পেলে ভোটাররা হয়তো বিকল্প চিন্তা করতো। ইশতিহারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ‘৫.৪ রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিষিদ্ধ করা হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ হবে। একটি সর্বসম্মত আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হবে। প্রবাসীদের মেধার সদ্ব্যবহারের জন্য পরামর্শক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে।' ২১.২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামী, কুপমন্ডুকতা, কুসংস্কার এবং জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের পাশাপাশি এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও জনগণকে বিজ্ঞানসম্মত এবং উদার মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হবে।' আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতিহারে (২০০৮) আরেকটি অঙ্গীকার করেছিল ‘২১.৩ কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না। সকল ধর্মের শিক্ষা ও মূল্যবোধের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে।'
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রীর নির্লিপ্ততা প্রমাণ করে এটি সরকারের বক্তব্য। কিন্তু জনমনে প্রশ্ন উঠছে, নির্বাচনী ইশতিহারে না থাকার পরও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে সরকারের এমন বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ কেন? জনগণ তো মহাজোট সরকারকে ধর্ম নিয়ে ‘নতুন রাজনৈতিক খেলা' শুরু করার কোন ম্যান্ডেট দেয়নি। তাছাড়া ধর্ম তথা ইসলাম থেকে সরে এসে, সেক্যুলারপন্থী রাজনীতি চালু হলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




