somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ দি হেলো ইফেক্ট ।

১৮ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৮:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঘুম ভাঙ্গার পরই যেন একটা ফুড়ফুড়ে অনুভুতি বয়ে যাচ্ছে শরীর-মন জুড়ে । বিভ্রম হচ্ছে, কোন শ্বেত-শুভ্র বরফঘেরা ঈগলু ঘরে শুয়ে আছি কিংবা সাদা কাফনে মোড়া কবরে । আচ্ছা, কবরেও কি এই রকম শীতল আনন্দের অনুভূতি হয় ? কিংবা ঈগলু ঘরে ? ইচ্ছে রইলো কোনদিন বরফের ঈগলু ঘরে রাত কাটিয়ে অনুভুতি পরখ করার । কিন্তু কবরে আদৌ কোন অনুভূতি বোধ থাকবেনা কিনা নিশ্চিত নই । তবে হোটেলের যে কক্ষে শুয়ে আছি তার পুরোটাই সাদা রঙে মোড়ানো- সাদা দেয়াল, জানালায় সাদা রঙের পর্দা, বালিশ-চাঁদর এমনকি সোফার কভারও সাদা ।

ফ্রেশ হয়ে চা-নাশতা খেয়ে নিচে নামলাম । অফিসের কাজে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চিটাগাং আছি, আজ এক বেলার জন্য একটু অবসর সময় পেলাম । যাই একটু আগ্রাবাদ ঘুরে আসি, ইউনি বন্ধু পাপন কয়েকদিন ধরে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করছে । আজকের এই একবেলা অবসর সময়টা কাজে লাগিয়ে আসি ।

চকবাজার মোড়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে সিএনজি'র জন্য দাঁড়িয়ে আছি । আগে কখনো আগ্রাবাদ যাইনি, তাই জানিনা ভাড়া কত নিবে । আমারও তাড়া নেই, আয়েশে সিগারেট ফুকছি আর সিএনজি ওয়ালাদের ভাড়া জিজ্ঞেস করছি । সিগারেট শেষ হতে হতে যেটা পাব সেটায়ই উঠে পড়বো । আশেপাশে অসংখ্য চলমান মানুষ আর যানবাহন, কেউ কারো দিকেই তেমন দৃষ্টিপাত করছেনা । হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে । এক নজর দেখেই দৃষ্টি সিএনজি'র দিকে দিলাম, তার দিকে ফের তাকানোর কোন আগ্রহ পেলাম না । আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢাকা, সাথে কালো নেকাব, কালো স্কার্ফ আর বাদামী রঙের রোদচশমা পড়া একজন মহিলা হয়ত আমার মতই, কোন বাহনের অপেক্ষায় । একটা ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস ধেয়ে আসছে সাগরের দিক হতে । চিটাগাংয়ের আবহাওয়া আর্দ্র আর ভ্যাপসা বলেই জানি, কিন্তু মার্চের এই সকালবেলার ঝিরঝিরে বাতাস দারুন উপভোগ্য ।

একটা সিএনজি ঠিক করে উঠতে যাব, এমন সময় পেছন দিক থেকে কে যেন ডাক দিলো, মাহমুদ শোন.. ! আশেপাশে সবাই চলমান, শুধু নেকাবধারিনী আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে । জায়গায় দাঁড়িয়েই বললাম, আমাকে কিছু বলছেন ? রোদচশমাটা এক হাত দিয়ে নামিয়ে মুচকি হেসে বললো, হ্যাঁ তোমাকেই বলছি !! ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস হঠাৎ যেন লু হাওয়ার রুপ নিয়ে আমার গায়ে গরম ছ্যাক দিলো । গলার স্বরের সাথে চোখ-মুখ পরখ করে নিশ্চিত হলাম, এ যে রুচিতা !! আড়ষ্ট পায়ে হেটে কাছে গেলাম, রুচিতা তখনও মিটমিট করে হাসছে । লং কোটের মতো ডিজাইন করা বোরখা আর রেশমী কাজ করা নেকাব-স্কার্ফে তাকে ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ বলে মনে হচ্ছে ।

অবাক হওয়ার ব্যাপারটা দ্রুত সামলিয়ে কন্ঠ নামিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম, 'তুমি এখানে ? কিভাবে সম্ভব ??' রুচিতা চোখ নাচিয়ে উত্তর দিলো, 'অসম্ভব হবে কেন ? তোমার সাথে যেকোন জায়গায়ই দেখা হতে পারে । এখানে হয়েছে, তাতে সমস্যা কি ?' রুচিতার কথার কৃত্রিম দৃঢ়তা দেখে হেসে ফেললাম । মজা করে বললাম, 'অবগুন্ঠনে আবদ্ধ রেখে পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে নিজেকে বন্চিত রেখেছো কেন ?' রুচিতা খিক খিক করে হেসে দিলো, সেই আগের মতোই প্রাণখোলা দীর্ঘ হাসি । হাসতে হসতেই বললো, 'তোমার সাথে দেখা হবে এই আশায় চোখ দুটি এখনো খোলা রেখেছি ।' তার এই কথাটি তীব্র শ্লেষ হয়ে যেন আমার বুকে বিঁধলো । প্রসংগ পাল্টিয়ে বললাম, 'কোথায় থাকো ? কি করো ?' আমার গলার স্বরের পরিবর্তন রুচিতা মনে হয় ধরতে পেরেছে । সেও গলা নামিয়ে বললো, 'আমরা জুরিখে থাকি । কিছুদিন আগে দেশে এসেছি । আমার একজন মামা থাকেন চিটাগাংয়ে, মা তাকে দেখার জন্য অস্থির হয়েছিলেন । কালকেই ঢাকা ফিরবো ।' তারপর রোদচশমাটা চোখে দিয়ে বললো, ' কিছু মনে করোনা মাহমুদ, তোমার সাথে বলার মতো অনেক কথা জমে আছে । কিন্তু এখন কিছুটা তাড়া আছে, প্লিজ তোমার সেল নাম্বারটা দাও ।'

সিএনজিতে আগ্রাবাদ যাচ্ছি, কেমন যেন একটা ঘোর ঘোর লাগছে । ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাসটা আবার গায়ে এসে লাগছে । মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছি, গায়ে কাঁটা দিলে যেমন হয় । রুচিতার সাথে এভাবে কখনো দেখা হয়ে যেতে পারে চিন্তাই করিনি । রুচিতার সাথে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা কি পাপন কে জানাবো ? আচ্ছা, রুচিতার দেশে আসার খবরটাতো পাপনের জানা থাকা উচিৎ । রুচিতার সাথে ক্যাম্পাসে আমার দীর্ঘ ছয় বছরের প্রেম ছিলো, পাপনও প্রেম করতো । প্রায় সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের কোন নির্জন স্থানে আমি-রুচিতা আর পাপন-তিথী পাশাপাশি বসে প্রেম করতাম । ক্যাম্পাস জীবন শেষে একটা ছোট চাকরি নিয়ে ঢাকায় আসার পর রুচিতার মা আমার বাবা-মায়ের সংগে কথা বলতে চাইলেন । পাপনই তখন দুই পক্ষের মাঝে মিডিয়া হিসাবে আবির্ভুত হয় । আমার মা কথা দিয়েছিলেন ছয় মাসের মধ্যে রুচিতাকে ঘরে তুলে নিবেন । তারপর থেকে পাপনকে নিয়ে আমি প্রায়ই যেতাম রুচিতাদের বাসায় । রুচিতার মা তার হবু মেয়েজামাইকে নিজের পরিবারের সদস্যের মতোই মনে করতেন । মাঝেমধ্যে চুপিসারে রুচিতার ঘরেও চলে যেতাম । সেই একান্ত মুহুর্তগুলো আজো স্মৃতিপটে ভেসে উঠে হৃদয়ে রক্তক্ষরন ঘটায় । এমনি এক একান্ত সময়ে রুচিতার ডায়েরীর ভাঁজ থেকে বেরিয়ে পড়ে সেই চিঠি । তার অলক্ষ্যেই পড়ে নিয়েছিলাম । জুরিখ থেকে তার এক কাজিন লিখেছিলো, প্রয়োজনে সে সারাজীবন অপেক্ষা করবে । যে কোন অবস্থায়, এমনকি রুচিতার বিয়ে হয়ে গেলেও সে তাকে পেতে রাজি ।

রুচিতাকে এটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে কোন সদুত্তর পাইনি, এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগতে থাকে রুচিতা । আর আমি নিরবেই সড়ে এসেছিলাম তার জীবন থেকে । এর পরের ঘটনা প্রবাহে পাপন আর রুচিতার মা অনেক চেষ্টা করেছিলো দুজনকে মিলিয়ে দেয়ার । এতে রুচিতার মায়ের সাথে পাপনের সম্পর্ক আর যোগাযোগটা থেকে যায় ।

পাপনের সাথে আমার দেখা বছর দশেক পর । আমাকে পেয়ে তার উচ্ছাসের শেষ নেই । তিথীর সাথে তখনই ফোনে আলাপ করিয়ে দিলো । ইউনির বন্ধু, যাদের সাথে আমার যোগাযোগ নেই তাদেরকেও ফোন দিলো । একসাথে ঘন্টা দুই আড্ডা দিয়ে ওর অফিস থেকে নামছি ফেরার জন্য । সিএনজিতে উঠার আগ মুহুর্তে পাপনের কাছে জানতে চাইলাম রুচিতার মায়ের সাথে তার যোগাযোগ আছে কিনা । পাপন একটা উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললো, 'শ্বাশুড়ীর কথা এখনও মনে আছে তাহলে ?' আমি বললাম, ফাজলামী রাখ, যোগাযোগ থাকলে বল ।' পাপন বললো, 'হ্যাঁ, সপ্তাহ খানেক আগে ফোনে কথা হয়েছে । রুচিতা আর তার মা আগামী মাসে দেশে আসবে । আমি চিটাগাং আছি শুনে উনিও বললেন চিটাগাং আসবেন ।'

পাপনের শেষ কথাগুলো আমি যেন ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছিনা, সাগরের ঢেউয়ের গর্জন আছড়ে পড়ছে আমার কানে । আর কথা না বাড়িয়ে পাপনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোন রকম সিএনজিতে উঠে বসলাম । সেই ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাসটা আবার বইতে শুরু করেছে, আর আমিও সমানে ঘেমে যাচ্ছি । সকালে আমি কার সাথে কথা বললাম ? কোন অশরীরি কি রুচিতা সেজে আমার সংগে কথা বলেছে ? নাকি এটা আমার মনের অন্তরালে নীরবে বয়ে চলা রুচিতা দুঃখগাঁথা ? কোন কিছুই ভাবতে পারছিনা । টাইগার পাস পার হবার সময় মনে হচ্ছে দুপাশের পাহাড়ে কালো বোরখা, কালো নেকাব-স্কার্ফ পড়া রুচিতা হিহি করে হাসছে.. । আর হাসির তরঙ্গ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গর্জন করে ধেয়ে আসছে আমার দিকে ।


************************************
সামুতে লেখা এই জাতীয় আরেকটি গল্প,

কে হায়, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায় :-< :-&
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০৫
৩৯টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×