somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ গোয়াইটুলি বাই লেইন ।

২২ শে জুন, ২০১৩ সকাল ১১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শহরের ঝাঁ চকচকে আম্বরখানা-টিলাগড় রোড ধরে মাইল খানেক যেতেই বাঁ দিকে একটা গলি । গলি থেকে কিছু দুরে একটা উপগলি মিশে গেছে লাক্কাতুড়া পাহাড়ের অপরুপ চা-বাগান আর রাবার বাগানের সাথে । গোয়াইটুলি বাই লেইন । জায়গাটা এখনো টিলাময়, মাঝে মাঝেই কিছু আদিম জঙ্গলের রুপ । ছাড়া ছাড়া কিছু পুরানো টিনশেড আধাপাকা বাড়ি । অল্প কিছু বহুতল ইমারত এই আদিম বসতিতে আধুনিক নগরের বিজয় ঝান্ডা তুলে ধরেছে । গোয়াইটুলি বাই লেইনের শেষ প্রান্তে চা-বাগানের জায়গা দখল করে কয়েকটা কলোনি, মুলত নিম্ন আয়ের মানুষের বাস । মুল গলি আর গোয়াইটুলি বাই লেইনের সংগমস্থলে একটা উঁচু টিলায় চাষনী পীরের দরগাহ । সারা মহল্লা জুড়ে অবাধে ঘুরে বেড়ায় লিজার্ট বানরের দল । লেংগুর হনুমানের তাড়া খেয়ে লাক্কাতুড়া উপত্যকার গভীর অরন্য থেকে বিতাড়িত হয়ে এই বানরের দল চাষনী পীরের দরগায় আশ্রয় নিয়েছে । দরগায় তারা সম্মানিত অতিথী, জিয়ারত করতে আসা লোকজন তাদের কলা-বিস্কুট খেতে দেয় । পুরো মহল্লা জুড়ে তাদের আধিপত্য । স্থানীয় মানুষের সাথে তাদের খুব একটা বিরোধ নেই, শুধু নিজেদের উপদলীয় কোন্দলের সময় বাড়িগুলোর টিনের চালে লংকাকান্ড ঘটানো ছাড়া । এই বুনো বানরের দলকেও যুঝতে হয় আরেকটি দলের সাথে, মহল্লার বালক দল ।

এই মহল্লার দেয়াল ঘেরা এক আধপাকা টিনের ঘরের বারান্দায় লম্বা একটা কাঠের বেঞ্চি । সন্ধ্যায় আলো জ্বলার পর বেঞ্চির এক প্রান্তে গোমড়া মুখে বসে আছে একাদশ বর্ষীয় বালক সৈকত । স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে সে । সারা বিকেল পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করে এসে রোজ সন্ধ্যায় এই বেঞ্চিতে বসেই পড়াশোনা করে, দু'পা ছড়িয়ে নৌকা চালানোর ভঙ্গিতে । প্রতিদিনের মতই তার সপ্তদশবর্ষীয়া বোন মিনু মুড়ির বৈয়াম হাতে বেঞ্চির অপর পাশে বসে । বৈয়াম খুলতে খুলতে আড়চোখে গোমড়ামুখো ভাইটিকে দেখে নেয় মিনু । মুখে কপট হাসি ফুটিয়ে শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,
"কি রে সৈকত, তোর আবার ডিমুশুন হইছে নি ?"
বুবুর প্রশ্ন শুনে সৈকতের গুমড়ামুখো গাল আরো ফুলে উঠে । কড়া চোখে বুবুর দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে নেয় । মিনু মজা পেয়ে মুখে কৃত্রিম রাগ ফুটিয়ে আবার বলে,
"কত্ত বড় সাহস ঐ পুচকে রাশু'র ! আমার ভাইকে ইস্টাইকার থাইকা ডিমুশুন দিয়া বেগি বানায়া দিছে ! কয়, আমার ভাই নাকি খালি আসমানের দিকে গৌল করে । আবার আমার ভাইরে সবার সামনে বটলা সৈকত ডাকে । ওরে পাইয়ালই, এমুন কানমলা দিমু না !"
সৈকত বুঝতে পারে মিনু বুবু কৌশল করে তাকেই 'বটলা' বলছে । দু'হাত দিয়ে বেঞ্চিতে বিশাল একটা থাপা দিয়ে চিৎকার করে উঠে, "বুবু তুমি চুপ করবা ?"
মিনু বুঝতে পারে আজকে বড় রকমের কোন ঝামেলা হয়েছে । তাই এবার গলার স্বরটা একটু নরম করে বলে,
"তোরে কি এবার ডিমুশুন দিয়া গৌলি বানাইছে ? অই, খুইলা কস না কেন ?"
সৈকত কোন কথা না বলে হাফপ্যান্টের পকেট থেকে একটা চামড়ার টুকরা বের করে মিনুর সামনে তুলে ধরে । মিনু এটা দেখেই বিস্ময়ে চিৎকার দিয়ে উঠে,
"হায় হায়, এইডা কি ? এইডাতো দেখি ফুটবলের চামড়া । আমি তোরে ফুটবল কিনার লাগি চান্দার টাকা দিলাম, নতুন বলটা কাটলো কেডা ??"
সৈকত মাথা নিচু করে উত্তর দেয়, "রাশু !"

এই হলো রাশু । সৈকতদের ফুটবল টীমের ক্যাপ্টেন রাশু । গোয়াইটুলি বাই লেইনের বালকদের অবিসংবাদিত নেতা । সৈকতের চেয়ে বছর তিনেক বড়, ক্লাস টু পর্যন্ত স্কুলে যাওয়া আসা করেছে । বাবা নাই, মা আর সৎ বাবার সাথে কলোনীতে ভাড়া থাকে । শাহীঈদগাহ মোড়ে বাবার চায়ের টংয়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে । বাবা দুপুরে বাসা থেকে ভাত খেয়ে দোকানে ফিরে আসার পর তার ছুটি । সারা বিকেল মহল্লায় ঘুরে বেড়ানো, ফুটবল ডাংগুলী মার্বেল খেলা আর ঘুড়ি উড়ানোই তার কাজ । ছোটরা তাকে সমীহ করার আরেকটা কারন রাশু সবজান্তা । আম্বরখানা থেকে শাহীঈদগাহ পর্যন্ত যতগুলো মহল্লা ভিত্তিক মাস্তান গ্রুপ আছে, সবাইকে সে চেনে । শুধু চিনে বললে কম বলা হয়, হাঁড়ির খবরও রাখে । কোন গ্রুপের সাথে কোন গ্রুপের টক্কর লেগেছে, কাদের হাতে কি ধরনের 'জিনিসপত্র" আছে, সব তার নখদর্পণে । গোয়াইটুলি বাই লেইনের মাস্তান গ্রুপের কাছে রাশু খুব বিশ্বস্ত । আশেপাশের সব মহল্লার খবর সে এখানে পৌছে দেয় ।

পরেরদিন বিকেলে মাঠে যাওয়ার জন্য সৈকতের মন উসখুস করতে থাকে । কিন্তু ফুটবল ছাড়া কিভাবে খেলবে ? আটজন মিলে দশ টাকা করে চাঁদা তুলে ওরা একটা পাঁচ নম্বরি ফুটবল কিনেছিলো । গতকাল খাসদবিরের ছেলেদের সাথে খেলা ছিলো । সে খেলায় হেরে যাওয়ায় রাশু রাগ করে ফুটবলটাকে কেটে আট টুকরো করে ভাগীদারদের হাতে কাটা চামড়া ধরিয়ে দেয় । তবু সৈকত মাঠের দিকে হেটে যায় । লাক্কাতুড়ার একটা কম ঢালু টিলা সামান্য কেটেছেঁটে বানানো হেলানো মাঠে দশবারো জন জটলা করে আছে । কাছে গিয়ে সৈকত দেখতে পায় রাশু একটা অভিনব বল নিয়ে এসেছে । ছাইপুড়া জাম্বুরার বলটা নিয়েই সবার জটলা । সাথে একটা সুখবরও আছে, মহল্লার এক বড়লোক বড়ভাই একটা ফুটবল কিনে দিবে । এর বিনিময়ে রাশুকে একটা কাজ করে দিতে হবে, কিন্তু কাজটা কি ধরনের তা সবার কাছে খুলে বলেনা । এটা নিয়ে না ভেবে সবাই মহা উৎসাহে জাম্বুরা বল নিয়েই ফুটবল খেলতে শুরু করে দেয় ।

একটা আধপুড়া জাম্বুরা নিয়ে সবাই যার যার ফুটবল প্রতিভা দেখাতে থাকে । জাম্বুরা নিয়ে যে যত বেশি ডজ দিতে পারে সে তত ভালো প্লেয়ার । নিজেরা দুভাগ হয়ে খেলছে । সৈকত তার নতুন পজিশন অর্থাৎ ব্যাক স্টপারে বেশ ভালো কয়েকটি ক্লিয়ার করে । এবার প্রতিপক্ষ দলের স্টাইকার রাশু জ্বলে উঠতে থাকে । কেরি কেটে কয়েকজনকে ডজ দিয়ে বিপুল বিক্রমে জাম্বুরা পায়ে গোল পোস্টের দিকে আগাতে থাকে । গোলকিপার ছাড়া খেলা, তাই সৈকতই শেষ ভরসা । নিশ্চিত গোল ঠেকানোর জন্য সৈকত কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে জাম্বুরা বরাবর লাস্ট চার্জ করে । কিন্তু তার কিক জাম্বুরায় না লেগে রাশুর পায়ে লাগে । সাথে সাথে রাশু 'ও আল্লাগো' বলে চিৎকার দিয়ে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় । সারা মাঠ হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায়, প্লেয়াররা যে যেখানে ছিলো সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে । সৈকত বুঝতে পারে রাশু এটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিবেনা, তাই সে দৌড়ে মাঠ থেকে পালাবে বলে মনস্ত করে । কিন্তু পালাতে গিয়ে যেন সৈকত এক পা ও নড়তে পারেনা, মাটিতে গড়িয়ে পড়া রাশুর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে । রাশু এক লাফে মাটি থেকে উঠে 'ফকিন্নির পোলা আমারে ফাউল করছস' বইলা ধরাম করে সৈকতের উরু বরাবর একটা লাথি মারে । আঘাতের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে সৈকত টালমাটাল হয়ে মাটিতে পরে যায় । লাথি দিয়েও রাশুর রাগ পড়েনা, সৈকতের উদ্দেশ্যে অনবরত খিস্তি আউরে যেতে বলতে থাকে, "অই ফকিন্নির পোলা, তোর মিনু বইনরে কলেজের সামনে থাইক্যা বালুচরের মস্তানরা উঠায়া নেয়ার লাগি টানাটানি করছিলো, এইডা আমি জানিনা মনে করছস ??"

মার খেয়ে সৈকত এমনিতেই ফুঁসছিলো, এবার মিনু বুবুরে নিয়ে রাশু খারাপ কথা বলায় তার বুক ফেটে কান্না আসতে থাকে । চোখের সামনে সদা হাস্যজ্জোল মিনু বুবুর মুখ ভাসতে থাকে । মিনু এক বছর ধরে কলেজে যায়না মাস্তানদের ভয়ে । সৈকত মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সেও বড় মাস্তান হবে । প্রকাশ্যে তার বোনের হাত ধরে টানাটানি করা মাস্তানদের খুঁজে বের করে উচিৎ শিক্ষা দিবে । তার মাস্তানি শুরু হবে আজ, এখন থেকেই । রাশুকে পিটিয়ে আজ সে মানুষ বানাবে । কিন্তু সৈকত তার প্রতিজ্ঞায় অবিচল থাকতে পারেনা, রাশুর কাছে নিজেকে বড়ই দুর্বল আর অসহায় মনে হয় । অন্যরা ইতিমধ্যে রাশুকে সৈকতের সামনে থেকে সড়িয়ে নিয়ে গেছে । সৈকত মাটি থেকে উঠে শরীরের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বাসার দিকে যেতে থাকে ।

এই ঘটনার পর সৈকত আর রাশুদের সাথে খেলবেনা বলে প্রতিজ্ঞা করে । কিন্তু পরদিন বিকেল হতেই মাঠে যাওয়ার জন্য আবার তার মন চঞ্চল হয়ে উঠে । বিকেলের অলস সময়টা পার করার জন্য সে চাষনী পীরের দরগার দিকে হাটা দেয় । প্রতিদিনের মত আজকেও কিছু ভক্ত দরগায় এসেছে । তারা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে বানরদের কলা-বিস্কুট সাধছে, আর বানরেরা কাছে এসে হাত দিয়ে সেগুলো নিয়ে যাচ্ছে । জন্মের পর থেকেই সৈকত এই দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত, তবু আজ এগুলো দেখে তার খুব মজা লাগছে । তার নিজেরও ইচ্ছে হয় দুটো কলা কিনে বানরকে দিতে, কিন্তু পকেটে হাত দিয়েই সৈকত চুপসে যায় ।

সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে আসে সৈকত । বারান্দায় বেঞ্চির এক পাশে দু'পা ছড়িয়ে বসে বাঘবন্দী খেলা খেলতে থাকে । খেলায় মগ্ন সৈকত টেরই পায়না কখন রাশু এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছে । কোন ভনিতা না করে বেঞ্চির অপর পাশে বসতে বসতে রাশু বলে, "কিরে আজকে মাঠে যাস নাই যে !" সৈকত রাশুকে দেখতে পেয়ে প্রথমে হতচকিত হলেও রাগ আর অভিমানে মাথা নিচু করে ফুঁসতে থাকে । রাশু নরম গলায় বলে, "কাইল তোরে মারছি, মিনু'বুরে গাইলাছি । ক্যান মারুমনা, এই দ্যাখ আমার এংকেল ফুইলা গেছে ।"
সৈকত রাশুর ফুলে যাওয়া পায়ের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে থাকে । দুজনে কিছুক্ষন মুখোমুখি চুপচাপ বসে থাকে । এমন সময় মিনু আসে । রাশুরে দেখেই বলে, "কেডা, রাশু লিডার নি ? দুইজনে ঘাপটি মাইরা বইয়া আছস ক্যান ? খাড়া, তোগো লাইগা গুড়মুড়ি নিয়া আসি ।"
মিনু ঘরে চলে যায় । সৈকত রাশুর দিকে চোখ বাঁকা করে তাকায় । রাশু মাথা নিচু করে অপরাধীর মত বসে আছে । আবার দুজনে চোখাচোখি হতেই রাশু হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় । তারপর ঘরের বাইরে চলে যেতে যেতে সৈকতকে বলে যায়, "কাইল নতুন ফুটবল আইবো, মাঠে আহিস ।"

পরদিন বিকেলে সৈকত যাবনা যাবনা করেও মাঠের দিকে চলে যায় । রাশু পাঁচ ছয় জন অনুসারীকে নিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে । সৈকতও তাদের পাশে গিয়ে বসে । ওদের মন খারাপের কারন অনুমান করতে কষ্ট হয় না । প্রতিশ্রুতি মত মাহল্লার বড় ভাই নতুন ফুটবল কিনে দেয় নাই । আজকে জাম্বুরা বলও নিয়ে আসা হয় নাই । এই অবস্থায় কি করা যায় তা কেউ ভেবে পায়না । রাশুই প্রস্তাবটা দেয়, নারিকলের মোয়া খাওয়ার । সবাই আগ্রহভরে জানতে চাইলে রাশু সবাইকে ইশারায় সাবধান করে দেয় । তারপর ফিসফিস করে বলে, "দেখিস কেউ য্যান না জানে । হাসু মিয়ার কলোনিতে এক বেডা নয়া ভাড়া আইছে । দিনরাত ঘরের ভিতর বইয়া থাকে, কোনহানে যায়না । হের ঘরে একদিন চুপি দিতেই আমারে ডাক দিছে । নাম জিগায়, বাসা জিগায় । হেরপর বেডায় আমারে নারকেলের মোয়া খাইতে দিছে । আমার কেমুন জানি সন্দে লাগছে যে বেডা ভালা না । সাংবাদিক মাহবুব ভাইরে কথাডা কইতেই আমারে কইছে বেডারে চোখে চোখে রাখতে । এখন আমি প্রায়ই বেডার কাছে যাই আর মোয়া খাইয়া আসি । এখন বল, তোরা নারিকেলের মোয়া খাবি কি না ?"

রাশুর গল্প বলার ভঙ্গিতেই ভয় পেয়ে দুজন যাবেনা বলে দিয়েছি । সৈকত শিশির আর পরাগ রাশুর সাথে যেতে রাজি হয় । রাশু দীপ্ত পায়ে সামনে হাটতে থাকে । অজানা আশংকা আর মোয়া খাওয়ার প্রলোভনে বাকি তিনজন তার অনুগামি হয় । ফিরোজ মিয়ার কলোনি পার হয়ে একটা রাস্তা চা-বাগানে মিশে গেছে, আরেকটা সরু রাস্তা দুইটা ছোট টিলা পার হয়ে হাসু মিয়ার কলোনিতে গেছে । জায়গাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন, কলোনিতে দশ-বারোটা খুপড়ি ঘর । কলোনির পেছনে একটা টিনশেড ঝুপড়ি ঘরের সামনে তারা দাঁড়ায় । রাশু তিনজনকে ইশারায় দাঁড় করিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে দেখার চেষ্টা করে । হঠাৎ তার হাত লেগে পুরানো টিনের দরজা মচমচ করে উঠে । ভিতর থেকে একজন হাঁক দেয়, 'কেডা ?' রাশু গলা নামিয়ে জবাব দেয়, 'আমি রাশু ।'

কিছুক্ষন পর দরজা খুলে গাট্টাগোট্টা মাঝবয়সি একটা লোক বেরিয়ে আসে । রাশুরে দেখেই বলে উঠে, 'কিল্লাই আইছস ?' রাশু প্রথমে আমতা আমতা করে, তারপর দ্রুত নিজেকে সামলিয়ে বাকি তিনজনকে দেখিয়ে বলে, ' আমরা এইহান দিয়া যাইতেছি, আপনের মোয়া খুব মজা শুইনা ওরা কইলো.." লোকটা বাকি তিনজনের দিকে চোখ পিটপিট করে তাকায় । "ও মোয়া খাইবি ? খাড়া লই আই" । লোকটা ঘরে গিয়ে মোয়া হাতে ফিরে আসে । রাশুর হাতে একটা মোয়া দিয়ে পরাগের দিকে তাকিয়ে বলে 'তোর নাম কি ?' পরাগ নাম বলার পর লোকটা তার হাতে একটা মোয়া দিয়ে গালটা আলতো করে টিপে দেয় । তারপর শিশিরকেও একটা মোয়া দিয়ে তার গাল টিপে সৈকতের দিকে এগিয়ে যায় । সৈকতের গলার পেছনে একটা হাত আলতো করে রেখে তার নাম জিজ্ঞেস করে । সৈকত খুব ইতস্তত করতে থাকে । লোকটা সৈকতের হাতে মোয়া দিয়ে ওর গাল আঙুল দিয়ে ঘষতে থাকে । সৈকতের প্রচন্ড খারাপ লাগতে শুরু করে, কিন্তু কি করবে ভেবে বুঝে উঠতে পারেনা । হ্যাচকা টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে লোকটা তাকে আরো চেপে ধরে বলে, খাস না ক্যান?' রাশু বুঝতে পারে সৈকত লোকটার হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না । সে চোখ লাল করে লোকটার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে, ওরে ছাইড়া দ্যান, নাইলে ভালা হইবো না কইলাম' । লোকটাও তখন চোখ বড় করে রাশুর দিকে তাকায় । রাশু তার হাতের মোয়া লোকটার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলে, 'বেডা বদমাইশ, তোরে আইজ শিক্ষা দিমু । লোকটা সাথে সাথে সৈকতকে ছেড়ে দিয়ে রাশুর গালে বিশাল একটা থাপ্পড় লাগায় । থাপ্পড় খেয়ে রাশু গালে হাত দিয়ে বসে পড়ে । বাকি তিনজন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । হঠাৎ রাশু উঠে এক দৌড়ে লোকটার ঘরে যায় এবং খানিক পরেই একটা চাকু হাতে বেরিয়ে আসে । লোকটাও তখন রাশুকে ধরার জন্য এগিয়ে যায় । রাশু চিৎকার করে বলতে থাকে, 'তোরা পালা, তোরা পালা ।' সৈকত-শিশির-পরাগ তখনই এক দৌড়ে আঙিনার বাইরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ায় । রাশু হাত দিয়ে চাকু ঘুরিয়ে যাচ্ছে আর লোকটা একবার ডানে একবার বামে ছুটে গিয়ে রাশুর হাত ধরার চেষ্টা করতে থাকে ।

শিশির হঠাৎ বলে উঠে, 'এই বেডায় রাশুরে মাইরা ফালাইবো' । সৈকত ওরে ধমক লাগিয়ে কয়েকটা ইট আনতে ইশারা করে । শিশির আর পরাগ তখনই কয়েকটা ইটের আধলা নিয়ে আসে আর গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তারা লোকটাকে অনবরত ঢিল ছুঁড়তে থাকে । একটা ঢিল লোকটার গায়ে লাগতেই সে ঘুরে দাঁড়ায়, অমনি রাশু এক দৌড়ে লোকটাকে কাটিয়ে গাছের কাছে চলে আসে । সেখান থেকে চারজন দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরোজ মিয়ার কলোনিতে এসে থামে । হাঁপাতে হাঁপাতে রাশু নির্দেশের সুরে বলে, 'অই তোরা এই ঘটনা চাইপা যাইস, কাউরে কইস না । চাকু আনার সময় বেডার ঘরে একটা 'জিনিস' দেখছি । আমি মাহবুব ভাইরে খবরটা দিয়া আসি, তোরা বাসায় চইলা যা ।'

ভয়ংকর সন্ধ্যাটার কথা ভেবে ভেবে সৈকত রাতে ঘুমুতে পারেনি । সকালে উঠে সে বেঞ্চিতে বইপত্র নিয়ে পড়তে বসে, কিন্তু চোখের সামনে থেকে বজ্জাত লোকটাকে কিছুতেই সড়াতে পারছে না । বেঞ্চির অপর পাশে বসে মিনু আপন মনে বালিশের কাভারে ফুল এঁকে যাচ্ছে । এমন সময় দৌড়াতে দৌড়াতে রাশু আসে । "সৈকত, অই বেডারে কাইল রাইতে পুলিশে ধরছে, এই দ্যাখ পেপারে ছবি দিয়া খবর ছাপছে ।"
"কোন বেডারে পুলিশে ধরছে রে রাশু, দেখি পেপারটা' বলেই মিনু রাশুর হাত থেকে স্থানীয় দৈনিকটা নিয়ে খবর খুজতে থাকে । রাশু পেপারের প্রথম পাতার নিচের দিকের খবরটা দেখায় । "টাঙ্গাইলের শিশু ধর্ষণকারী ফুরকান অস্ত্র সহ সিলেট থেকে গ্রেফতার ।" মিনু এক নিশ্বাসে খবরটা পড়ে । রাশু তখনই পেপারটা নিয়ে বাকিদের দেখানোর জন্য দৌড় লাগায় ।

খবরটা পড়ে মিনু রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে । বেঞ্চির ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সৈকত মিনুর আগুনে চোখ দেখে মাথা নিচু করে থাকে । "অই পোলাপানের লগে কালকে তুইও ছিলি ?"
সৈকত কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বেঞ্চিতে বসে পড়ে । মিনু সৈকতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, তার চোখগুলো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে । হাতগুলো শক্ত ইস্পাতের মত হয়ে যায় । মিনুকে এইভাবে এগিয়ে আসতে দেখেও সৈকতের কোন ভাবান্তর হয় না, নিশ্চুপ মাথা নিচু করে বসে থাকে । সৈকতের কাছে এসেই মিনু বেঞ্চিতে বসে পড়ে । তারপর সৈকতকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে বলে, "তুই আমার লক্ষ্ণী ভাই ।"
বুবু'র বুকে মাথা রেখে সৈকত বুঝতে পারে তার পিঠে-কাঁধে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে মিনুবু'র চোখের জল ।


***********************************

উৎসর্গঃ গল্পকার হাসান মাহবুব । 'অফস্পিন' পড়ার পর কিশোরদের নিয়ে আমিও কিছু লিখতে চেয়েছিলাম ।

***********************************


আরো একটি গল্পঃ

সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে স্নানঘাটের সিঁড়িতে ।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৩ সকাল ১০:২৭
৪১টি মন্তব্য ৪১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হেঁটে আসে বৈশাখ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০০


বৈশাখ, বৈশাখের ঝড় ধূলিবালি
উঠন জুড়ে ঝলমল করছে;
মৌ মৌ ঘ্রান নাকের চারপাশ
তবু বৈশাখ কেনো জানি অহাহাকার-
কালমেঘ দেখে চমকে উঠি!
আজ বুঝি বৈশাখ আমাকে ছুঁয়ে যাবে-
অথচ বৈশাখের নিলাখেলা বুঝা বড় দায়
আজও বৈশাখ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×