প্রথম চৈত্রের বিষণ্ণ দুপুর । খা খা রোদের প্রচন্ড তেজে ঝিমিয়ে পড়েছে বারুক গ্রাম । সাপের মত পেঁচানো গোপাট গ্রামের বিচ্ছিন্ন বাড়িগুলোর সামনে পেছনে ছুঁয়ে নেমে গেছে দখিনের বিশাল ধানী জমিতে । সেখানে ঘন হিজল গাছের সারি ঢেকে দিয়েছে পায়ে চলা পথ । নিস্তব্ধ দুপুর বিদীর্ণ করে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ।
বীভৎস দুপুরের বিভীষিকা উপেক্ষা করে ঝিঁঝিঁ পোকার পিছু নিয়েছে গ্রামের কয়েকটি দামাল ছেলে । লম্বা কঞ্চির আগায় বাঁধা মোরগের পালক চিটাগুড়ে ভিজিয়ে একমনে খুঁজে যাচ্ছে গাছের পাতার রঙের সাথে প্রায় মিশে থাকা সবুজ ঝিঁঝিঁ পোকা । তাদের কাছেই প্রথম জানতে পারি গ্রামের রসুল মাস্টারের সুমত্ত মেয়ে হাফসা বিবিকে নাকি শয়তানে ধরেছে ।
বারুক গ্রামে যে কয়েক ঘর সচ্চল মানুষ আছে, রসুল মাস্টার তাদের একজন । নির্বিবাদি ভালোমানুষ এই মাস্টার আর তার অন্য তিন ভাইয়ের মুখোমুখি চারটি ঘর । বাঁশের চাটাই ঘেরা বাড়িটিতে বাইরের মানুষের যাতায়াত সীমিত । শুধু বাড়ি নয়, ভেতর বাড়ির মানুষগুলো কঠিন পর্দা বজায় রাখে । তাই এরকম একটা বাড়ির সুমত্ত মেয়ের মানসিক বিকৃতির আসল খবর পেতে আমাদের উৎসাহ মাত্রা ছাড়িয়ে যায় ।
সম্ভাব্য প্রতিটা উৎস খুঁজে খুঁজে আমরা চেষ্টা করতে থাকি হাফসার অসুস্থতার পূর্ণ বিবরণ বের করার । মাস্টার বাড়ির ছোট বাচ্চাদের পাকরাও করে জানতে পারি, কয়েক মাস আগে এক ভরা পূর্ণিমার রাতে গায়েবি ডাক পেয়ে হাফসা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । বাড়ির পেছনে বিশাল পুকুরের বায়ুকোণে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা প্রাচীন নারিকেল গাছের নীচে যেতেই ঐ গাছে থাকা শয়তান তাকে আছড় করে । আরও বিস্তারিত জানতে ঐ বাড়ির সাংবাৎসরিক গোমস্তা রুস্তমকে কৌশলে হাত করি ।
গ্রামের চায়ের দোকানে বসে গোমস্তা রুস্তমের মুখে সে রাতের রোমহর্ষক বর্ণনা শুনি । চুপিসারে ঘরের পেছনের দরজা খুলে হাফসা চলে গিয়েছিল পুকুর পাড়ের নারিকেল গাছের নীচে । তারপর সেখান থেকে এক দৌড়ে ঘরে ফিরে এসেছিল । ফেনা বেরিয়ে আসা ভয়ার্ত মুখে চিক্কুর দিয়ে হাফসা 'আমারে শয়তানে পাইছে' বলেই মূর্ছা গিয়েছিল । এর পর সপ্তাহ ধরে হাফসা প্রায়ই ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠত আর তার মা কে জড়িয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকত ।
রসুল মাস্টার গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার ইরফান আলীকে ঘটনা খুলে বলেন । ডাক্তার রসুল মাস্টারকে অভয় দিয়ে কিছু ঔষধ দেন । সেই সাথে পাশের গ্রামের বড় হুজুরের কাছ থেকে পানি পড়া খাওয়ানোর পরামর্শ দেন । কিন্তু ঔষধ আর পানি পড়া খেয়েও হাফসার উদভ্রান্ত আচরণ আর ভয়ার্ত চিৎকার কমে আসার কোন লক্ষণ দেখা গেল না । কিছু ঘনিষ্ট মানুষের পরামর্শে শেষে হাফসাকে থানা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ।
একদিন সকাল বেলা বাড়ির সামনে রিক্সা আসে । পুরাতন কালো শাড়ি কেটে ঘরে বানানো বোরখা পড়ে হাফসা আর তার মা রিক্সায় উঠে বসে । অজানুলম্বিত কালো বোরখায় শুধু চোখের সামনে দুটি ছোট ফোকর । রিক্সায় উঠার পর একটা নতুন শাড়ি পেঁচিয়ে রিক্সাকে ঢেকে দেয়া হয় । রুস্তম আর হাফসার ছোট চাচা রিক্সার সাথে হেটে চলে তিন কিলো দুরে থানা হাসপাতালে ।
হাসপাতালের একমাত্র ডাক্তার কানুবাবু রোগী দেখেন কোয়ার্টারে বসে । একটা ফিফটি সিসি হোন্ডা সামনে দুটি সাদা পাখনা ছড়িয়ে রাজহাঁসের মত দাঁড়িয়ে আছে । কানুবাবু সাদা এপ্রোন গায়ে চাপিয়ে হোন্ডায় চড়ে রাজহাঁসের মত ছুটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী দেখেন । এখানকার মানুষ কোয়ার্টারকে সরকারি হাসপাতাল মনে করে ডাক্তারকে ভিজিট দিতে চায় না । তাই বাড়ি গিয়ে রোগী দেখার প্রতি কানুবাবুর আগ্রহ বেশি । ইঞ্জেকশন পুশ আর তেল খরচ দেখিয়ে অন্তত কিছু ভিজিট উদ্ধার করা যায় ।
হাফসাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দেয়া হয়েছে । সে প্রাণপন চেষ্টা করছে উঠে পড়ার জন্য, কিন্তু তার মা তাকে চেপে ধরে রাখে । ডাক্তার রোগীর হিস্ট্রি শুনেন, চোখের পাতা টেনে ভেতরটা দেখেন । জোড় করে হা করিয়ে জিহ্বা দেখেন । স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে পিঠে চাপ দেন, বেশ সময় নিয়ে বুকের নরম জায়গাতে স্টেথো চেপে পরীক্ষা করেন । তারপর একটা সিরিঞ্জ বের করে এ্যাম্পুল থেকে তরল টেনে নিয়ে হাফসাকে পুশ করেন । কিছুক্ষণের ভেতরেই হাফসার শরীর এলিয়ে পড়ে । শেষে প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে সমস্যা বেড়ে গেলে বাড়িতে ডাকার পরামর্শ দিয়ে রোগী বিদায় করেন ।
রুস্তমের কাছ থেকে হাফসার সর্বশেষ যে অবস্থা জানতে পারি তা হলো তাকে কয়েকমাস ধরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে । ইতিমধ্যে 'আমারে শয়তানে পাইছে' বাক্যটি প্রপঞ্চ আকারে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই এই শ্লোকের পুনঃ পুনঃ উচ্চারণে পৈচাশিক আনন্দ উপভোগ করতে থাকে । দুপুর গড়িয়ে বিকেল এলে গ্রামের কিছু মানুষ খালি মাঠের কোণায় ছাতিম তলায় এসে বসে, একটু জিরিয়ে নেয়ার আশায় । আধবুড়ো কয়েকজন গামছা বিছিয়ে শুরু করে দেয় তাস পেটানো । 'আমারে শয়তানে পাইছে' উক্তির যথেচ্ছ ব্যবহারের পর শুরু হয় হাফসার তত্ত্ব-তালাস । তাদের একজন গোপন খবর জানায়, হাফসার বাপ ওঝা এনে ঝাড়ফোক দিতে রাজি হয়েছে । খবরটা মুহূর্তের মাঝে বিকেলের ছোট জমায়েতে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয় ।
দুইঃ
বগলের চিপায় লুকিয়ে রাখা রঙের শেষ তাস দিয়ে প্রতিপক্ষের গোলাম মেরে উল্লাস করতে করতে আক্রম আলী এবার তার গল্পের ঝুড়ি খুলে দেয় । পেটানো শরীরের মাঝবয়সী আক্রাম সারা বর্ষায় ছিপ দিয়ে মাছ ধরে । গ্রামের লোকজন তাকে 'গফি আক্রম' বলে ডাকে । তার সব গল্পই রাত জেগে নির্জন গুইন্যার খালে নৌকায় বসে মাছ ধরা কেন্দ্রীক । কয়েকজন যুবক তাকে উস্কে দেয়, 'শয়তানে মাছ নেয়ার কাহিনীটা শুনাও আক্রম ভাই!' আক্রম তাদের দিকে চোখ পাকিয়ে বলে, 'শয়তান মাছ নিতে আইবো ক্যান, মাছ নিতে আয়ে পেত্নী'! পেত্নী কয়,
-অই আক্রাইম্যা, খিদা লাগছে! মাছ দে..
-খাড়া বুড়ি, আরো কয়টা ধইরা লই!
পেছন থাইক্যা পেত্নী তহন নানান মিঠা মিঠা কথা কয় । আমি জানি, হের কথা শুনতে একবার যদি পেছনে তাকাই, তাইলে পেত্নী আমার ঘাড় মটকাইবো । সারা রাইত পেত্নীর লগে কথা কই আর ছিপ দিয়া মাছ তুলি । নাওয়ের ভেতর মাছে ভইরা যায় । পেত্নী কয়,
-অই আক্রাইম্যা, অহনও দিলি না!
আমি একটা চ্যাং মাছ হাতে নিয়া কই,
-বুড়ি, হাত বাড়া..
-চ্যাং মাছ খামু না, ডিময়ালা শিং মাছ দে!
-না খাইলে ভাগ! বেশি জ্বালাইলে একটাও দিমু না, নিজে ধইরা খা ।
পেত্নী তহন পেছন থাইক্যা হাত বাড়াইয়া দেয় । হনুমানের হাতের লাহান হাত, পুড়া পুড়া চামড়া । চ্যাং মাছ হাতে নিয়া পেত্নী খুশি মনে চইলা যায় ।"
গ্রামের লোকজন সমস্বরে এই মহা সাহসী আক্রমের তারিফ করে উঠে । সেও খুশিতে গদগদ হয়ে পরের ডিলের তাস বাটে । কিন্তু গ্রামের মানুষ এটাও জানে, আক্রমের তিন সৎ ভাই কিছুদিন পর পরই তারে কুপিয়ে মারতে যায় । তার সৎ মা আগলিয়ে না রাখলে কবেই আক্রমের লাশ খালের পানিতে ভেসে উঠতো । কিছু দূর্মুখ এটাও বলে, আক্রম এক ঝুম বৃষ্টির রাতে পরিবার একা রেখে মাছ ধরতে গিয়েছিল । শেষ রাতে বৃষ্টির ছাঁট কমে এলে আক্রমের ঘর থেকে তার এক সৎ ভাইকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় ।
হাফসার ঝাঁড়ফুকের জন্য পাশের গ্রাম থেকে আসা ওঝার এক সাগরেদকে সেদিনই আমরা চা-বিস্কিট খাইয়ে পাকা খবর পাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখি । সেদিন বিকেলে সারা গ্রামের পুরুষ-মহিলা, ছেলে-বুড়ো ওঝার কেরামতি দেখার জন্য রসুল মাস্টারের বাড়ির বাইরে ভিড় জমায় । কিন্তু ভেতরে ঢুকার অনুমতি না পেয়ে তারা যারপরনাই হতাশ হয়ে ফিরে যায় ।
সাগরেদের বর্ণনামতে, শিকল দিয়ে বাঁধা হাফসা কে বোরখা পড়িয়ে ওঝার সামনে আনা হয় । ওঝা তাকে ঘিরে মাটিতে একটা বৃত্ত এঁকে দেয় । অনেকক্ষণ তন্ত্রমন্ত্র পাঠ করার পর উপস্থিত সবাইকে জানানো হয়, এখনই হাফসার শরীরে শয়তান প্রবেশ করবে । ওঝা এবার সরিষার তেলে কয়েক টুকরো গাছের বাকল দিয়ে গরম করে হাফসার নাকে উল্টো করে ঢেলে দেয় । তারপর একটা ঝাড়ু দিয়ে তার পায়ে আঘাত করতে থাকে । হঠাৎ হাফসার শরীরে দৈবশক্তি ভর করে । কয়েকজন মহিলা তাকে ধরে রাখতে পারে না, রসুল মাস্টারের ভায়েরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে । হাফসা তখন জোড়ে চিৎকার করে ওঝাকে গালিগালাজ করতে থাকে,
-ওঝা, আমি তোর মাথা কাঁচা চিবাইয়া খামু!
ওঝা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পূণরায় নাকে তেল ঢালে, আর ঝাড়ু দিয়ে আঘাত করতে করতে বলে,
-ক, তুই কই থাইক্যা আইছস!
-উত্তুরের জংলা থাইক্যা..
-তুই কি চাস?
-আমি হাফসারে নিয়া যামু..
ওঝা আবার নাকে তেল ঢালতে উদ্যত হতেই,
-আর মারিস না! একটা মহিষ দে, চইল্যা যামু
-তোরে মহিষ খাওয়াইতাছি খাড়া..
-তাইলে একটা দামা বলদ আইন্যা দে
ওঝা ঝাড়ু দিয়ে একটা আঘাত করে,
-আইচ্ছা যা, একটা কালা চিকচিকা বকরি দে
-বকরি দিতে পারুম না, একটা পাতিহাঁস পাবি
-একটা না, তাইলে এক জোড়া পাতিহাঁস দিস ।
সাগরেদের বর্ণনামতে তখনই হাফসা মূর্ছা যায় এবং ঐ শয়তান হাফসা কে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় । রসুল মাস্টার ওঝাকে নগদ একশত টাকা এবং একজোড়া পাতিহাঁস দিয়ে বিদায় দেয় ।
তিনঃ
পুরো চৈত্রমাস জুড়ে তীব্র দাবদাহে পুড়ছে গ্রাম, আকাশে বৃষ্টির লেশ মাত্র নেই । শুধু মাঝে একদিন হঠাৎ শিলাবৃষ্টি নেমে আধপাকা ফসলের মাঠ মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে গেছে । তাপদাহে পুড়ে আর শিলাবৃষ্টির আতন্কে মসজিদে প্রার্থনাকারীর সংখ্যা বেড়ে যায় । কেউ কেউ বলে, এই গ্রাম পাপে ভরে গেছে । তাই গ্রামের উপর খোদায়ী গজব নাজিল হয়েছে ।
বোশেখের প্রথম ভোরে খবরটা বিদ্যুৎবেগে গ্রামের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে । প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী কে, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না । ছেলে-বুড়ো, পুরুষ-মহিলা সবাই দলবেঁধে ছুটে চলেছে গ্রামের শেষ মাথায় হিজলের জংলায় । সেখানে একটা গাছের নীচে পড়ে রয়েছে মানবভ্রুন । অপরিপক্ব শরীরের অর্ধেকটা শিয়ালে খেয়ে নিয়েছে । পাশেই ওড়াউড়ি করছে এক ঝাঁক শকুন । মৃতজীবিরা পৌছার আগেই মানুষ চলে আসায় এখন দুর থেকে হাপিত্যেশ করছে ।
মানবভ্রুনের পিন্ড ঘিরে উৎসুক মানুষের জটলা ক্রমেই বাড়ছে । কিছু মানুষ হাহাকার করে উঠে, 'খরা আর হিল পড়বো না ক্যান, এই পাপে খোদার আরশ কাইপ্যা উঠবো' । দুয়েকজন সন্দেহবাদি এগিয়ে আসে, 'এটা আমগোর কারো না, ভিন গ্রাম থাইক্যা এহানে রাইখ্যা গেছে' । একজন টিপ্পনী কাটে, 'হাফসারে ছাইরা যাওয়ার সোময় শয়তান এই বাচ্চাডারে মাইরা এহানে রাইখ্যা গেছে' ! তার কথার সূক্ষ্ণ ইঙ্গিতে কয়েকজন মুচকি হাসে ।
হযরত আলীর বড় ছেলে কাইয়ুম খবরটা পেয়ে দৌড়ে আসে । কোন রকম ভিড় ঠেলে সামনে এসে বীভৎস মানবভ্রুন দেখে আপনমনে কি যেন জপতে থাকে । এক সময় চোখ উল্টে জ্ঞান হারিয়ে ধুপ করে পড়ে যায় । কয়েকজন তাকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসে । চোখে মুখে পানি দিতেই তার চৈতন্য ফিরে আসে । লাফ দিয়ে উঠে সামনে যাকেই পায় তাকে কিলঘুষি মারতে থাকে । সাথে চিৎকার করতে থাকে, 'আমি শয়তান, ঐ পোলাডারে আমি খাইছি..'
মাঠ ফেরা উৎসুক জনতা এবার হযরত আলীর বাড়িতে ভিড় জমায় । জোয়ান ছেলেরা এগিয়ে গিয়ে কাইয়ুমকে ধরার চেষ্টা করে । কিন্তু তার শরীরে হঠাৎ করে যেন অসূরের শক্তি ভর করে । অনেক চেষ্টার পর তাকে বাগে আনা সম্ভব হয় । একটা শক্ত দড়ি দিয়ে তাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয় । দুপুরে রোদের তীব্রতা যখন বেড়ে যায়, দাঁত দিয়ে দড়ির বাঁধন প্রায় ছিড়ে ফেলে । এবার তার হাত পায়ে আলাদা করে শিকল পরিয়ে দেয়া হয় । কাইয়ুম এক সময় হাত-পা নাড়ানোর সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে কেবল চিৎকার করে যায়, 'ঐ পোলাডারে আমি খাইছি'..
টানা তিনদিন কাইয়ুম মুখে কিছু নেয়নি, শুধু চিৎকার করে গেছে । অনাহার, অনিদ্রা আর শিকলবন্দীর প্রতিক্রিয়ায় শক্তি হারিয়ে সে মাটিতে উপুড় হয়ে কুকুরের মত হাঁপাতে থাকে । ওঝার খোঁজে পাশের গ্রামে লোক পাঠানো হয়েছে, কিন্তু তাকে এখনো পাওয়া যায় নি ।
সকাল বেলা হযরত আলী তার বউ কে নিয়ে মাটির বারান্দায় বসেছিল । এমন সময় খবর এলো রসুল মাস্টারের অসুস্থ মেয়ে হাফসা ভোর বেলা মারা গেছে । হযরত আলী তখনই রসুল মাস্টারের বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় । রসুল মাস্টারের পরিবার অনেকটা নিভৃত্যে হাফসার শেষকৃত্যের আয়োজন করে । ধর্মীয় বিধি মেনে দ্রুত তাকে কবরস্ত করার ব্যবস্থা করা হয় ।
কাইয়ুমের মা হাফসাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়, কিন্তু কাইয়ুম কিছুতেই তাকে যেতে দিচ্ছে না । প্রাণপনে কি যেন বলতে চাইছে, কিন্তু শক্তি না থাকায় গলা দিয়ে কেবল ঘোৎ ঘোৎ শব্দ বের হচ্ছে । মা অনেকক্ষণ পাশে বসে কাইয়ুমের কথা বুঝার চেষ্টা করে । পাগল হয়ে যাওয়া ছেলের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে সেখানেই বসে থাকে ।
কাইয়ুমের মা যখন রসুল মাস্টারের বাড়ি পৌছায়, ততক্ষণে হাফসাকে কবর দেয়া হয়ে গেছে । আগত গ্রামবাসিরা একে একে চলে যাওয়া শুরু করেছে । উঠোনের এক কোণে একটা খুটিতে হাত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কাইয়ুমের মা । একটা অপরাধবোধ যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে । আকাশটা সকাল থেকেই কালো হয়ে আছে । এখন শুরু হয়েছে দমকা বাতাস । বাতাসের গতি হঠাৎ করেই বেড়ে যায় । ধুলিঝড়ে চারদিক অন্ধকার করে আসে, সাথে শুরু হয় গগনবিদারি বজ্রপাত । কাইয়ুমের মা দেখতে পায়, তাদের বাড়ির দিকটাতে আকাশ যেন সমস্ত ক্রোধ নিয়ে ভেঙ্গে পড়ছে । সাথে সাথেই সে চিৎকার দিয়ে উঠে, 'আমার পুলারে মাইরা ফালাইলো..
তখনো বেশ কিছু মানুষ ঝড় থেকে বাঁচার জন্য রসুল মাস্টারের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল । কাইয়ুমের মায়ের চিৎকার দিয়ে দৌড়ানো দেখে তারাও তার পিছু নেয় । এমন সময় নেমে আসে বৃষ্টি । বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সবাই হযরত আলীর উঠোনে এসে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে । কি বিপুল শক্তিতে আঘাত করলে একটা মানুষের কোমর পর্যন্ত মাটিতে গেঁথে যেতে পারে, তা তাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না । মাটিতে অর্ধপোতা কাইয়ুমের ঘাড় পুরো বেঁকে গিয়ে বীভৎস ভাবে হা করে আছে । পুরো জিহ্বাটাই বের হয়ে এসেছে মুখ দিয়ে । চোখগুলো কোটর থেকে বের হয়ে বলের মত ঝুলছে । মৃতদেহের এই ভয়ার্ত রুপ দ্বিতীয়বার দেখতে কারোই সাহস হলো না ।
শুধু কাইয়ুমের মা মৃতদেহের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আর মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে বলছে, 'আমার পুলায় পাপ করছে, আল্লায় হেরে উডাই নিয়া গেছে..'
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৪ সকাল ১০:২১