somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ কাল বোশেখ !

১১ ই মে, ২০১৪ সকাল ১০:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রথম চৈত্রের বিষণ্ণ দুপুর । খা খা রোদের প্রচন্ড তেজে ঝিমিয়ে পড়েছে বারুক গ্রাম । সাপের মত পেঁচানো গোপাট গ্রামের বিচ্ছিন্ন বাড়িগুলোর সামনে পেছনে ছুঁয়ে নেমে গেছে দখিনের বিশাল ধানী জমিতে । সেখানে ঘন হিজল গাছের সারি ঢেকে দিয়েছে পায়ে চলা পথ । নিস্তব্ধ দুপুর বিদীর্ণ করে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ।

বীভৎস দুপুরের বিভীষিকা উপেক্ষা করে ঝিঁঝিঁ পোকার পিছু নিয়েছে গ্রামের কয়েকটি দামাল ছেলে । লম্বা কঞ্চির আগায় বাঁধা মোরগের পালক চিটাগুড়ে ভিজিয়ে একমনে খুঁজে যাচ্ছে গাছের পাতার রঙের সাথে প্রায় মিশে থাকা সবুজ ঝিঁঝিঁ পোকা । তাদের কাছেই প্রথম জানতে পারি গ্রামের রসুল মাস্টারের সুমত্ত মেয়ে হাফসা বিবিকে নাকি শয়তানে ধরেছে ।

বারুক গ্রামে যে কয়েক ঘর সচ্চল মানুষ আছে, রসুল মাস্টার তাদের একজন । নির্বিবাদি ভালোমানুষ এই মাস্টার আর তার অন্য তিন ভাইয়ের মুখোমুখি চারটি ঘর । বাঁশের চাটাই ঘেরা বাড়িটিতে বাইরের মানুষের যাতায়াত সীমিত । শুধু বাড়ি নয়, ভেতর বাড়ির মানুষগুলো কঠিন পর্দা বজায় রাখে । তাই এরকম একটা বাড়ির সুমত্ত মেয়ের মানসিক বিকৃতির আসল খবর পেতে আমাদের উৎসাহ মাত্রা ছাড়িয়ে যায় ।

সম্ভাব্য প্রতিটা উৎস খুঁজে খুঁজে আমরা চেষ্টা করতে থাকি হাফসার অসুস্থতার পূর্ণ বিবরণ বের করার । মাস্টার বাড়ির ছোট বাচ্চাদের পাকরাও করে জানতে পারি, কয়েক মাস আগে এক ভরা পূর্ণিমার রাতে গায়েবি ডাক পেয়ে হাফসা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । বাড়ির পেছনে বিশাল পুকুরের বায়ুকোণে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা প্রাচীন নারিকেল গাছের নীচে যেতেই ঐ গাছে থাকা শয়তান তাকে আছড় করে । আরও বিস্তারিত জানতে ঐ বাড়ির সাংবাৎসরিক গোমস্তা রুস্তমকে কৌশলে হাত করি ।

গ্রামের চায়ের দোকানে বসে গোমস্তা রুস্তমের মুখে সে রাতের রোমহর্ষক বর্ণনা শুনি । চুপিসারে ঘরের পেছনের দরজা খুলে হাফসা চলে গিয়েছিল পুকুর পাড়ের নারিকেল গাছের নীচে । তারপর সেখান থেকে এক দৌড়ে ঘরে ফিরে এসেছিল । ফেনা বেরিয়ে আসা ভয়ার্ত মুখে চিক্কুর দিয়ে হাফসা 'আমারে শয়তানে পাইছে' বলেই মূর্ছা গিয়েছিল । এর পর সপ্তাহ ধরে হাফসা প্রায়ই ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠত আর তার মা কে জড়িয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকত ।

রসুল মাস্টার গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার ইরফান আলীকে ঘটনা খুলে বলেন । ডাক্তার রসুল মাস্টারকে অভয় দিয়ে কিছু ঔষধ দেন । সেই সাথে পাশের গ্রামের বড় হুজুরের কাছ থেকে পানি পড়া খাওয়ানোর পরামর্শ দেন । কিন্তু ঔষধ আর পানি পড়া খেয়েও হাফসার উদভ্রান্ত আচরণ আর ভয়ার্ত চিৎকার কমে আসার কোন লক্ষণ দেখা গেল না । কিছু ঘনিষ্ট মানুষের পরামর্শে শেষে হাফসাকে থানা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ।

একদিন সকাল বেলা বাড়ির সামনে রিক্সা আসে । পুরাতন কালো শাড়ি কেটে ঘরে বানানো বোরখা পড়ে হাফসা আর তার মা রিক্সায় উঠে বসে । অজানুলম্বিত কালো বোরখায় শুধু চোখের সামনে দুটি ছোট ফোকর । রিক্সায় উঠার পর একটা নতুন শাড়ি পেঁচিয়ে রিক্সাকে ঢেকে দেয়া হয় । রুস্তম আর হাফসার ছোট চাচা রিক্সার সাথে হেটে চলে তিন কিলো দুরে থানা হাসপাতালে ।

হাসপাতালের একমাত্র ডাক্তার কানুবাবু রোগী দেখেন কোয়ার্টারে বসে । একটা ফিফটি সিসি হোন্ডা সামনে দুটি সাদা পাখনা ছড়িয়ে রাজহাঁসের মত দাঁড়িয়ে আছে । কানুবাবু সাদা এপ্রোন গায়ে চাপিয়ে হোন্ডায় চড়ে রাজহাঁসের মত ছুটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী দেখেন । এখানকার মানুষ কোয়ার্টারকে সরকারি হাসপাতাল মনে করে ডাক্তারকে ভিজিট দিতে চায় না । তাই বাড়ি গিয়ে রোগী দেখার প্রতি কানুবাবুর আগ্রহ বেশি । ইঞ্জেকশন পুশ আর তেল খরচ দেখিয়ে অন্তত কিছু ভিজিট উদ্ধার করা যায় ।

হাফসাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দেয়া হয়েছে । সে প্রাণপন চেষ্টা করছে উঠে পড়ার জন্য, কিন্তু তার মা তাকে চেপে ধরে রাখে । ডাক্তার রোগীর হিস্ট্রি শুনেন, চোখের পাতা টেনে ভেতরটা দেখেন । জোড় করে হা করিয়ে জিহ্বা দেখেন । স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে পিঠে চাপ দেন, বেশ সময় নিয়ে বুকের নরম জায়গাতে স্টেথো চেপে পরীক্ষা করেন । তারপর একটা সিরিঞ্জ বের করে এ্যাম্পুল থেকে তরল টেনে নিয়ে হাফসাকে পুশ করেন । কিছুক্ষণের ভেতরেই হাফসার শরীর এলিয়ে পড়ে । শেষে প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে সমস্যা বেড়ে গেলে বাড়িতে ডাকার পরামর্শ দিয়ে রোগী বিদায় করেন ।

রুস্তমের কাছ থেকে হাফসার সর্বশেষ যে অবস্থা জানতে পারি তা হলো তাকে কয়েকমাস ধরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে । ইতিমধ্যে 'আমারে শয়তানে পাইছে' বাক্যটি প্রপঞ্চ আকারে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই এই শ্লোকের পুনঃ পুনঃ উচ্চারণে পৈচাশিক আনন্দ উপভোগ করতে থাকে । দুপুর গড়িয়ে বিকেল এলে গ্রামের কিছু মানুষ খালি মাঠের কোণায় ছাতিম তলায় এসে বসে, একটু জিরিয়ে নেয়ার আশায় । আধবুড়ো কয়েকজন গামছা বিছিয়ে শুরু করে দেয় তাস পেটানো । 'আমারে শয়তানে পাইছে' উক্তির যথেচ্ছ ব্যবহারের পর শুরু হয় হাফসার তত্ত্ব-তালাস । তাদের একজন গোপন খবর জানায়, হাফসার বাপ ওঝা এনে ঝাড়ফোক দিতে রাজি হয়েছে । খবরটা মুহূর্তের মাঝে বিকেলের ছোট জমায়েতে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয় ।

দুইঃ

বগলের চিপায় লুকিয়ে রাখা রঙের শেষ তাস দিয়ে প্রতিপক্ষের গোলাম মেরে উল্লাস করতে করতে আক্রম আলী এবার তার গল্পের ঝুড়ি খুলে দেয় । পেটানো শরীরের মাঝবয়সী আক্রাম সারা বর্ষায় ছিপ দিয়ে মাছ ধরে । গ্রামের লোকজন তাকে 'গফি আক্রম' বলে ডাকে । তার সব গল্পই রাত জেগে নির্জন গুইন্যার খালে নৌকায় বসে মাছ ধরা কেন্দ্রীক । কয়েকজন যুবক তাকে উস্কে দেয়, 'শয়তানে মাছ নেয়ার কাহিনীটা শুনাও আক্রম ভাই!' আক্রম তাদের দিকে চোখ পাকিয়ে বলে, 'শয়তান মাছ নিতে আইবো ক্যান, মাছ নিতে আয়ে পেত্নী'! পেত্নী কয়,
-অই আক্রাইম্যা, খিদা লাগছে! মাছ দে..
-খাড়া বুড়ি, আরো কয়টা ধইরা লই!
পেছন থাইক্যা পেত্নী তহন নানান মিঠা মিঠা কথা কয় । আমি জানি, হের কথা শুনতে একবার যদি পেছনে তাকাই, তাইলে পেত্নী আমার ঘাড় মটকাইবো । সারা রাইত পেত্নীর লগে কথা কই আর ছিপ দিয়া মাছ তুলি । নাওয়ের ভেতর মাছে ভইরা যায় । পেত্নী কয়,
-অই আক্রাইম্যা, অহনও দিলি না!
আমি একটা চ্যাং মাছ হাতে নিয়া কই,
-বুড়ি, হাত বাড়া..
-চ্যাং মাছ খামু না, ডিময়ালা শিং মাছ দে!
-না খাইলে ভাগ! বেশি জ্বালাইলে একটাও দিমু না, নিজে ধইরা খা ।
পেত্নী তহন পেছন থাইক্যা হাত বাড়াইয়া দেয় । হনুমানের হাতের লাহান হাত, পুড়া পুড়া চামড়া । চ্যাং মাছ হাতে নিয়া পেত্নী খুশি মনে চইলা যায় ।"

গ্রামের লোকজন সমস্বরে এই মহা সাহসী আক্রমের তারিফ করে উঠে । সেও খুশিতে গদগদ হয়ে পরের ডিলের তাস বাটে । কিন্তু গ্রামের মানুষ এটাও জানে, আক্রমের তিন সৎ ভাই কিছুদিন পর পরই তারে কুপিয়ে মারতে যায় । তার সৎ মা আগলিয়ে না রাখলে কবেই আক্রমের লাশ খালের পানিতে ভেসে উঠতো । কিছু দূর্মুখ এটাও বলে, আক্রম এক ঝুম বৃষ্টির রাতে পরিবার একা রেখে মাছ ধরতে গিয়েছিল । শেষ রাতে বৃষ্টির ছাঁট কমে এলে আক্রমের ঘর থেকে তার এক সৎ ভাইকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় ।

হাফসার ঝাঁড়ফুকের জন্য পাশের গ্রাম থেকে আসা ওঝার এক সাগরেদকে সেদিনই আমরা চা-বিস্কিট খাইয়ে পাকা খবর পাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখি । সেদিন বিকেলে সারা গ্রামের পুরুষ-মহিলা, ছেলে-বুড়ো ওঝার কেরামতি দেখার জন্য রসুল মাস্টারের বাড়ির বাইরে ভিড় জমায় । কিন্তু ভেতরে ঢুকার অনুমতি না পেয়ে তারা যারপরনাই হতাশ হয়ে ফিরে যায় ।

সাগরেদের বর্ণনামতে, শিকল দিয়ে বাঁধা হাফসা কে বোরখা পড়িয়ে ওঝার সামনে আনা হয় । ওঝা তাকে ঘিরে মাটিতে একটা বৃত্ত এঁকে দেয় । অনেকক্ষণ তন্ত্রমন্ত্র পাঠ করার পর উপস্থিত সবাইকে জানানো হয়, এখনই হাফসার শরীরে শয়তান প্রবেশ করবে । ওঝা এবার সরিষার তেলে কয়েক টুকরো গাছের বাকল দিয়ে গরম করে হাফসার নাকে উল্টো করে ঢেলে দেয় । তারপর একটা ঝাড়ু দিয়ে তার পায়ে আঘাত করতে থাকে । হঠাৎ হাফসার শরীরে দৈবশক্তি ভর করে । কয়েকজন মহিলা তাকে ধরে রাখতে পারে না, রসুল মাস্টারের ভায়েরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে । হাফসা তখন জোড়ে চিৎকার করে ওঝাকে গালিগালাজ করতে থাকে,
-ওঝা, আমি তোর মাথা কাঁচা চিবাইয়া খামু!

ওঝা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পূণরায় নাকে তেল ঢালে, আর ঝাড়ু দিয়ে আঘাত করতে করতে বলে,
-ক, তুই কই থাইক্যা আইছস!
-উত্তুরের জংলা থাইক্যা..
-তুই কি চাস?
-আমি হাফসারে নিয়া যামু..
ওঝা আবার নাকে তেল ঢালতে উদ্যত হতেই,
-আর মারিস না! একটা মহিষ দে, চইল্যা যামু
-তোরে মহিষ খাওয়াইতাছি খাড়া..
-তাইলে একটা দামা বলদ আইন্যা দে
ওঝা ঝাড়ু দিয়ে একটা আঘাত করে,
-আইচ্ছা যা, একটা কালা চিকচিকা বকরি দে
-বকরি দিতে পারুম না, একটা পাতিহাঁস পাবি
-একটা না, তাইলে এক জোড়া পাতিহাঁস দিস ।

সাগরেদের বর্ণনামতে তখনই হাফসা মূর্ছা যায় এবং ঐ শয়তান হাফসা কে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় । রসুল মাস্টার ওঝাকে নগদ একশত টাকা এবং একজোড়া পাতিহাঁস দিয়ে বিদায় দেয় ।

তিনঃ

পুরো চৈত্রমাস জুড়ে তীব্র দাবদাহে পুড়ছে গ্রাম, আকাশে বৃষ্টির লেশ মাত্র নেই । শুধু মাঝে একদিন হঠাৎ শিলাবৃষ্টি নেমে আধপাকা ফসলের মাঠ মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে গেছে । তাপদাহে পুড়ে আর শিলাবৃষ্টির আতন্কে মসজিদে প্রার্থনাকারীর সংখ্যা বেড়ে যায় । কেউ কেউ বলে, এই গ্রাম পাপে ভরে গেছে । তাই গ্রামের উপর খোদায়ী গজব নাজিল হয়েছে ।

বোশেখের প্রথম ভোরে খবরটা বিদ্যুৎবেগে গ্রামের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে । প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী কে, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না । ছেলে-বুড়ো, পুরুষ-মহিলা সবাই দলবেঁধে ছুটে চলেছে গ্রামের শেষ মাথায় হিজলের জংলায় । সেখানে একটা গাছের নীচে পড়ে রয়েছে মানবভ্রুন । অপরিপক্ব শরীরের অর্ধেকটা শিয়ালে খেয়ে নিয়েছে । পাশেই ওড়াউড়ি করছে এক ঝাঁক শকুন । মৃতজীবিরা পৌছার আগেই মানুষ চলে আসায় এখন দুর থেকে হাপিত্যেশ করছে ।

মানবভ্রুনের পিন্ড ঘিরে উৎসুক মানুষের জটলা ক্রমেই বাড়ছে । কিছু মানুষ হাহাকার করে উঠে, 'খরা আর হিল পড়বো না ক্যান, এই পাপে খোদার আরশ কাইপ্যা উঠবো' । দুয়েকজন সন্দেহবাদি এগিয়ে আসে, 'এটা আমগোর কারো না, ভিন গ্রাম থাইক্যা এহানে রাইখ্যা গেছে' । একজন টিপ্পনী কাটে, 'হাফসারে ছাইরা যাওয়ার সোময় শয়তান এই বাচ্চাডারে মাইরা এহানে রাইখ্যা গেছে' ! তার কথার সূক্ষ্ণ ইঙ্গিতে কয়েকজন মুচকি হাসে ।

হযরত আলীর বড় ছেলে কাইয়ুম খবরটা পেয়ে দৌড়ে আসে । কোন রকম ভিড় ঠেলে সামনে এসে বীভৎস মানবভ্রুন দেখে আপনমনে কি যেন জপতে থাকে । এক সময় চোখ উল্টে জ্ঞান হারিয়ে ধুপ করে পড়ে যায় । কয়েকজন তাকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসে । চোখে মুখে পানি দিতেই তার চৈতন্য ফিরে আসে । লাফ দিয়ে উঠে সামনে যাকেই পায় তাকে কিলঘুষি মারতে থাকে । সাথে চিৎকার করতে থাকে, 'আমি শয়তান, ঐ পোলাডারে আমি খাইছি..'

মাঠ ফেরা উৎসুক জনতা এবার হযরত আলীর বাড়িতে ভিড় জমায় । জোয়ান ছেলেরা এগিয়ে গিয়ে কাইয়ুমকে ধরার চেষ্টা করে । কিন্তু তার শরীরে হঠাৎ করে যেন অসূরের শক্তি ভর করে । অনেক চেষ্টার পর তাকে বাগে আনা সম্ভব হয় । একটা শক্ত দড়ি দিয়ে তাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয় । দুপুরে রোদের তীব্রতা যখন বেড়ে যায়, দাঁত দিয়ে দড়ির বাঁধন প্রায় ছিড়ে ফেলে । এবার তার হাত পায়ে আলাদা করে শিকল পরিয়ে দেয়া হয় । কাইয়ুম এক সময় হাত-পা নাড়ানোর সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে কেবল চিৎকার করে যায়, 'ঐ পোলাডারে আমি খাইছি'..

টানা তিনদিন কাইয়ুম মুখে কিছু নেয়নি, শুধু চিৎকার করে গেছে । অনাহার, অনিদ্রা আর শিকলবন্দীর প্রতিক্রিয়ায় শক্তি হারিয়ে সে মাটিতে উপুড় হয়ে কুকুরের মত হাঁপাতে থাকে । ওঝার খোঁজে পাশের গ্রামে লোক পাঠানো হয়েছে, কিন্তু তাকে এখনো পাওয়া যায় নি ।

সকাল বেলা হযরত আলী তার বউ কে নিয়ে মাটির বারান্দায় বসেছিল । এমন সময় খবর এলো রসুল মাস্টারের অসুস্থ মেয়ে হাফসা ভোর বেলা মারা গেছে । হযরত আলী তখনই রসুল মাস্টারের বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় । রসুল মাস্টারের পরিবার অনেকটা নিভৃত্যে হাফসার শেষকৃত্যের আয়োজন করে । ধর্মীয় বিধি মেনে দ্রুত তাকে কবরস্ত করার ব্যবস্থা করা হয় ।

কাইয়ুমের মা হাফসাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়, কিন্তু কাইয়ুম কিছুতেই তাকে যেতে দিচ্ছে না । প্রাণপনে কি যেন বলতে চাইছে, কিন্তু শক্তি না থাকায় গলা দিয়ে কেবল ঘোৎ ঘোৎ শব্দ বের হচ্ছে । মা অনেকক্ষণ পাশে বসে কাইয়ুমের কথা বুঝার চেষ্টা করে । পাগল হয়ে যাওয়া ছেলের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে সেখানেই বসে থাকে ।

কাইয়ুমের মা যখন রসুল মাস্টারের বাড়ি পৌছায়, ততক্ষণে হাফসাকে কবর দেয়া হয়ে গেছে । আগত গ্রামবাসিরা একে একে চলে যাওয়া শুরু করেছে । উঠোনের এক কোণে একটা খুটিতে হাত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কাইয়ুমের মা । একটা অপরাধবোধ যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে । আকাশটা সকাল থেকেই কালো হয়ে আছে । এখন শুরু হয়েছে দমকা বাতাস । বাতাসের গতি হঠাৎ করেই বেড়ে যায় । ধুলিঝড়ে চারদিক অন্ধকার করে আসে, সাথে শুরু হয় গগনবিদারি বজ্রপাত । কাইয়ুমের মা দেখতে পায়, তাদের বাড়ির দিকটাতে আকাশ যেন সমস্ত ক্রোধ নিয়ে ভেঙ্গে পড়ছে । সাথে সাথেই সে চিৎকার দিয়ে উঠে, 'আমার পুলারে মাইরা ফালাইলো..

তখনো বেশ কিছু মানুষ ঝড় থেকে বাঁচার জন্য রসুল মাস্টারের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল । কাইয়ুমের মায়ের চিৎকার দিয়ে দৌড়ানো দেখে তারাও তার পিছু নেয় । এমন সময় নেমে আসে বৃষ্টি । বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সবাই হযরত আলীর উঠোনে এসে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে । কি বিপুল শক্তিতে আঘাত করলে একটা মানুষের কোমর পর্যন্ত মাটিতে গেঁথে যেতে পারে, তা তাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না । মাটিতে অর্ধপোতা কাইয়ুমের ঘাড় পুরো বেঁকে গিয়ে বীভৎস ভাবে হা করে আছে । পুরো জিহ্বাটাই বের হয়ে এসেছে মুখ দিয়ে । চোখগুলো কোটর থেকে বের হয়ে বলের মত ঝুলছে । মৃতদেহের এই ভয়ার্ত রুপ দ্বিতীয়বার দেখতে কারোই সাহস হলো না ।

শুধু কাইয়ুমের মা মৃতদেহের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আর মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে বলছে, 'আমার পুলায় পাপ করছে, আল্লায় হেরে উডাই নিয়া গেছে..'
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৪ সকাল ১০:২১
৫৫টি মন্তব্য ৫৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×