-- ধুস্ শালা!
প্রচন্ড বিরক্ত জিসান তার বেন্ড করা লম্বা চুলের ভিতর থেকে সান-গ্লাসটা খুলে টি-শার্টের কোনা দিয়ে মুছতে থাকে । টি-শার্ট কিঞ্চিত উপরে উঠায় তার সদ্য গজানো ভূড়িটা থলথল করে দুলছে । আর পেছনে জিন্সের প্যান্ট কোমড় ছাড়িয়ে আরো ইঞ্চি কয়েক নেমে গুহ্যদ্বারের মুখে আটকে আছে । ভাগ্যিস আন্ডারওয়্যার প্যান্ট কে অনুসরণ করেনি, কোমড়ের সাথে লেপ্টে থেকে গুহ্যদ্বারের আব্রু রক্ষা করে চলেছে ।
সান-গ্লাস পরিষ্কার করে জিসান মাথায় বেন্ড করা চুলের ভিতর আবার গুজে দেয় । ভরদুপুরে অস্থির পায়চারি করতে করতে রাস্তার দিকে ইতিউতি তাকায় । ঠাসা ডাসা মালের খোঁজে এদিকে আসার পর তার স্টাইলিস্ট পালসার বাইকের পেছনের চাকা হঠাৎ পাংচার হয়েছে । সাগরেদ জইস্যা সাথেই ছিল, সে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ভারী বাইকটাকে নিয়ে গেছে পাংচার সাড়িয়ে আনার জন্য । প্রায় ঘন্টা খানেক হয়ে গেল, তার ফেরার কোন নাম-গন্ধ নেই ।
অস্থিরতার আরও একটা কারণ আছে । আজ চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদ । ঈদের আগের দিন রাস্তাঘাটে খাসা ডাসা সব মাল মিছিল দিয়ে বেরুবার কথা । অথচ ঘন্টাখানেক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেও তেমন কোন পিসের দেখা মিলল না । রাস্তায় পড়ে থাকা আধলা ইটের উপর আক্রোশ মেটানো কিক দিয়ে সে চলল পাশের টং দোকানের দিকে । দোকানের সামনের দিকটা কালো পর্দায় মোড়ানো । রোজার মাসে পর্দার ভিতরে বসে খাওয়া-দাওয়া করার নিয়ম । চায়ের অর্ডার দিয়ে জিসান একটা বেঞ্চু ধরালো । ছোট জায়গায় অনেক মানুষের এক সাথে ধুমপান, নিকোটিনের তীব্র ধোঁয়ায় চোখটা খুব জ্বলছে ।
দ্রুত চা-সিগ্রেট খেয়ে টং থেকে বের হবার পর দুপুরের তীব্র সূর্যালোকে জিসানের চোখ ঝলসে উঠে । কিন্তু অত্যুজ্জ্বল এই সূর্যকিরণ জহুরীর চোখে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি । চোখের সামনে হাত দিয়ে রোদ ঢেকে জিসান সূর্যালোকের চেয়েও উজ্জ্বল কিছু দেখতে পায় । জিসান চোখ বড় বড় করে বিস্ফোরিত নয়নে দেখতে থাকে তার থেকে সামান্য দূরে রাস্তায় একটা খাসা মাল ! এই মাত্র মালডা রিক্সায় উঠলো । উজ্জ্বল হলুদ রঙের পায়ের পাতা দুটো রিক্সার পাটাতনে ছন্দ তুলে দুলছে । নিটোল পায়ের ছন্দে জিসানের লকলকে জিভে জল এসে যায় । রিক্সাওয়ালা রিক্সার হুড টেনে দেয় । হুডের এক পাশ কোমল করে ধরে আছে মায়াবী হাতের সুন্দর লতানো সেক্সি আঙুল । আর হুডের ফাঁক দিয়ে জিসান দেখতে পায় বাতাসে দোল খাওয়া উড়ন্ত চুলের ফাঁকে দুধে আলতা কামিনী যৌবন।
জিসান দ্রুত হেটে রিক্সার কাছে পৌছুতে চেষ্টা করে । কিন্তু ততক্ষনে রিক্সা চলতে শুরু করে বেশ সামনে চলে যায় । রিক্সার পেছনের পর্দা সড়ে গিয়ে কেবল উড়তে থাকে এলোমেলো বন্য কেশরাজি । নিজের উপর আক্রোশে এক হাত দিয়ে ঘুষি চালায় আরেক হাতের তালুতে । দিনের সেরা জিনিসটা একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তীব্র আক্ষেপ- শীট...
ঠিক এই সময়ে পিঁপ পিঁপ বাজিয়ে একটা বাইক জিসানের গায়ের উপর উঠতে উঠতে শেষ মূহুর্তে ব্রেক কষে । হার্ড ব্রেকের শব্দে ঘুরে দাঁড়িয়ে জইস্যা কে দেখতে পেয়ে খিস্তি ঝাড়ে,
-বাইনচোত, এত দেরি করলি ক্যা ? বাইক লইয়া কৈ গেছিলি ?
জইস্যা বাইক থেকে নেমে মিনমিন করে বলে,
-দুইটা লিক খাটানোর পরেও চাক্কায় বাতাস থাকে না । পরে ম্যালা খুইজ্জা আরেকটা ছুপা লিক পাইছে । বিশ্বাস না হয় যিসু মাম্মা, মেকানিক্স রে জিগায়েন ।
-হইছে, এত্ত কথা শুনার টাইম নাই । খাসা মালডা বুঝি মিস হইয়া যায় ! এখন পিছে উঠ, আওগাইয়া দেখি পাই কি না !!
জিসান তখনই বাইক স্টার্ট দেয় । পালসার সিংহের মত গর্জন করতে করতে ছুটতে থাকে । কিছুদুর যাবার পর জিসান চিৎকার দিয়ে উঠে,
-অই জইস্যা, সামনের রিক্সায় মালডা বসা!
-যিসু মাম্মা, আমি আছি! নো টেনছন!!
জইস্যা হেড়ে গলায় গান ধরে, "তেড়ি মেরি মেরি তেড়ি প্রেম কাহানী হে মুশকিল.. "
জইস্যার কর্কশ গলার গানের সাথে বাইকের বিকট পিঁপ পিঁপ আওয়াজে সামনের রিক্সা বাঁয়ে সরতে থাকে । রিক্সার ডান পাশে চেপে এসে জিসান বলে, "হাই ডার্লিং, কুলফি খাবা!!" তার পর রিক্সাটাকে দ্রুত ওভারটেক করে । জইস্যা তখনো বাইকের পেছনে হাত-পা ছুড়ে গেয়ে যাচ্ছে, "তেড়ি মেরি মেরি তেড়ি প্রেম কাহানী.. "
আর কিছুক্ষন যাওয়ার পর একটা মোড়ের আগে বাইক থামায় জিসান । দুজনে সেই রিক্সার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে..
-মালডা কেমুন দেখলিরে জইস্যা ?
-যিসু মাম্মা,চরম! হেভ্ভী জিনিস!! মালের ঘাড়-গলার রঙ যেন দুধে আলতা । মাগার বুকের সাইজটা মাপতে পারলাম না মাম্মা ।
-চুপ কর বাইনচোত! উস্তাদের মাল লইয়া খারাপ কথা কবি না ।
-মাম্মা! খারাপ কথা কমু না!! কি কউ মাম্মা.. হাঃহাঃহাঃ
এবার দুজনেই ইঙ্গিতপূর্ণ হাসিতে ফেটে পড়ে । এই সময় রাস্তার উল্টো দিকে রিক্সাটা থামে । জিসান-জইস্যা দুজনে একে অপরকে চোখ টিপি দেয় । তারা বাইক থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে রিক্সার দিকে এগুতে থাকে । রিক্সার যাত্রী সীটে বসে পার্টস থেকে ভাংতি টাকা বের করে ভাড়া মিটিয়ে দেয় । জিসান রিক্সার পাশে গিয়ে জইস্যার কাঁধে হাত রেখে সান-গ্লাস চোখ থেকে সরিয়ে কপালের উপর রাখে । তাদের কর্মকান্ড দেখে রিক্সাওয়ালা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে । জিসান ভাব নিয়ে বলে,
-নাইম্যা আসেন ম্যাম, নাকি কোলে কইরা নামাইতে হইব !!
রিক্সা যাত্রীর উজ্জ্বল হলুদ রঙের কোমল পা দুটো রিক্সার পাটাতন থেকে ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে আসে । সেই সাথে নূরানী দেহ খানি সন্তর্পনে রিক্সা থেকে নামিয়ে এনে কৌতুহলী চোখে দুজনের দিকে তাকায় । অত:পর কোমল মোলায়েম মিহিস্বরে সালাম জানায়,
-আসসালামুয়ালাইকুম । জনাব, আপনাদের কী খেদমতে আসতে পারি ??
জিসান-জইস্যা পরষ্পরের দিকে হা করে তাকিয়ে চোখ কপালে তুলে । কিন্তু তাদের কারো মুখ থেকে কোন কথা বের হয় না । কিংকর্তব্যবিমূঢ় দুই আগুন্তকের কাছ থেকে সালামের জবাব পাবার আশা ত্যাগ করে রিক্সাযাত্রী দ্রুত স্থানত্যাগ করে । রিক্সাওয়ালাও নিজের পথে চলতে শুরু করে । অবশেষে জইস্যার কথায় অসহ্য নীরবতা ভাঙ্গে,
-যিসু মাম্মা, এইডা কি হইল মাম্মা!! এইডা তো জোব্বা পড়া হুজুর!!
জিসান ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় জইস্যার গালে,
-বাইনচোত! তোরে না ভাল কইরা খেয়াল করতে কইলাম!
-(চড় খেয়ে গাল ঘষতে ঘষতে) মাম্মা, তুমিই না কইলা মালডা খাসা!!
-হাত-পা-চুল আর গায়ের নরম চামড়া দেইখাতো মালই ভাবছিলাম!!
জিসান আবার জইস্যার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলে,
-তোর তো আবার পেট পাতলা স্বভাব । মহল্লার বেবাকরে তুই এই গল্প কইরা বেড়াইবি!
জইস্যা অপরাধীর মত চুপ করে থাকে । জিসান মাথাটা নিচু করে হনহন করে হেটে বাইকের দিকে এগিয়ে যায় । সেলফে স্টার্ট দিতেই জইস্যা এক লাফে বাইকের পেছনে চড়ে বসে । পিকআপ বাড়ানোর সাথে সাথে বাইক ভোঁ করে গর্জে উঠে । জিসান আপন মনে শ্রাগ করে, 'শালার, রাম ধরা...'
***************************সমাপ্ত****************************
গল্পটি ব্লগে 'হাসি-কান্নার এক জোড়া ঈদ গল্প' নামক পোস্টে পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল ।