somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিয়োগান্তিক !

১৬ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শহরের বনেদি পাড়ায় ছিমছাম সুন্দর এই বাড়ির রিডিং রুম সূর্যাস্তের পরই মুখরিত হয়ে উঠে আড্ডায় । সন্ধ্যা প্রার্থনার পর থেকে রাতের প্রার্থনার পূর্ব পর্যন্ত শহরের সব গল্প যেন এই ঘরে এসে ভীর করে । প্রাত্যহিক সকল কর্ম, চাহিদা, দায়িত্ব, ব্যস্ততা, অভাব, অনুযোগ, ব্যর্থতা সবকিছু ঢাকা পড়ে যায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই চারজন মানুষের প্রাণখোলা উচ্ছাসে । তাস ফেটা, বিলি-বন্টন আর সোৎসাহে ট্রিক-টার্ম এর সাথে চলতে থাকে অদ্ভুত সব গল্প খেলা ।

প্রতিপক্ষের একজন তাসের টেক্কা চার্জ করতেই গৃহকর্তা নিজাম চৌধুরীর ফুকা সাহেব বেরিয়ে আসে । তার ক্ষেত্রে ইদানিং ব্যাপারটা ঘন ঘন ঘটছে । সাহেবের ট্রিক কিংবা ফুকা সাহেবকে টেক্কা এসে ঘাড় মটকে দিচ্ছে । 'এটা খুবই ট্র্যাজিক, মর্মান্তিক এবং অমানবিক'- শওকত আজিজ ফোড়ন কাটেন । আরিফ বক্ত এক কাঠি এগিয়ে ঘোষনা দেন, 'নিজাম চৌধুরীর জীবনে সবচেয়ে করুণ ট্র্যাজেডি হলো তাসের সাহেব বাঁচাতে না পারা' । নিজাম চৌধুরী ম্লান হেসে বলেন, 'আমার জীবনটা যে এখন পুরো ট্র্যাজেডির উপর দাঁড়িয়ে, সেই খবর রাখেন!' প্রায় আৎকে উঠার স্বরে শামীম আহমদ প্রতিবাদ করেন, রাবেয়া ভাবীর মত গিন্নী যার ঘরে তার মুখে ট্র্যাজেডির গল্প! এটা কি একটা কমেডি হয়ে গেল না!'

'হ্যাঁ, গিন্নীই আমার ট্র্যাজেডির কারণ । একটু কষ্ট করে শুনুন, তাহলে বুঝবেন কতোটা যন্ত্রণার মাঝে আছি' ।

সবাই নড়েচড়ে বসলেন । শামীম আহমদ তাস শাফল করে বেটে দিচ্ছেন । নাজিম চৌধুরী চেয়ারে কিছুটা হেলান দিয়ে শুরু করেন তার ট্র্যাজেডির গল্প ।

'আমার জীবনটা কেটেছে কাজের মাঝে, শুধু কাজ আর কাজ । কলেজের শিক্ষকতার পাশাপাশি বইয়ের দোকান দিয়েছি । অবসরে পত্রিকা ম্যাগাজিনের জন্য আর্টিকেল লিখেছি । স্ত্রী-সন্তান অর্থের জন্য কষ্ট পাক, এটা কখনো চাইনি । ছেলে মেয়ে দুটো যখন বড় হতে থাকে, তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কাজের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছি । মেয়েটার ভালো একটা জব হলো, বিয়ে হলো । ছেলেটা স্কলারশিপ নিয়ে প্রবাসে গেল । এবার ঘোষনা দিলাম, অনেক করেছি আর কিছু করতে পারবো না । কলেজে এক দুইটা ক্লাস নিয়ে বাকি সময়টা ঘরে শুয়ে বসে আরাম করছিলাম । অখন্ড অবসরে ডুবে গিয়ে অতীতের সকল ক্লান্তি মুছে দিচ্ছিলাম । কিন্তু কিসের কি! কয়েকদিন যেতে না যেতেই রাবেয়া লেগে গেল আমার পেছনে । সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে নাকি শরীর খারাপ করবে! যাও একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসো, বাজার থেকে তাজা মাছ আর সবজী নিয়ে আসো । এই বিল, ঐ পেমেন্ট! আমার অবসর ক্রমেই অশান্তিতে রুপ নিয়েছে । এই দেখেন, আজকে দুপুরে ফরমান এলো মাস কালাইয়ের ডাল আনার । তো, ভরদুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে এ বাজার ও বাজার ঘুরে কোথাও কালাই পাইনা । আরে পাবো কিভাবে, সিলেটের মানুষ মাসকালাই চেনেও না, খায়ও না- এটা আমার বিক্রমপুরী গিন্নী বুঝবে কিভাবে! অনেক খুঁজে অনেক ঘুরে শেষে চালিবন্দর গিয়ে নিয়ে আসলাম । কালাই দেখে বউ বলে আমি নাকি বেছে বেছে পোকায় খাওয়া ডাল এনেছি । এখন বলেন, এর চেয়ে ট্র্যাজিক আর কি হতে পারে!'

শওকত আজিজ উত্তেজিত ভঙ্গিতে টেবিলে তাস ছুঁড়ে বললেন, ' এটাই আপনার ট্র্যাজিক স্টোরি?' শামীম আহমদ গলাটা একটু চড়িয়ে বললেন, 'আগেই বলেছিলাম কিনা একটা কমেডি শুনতে যাচ্ছি!' আরিফ বক্ত হাসিমুখে তাস শাফল করতে করতে বললেন, 'আপনি পোকায় খাওয়া মাসকালাই কিনে আনবেন, আর ভাবী সেটা বললে আপনার জন্য তা ট্র্যাজেডি হয়ে যাবে! তাসের সাহেব ধরা খাওয়া যে আপনার জীবনের সেরা ট্র্যাজেডি, এটা মেনে নেন ।'

গলা খাকারি দিয়ে শওকত আজিজ ভারী কন্ঠে বললেন, 'দেখুন, ট্র্যাজেডি ব্যাপারটাকে এত খেলো হিসেবে দেখা ঠিক না । ট্র্যাজেডি হলো জীবনের পরাজয়, আদর্শের পরাজয় । আপনার দৃঢ় বিশ্বাসটা একদিন ভেঙ্গেচুরে গুরো হয়ে গেল, সেটাই ট্র্যাজেডি! তাহলে আমার জীবনের ট্র্যাজেডি শুনুন..

শওকত আজিজের ট্র্যাজিক গল্প-

'আশির দশকের মাঝামাঝি ঠিকাদারি ব্যবসায় নামি । তখন এরশাদ পিরিয়ড, ঘুষ-দূর্নীতি প্রাতিষ্টানিকতা পাওয়া শুরু করেছে । যে কাজ প্রাক্বলিত মুল্যের দশ ভাগ নিচে নেমে করলে লস হওয়ার কথা, সেই কাজ লোকজন তিরিশ চল্লিশ ভাগ আন্ডাররেটে নিয়ে যেত । তারপর অর্ধেক ডায়ার রড আর সিমেন্টের জায়গায় বালি দিয়ে কাজটা করে দিত । কাজের মান যত খারাপ, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবদের তত পোয়াবারো । যত বেশি দূর্নীতি, তত বেশি পার্সেন্টেজ! একবার চীফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমার একটা প্রজেক্ট পরিদর্শনে এসে সবকিছু খুটিয়ে দেখে বললেন, ঠিকাদারি করে বউপোলাপানদের খাওয়াব কিভাবে? আমি বললাম, বউপোলাপান না খেয়ে মরে গেলে দুঃখ নেই, কিন্তু স্পেসিফিকেশনের বাইরে গিয়ে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না । স্বাভাবিক ভাবেই আমি কোন কাজ পাইনা । মসজিদ, স্টাফ কোয়ার্টার বা মন্ত্রীর বাড়ির সামনে খালের উপর ব্রিজ- মানে যেসব কাজে মানুষ দূর্নীতি করতে চায়না বা পারেনা, শুধু সেই কাজগুলোই আমার হাতে এসে পড়ত ।

তারপর এলো নব্বোই, দূর্নীতিগ্রস্ত অবৈধ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সারা দেশ ফুঁসে উঠেছে । নতুন দিনের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে আমিও যোগ দিলাম সেই আন্দোলনে । সামরিক সরকারের পতন হলো, গনতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু হলো । কিন্তু মানুষের সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেলো । গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিকেরা সব টেন্ডার ভাগজোক করে নিয়ে নেয় । নেতাদের কেন্দ্র করে ঠিকাদারেরা পেশিবহুল বৃত্ত গড়ে তুলে । ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সকল নেতাই ঠিকাদার কিন্তু সকল ঠিকাদার নেতা নন । চরম হতাশ হয়ে ঠিকাদারি ছেড়ে দিয়ে রড সিমেন্টের দোকান দিলাম ।

আজ আমার ছেলে এক রাজনৈতিক দলের ছাত্রনেতা । কত করে বোঝালাম, ফেরাতে পারিনি । দুদিন পরে সে ও অন্যদের মত টেন্ডারবাজি করবে । আর লোকে বলবে, দেখো শওকত ঠিকাদারের ছেলে টেন্ডারবাজ! এখন আপনারাই বলেন, জীবনে এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কি হতে পারে!'

তাস খেলার আসরে একটা সাময়িক নিরবতা নেমে আসে । শামীম আহমদ মৌনতা ভেঙ্গে বললেন, 'আপনার ছেলে রাজনীতি করে, কিন্তু কখনো খারাপ কাজ করেছে বলে শুনিনি ।'
'করতে কতক্ষণ, সে না করলেও তার গ্রুপ করবে, তার দল করবে- কথাতো একটাই নাকি!' শওকত আজিজের গলায় ঝাঁঝ ঝরে পড়ে ।
নাজিম চৌধুরী টেবিলে ছড়ানো তাসগুলোকে হাতে নিয়ে বলেন, ' আমি ব্যাপারটাকে অন্যভাবে দেখছি, এটা বরং খানিকটা আশাবাদিতার গল্প!'
আরিফ বক্ত মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেন, ' রাজনীতিবিদরা সবাই খারাপ না । আর দেশ শাসনের মত কাজ অযোগ্য লোকদের হাতে ছেড়ে দেয়াও ভালো কাজ নয় । ভালো মানুষদের বেশি বেশি রাজনীতিতে আসা উচিত । আপনার ছেলের মত ভালো ছেলেরাই একদিন রাজনীতিতে সুস্ততা ফিরিয়ে আনবে । আর আমার কাছে ট্র্যাজেডির মানে হলো প্রত্যাশিত কিছু পেতে পেতে হারিয়ে ফেলা । আজকে যেহেতু ট্র্যাজেডির গল্প উঠেছে, তাহলে আমার গল্পটা শুনুন । একটা আদর্শ ট্র্যাজিক গল্প!


আরিফ বক্তের ট্র্যাজিক গল্পঃ

পাশ করে মাল্টিন্যাশনালে ঢুকেছি । প্রিমিয়াম স্যালারি, ওভারটাইম, বোনাস, ইনসেনটিভ সব মিলিয়ে রমরমা অবস্থা । বসদের এক কথা, ইনকাম করো আর ভোগ করো । শহরের অভিজাত বাড়ি, দামি গাড়ি, পশ রেস্তোরা, নামী ব্র্যান্ড- সব তোমার জন্য । ভোগের নেশাটা তারা ভালোভাবেই ধরিয়ে দিলো । ছোট্ট একটা ট্রেনিং নিতে ইংল্যান্ড গেলাম । থরে থরে সাজানো ভোগবিলাস দেখে চক্ষু চড়কগাছ । তখন তরুন বয়স, বুক ভরা সাহস আর চোখ ভরা ফুর্তি । একদিন সুযোগ বুঝে ট্রেনিং থেকে কেটে পড়লাম । রাত জেগে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করি । রবিবার ছুটির দিনটাও কাজে লাগিয়ে দিলাম । হাইড পার্কে সারাদিন ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করি । চরুয়া ইংরেজ আর যাই হোক, রবিবারে বউ-ডারলিং নিয়ে ঘুরতে বেরোয় আর হাত ভরে ফুল কিনে । ফুল বিক্রি করতে গিয়েই মাশার সাথে পরিচয় । তুলতুলে বিশাল শরীর আর শিশুর মত সরল মুখের মাশাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় । ওর সাথে স্ন্যাক্স খেতে যাই । মাশা কিছুই খাবেনা, অনেক বলার পর একটা আস্ত হটডগ আর দুটো আইসক্রিম খেলো ।

সেই থেকে শুরু । মাশার সাথে রোজ ঘুরতে যাই আর ফুডশপে ওর পৈচাশিক খাদ্যভক্ষণ দেখি । মাশা খেতে খুব ভালোবাসে, আমি ভালোবাসি মাশাকে । তাছাড়া আরপি পাওয়ার জন্য ওকে বিয়ে করা খুব দরকার । একদিন আমরা গেলাম গোল্ডস্মিথের ডায়মন্ড শপে । হীরে চুন্নী পান্নার জৌলুস দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায় । মাশা একটা রুবীর রিংয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে । যা দাম, আমার এক বছরের জমানো টাকা শেষ হয়ে যাবে । পটেনশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট, তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম । আগামিকাল দুজনে লং ড্রাইভে যাব । তারপর হাটু গেড়ে ঐ রুবীর রিং দিয়ে মাশাকে প্রপোজ করবো ।

অপার্থিব পুলকে নিদ্রাহীন রাত । এদিকে বাড়িওয়ালীর দুই মেয়ের মাঝে তুমুল ঝগড়া লেগেছে । বাংলাদেশ থেকে আসা তাদের জামাইরা এমনিতে খুব নিরিহ আর ভদ্র । কিন্তু বউরা তাদের তাতিয়ে দেয় । ইউ কাওয়ার্ড, আমাকে এত বড় কথা বললো আর তুমি কিছু বলবে না! দুই পুরুষপুঙ্গব তখন মহাপ্রতাপে একে অন্যের দিকে তেড়ে যায় । চেঁচামেচির সাথে ধুপধাপ শব্দ । মেজাজটা খিচরে গেল । সোজা গিয়ে দরোজায় নক করে দিলাম রামঝাড়ি । ঝাড়ি খেয়ে দুই বোন সাপের মত ফুঁসে উঠলো । সেই সাথে তাদের জামাইরাও গলা চড়ালো । চোস্ত ইংরেজিতে একটা লম্বা লেকচার দিচ্ছি, দেখি নিচে পুলিশের গাড়ি । বুঝলাম ওদের কেউ ইমার্জেন্সিতে কল দিয়েছে । অফিসার এসে আইডি দেখতে চাইলো । আইডি পাবো কোথায়? মাশার সাথে বিয়েটা হয়ে গেলে না হয়..

এক সপ্তাহের গরাদবাস । মাশাকে খবর দেয়ার পরেও আসেনি । অযাচিত পুলিশী ঝামেলায় কেই বা জড়াতে চায় । শেষে ইমিগ্রেশন পুলিশ পশ্চাদ্দেশে ছাপ্পা দিয়ে সোজা উঠিয়ে দিলো দেশের প্লেনে । দেশে ফিরেও স্বপ্ন দেখেছি, মাশা হয়ত একদিন ঠিক উড়ে আসবে আমার কাছে । অপেক্ষার অবসান হয় আমার এক বন্ধুর ফোন পেয়ে । মাশা তার নতুন বয়ফ্রেন্ডের সাথে নিয়মিত ফুডশপে গিয়ে যাবতীয় চর্ব্য-লেহ্য-চুষ্য-পেয় গলধঃকরণ করে যাচ্ছে, পোলার বিয়ারের মত শরীরে ফ্যাট-কার্বোহাইড্রেডের ডিপো বানাবে বলে!

আজ এতো বছর পরে এসেও আমার বউ সুযোগ পেলেই খোঁচা দেয় । ওর মত মেয়ে বলেই নাকি আমার ঘর করতে পেরেছে । আমাকে সোজা করার জন্য নাকি মাশার মত সর্বভূকের দরকার ছিল! এবার বুঝেন, এটা ট্র্যাজেডির উপর ট্র‌্যাজেডি কিনা?

'প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলে হে! এটা তো নতুন জীবন পাবার মত আনন্দময় গল্প!' শওকত আজিজ খোঁচা দিলেন । সাথে সাথে সবাই হো হো করে হেসে উঠে ।



মিসেস চৌধুরী অর্থাৎ রাবেয়া বেগম প্রবেশ করতেই সবার দৃষ্টি তার হাতে থাকা নাশতার প্লেটের দিকে চলে যায় । ভদ্রতা করে বিনয় দেখানোর চেষ্টা করলেও রাবেয়া বেগম প্লেট এগিয়ে দিতে সবাই খাওয়া শুরু করে দেয় । শুধু শওকত আজিজ সাহেব একটু ইতস্তত করছিলেন । তার দিকে তাকিয়ে রাবেয়া বেগম বললেন, ' কম তেলে ভেজেছি ভাই, খান কিচ্ছু হবে না । আর সমস্যা হলে ওমেপ্রাজল এনে দিচ্ছি!'
'বুঝলে, ঘরে ঘরে ডাক্তার!' নাজিম চৌধুরী ফোড়ন কাটেন । "এখানে ডাক্তারির কি হলো! এটা কে না জানে!' স্বামীর দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণস্বরে কথাগুলো বলে রাবেয়া বেগম প্রস্থান করেন ।

'ডাক্তার, হ্যাঁ ডাক্তার! ডাক্তার আর তার বউয়ের বড় বোন সুর মিলিয়ে কাঁদছে- এর চেয়ে ট্র্যাজিক ঘটনা দুনিয়াতে আগে ঘটেনি'- রহস্যময় ভঙ্গীতে শামীম আহমদ কথাটি বলেন । আরিফ বক্ত কিছুটা ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করেন, 'কোন ডাক্তার! মনসুর ডাক্তার নাকি?' শামীম আহমদ ইশারায় সায় দিতেই নাজিম চৌধুরী গলা খাকারি দিলেন । তারপর নিচুস্বরে বললেন, 'থাক, এসব নোংরা গল্প বাসায় না বলাই ভালো ।'
শামীম আহমেদ নড়েচড়ে বসলেন, 'এখানে নোংরামোর কি দেখলেন ভাই? মনসুর ডাক্তারের বউ তার গাড়ির ড্রাইভারের সাথে পালিয়েছে তো! আরে, এটা হলো বাইরের আবরন । ভেতরের কেসটা অনেক জটিল এবং ট্র্যাজিক!'
গরম পাকুড়া খেতে খেতে জটিল গল্পটা শোনার জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে বসলো ।

শামীম আহমদের গল্পঃ

'মনসুর সাহেব আর দিলারা নিশাত দুজনেই ডাক্তার । রোগী হাসপাতাল চেম্বার নিয়ে দুজনেই ব্যস্ত । তাদের বাচ্চাটাকে দেখাশোনার জন্য বাসায় পার্মানেন্ট কাজের মেয়ে রাখতে হয় । কিন্তু সমস্যা হলো, তাদের বাসায় কোন কাজের মেয়েই বেশিদিন টেকে না । যদিওবা কেউ থেকে যায়, মাস ছয়েকের ভেতরেই তাকে অবৈধ ম্যাটার্নিটি ক্লিনিকে যেতে হয় । দিলারা নিশাত তার স্বামীর অপকর্ম রুখতে হাসপাতালের চাকরিটা ছেড়ে দেন । বিকেলে নিজের বাসায় চেম্বার করে রোগী দেখতে থাকেন । বাসায় তেমন একটা রোগী আসেনা । দিলারার ইনকাম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মনসুর সাহেবের উপর আর্থিক চাপ বাড়ে । ইনকামের ব্যাপারটা দিলারার জন্য অস্বস্তিকর হলেও চোখের সামনে তার স্বামীর দুশ্চরিত্রতা দেখতে হচ্ছেনা ভেবে মানসিক শান্তি পান । এভাবে মোটের উপর তারা সুখেই দিন পার করছিলেন ।

বেশ কয়েজক বছর পর দিলারার বড় বোনের স্বামী অকাল প্রয়াত হলে তিনি তার ছেলেসহ ছোট বোনের বাসায় আশ্রয় নেন । দিলারা এতে খুশিই হোন, বোন আসায় তিনি অনেকটা রিলাক্স বোধ করেন । বোনও খুশি মনে দিলারার সংসারের সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেন । একটু রিলিফ পেয়ে দিলারা আবার একটা হসপিটালে চাকরি নেন এবং নতুন চেম্বার নিয়ে রোগী দেখতে শুরু করেন । কিছুদিন পর দিলারা কিছু একটা অস্বাভাবিকতা টের পান । মনসুর আর তার বড় বোনের মাঝে হৃদ্যতা ছিল চোখে পড়ার মত । মনসুরের চরিত্র সম্পর্কে দিলারা সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকায় ব্যাপারটা নিয়ে তিনি চিন্তায় পরে যান । কিন্তু বিষয়টা এতোই স্পর্শকাতর যে, হাতেনাতে প্রমান না পেয়ে কিছু বলাও যাচ্ছে না । এটা নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন মানসিক অশান্তিতে ভোগেন । বোনের সাথে মনসুরের অন্তরঙ্গতা দিন দিন বাড়ছিলো । দিলারা মোটামুটি এদের অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যান । হতাশায় ভুগে তিনি এক সময় আত্মহত্যার কথাও ভাবেন । শেষে তার মাঝে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠে । মনসুরকে চরম শিক্ষা দিতে দিলারা বাসার গাড়ির ড্রাইভারকে পটিয়ে তার সাথে পালিয়ে যান ।

দিন তিনেক যেতেই দিলারা তার ভুল বুঝতে পারেন । সন্তানের খোঁজ নি্তে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফোন করেন । দিলারার ফোন পেয়ে মনসুর সাহেবের বাসায় কান্নার রোল পড়ে যায় । মনসুর সাহেব আর দিলারা নিশাতের বড় বোন দুজনেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন ।

ঠিক এই জায়গায় এসে গল্পের ট্র্যাজিক পরিণতির কথা চিন্তা করেন । তিনজনই হাউমাউ করে কাঁদছে, এর চেয়ে ট্র্যাজিক আর কি হতে পারে!

'মনসুর একটা সাক্ষাৎ লোফার, চরিত্রহীন- এর কান্নায় কি আসে যায়! শওকত আজিজ উস্মা প্রকাশ করেন ।
আরিফ বক্ত বলেন, 'গল্পটাকে বড়জোড় একটা সাইকো রিভেঞ্জ স্টোরি বলা যেতে পারে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের হাতে ধর্ষিতা ফরাসি মেয়েরা প্রসবের পর বাচ্চাটাকে গলা টিপে মেরে ফেলত, শত্রুর প্রতি প্রতিশোধ হিসেবে । এখানে কোন ট্র্যাজেডি নেই, পুরাই সাইকো!'

'আজকে ভালোই গল্প জমেছে দেখি!' চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে রাবেয়া বেগম যোগ দেন ।
শামীম আহমদ জিভে কামড় দিয়ে বলেন, 'আপনি শুনেছেন নাকি!'
'হ্যাঁ, সবগুলোই শুনলাম, মনযোগ দিয়ে ।' সবার হাতে চায়ের পেয়ালা পৌছে দিয়ে রাবেয়া বেগম একটা চেয়ার টেনে বসেন । তারপর মিটিমিটি হেসে বলেন, ' ট্র্যাজেডি অনেক গভীর ব্যাপার, উপলব্ধীর ব্যাপার । ট্র্যাজেডির গল্প আসলে কাউকে বলা যায় না । এটা মানুষের বুকের গভীরে আমৃত্যু ঘা হয়ে বসে থাকে । নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে অতি সন্তর্পনে চলাচল করে । ট্র‌্যাজিক ব্যাক্তির খুব কাছের মানুষই কেবল সেই নিঃশ্বাসের উত্তাপ বুঝতে পারে ।'

বিয়োগান্তিকঃ

আড্ডা ভাঙ্গার পর রুটিন ভদ্রতা হিসেবে নাজিম চৌধুরী তিনজনকে বাসার গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন । ফিরে এসে দরোজা বন্ধ করতেই হঠাৎ যেন তার বুকটা ভারী হয়ে আসে । শরীর খারাপ হয়েছে ভেবে স্ত্রী কে ডাকতে গিয়ে মনে হলো এটা তাকে বলার নয় । এটা তার অনেক পুরনো অসুখ , প্রায় এক যুগ পর আবার ফিরে এসেছে । ধীর পায়ে হেটে গিয়ে অন্ধকার ব্যালকনিতে রেলিং ধরে দাঁড়ালেন । বুকে আটকে থাকা ভারী বাতাস নিঃশ্বাসের সাথে বের হয়ে আসছে । পুরনো কিছু স্মৃতি তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে । প্রথম জীবনে প্রেম করে বিয়ে করা ফারজানা মাত্র কয়েক মাসের মাথায় তাকে ডিভোর্স দেয় । আর্থিক দৈন্যতা একটা ব্যাপার ছিল, সেটা কাটিয়ে উঠার প্রাণপন চেষ্টাও ছিল । ডিভোর্স লেটার হাতে পেয়ে হতভম্ব নাজিম অনেক চেষ্টা করেছিলেন ফারজানার সাথে একটিবার কথা বলার । কিন্তু ফারজানা তাকে সে সুযোগ দেয়নি, সুইস প্রবাসী তার এক কাজিনকে বিয়ে করে সে পরবাসী হয় । আজও কিছু কথা, কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরেন নাজিম সাহেব, একাকী আনমনে ।

স্ত্রী সন্তান বন্ধু আড্ডা ব্যস্ততা- কোন কিছুই পারেনা এই পুরনো ক্ষত পুরোপুরি উপশম করতে ।
৯৬টি মন্তব্য ৯৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা : অরাজকতার পালে নতুন হাওয়া!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:০৩


বাংলাদেশে আজকাল দাবি না জানালে কেউ আর মানুষ থাকে না—ছাত্র, শিক্ষক, গৃহিণী, পুলিশ, পিয়ন, কবি, কুস্তিগির, সবাই 'অধিকার' চায়। তবে অধিকার মানে এখানে মোটেই দায় বা কর্তব্য নয়, বরং ছিনিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্পা এবং দেহ ব্যবসায়ীদের কথা শুনলে রেগে যাবেন না

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:৪৯



পুরো পৃথিবীতে স্পা এর সংখ্যা ১ লক্ষ ৮১ হাজার। এইসব স্পা-গুলোর বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে ইউরোপে। এশিয়া - প্যাসিফিকের দেশগুলোতেও স্পা-এর সংখ্যা কম নয়। ৫১ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশে স্পা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাটির রঙভঙ্গ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:৫০


হ হ আজ কাল মানুষগুলো
হাসলেও মারে, ভাত চাইলোও মারে-
এমন কি চেয়ে থাকলোও মারে;
কি অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে খারাপ-
মারার বিকল্প কিছু খুঁজে পায় না
যত রাগ বাবা এখন রক্তাক্ত সাপ
ক্ষমতায় দেখে শুধু... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম বিহীন বিশ্ব গড়ার চেষ্টা বিশ্ব জনসংখ্যা অনেক কমিয়ে দিবে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৫০



নেতানিয়াহু বলেছে তাদের সাথে অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র আছে। সে মুসলিম বিশ্বকে বড় রকমের হুমকি দিয়েছে। সে গণহত্যা চালাচ্ছে। আত্মরক্ষায় মরিয়া মুসলিমরাও গণহত্যা চালাবে। তখন আর সভ্যতার বাণীতে কাজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার মিরর ডোল, নিজের মনের অশান্তি অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে ফ্যাসিস্টের মতো আচরণ করবেন না

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:৩৫

ব্লগার মিরর দৌলাকে বলছি।
আপনাকে কিছু কড়া কথা আজ বলবো। ব্লগে বর্তমানে আপনার কোন অবদান নেই। সামুর যে ব্লগপেইজটা আপনি চালান, সেখান থেকে সব পোষ্ট আপনি ড্রাফটে নিয়েছেন। সেটা আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×