আজকাল........
মধ্যরাত্রিতে ঝিঁ ঝিঁ পোকা, রাত্রিচারী বাদুড় আর পেঁচাদের সহগামী হয়ে একা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে স্ট্রিটলাইটগুলো আচমকাই চোখে ঝাপসা হয়ে আসে মাঝে মাঝে। দু'তিনটা রাতজাগা বিড়াল পথ কেটে চলে গেলে নিজেকে আবিষ্কার করি ল্যাম্প পোস্টের নিচে পড়ে থাকা এক টুকরো অন্ধকারের মত পরিত্যক্ত ভাসমান মানুষগুলোর শয্যার পাশে ফুটপাতে দু'পা ছড়িয়ে বসে ঘোরাচ্ছন্ন অবস্থায়। অতঃপর ভ্রমগ্রস্থ হয়েই নিশীতে পাওয়ার মত ঢুলুঢুলু চোখে ফের হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌছে যাই রাত্রিবাসের ঠিকানায় - যাকে সবাই বলি ঘর। ভারক্লান্তের মত অবসন্ন শরীরটাকে ছুঁড়ে দিই আরামদায়ক তুলতুলে বিছানার কোলে, শরীরের ভার তখন শূন্য হয়ে আসে - কিন্তু মনের ভার কমে না তাতে। একটা চিনচিনে ব্যথা বুকের ভেতর থেকে পাক খেতে খেতে ছড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে,তখন পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবার তীব্র যন্ত্রণাক্লিষ্ট অনুভূতি হয়। অমানুষিক তেষ্টায় গলা শুকিয়ে এলে হাত বাড়িয়ে জলের গ্লাস টেনে নিই, অথচ হাতে আসা মাত্রই প্রচন্ড আক্রোশে তাকে ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করে। ভাঙ্গি না। ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু জল গলায় চালান দিয়ে জমাট বাধা অন্ধকারে দুহাতে মাথা চেপে বসে থাকি ভূতগ্রস্থের মত।
তারপর........
কিছু বৈদ্যুতিক সিগনাল শরীরের আনাচে কানাচে অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গের মত প্রবাহিত হতে থাকে ঘড়ির কাঁটার চার ভাগের এক ভাগ পরিধি জুড়ে। আমি বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মত একটা তড়িতাহত অবশ মূর্তি হয়ে যাই........
কেন হয়?
এমন কেন হয়?
কেন তাকে দেখলেই আজকাল আমার হৃৎপিন্ড একশ মাইল ম্যারাথন রেসের দুরন্ত ঘোড়ার মত অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটতে শুরু করে..........আমার বশে থাকে না আর? শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বাড়তে বাড়তে একসময় বুকের ভিতর নিঃশ্বাসের চাপ ধরে যায়। পাঁচশ ওয়াট ফ্লাশ লাইটের আলোর মত আমার চোখজোড়া ঝলসে দেয় তার ভুবনভোলানো হাসি,আমি বুকের ভিতর অবিরাম দ্রিম দ্রিম ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাই। ক্লাসের ফাঁকে আড়চোখে অথবা বন্ধুদের ভিড়ের মাঝে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে কেন আমার অপলক শুধু তার দিকেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়? আমি জানি না। অথবা জানতে চাই না। আমার ভয় হয়, আমি তার চোখের দিকে তাকাতে পারি না। যদি তার দৃষ্টি হঠাৎ অন্তর্ভেদী হয়ে যায়? আর সে আমার দৃষ্টি বেয়ে মস্তিষ্কের ভেতর প্রবেশ করে ফেলে? তাই তার স্পর্শ বা আমার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়া তার কথাগুলো যখন আমার হৃদপিন্ডের তারে অনিয়ন্ত্রিত কাঁপন সৃষ্টি করে তখন আমি কদাচিৎ তার মুখের দিকে চোখ তুলে চাই আর প্রতিনিয়ত চূড়ান্ত নিস্পৃহ এক উদাস ছেলের অভিনয় করে যাই।
অতঃপর..........
কিছু অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে ভগ্নদেহে ঘরে ফিরে ততোধিক ভগ্ন মনের যন্ত্রণায় শরবিদ্ধ হরিণশাবকের মত কাতরাতে থাকি। মাথার ভেতর একশো একটা সাইরেন রিনরিন করে বাজতে থাকে ডেথ মেটালিক পীচে বেজ গিটারের তারছেঁড়া আর্তনাদের মত............আর কিছু কন্ঠস্বর আমার নিউরনের অলিতে গলিতে তুফানের মত তোলপাড় চালিয়ে যায়........
রিশাদ!
দ্রিম দ্রিম দ্রিম............
Why are you being so careless day by day?
রিন রিন রিন রিন রিন..............
মাত্র গত সপ্তাহেই তো তোমাকে একটা নতুন হ্যান্ডিক্যাম কিনে দিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যেই কি করে হারালে ওটা? রিশাদ,I'm talking to you! answer my questions!
দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম..................
I'm warning you for the last time। এখন থেকে কেয়ারফুল হতে শেখ এবং নিজের সবকিছুর খেয়াল নিজেই রাখা শেখ। You'll have to learn it। আমার অথবা তোমার বাবার পক্ষে পসিবল না সর্বক্ষণ তোমাকে চোখে চোখে রাখা........you'll have to take your own responsibilities। Are you hearing me?
রিন রিন রিন রিন রিন রিন রিন রিন রিন রিন........................
আর হ্যাঁ, শোনো, আজ আমার বাসায় ফিরতে রাত হবে। তুমি রীনাকে কোনরকম ট্রাবল না দিয়ে লক্ষ্মী ছেলের মত খেয়ে নেবে,বুঝেছ? গতকালও সে আমাকে কমপ্লেইন দিয়েছে তুমি খাওয়া নিয়ে তাকে যথেষ্ট বিরক্ত করেছ, এইসব আমি আর শুনতে চাইনা, did you get that?
দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম............
আমার মাথার মধ্যে একটানা অনেকক্ষণ সাইরেনের আর্তনাদ বেজে যায়.........মস্তিস্ককোষে আবর্জনার মত জমা হয়ে থাকা যাচিত অযাচিত বহু স্মৃতি আমাকে বারবার সহস্র ফিট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে আছড়ে আছড়ে ফেলে............আর চোখের সামনে বায়োস্কোপের মত একের পর এক ভিড় করতে থাকে বহু চেনা কিছু দৃশ্যাবলী.........
খেলার মাঠে, টুইস্টারের ক্যান্টিনে, বাসের লাইন, মুভি থিয়েটার, দুপুরের উদ্দাম রোদে কৃষ্ণচুড়ার ছায়া বিছানো রাজপথে তার আর আমার পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া,বাদাম খাওয়া, খোসাগুলো মুহুর্তেই ছুঁড়ে দেয়া দূরবর্তী কোনো বাসের ছাদে,ছন্নছাড়া এলোমেলো টুকরো টুকরো কথা আর দুর্বোধ্য সাংকেতিক ভাষায় অশ্লীল সব রসালো কৌতুক আউড়ে নিজেদের ভেতর অট্টহাসিতে ফেটে পড়া...............
অথবা,রাত জেগে পরবর্তী পরীক্ষার নোট তৈরী,বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় স্যারদের ক্যারিকেচার এঁকে ভরিয়ে তোলা,ল্যাব এসিস্ট্যান্টদের তুচ্ছ সব দোষত্রুটি নিয়ে অবর্ণনীয় খিস্তি-খেউর, সপ্তাহান্তে ছুটি পেলেই বাসায় বসে কম্পিউটার গেমস, জয়স্টিক নিয়ে তার আর আমার টানাটানি...........শিশুসুলভ সারল্যে কেটে যাওয়া কিছু দিন.........কিছু দৃশ্যাবলী স্মৃতির পাতাজুড়ে হামলা করতে থাকে বিক্ষিপ্ত কিছু মিসাইলের মত।
অবসন্ন আমি......
বিক্ষিপ্ত আমি............
বিব্রত আর যন্ত্রণাক্লিষ্ট আমি................
যাপিত জীবনের হিসেব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে পরিত্যক্ত এক টুকরো ছেঁড়া কাগজের মত শুষ্ক,ফ্যাকাশে আর নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে থাকি ডিভানের উপর। ক্লান্ত আমার চোখে ঘুম নেমে আসে কিন্তু দুঃস্বপ্নরা পিছু ছাড়ে না। একটা হীমশীতল ঘরে আমি ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকি বৃহন্নলা হয়ে.........
একটা সময় আমার হাত জড়িয়ে আসে..........
পা জড়িয়ে আসে.........আমি উদ্ভ্রান্তের মত হাত দুটো ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকি........পারিনা........আতঙ্কে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি........
দূর আকাশ থেকে উড়ে আসা শত শত এলবাট্রাস আমাকে ঘিরে ফেলে চারপাশ থেকে........একে একে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়ে তারা আমার কপালের ভাঁজে রেখে যায় একটি করে স্মৃতিচিহ্ন...........
খড়ের গাদায় আমার পরিত্যক্ত দেহ পড়ে থাকে........আমি হয়ে যাই বহু ব্যবহৃত জল..........
তারপর...........
নিস্তব্ধ রাত নেমে আসে.............
রাতের পাখিরা আমাকে ডাকে.........আমি সাড়া দিই না.......আমি ভোরের প্রতীক্ষা করি.........তাকে দেখার প্রতীক্ষা......একটা দীর্ঘ বিনিদ্র রজনী শেষ হবার পর তার কন্ঠস্বর শোনার প্রতীক্ষা..........তার স্পর্শের প্রতীক্ষা.......আমার তৃষিত নয়ন, শ্রবণেন্দ্রিয় আর আমার তৃষিত দেহ........দীর্ঘদিনের বিরহী প্রেমিকের মত আকুল হয়ে তার প্রতীক্ষা করে।
অবশেষে.......
সকাল হলে চিরচেনা ক্যাম্পাসে বন্ধুদের নিত্যদিনের কলকাকলি আর খুনসুটির মাঝে ভীড় থেকে বেরিয়ে আসা তার মুখ খুঁজে পাই.........কিন্তু পাওয়া মাত্রই ভয়ে সিঁটিয়ে পাশ ফিরি,নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখি নিজেকে..........
হঠাৎ কাঁধের উপর তার আলতো হাতের স্পর্শ হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিক শকের মত আমাকে চমকে দেয়, আমার বজ্রাহত দৃষ্টিকে অনুসরণ করে তার অবাক হওয়া কন্ঠস্বর,
-তোর হয়েছেটা কি?
আমি নির্বাক হয়ে কেবল একটুখানি মাথা নাড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করি,সে আরো একটু ঘন হয়ে আমার কাছে এসে একহাতে আমার মুখটা তুলে তাকায়.........আমি ভেতরে তোলপাড় হয়ে যেতে যেতে খড়কুটো ধরে বাঁচার শেষ চেষ্টায় অস্ফুট স্বরে বলি, কিছু না আবির! রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি তোকে নিয়ে.......তাই ভয় হচ্ছিল.....স্বপ্নটা সত্যির মত ছিল........
আবির এক্সরে রশ্মির মত গভীর দৃষ্টি মেলে অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে চেয়ে থাকে.........কিছু পড়ার চেষ্টায়.........আমি জানি সে আমাকে পড়তে পারে........
সে কি আজ আমার নিউরনের কোণে কোণে জমা হওয়া দুর্দমনীয় অনুভুতিগুলো এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে পারবে?
আমার দৃষ্টির ভাঁজে সযতনে বহুদিনের লুকিয়ে রাখা অদম্য আবেগগুলো কি আজ খোলা বইয়ের পাতার মত তার সামনে নগ্ন হয়ে পড়বে?
আমি জানি না............
আমি কিছুই জানি না.................
প্রতিটা মুহূর্ত একেকটা সহস্রাব্দির মত দীর্ঘ হয়ে যায় আমার কাছে আর আমি রুদ্ধশ্বাসে কোনো এক আসন্ন তুমুল ঝড়ের অপেক্ষা করতে থাকি................

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




