somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাগরের বুকে ভয়াল রাতগুলো - প্রবাসের টুকরো কথা

১৮ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চট্রগ্রাম জেলার উকিয়া থানার লমবরপাড়া গ্রামের মোঃ জালাল উদ্দিন। রোদে পোড়া চুল আর তামাটে গায়ের চামড়ার ২৫-২৬ বছরের যুবক। সেন্ট্রাল মার্কেটের সামনে প্লাস্টিকের একটি ব্যাগ হাতে বাসের অপেক্ষায় দাড়িয়েছিলো, গুড়ু-গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো মাথার উপর। বাসের সময় হয়েছে তাই অন্য কোথাও যেতেও পারছেনা। পোষাক-আশাকে আর চেহারায় বাঙালী মনে হওয়ায় ডেকে কোন দেশী জানতে চাইলাম। বাঙালী বলাতে বললাম গাড়ীতে উঠে পড়। কথা প্রসঙে জানতে চাইলাম কি করে কোথায় থাকে। জানাল দেশে চলে যাবে দু-একদিনের মধ্যেই। তাই শেষ কেনাকাট করছে। কাজ করত নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে। বেতন ভালোই ছিলো, তারপরও দেশে মায়ের শাররীক ভালো নয়, তাই দেশে ফিরে যাচ্ছে। জানাল বেতন এখন ভালো হলেও প্রথমদিকে দেড় বছর ইন্দোনেশিয়ার জেলে কাটিয়েছে। তেমন একটা রোজগার হয়নি। জানতে চাইলাম, ইন্দোনেশিয়ার জেলে (শরণার্থী ক্যাম্প) কেন ছিলে? তারপর সে জানাল তা এক লোমহর্ষক কাহিনী। ' আমরা দালাল ধরে মালয়েশিয়া আসার চেষ্টা করেছিলাম। অল্প টাকায় আমাদের এলাকার কিছু দালাল মালয়েশিয়া পাঠায় বোটে করে। আমিও এক দালালের মাধ্যমে আসার জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দালাল কে দেই। যথাসময়ে দালাল চারটি বোটে মোট ৫৬০ জন যাত্রী উঠিয়ে দেয়। গন্তব্য থাইল্যান্ড। থাইল্যান্ড থেকে অপর দালাল আমাদের রিসিভ করে নিয়ে যাবে গোডাউনে, সেখান থেকে সময় সুজোগ করে আস্তে আস্তে মালয়েশিয়ার বর্ডার পার করে দেবে। আমি যেই বোটে উঠি, সেটা ছোট্ট একটা ইন্জিনের মাছ ধরার বোট। দালাল সেখানে ১৯৪ জন যাত্রী তুলে দেয়। আমরা ৬০ জনের মত ছিলাম বাঙলাদেশী, বাকী সব বার্মার লোক। বোট চলতে শুরু করল। বোটের চালক জানাল ১৪ দিনের মত লাগবে থাইল্যান্ডের মাটিতে পৌছতে। ঐ যে আকাশে রাতে একটা তারা দেখা যায় সেটাকে বোটের খুটির উপর ধরে পথ এগুলেই থাইল্যান্ড। আর একটা কম্পাসও ছিলো। বোট চলটে শুরু করল। রাত দিন একটানা বিরামহীন ভাবে। সবাই বসে কথা বলি, গল্প করি। এভাবেই সময় কাটে। বোট টার উপরে যত জায়গা, নীচেও তত জায়গা খালি। কিন্তু নিচেও লোকে ঠাসাঠাসি অবস্থা। চাল-ডাল দিয়ে নিচে প্রতিদিনই খিচুরীর মত কিছু একটা রান্না হয়। বসে থাকলে সবার জায়গা হয়, কিন্তু শু'তে গেলে জায়গা নাই। একজনের গায়ের উপর আরেকজন শুতে হয়। আমরা বাঙালীরা সংখায় কম, তাই বার্মার লোকগুলে নানা ভাবে উতক্ত করে। এটা করা যাবেনা, সেটা করা যাবেনা, নানা ধরনের ঝামেলা। তবে আমরাও সুযেগ বুঝে তাদের নিজেদের মধ্যে গ্যান্জাম লাগিয়ে দিতাম। সাগরের বুকে শুধু খা-খা। যেদিকে দুচোখ যায় শুধু পানি আর পানি, লাল পানি, নীল পানি, ঘোলা পানি কত পানি পেরিয়ে অবশেষে ১৩ দিন পর থাইল্যান্ডের বর্ডারে পৌছুলাম। বর্ডারে পৌছার পর শুরু হল আসল সমস্যা। আমরা চারটা বোটই ধরা খেলাম থাইল্যান্ডের নৌবাহিনীর হাতে। যথাসময়ে দালাল ওদের কন্ট্রাক্ট করতে পারেনি বিধায় তারা আমাদের কিছুতেই থাইল্যান্ডে ঢুকতে দেয়নি, উপরন্তু আমাদের চারটি বোটের ইন্জিন খুলে নিয়ে আমাদের মাঝ সাগরে নিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে আসে। ভয়ে অনেকেই কাদতে শুরু করল। এই অকূল দরিয়ায় আমরা এখন কোথায় যাবো। এদিকে আমাদের খাওয়ার প্রায় শেষ, যা আছে তাই দিয়ে কোনমতে শেষ বেলা রান্না করে খেয়ে নিলাম। এবার সবাই জড়োশড়ো হয়ে বসে শুধু আকাসের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ নেই, এখন আর কোন বাঙালী বার্মা নেই, সবার মুখগুলো একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে। আমরা ভেসে চলেছে অজানার উদ্দেশ্যে। সেই রাতে আর কারো ঘুম হয়নি। সবাই বসে বসে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিলাম। পরের দিন সূর্য উঠল, বোট ভেসে চলছে গন্তব্যহীন ভাবে। কারো মুখে কোন কথা নেই। সেই দিনটিও শেষ হল। পরের দিন, অনেকেই এখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করেছে। খাবার নেই পানি নেই। পানি নেই ঠিক না, চারদিকে অথই পানি, কিন্তু পান করার মত কোন পানি নেই। এদিকে ক্ষুধা আস্তে আস্তে বাড়ছে। শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে উঠছে। চোখে ধোয়া ধোয়া লাগে। পরের দিন অনেকেই বোটের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। উঠে দাড়াবার শক্তি কারো নাই। শুরু হল প্রচন্ড বৃষ্টি। অনেকটা ঝড়ের মত। কিন্তু আমরা কেউই ভয় পেলাম না। বরং প্লাস্টিক বিছিয়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখলাম। ঝড়ে বোট উল্টে গেলে তো মরেই যাবো, না উল্টালেও খাবারের অভাবে দু-একদিনের মধ্যেই মরতে হবে। তাই প্রচুর পানি জমিয়ে নিলাম। সেদিন পানি খেয়ে মনে হল আরো তো দুটা দিন বাচব। কিন্তু পানি খেয়ে তো আর পেট চলেনা, বরং বমি বমি লাগছিলো। কখনো বোটের কয়লা খাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেটাও মুখ দিয়ে ঢুকতে চায়না। এভাবে পাচদিন চলার পর যখন বাচার আশা আমরা সবাই ছেড়ে দিয়েছি তখন দুরে দেখলাম একটা ছোট্ট স্পীডবোটের মত দেখা যায়। একজনের গায়ে লাল জামা ছিলো খুলে উপরে তুলে নাড়াতে থাকলাম, প্রায় দশ পনর মিনিট নাড়ার পর বোট টি আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। সবাই যেন আবার নতুন করে বাচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। দূর্বল হয়ে যে মাঝেতে শুয়ে ছিলো, সেও নড়েচড়ে বসল। কাছে আসতেই দেখলাম এক লোক মাছ ধরার বর্ষি হাতে। আমাদের মাঝে মাত্র তিনজন টুকটাক ইংরেজী জানত, ততদিনে কারো কথা বলার শক্তি নেই। তারা জানাল বিপদের কথা। লোকটিকে ঠিকভাবে বুঝাতে পারল কিনা জানিনা, তবে সে ঠিকই আমাদের চেহারা দেখে বিপদ বুঝে নিল। সে কাকে যেন ফোন করল, ঘন্টা দুয়েক পর দুটা বড় বড় নোবাহিনীর জাহাজ এসে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে গেল। যাদের অবস্থা বেশী খারাপ, তাদের স্যালাইন দেয়া হল, আর সবাইকে যার যার মত ঔষধ দেয়া হল। আর খাবার দেয়া হল। আশ পাশের মহিলা বাচ্চারা যে যা পারল ফল-মূল খাবার-দাবার এনে দিয়ে গেল। আমরাও খেলাম যমের মত। তারপের দুদিন পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ক্যাম্পে। সেখানে দুমাস থাকার পর জাতিসংঘের লোক এসে নিয়ে গেল আরেকটা ক্যাম্পে। সেখানে দেড় বছর থাকার পর সাথের একজনের পরিচিতের সাথে মালয়েশিয়া ঢুকলাম।'
অনেকক্ষন তার গল্প শোনার পর বললাম, আমিতো জানি মাত্র ২৫ হাজার টাকা দিয়ে বোটে করে লোক মালয়েশিয়া ঢুকে, সে বলল, 'ভাই আগে জানতাম না এখন জানি। আসলে তারা ২৫ হাজার নিয়ে বোটে তোলে, তার পর থাইল্যান্ড বর্ডারের দালাল নেয় আরো ৪০ হাজার, সেখান থেকে মালয়েশিয়ার দালাল নেয় বাকীটা, এভাবে প্রায় লাখের উপর যায়। আর অনেক সময় টাকা যোগান দিতে না পারলে দালাল মাছ ধরার নৌকায় বিক্রি করে দেয় দু-তিন বছরের জন্য।'
তাকে বললাম কিছুদিন আগেওতো ১২০ জনের মত নৌকাডুবিতে মারা গেল, আরো আরো মরছে, প্রশাষন এদের বিরুদ্ধে কিছু করেনা? একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে বলল ' ভাই বিদেশীদের কাছে আমরা আবর্জনা-বর্জ্য, আর আমাদের নেতানেত্রী প্রশাষন আর বড় বড় লোকদের কাছেও আমরা আবর্জনা বর্জ্য। এই দালালদের সাথে বড় বড় লোকদের হাত আছে, আমাদের মরনের আগে দেয়া লাখলাখ টাকার ভাগ মন্ত্রী-এমপি, প্রশাষন সবার পেটেই গেছে। আবার আমরা মরার পরও বাচার জন্য দালালরা তাদের পকেট ভর্তি করে, মাঝে দিয়ে আমরা বাচি, আমরা মরি।'
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×