অজ-পাড়াগাঁ বলতে যা বুঝায় মেয়েটি এসেছিলো তেমন একটি আধুনিকতা বর্জিত প্রত্যন্ত অন্চল থেকে। দস্যিপনায় মেতে থাকা দূরন্ত কৈশর কাটিয়ে, তারুণ্য পদার্পনের সাথে সাথে ক্রীড়া বিশ্বের আকাশে ঝলমল করে উঠে এক তারকা হয়ে...!!!
চোখভরা স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে সমসাময়িক সকলকে ছাড়িয়ে যায় মেয়েটি, আক্ষরিক অর্থেই ছাড়িয়ে যায়, “ওর্য়াল্ড চ্যাম্পিয়ন অফ এ্যাথলেট” প্রতিযোগিতায় ৮০০ মিটার দৌড়ে এই অষ্টাদশী ছিনিয়ে নেয় স্বর্ন পদক, ২০০৯ সালের দ্রততম নারী হিসেবে!!!
এই স্বর্ণপদক হতে পারতো বিদ্যুৎ এমনকি সুপেয় পানির সুবিধা বর্জিত আফ্রিকার প্রত্যন্ত অন্চলে বেড়ে উঠা একটি প্রাণের স্বপ্নীল এক অধ্যায়, ঝলমলে এক তারকার স্বর্গীয় একটি যাত্রার শুরু... পরিবর্তে এই গৌরবান্বিত বিজয়, এই পদক অষ্টাদশী ক্যাস্টার সেমিনিয়ার জন্য হয়ে দাঁড়ায় বিভীষিকাময় এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন!!!
উঠে সেমিনিয়ার জেন্ডার বা লিঙ্গ নিয়ে। ভারী কন্ঠ আর পুরুষালী গড়ন নিয়ে চিতার বেগে ছুটে চলা তরুনীর রক্তে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের মাত্রা নারীর স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে তিনগুন বেশি যা বিভিন্ন সময় কিছু ক্রীড়াবিদ বেআইনী ভাবে স্টেরয়েড সেবনের মাধ্যমে করে থাকে স্ট্যামিনা বৃদ্ধির জন্য!!! নগর জীবন শুরুর পর শারীরিক গড়ন ও ভারী কন্ঠের কারনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপমানের মধ্য দিয়ে পার হওয়া সেমিনিয়া ব্যথিত হলেও অবাক হননা এমন অভিযোগ শুনে। তাঁর অশিক্ষিত গ্রাম্য দাদী প্রতিবাদ করেন নাতনীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের, সেমিনিয়ার পিতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন; “দীর্ঘদিন পর আফ্রিকা গর্ব করার মতো একটি বিজয় পেয়েছে, তোমরা তা ছিনিয়ে নিতে চাইছো?”।
বিজয়ী হয়েও অপমান আর জেন্ডার টেস্টের মতো বিব্রতকর অভিজ্ঞতা শেষে দেশে পৌঁছলে সেমিনিয়া পান বীরোচিত সন্মান! দক্ষিন আফ্রকাবাসী যেনো তাঁর অপমানের জ্বালা ভুলিয়ে দিতেই সেমিনিয়ার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহুর্তে বিমানবন্দরটিকে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের জনারন্যে পরিনত করে, বুকে তুলে নেয় ক্যাস্টার সেমিনিয়া নামের বিজয়ীকে। হাসি ফুটে সেমিনিয়ার মুখে!
খুব ক্ষণস্থায়ী হয় এই আনন্দ.... জেন্ডার টেস্টের নামে যে বিভীষিকা পিছে ফেলে এসেছেন তা আবার তাড়া করে তাঁকে। অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানানো হয়, “ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অফ এ্যাথলেট ফেডারেশনে”র হাতে সেমিনিয়ার জেন্ডার টেস্ট রিপোর্ট এসে পৌঁছেছে, তাতে লেখা আছে সেমিনিয়ার শরীরে একজোড়া ওভারী বা ডিম্বাশয়ের পরিবর্তে দুটো টেস্টিস বা শুক্রাশয় আছে, সুতরাং বাহ্যিক ভাবে কিছুটা মেয়েদের মতো দেখতে হলেও সেমিনিয়া নারী নন!!!!!......... নাহ্!!! তিনি পুরুষও নন!!
“ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অফ এ্যাথলেট ফেডারেশনে”র পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাঁরা টেস্টের ফলাফল পেলেও খুলে দেখেননি, তাই ২-৩ সপ্তাহ আগে অফিশিয়ালি কিছু জানাতে পারবেননা!! গুজব সত্য হলেও সেমিনিয়া যেহেতু ড্রাগ সেবন বা কৃত্রীম ভাবে নিজের শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি করেননি তাই তাঁর স্বর্ণ পদকটি হয়তো ছিনিয়ে নেয়া হবে না এমন আভাস ফেডারেশনের পক্ষ থেকে দেয়া হয়।তবে তাঁরা জোড় দিয়ে জানান, টেস্টের রেজাল্ট নিয়ে সেমিনিয়ার সাথে গোপন বৈঠকের পরই তা প্রকাশ করা হবে, আগে নয়!!
ফেডারেশনের পক্ষ থেকে অফিশিয়াল ঘোষনার পূর্বেই শংকিত, অপমানিত সেমিনিয়া সরে দাঁড়ান আসন্ন প্রতিযোগিতা থেকে।
তাই তো... কোন গ্রুপে প্রতিযোগী হবেন তিনি? নারী না পুরুষ?
অথচ.. বিকৃতির চর্চায় মেতে আছে সারা বিশ্ব। সেই বিকৃতিকে রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি দিতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে প্রতিদিন!!! পরিপূর্ণ নারী বা পুরুষ হিসেবে জন্ম নিয়েও বিকৃত এক ভাবনায় হরমোন ইনজেকশন আর সার্জারী করে কৃত্রীম ভাবে লিঙ্গান্তরিত হবার প্রয়াসে অসম্পূর্ণ নারী বা পুরুষ হয়েও সমাজে স্বীকৃতি লাভ করছে তারা।
কয়েক মাস পূর্বে বিশ্বে সাড়া জাগায় একটি সংবাদ, “বিশ্বের একজন পিতার প্রথম গর্ভধারন ও সন্তানের জন্মদান!!!!!!” ভীষণ রকম চমকে যাই সংবাদটি জেনে.. হাজারো চিন্তা খেলা করে মাথায়... কোথায় ধারন করেছে সন্তান.. পুরুষের শরীরের ভিতরের প্রতিটি অর্গ্যানের স্ট্রাকচার আর কম্পোজিশন মনে করিয়ে দেয়; “এ কোন ভাবে সম্ভব নয়! যদি না আর্টিফিশিয়াল গর্ভাশয় বা ইউটেরাস ইম্প্ল্যান্ট করা হয়!!! তা করা হলেও, পুরুষের শরীরে সেই ইউটেরাসটি কে সার্ভাইভ করানো, স্বাভাবিক কাজ করানো প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার হবে!! সেখানে গর্ভধারন!!!”
.....................চটকদার সংবাদটির সত্যতা জেনে তিতকুটে হয়ে উঠে মন!!! পিতার গর্ভধারন মানেই যে কারো কারো কাছে পুরুষের গর্ভধারন নয় তা ভুলে গিয়েছিলাম!! সমকামী নারী, পুরুষ হরমোন গ্রহনের মাধ্যমে বাহ্যিক ভাবে নারী পুরুষের মাঝামাঝি একটি চেহারা পেলেও শরীরের ভিতরে ধারন করে আছে করুণাময় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত গর্ভাশয়, তাতে এক পুরুষের শুক্রাণু আর তার পার্টনারের ডিম্বানু'র মিলণ ঘটিয়ে সৃষ্ট ভ্রূনটি ধারন করে!!! তাতেই মেতে উঠে বিশ্ব!!!!
একজন অসম্পূর্ণ নারী অথবা পুরুষকে প্রথম প্রেগন্যান্ট ফাদার হিসেবে স্বীকৃতি জানাতে দেরী করেনা বিশ্ব অথচ একজন সেমিনিয়া, যাঁর এই অসম্পূর্ণতায় নিজের কোন হাত নেই তাঁকে যেতে হয় অপরিসীম অপমানের মধ্য দিয়ে!!! তাঁকে প্রাপ্য পদকটি দিতেই যতো দ্বিধা!!!
-একজন ক্রীড়াবিদের শারীরিক অবস্থা ও সুস্থততার গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থ ও তাঁকে অপমানতি করার অভিযোগ এনে দক্ষিন আফ্রিকার নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী জাতি সংঘে মামলা করেছেন ফেডারেশনের বিরুদ্ধে! একজন ক্যাস্টার সেমিনিয়ার অধিকারের লড়াইয়ে নেমেছে পুরো একটি দেশ।।
তবে সেমিনিয়ার মতো অগুনিত মানুষের অধিকার আদায়ে তেমন সোচ্চার কেউ নেই!!
শিখন্ডিরা আজও সোশ্যাল ট্যাবু। আমাদের দেশে তাঁদের সভ্য সমাজ থেকে ছুড়ে ফেলা হয়। হাস্যরস, অবজ্ঞা আর অবহেলার জীবে পরিনত হন তাঁরা! ছোটবেলায় প্রথম যখন তাঁদের অস্তিত্বের কথা জানি, ভীষণ মন খারাপ করেছিলাম তাঁদের অবধারিত পরিনতির কথা শুনে। আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বলা হয়েছিলো.. সলভেন্ট বা সমর্থ ঘরের সন্তানদের নারী অথবা পুরুষ একটি পরিচয়ে লালন করেন তাঁদের পিতা মাতারা। পরবর্তীতে শুনেছিলাম, শিখন্ডি সমাজ যদি কোন পরিবারে স্বগোত্রীয় কারো আবির্ভাবের সংবাদ জানে, তারা ছিনিয়ে আনে সেই শিশুকে....!!!
কেনো????
একজন শিশুর কি অধিকার নেই বাবা মা'র স্নেহ ভালোবাসায় বেড়ে উঠার? একজন মানুষের কি অধিকার নেই লেখাপড়া করে নিজেকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার? জন্মগত শারীরিক ত্রুটির কারনে তাঁকে কেনো ছুঁড়ে ফেলা হয় এক অন্ধকার কূপে? কেনো তাঁকে বার বার চোখে আঙ্গুল দিয়ে স্মরন করিয়ে দেয়া হয় “তুমি একজন অসম্পূর্ণ মানুষ”!!!
শিখন্ডিদের প্রতিভা থাকতে নেই! প্রতিভার অধিকারী হলেও তা বিকশিত করার অধিকারী নন। বিশেষ করে নারী পুরুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে যেসব প্রতিযোগিতা, তাতে অংশগ্রহনের কোন সুযোগ নেই। এমনকি প্রতিবন্ধীদের জন্য আছে বিশেষ অলিম্পিকের আয়োজন! প্রতিবন্ধী না হয়ে সম্পূর্ণ সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও শিখন্ডিদের প্রতিভা বিকাশের কোন সুযোগ নেই। শুধুমাত্র লেখালেখি বা ছবি আঁকার মতো কিছু মাধ্যমে হয়তো তাঁরা সার্ভাইভ করতে পারেন তবে স্বপরিচয়ে নাম করার অধিকার রাখেন কিনা জানা নেই।
প্রজনন ক্ষমতা একজন মানুষের জীবনের সব কিছু হতে পারেনা। সারা বিশ্বে অগুনিত নারী পুরুষ আছেন যাঁরা সন্তান জন্মদানে অক্ষম। তাঁরা সু্স্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। বিকৃত চিন্তার ফলে নিজের জন্মগত লিঙ্গটিকে অস্বীকার করে অসম্পূর্ণ নারী পুরুষ হয়ে সমাজে দাপটের সাথে বেঁচে আছে মিলিয় মিলিয়ন সমকামী আর ট্রান্সসেক্চুয়্যালরা!!
-অথচ, ঈশ্বর যাঁদের অসম্পূর্ণ নারী অথবা অসম্পূর্ণ পুরুষ করে পাঠালেন আমরা তাঁদের আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলার ধৃষ্টতা দেখাই।
পোস্টের শিরোনামে বড় ভুল হয়েছে... সেমিনিয়ারা নারী অথবা পুরুষ নয়, মানবী অথবা মানব নন... তাঁরা শুধুই মানুষ।
-আর তাই হয়তো আমাদের (?)সভ্য সমাজে তাঁদের কোন স্থান নেই!!!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১১:৪৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



