somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শহরে যেভাবে নতুন শান্তিরা ধেয়ে আসছে

২৭ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(শখের বশেই চাইলাম এখানেও দুচার জন গল্পটি পড়ুন। আমি এত কম লিখি, লিখতে পারি যে নিত্যনতুন বস্তু হাজির করা কঠিন। বছরে দেড় বা দুইটা গল্প লেখা লোক কীভাবেই বা পাঠকতে তুষ্ট করবেন বলুন! তো এটা প্রকাশ পেয়েছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সমকাল সাহিত্যপাতা 'কালের খেয়া'তে। পরে এ বছরে আমার পুস্তকাকারে যে গল্পের বইখানি বেরোয় সেখানেও পাতা বাড়াতে গল্পটা দিয়ে দিয়েছি।)


গফুর সাহেব উত্তেজিতভাবে বের হলেন। তিনি উত্তেজিত হলেও দরজা সজোরে বন্ধ করতে পারলেন না। হয়তো চেয়েছিলেন। কিংবা চেয়েছিলেন কি-না জানা যায় না। কারণ দরজাটা নিজের অনিচ্ছুক গতিতেই প্রায় বন্ধ হতে না চেয়ে বন্ধ হলো।

ইদানীং এসি-করা রুমের কারণে দরজা দিয়ে রাগ প্রকাশের রাস্তাটা বন্ধই বলতে হবে। অফিসের কক্ষে শীতাতপ লাগানোর সঙ্গেই সঙ্গেই ঠিকাদাররা দরজা বন্ধ করার একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বসিয়ে দেয়। কারও সাধ্য নেই দরজার গতি আর নিয়ন্ত্রণ করে, সেই যন্ত্রটা ছাড়া। তামাম অফিস-আদালতে এই সংকট বা সম্ভাবনা এখন অতি পরিচিত ঘটনা। দরজার এই আচরণটা সংকট, নাকি সম্ভাবনা; তা নির্ভর করে ওই বিশেষ মুহূর্তে দরজা ব্যবহারকারীর মোটিভ বা পদবিন্যাসের ওপর। একবার শোনা গিয়েছিল একটা সেমিনারও হওয়ার কথা। 'কর্মক্ষেত্রে শান্তি আনয়নে দরজা বন্ধকারী মেশিনের নয়াদিগন্ত ভূমিকা'। সেমিনারটা পরে আর বাজেট অনুমোদনের অভাবে হয়নি। একটা গোলটেবিল মিনি বৈঠক দিয়েই সারতে হয়েছিল। একেই সেমিনারটা হলো না, তাই গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য কেউ কেউ গোলটেবিলের শিরোনামকে ইংরেজি করতে বসলেন। তাতেও ঝামেলা দেখা দিল। কয়েকটা টেবিলে কাটাছেঁড়া চলার পর অনুবাদ দাঁড়াল 'নিউ হরাইজন অন দ্য অফিস পিস ব্রিঙিইঙ ভায়া ডোর শাটিং মেশিন'। মন্ত্রীর রুম পর্যন্ত যখন সেই বহু সম্পাদিত টাইটেলখানা গেছে, মন্ত্রী গম্ভীর মুখে পড়লেন। তারপর নির্লিপ্ত মুখে জানালেন, একটু লম্বা হলেও বেশ নতুন আর স্ট্রাইকিং লাগছে শুনতে। সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন গফুর সাহেবের ডেপুটি রায়হান সাহেব। তিনিই শেষ ডেস্ক থেকে অনুবাদের শেষ ভার্সনটি বয়ে এনেছেন। এনে দাঁড়িয়ে আছেন মন্ত্রীর হাসিমুখ দেখবেন বলে। মন্ত্রী খুব হাসিমুখ দেন না। কিন্তু নির্লিপ্ত মুখকেই হাসিমুখ ধরে নিয়ে সবার কাজ চলে। রায়হান সাহেব মন্ত্রীর অনুমোদন নিয়েই ছুটবেন গফুর সাহেবের ঘরে।

কিন্তু মন্ত্রীর কথা শেষ হতে না হতেই সামনে বসে থাকা সিইও হাউমাউ করে পড়লেন। 'স্যার, টাইটেলে আমার কোম্পানির নামটা দিয়ে দেন।' মন্ত্রী দিতে সম্মত, নাকি অসম্মত তা বোঝা গেল না। কিন্তু তিনি বেশ সময় নিয়ে বললেন :

'তাহলে কী দাঁড়ায়?'

'কী দাঁড়াবে স্যার?' রায়হান সাহেব আচমকা চিন্তিতভাবে বলে ফেললেন, দাঁড়িয়েই।

'দাঁড়াবে স্যার, দাঁড়িয়ে যাবে।' আশ্বস্ত করলেন সিইও, রায়হান সাহেবের দিকে একবারও না তাকিয়ে।

'হুমমম!! নিউ হরাইজন অন দ্য অফিস পিস ব্রিঙিইঙ ভায়া শাট-অফ ডোর শাটিং মেশিন।'

গম্ভীরভাবে ধীরে ধীরে সেই আবৃত্তি করলেন যখন মন্ত্রী, পরম আগ্রহে সেদিকে শাট-অফ দরজা মেশিন সরবরাহকারী কোম্পানির সিইও সাহেব চেয়ে রইলেন। তিনি যখন প্রায় সম্মতি ভাবতে বসছেন তখন মন্ত্রী সামনের স্মার্টফোনটা এগিয়ে দিলেন রায়হান সাহেবের দিকে। সিইওকে একটু হকচকানো মনে হলো। এবং এই প্রথম তিনি ভালোমতো মনোযোগ দিলেন রায়হান সাহেবের দিকে। আর তেমন কোনো উপায়ও নেই। রায়হান সাহেব ফোনের পর্দা আলোকিত করে গোটা চারেক ছোঁয়াছুঁয়ি করে মন্ত্রীকে আবার ফোনটা ফেরত দিলেন। এতক্ষণে শাট-অফ সিইও বুঝেছেন, এই দাঁড়িয়ে থাকা লোকের দিকে তার না তাকালেও চলত।

মন্ত্রী ধীর লয়ে কোনো রকম উত্তেজনা ছাড়াই ওদিকে ফোন ধরার অপেক্ষা করতে থাকলেন। তার পর কোনো ভূমিকা, কুশলাদি ছাড়াই নতুন এই শিরোনামটি ফোনে পড়ে শোনালেন। শেষে শুধু বললেন, 'কেমন হবে?' এর পর তিনি প্রায় পৌনে দু'মিনিট একটা কথাও বললেন না। ফোনের ওদিকের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকলেন। তার মুখে খুশির মুহুর্মুহু প্রসন্নতা দেখা দিচ্ছিল। আর সিইও সেদিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কেবল দাঁড়িয়ে থাকা রায়হান সাহেব জানেন, এটা মন্ত্রী মহোদয়ের পুত্রবধূকে নিয়ে গৌরবের আনন্দ মাত্র; অনুমোদনের বিষয় নয়। মন্ত্রী যে কোনো সিদ্ধান্তই পুত্রবধূর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে নেন। বা বলা চলে সেল-পরামর্শ করে নেন। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সবারই সেটা জানা। এবং এই পরামর্শ গ্রহণে মন্ত্রীকে কখনও বিচলিত বা কুণ্ঠিত দেখা যায় না। বরং তিনি অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে এ কাজটা করে থাকেন। প্রকাশ্যে ও চিত্তপ্রসন্নভাবে। সেটা হওয়ারও কথা। মন্ত্রী মহোদয়ের পুত্রবধূ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা এবং জ্ঞানী হওয়া যে তার ন্যায্য অধিকারের মধ্যেই পড়ে, সেটা মন্ত্রণালয়ের প্রায় সব কর্মচারীই মানেন। এমনকি আরদালিও। সবাই এ বিষয়েও একমত যে, এই মন্ত্রীর এই আচরণকে জ্ঞানতৃষ্ণা হিসেবেও দেখা কর্তব্য। নিছক পুত্রবধূ-স্নেহ হিসেবে দেখলে মন্ত্রীর জ্ঞানতৃষ্ণাকে খাটো করে দেখা হয়। কেবল মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা মাঝেমধ্যে সংশয়ে পড়ে যান যে, এত ঘণ্টা টেলিভিশনে বসে থাকলে পুত্রবধূ ক্লাসে বা অন্যান্য কাজে কখন যান! টেলিভিশনে যে পুত্রবধূ যান, সেটা তো তারা বাসায় গিয়ে টেলিভিশন টেপাটেপিতেই জেনে যান। কেবল সেটাই নয়। দিবাভাগে যদি পুত্রবধূ টেলিভিশনে জ্ঞান বিতরণে যান, তাহলে মন্ত্রী নিশ্চিত করেন যেন মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা তা থেকে বঞ্চিত না হন। মন্ত্রীর নিজের ঘরের টেলিভিশনে তো বটেই, আর যে তিনটা টেলিভিশন এই মন্ত্রণালয়ে আছে বিভিন্ন মাপের, সেগুলোতেও তখন ওই চ্যানেলই চলার ব্যবস্থা করেছেন মন্ত্রী। ফলে সবাই ক্রমাগত নিশ্চিত হতে থাকেন তিনটি বিষয়ে :মন্ত্রীর জ্ঞানতৃষ্ণা, মন্ত্রীর পুত্রবধূ-স্নেহ এবং মন্ত্রীর অধস্তন কর্মীদের জ্ঞানী বানানোর দায়িত্ববোধ।

সমস্যা হলো, ওই সংশয় যে ভদ্রমহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখন যান। সেসব সংশয় তারা যথাসম্ভব পেটের মধ্যে রাখলেও একদিন কীভাবে যেন লিক করে; মন্ত্রীর কানে চলে যায়। এই দিনে তার রুদ্রমূর্তি সবার জন্য একাধারে বিস্ময় ও আনন্দের ছিল। মন্ত্রীর এই জলদগম্ভীর ধীর লয়ের ব্যক্তিত্ব তাকে অনায়াসে আর পাঁচজন থেকে স্বতন্ত্র করে। তিনি চেঁচামেচি, হুমহাম, দুড়দাড়, ধড়পাকড় পদ্ধতির চেয়ে গুরুগম্ভীর, চাম-চিকন, গজগমন ও মাইনকাচিপা পদ্ধতির অনুগ্রাহী। সেটা তিনি প্রকাশ্যে বলেনও বটে। এবং এই রাস্তাতেই অধিক সাফল্যমণ্ডিত টিকসই মন্ত্রিত্ব করা যায় বলেও তিনি দাবি করেছেন। লোকে বলে। এমনকি তথ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তার কলিগরা টিপ্পনী কেটে পূর্ত মন্ত্রণালয়কে যে 'পুরতি মন্ত্রণালয়' বলেন, তাতেও মন্ত্রী মহোদয়কে কখনও উত্তেজিত দেখা যায়নি। বরং তিনি গফুর সাহেবকেও একদিন সান্ত্বনা দিয়েছেন :

'গফুর সাহেব, ফুর্তি মন্ত্রণালয়ের থেকে পুরতি নাম হিসেবে কিন্তু ভালো। একটা পারপাসফুল নাম।'

গফুর সাহেব সেদিন রাগে বলে বসেছিলেন :

'স্যার, আমরাও ফাতরা মন্ত্রণালয় ডাকতে পারি।'

'আহা! তথ্যের সঙ্গে ফাতরা ভালো মেলে না। তা ছাড়া ওসব করে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি।'

মন্ত্রণালয়ের সবাই মন্ত্রীর ধৈর্যের প্রশংসা করেন। আর তো তার জ্ঞানতৃষ্ণা আছেই। সেই মন্ত্রীও লিক করা ওই খবরে বেজায় চটলেন। চেঁচামেচি করলেন। সবাই চমকে গেল। আশু শাস্তির ভয়ও তাদের চিত্তে দেখা দিল। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় প্রকৃতই ধড়পাকড় পদ্ধতির নন। তিনি অনাগত কোনো মাইনকাচিপার অভিলাষে থাকতে পারেন, কিন্তু আশু কোনো শাস্তির রাস্তা নিলেন না। বেশ দ্রুত শান্ত হলেন এবং যেন কিছু ঘটেনি মুডে স্থানান্তরিত হলেন। ক'দিন পরে অবশ্য জলদগম্ভীর গলায়, মানে স্বভাবসিদ্ধ উপায়ে সবাইকে ডেকে ডেকে বুঝিয়েছেন যে, নতুন দিনের নতুন ভাবনার বিশ্ববিদ্যালয় আর কেবল একটা ইটকাঠের ভবন নয়। বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত একটা প্রতিষ্ঠান। যেখানে শিক্ষক যাবেন, সেটাই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহ তৈরি করবে। তিনি অধুনা নতুন নতুন প্রযুক্তির সর্বাত্মক ব্যবহার কতটা জরুরি, সে বিষয়েও অধস্তন সহকর্মীদের জ্ঞাত করেন। আর এ ক্ষেত্রে টেলিভিশন যে জ্ঞানচর্চার একটি দুর্নিবার মাধ্যম, তা বলতেও ছাড়েননি। ঠিক ওই সময়ে গফুর সাহেবের সঙ্গে তার চোখাচোখি হওয়াতে তিনি বুঝতে পারেন, তার সর্বশেষ বাণী তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি অনুরাগময় শোনাচ্ছে। কিন্তু সেটাকে তিনি প্রথমে মহত্ত্বধর্মী হিসেবে পোজ করলেন; পরে পুনর্বিন্যাস ঘটালেন এইভাবে যে, আরও আরও জ্ঞানচর্চাময় টেলিভিশন এখনো যে দেশে খোলা হয়নি, সেটা তথ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখা দরকার। সেদিনের সেমিফর্মাল ব্রিফিং তিনি শেষ করেছিলেন এই ঘোষণা দিয়ে- যেসব শিক্ষক এখনো জ্ঞানের বিস্তার ঘটাতে ভবন থেকে বের হয়ে পর্যাপ্ত টেলিভিশন অনুষ্ঠান করছেন না; তাদেরকে শিক্ষার কলঙ্ক হিসেবেই দেখা উত্তম। সবাই মন্ত্রীর জ্ঞানতৃষ্ণার আরেকটি উচ্চতার ধারণা পেয়ে প্রশমিত হয়েছিলেন। পুত্রবধূকে নিয়ে আর কোনো টিকা-টিপ্পনী, যদি আগে হয়েও থাকে, কোনোদিন আর শোনা যায়নি।

যাহোক, ফোনটি রাখতে রাখতেই মন্ত্রী ওই দুই মিনিটের মুখলাবণ্য ও উদ্ভাস মুছে ফেললেন। ঘোষণা দিলেন :

'হবে না। দাঁড়াচ্ছে না।'

'স্যার, বলেন কী? ভালো শোনাচ্ছিল তো।' সিইও আর্তনাদ করে উঠলেন।

'না, ফারজানা বলেছে, যদি আপনার কোম্পানির নাম রুদ্ধদ্বার হতো তাহলেও চলত। শাট-অফ বাজে নাম।'

'স্যার, নাম তো আমি দিই নাই।'

'দেখুন, সিইও সাহেব। আপনার উপকার করতে আমার আগ্রহ। কিন্তু এই নাম টাইটেলে চলবে না। নাম আপনি দেননি তো ঠিকই। কিন্তু এখন তো আমার মন্ত্রণালয়ের গোলটেবিলের ব্যানারে দিতে হবে।স্পন্সর আছেন, খুব খুশির খবর। কিন্তু টাইটেলে এ রকম একটা নাম দিয়ে আমি বদনাম আনতে পারি না। আমার একটা ইমেজ আছে। এফিডেভিট করে কোম্পানির নাম বদলাতে পারেন কি-না এমডিকে বলে দেখেন।'

সিইওকে আতঙ্কিত দেখাল, পরে বেদনার্ত। তিনি অস্ম্ফুটে বললেন :

'না স্যার, আপনি যা বলেন।'

'তা ছাড়া গোলটেবিলে ইংরেজি টাইটেলও দেওয়া যাবে না। এটা দিলেও বদনাম হতে পারে।'

এ দফা রায়হান সাহেবকে বিচলিত দেখাল, কিন্তু মন্ত্রী সেদিকে নজর না দিয়ে বলে চললেন-

'একটা ইংরেজি টাইটেলের গোলটেবিলে মন্ত্রীরও ইংরেজি বলার একটা ইয়ে থাকে। সেটা খুবই ইয়ে হয়ে যাবে। এবং দেশাত্মবোধক চেতনারও লঙ্ঘন হবে।'

ইয়ে পর্যন্ত বললেই চলত। রায়হান সাহেবের চেহারায় সঞ্জীবনী উদ্যম ফিরে আসছিল ইতিমধ্যে। শেষ পর্যন্ত বলে মন্ত্রী সেটাকে চিরস্থায়ী করে দিলেন। গোলটেবিল বাংলাতে হলো। টাইটেল ব্যানারও সে দফা বাংলাতেই হলো। কেবল একটা দু'দিনব্যাপী মহা সেমিনার করা গেল না বলে সবাই খানিক মনোকষ্টে ছিলেন। শাট-অফ কোম্পানিও পরে আফসোস করেছে। আরও একটু চেষ্টা করলে তারাও স্পন্সরশিপ হয়তো বাড়াতে পারত। এ রকম জাগতিক দুঃখ আর কি!

তো সেই গোলটেবিলে তারপরও গুরুত্বপূর্ণ লোকজন এসেছিলেন। 'কর্মক্ষেত্রে শান্তি আনয়নে দরজা বন্ধকারী মেশিনের নয়াদিগন্ত ভূমিকা'। মন্ত্রীর অফিসের সবাই তো বটেই; শাট-অফ কোম্পানির এমডি, পিআর হেড, সেল্‌স চিফ, সিআরও। শাট-অফ কোম্পানির মূল যারা উৎপাদক সেই চীনা কোম্পানির তিনজন বড় কর্তা, সেসব আসে যে ড্যানিশ জাহাজে সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন, দেশে নিযুক্ত চীন ও ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ও কর্মকর্তাবৃন্দ। এখানেই অভ্যাগত তালিকা শেষ নয়। যেহেতু শান্তি কনসেপ্টটি মুখ্য, তাই জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যেসব সেনা অফিসার গিয়েছিলেন তাদেরও কাউকে কাউকে ডাকা হয়েছিল, এসেছিলেন কেউ কেউ। রেড ক্রসের স্থানীয় বড়কর্তা এসেছিলেন। মাদার তেরেসা ফাউন্ডেশনের কোলকাতীয় প্রধানকে আসতে বলা হয়েছিল। একদিনের জন্য তিনি ফসকে গেছেন, তিনি তখন জেনেভা। কিন্তু এই গুরুতর গোলটেবিলে আরও ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ গুরুভার কর্মকর্তারাও।

এই শেষোক্তরা একটা বিশাল ট্রিক। অনুষ্ঠানের আয়োজনের একদম প্রাক্কালে মন্ত্রী মহোদয়ের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে এবং তিনি গোলটেবিলের শিরোনামটি বদলে দেন এভাবে :'পরিবারে ও কর্মক্ষেত্রে শান্তি আনয়নে দরজা বন্ধকারী মেশিনের নয়াদিগন্ত ভূমিকা'। কি-নোট না পড়লেও মন্ত্রী নিজেই অনুষ্ঠানের স্বাগত ভাষণে বিরল হাসিমুখে বলছিলেন, 'আপনারা ভাবছেন, পূর্ত কেন পরিবার নিয়ে বলে? কেনই বা আপনাদের ডাকে? ভাবুন, দরজা যদি জোরে বন্ধ করার সুযোগ না থাকে কত পরিবার কত হাজার ক্রোধের অনুশীলন থেকে দূরে সরবে! ভেবেছেন একবার, পরিবারের শান্তির একটা মুখ্য স্তম্ভ কেবল সন্তান নিয়ন্ত্রণ নয়; দরজা নিয়ন্ত্রণ, অর্থাৎ সশব্দে দরজা বন্ধ করার অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ?!...' বিদেশি মেহমানদের কানে কানে অনুবাদ করে দেওয়ার জন্য ইন্টার্নদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সবাই মন্ত্রীর প্রতিভায় বিস্মিত হয়ে যান। আবারও। সবাই আবারও চামে-চিকনে পদ্ধতির গুরুত্ব অনুধাবন করেন। মন্ত্রীর শেষ ট্রিকের কারণেই বরং গোলটেবিল শেষ হয় পরে এ বিষয়ে একটি প্রকৃত তিন দিনব্যাপী সেমিনার ঘোষণার মধ্য দিয়ে। যেটা আগামী বছর হওয়ার কথা।

কথা হচ্ছিল আজ সকালে গফুর সাহেবের উত্তেজনা নিয়ে। এত বিশদ খুঁটিনাটি বিষয়ে জানানো লাগল কারণ, সেদিনের সেই গোলটেবিলেও গফুর সাহেব, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বয়ংক্রিয় দরজার পÿে বিরাট মতামত রেখেছিলেন। আজ যখন তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের ঘর থেকে তিনি বের হন তখন তিনি উত্তেজিত। আসলে ভয়ানক উত্তেজিত। উত্তেজিত হলেও তিনি দরজা সজোরে বন্ধ করতে পারলেন না। হয়তো সজোরে ও সশব্দে তিনি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন যাতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের আশফাক সাহেব তার ক্রোধ আর হতাশা ঠিকঠাক বোঝেন। হয়তো। কিন্তু তিনি চান বা না চান, দরজা সজোরে বন্ধ হয়নি।

এটি একটি নতুন ক্যাম্পেইন। প্রকৌশল বিষয়ক ক্যাম্পেইন। আইডিয়াকে যুগান্তকারী বলা হচ্ছে। গফুর সাহেবের কানে এনেছেন মন্ত্রী। জানা যায় তার কানে এনেছেন অন্য কোনো এজেন্সির লোকজন। সেই এজেন্সি ইদানীং পুরকৌশলের যাবতীয় কাজে মন দিয়েছে। গঠন মানেই সংগঠন! যা কিছু কনস্ট্রাকশন তা কিছু এখন এজেন্সির আগ্রহ। এমনকি যেখানে কনস্ট্রাকশনের কোনো সম্ভাবনা দেখা দেয়নি সেখানেও খতিয়ে দেখে দেখে নয়া নয়া কনস্ট্রাকশনের বুদ্ধি-পরিকল্পনা চলছে শহরে। তামাম দেশে। কনস্ট্রাকশনকে দেখা হচ্ছে উন্নতির উপায় হিসেবে। আর উন্নতি মানেই শান্তি। তা ছাড়া উন্নতি কথাটাও অতিব্যবহারে মলিন হওয়ার জোগাড়। পক্ষান্তরে শান্তি চিরনতুন একটি কনসেপ্ট। ঈশ্বরের রাজ্য থেকে শুরু হয়েছিল। আবার পারলৌকিক কাল পর্যন্ত তা বিস্তৃত হয়ে আছে। শান্তি শান্তি শান্তি! ইহকাল, পরকাল, মহাকালব্যাপী এক কনসেপ্ট। সে জন্য এজেন্সির লোকজন একটা ক্যাম্পেইন আইডিয়া বের করেছেন। তা ছাড়া শান্তিরক্ষী হিসেবে নানাবিধ মিশনে কাজ করার কারণে কনসেপ্ট হিসেবেও এর প্রতি মায়া পড়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে তাদের। আর তারা এ কাজে সঙ্গী হওয়ার বিরল সুযোগ দিয়েছেন পূর্ত মন্ত্রণালয়কে। মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে এ প্রস্তাব আসার পর মন্ত্রী একে এজেন্সির মহানুভবতা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেননি। তিনি কৃতজ্ঞ হলেন। তার মুখ দেখেই বোঝা গেল, দাঁড়িয়ে গেছে। আইডিয়াটি। সারা দেশব্যাপী পূর্ত মন্ত্রণালয় এখন নামবে 'শান্তি প্রকৌশল' ক্যাম্পেইনে। 'পিস ইঞ্জিনিয়ারিং'। গফুর সাহেবের এখন অতিশয় ব্যস্ততার কাল।

কিন্তু ক্যাম্পেইন মানেই হলো আন্তঃমন্ত্রণালয় কাজ হতে হবে। তথ্য মন্ত্রণালয় যতই 'পুরতি' নাম দিক, এখন গফুর সাহেবের তাদের সঙ্গে যুগপৎ কাজ করতেই হবে। গফুর সাহেব একবার নিজ মন্ত্রণালয়ে দৌড়ে বেড়ান, একবার তথ্য মন্ত্রণালয়ে দৌড়ে বেড়ান। আশফাক সাহেবের অফিসে তো তাকে দেখা যায়ই, তাদের দুঃজনকে একত্রে গাড়িতে চড়তে দেখা যায়। কারও কারও মতে, ইদানীং কখনও কখনও একত্রে তারা পানাহারেও বসেছেন। এই ক্যাম্পেইনের একটা বড়সড় পার্টনার হলো টেলিভিশন। মন্ত্রী মহোদয় একদা দাবি করেছিলেন, জ্ঞানবিস্তারে আরও আরও টেলিভিশন চ্যানেল খুলতে পারা তথ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে এজেন্সির সঙ্গে পার্টনারশিপে 'শান্তি প্রকৌশল' ক্যাম্পেইনে নেমে ডজনতিনেক চ্যানেলের কনটেন্ট জোগান দিতেই গফুর সাহেবের হিমশিম খাওয়ার জোগাড়।

আশফাক সাহেবের মতের দামও দেওয়া হয়েছিল। তিনিই চূড়ান্ত রায় দিয়েছিলেন যে 'পিস ইঞ্জিনিয়ারিং' নয়, চ্যানেলে যাবে 'শান্তি প্রকৌশল' প্রমো। তথ্য মন্ত্রণালয় ভিডিও বানাচ্ছে যথাক্রমে ১ মিনিট, দেড় মিনিট, ৩ মিনিট, সাড়ে ৭ মিনিট ও ৩৩ মিনিটের। বিভিন্ন চ্যানেলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রার ভিডিও দেখানো হবে। উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট। যাতে জনগণ কনস্ট্রাকশন কার্যাদির গুরুত্ব বুঝতে পারে, যাতে এসবের চূড়ান্ত লক্ষ্য যে শান্তি আনয়ন, সেটাও তাদের কাছে ডাল-ভাতের মতো পরিস্কার হয়। পরিশেষে যাতে তারা আগামীতে 'জল দাও, জল দাও'-এর মতো করে 'কনস্ট্রাকশন দাও, নয়া কনস্ট্রাকশন দাও, কনস্ট্রাক্ট করো মোরে'- এ রকম জিকির তুলতে পারে। ডিমান্ড ফ্রম বটম! পিস ফ্রম বটম! বটম পিস!! সাফ কথা। সাফ মোটো। প্রমো সেই লক্ষ্যে বানানো হচ্ছে।

সবকিছু বিপুল বেগে চলছিল। ঠিকঠাক চলছিল। সকালে অফিসে এসেই গফুর সাহেব আশফাক সাহেবের অফিসে গেলেন। গতকাল মধ্যরাত থেকে বিভিন্ন চ্যানেলে বিভিন্নন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রার ভিডিও সম্প্রচারিত হচ্ছে। ক্লান্ত গফুর সাহেব তখন ঘুমাচ্ছিলেন। কাজের চাপে ইদানীং তার পোশাকের কম্বিনেশন পর্যন্ত ভুলভাল হয়ে যাচ্ছে। তিনি আজ সকালে অবশ্য কোনো ভুল ছাড়াই ঠিক পোশাক পরেছেন। কৌতূহল থাকলেও টিভি খোলার সময় হয়নি।

আশফাক সাহেবের ঘরেই তিনি আবিস্কার করলেন, টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে উদ্ভট এক পাঞ্চ লাইন। 'শান্তি প্রকৌশল' নয়; 'সান্ত্রী প্রকৌশল'। তিনি টেবিল টেনিসের বলের মতো চোখ করে আশফাক সাহেবের দিকে তাকালেন একবার। আশফাক সাহেব কেমন জানি চোখে তার দিকে তাকালেন। তারপর গফুর সাহেব আর এক সেকেন্ডও সেখানে থাকলেন না। হ্যাঁচকা টানে চেয়ার সরিয়ে দরজা টেনে বাইরে আসলেন। আর দরজাটা সজোরে বন্ধ করতে পারলেন না।

হনহন করে হেঁটে নিজের ঘরে ঢুকতে গেলেন গফুর সাহেব। সেখানেও স্বয়ংক্রিয় শাট-অফ কোম্পানির দরজা বন্ধের মেশিন লাগানো। শক্তি বাড়তি খরচ করে দরজা খুলতে খুলতে গফুর সাহেব মনে করতে পারলেন আশফাক সাহেবের মুখ। তার দিব্যি মনে হলো, ওটা ভয়ার্ত ফ্যাকাসে মুখ।

এই এতক্ষণে গফুর সাহেব নিশ্চিত হলেন, তার নিজেরও একটা ভয়ার্ত মুখ থাকা আবশ্যক। প্রকৃতার্থে তার মুখ হয়তো ভয়ার্তই হয়ে আছে। দরজাটা জোরে বন্ধ করতেই তিনি চেয়েছিলেন কি-না, এ বিষয়ে তার আর কোনো বিভ্রান্তি রইল না। তিনি দিবা-খোয়াব দেখতে শুরু করলেন তার দরজায় এমন এক যন্ত্র লাগানো হচ্ছে, যাতে কোনোদিন খুলে তাকে ঘর থেকে বের করা যাবে না। এই খোয়াব দেখতে দেখতে তিনি কোমরের বেল্টের বাকল্‌সে হাত দিলেন, তারপর বাথরুমের দিকে দৌড় লাগালেন। ধেয়ে গেলেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×