somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘আবুল’ ও ‘মফিজ’

২৯ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঢাকা শহরে, তথা ঢাকাবাসীদের ভাষামালায়, তথা ঢাকাই বাংলা-জানা তরুণ, মুখ্যত পুরষ মধ্যবিত্তদের চিন্তারাজিতে ‘আবুল’ ও ‘মফিজ’ দুই-ই খুব জাগরুক বর্গ। তবে সাধারণ বিবেচনায় দুই বর্গের সীমানা এমন কিছু গুরুতর মেলামেশা নয় যে একত্রে আলাপ পাড়তে হবে। কিন্তু আবার চূড়ান্ত বিচারে, এদুয়ের প্রয়োগে এমন কিছু অবিমিশ্রতা রয়েছে যে সেটার বিষয়ে আলোকপাত করবার জন্য একত্রে দুই বর্গকে হাজির করা আমার জরুরি মনে হয়েছে। ফলে আমার তরফে এই দুই বর্গকে আলোচ্য বানানো যেমন অত্যন্ত ইচ্ছাকৃত বিষয়, তেমনি তাদের একত্র রাখাও বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। ‘আবুল’ ও ‘মফিজ’ বর্গকে যাতে আকছার গুলিয়ে ফেলা না হয় সেটাও এই রচনার অন্যতম উদ্দেশ্য।

আরও একটা ডিসক্লেইমার ধরনের ঘোষণা এখানে দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। শুরুতেই তরুণ মধ্যবিত্ত পুরুষদের ভাষা ও চিন্তামালার বিষয়ে বলেছি বলে এটা আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। তাঁরা প্রায়শই এই পদবাচ্যযুগল প্রয়োগ করে থাকেন ‘নিজ’ বর্গের লোকজনের উদ্দেশ্যে, বা কাছাকাছি সমগোত্রীয় বর্গের লোকজনের উদ্দেশ্যে। সহজ প্রচলিত ঢাকাই বাংলায় একে বলা হয়ে থাকে ‘পচানি’। তো সেই ‘পচানি’মূলক আবুল ও মফিজ আজকের আলাপের মুখ্য পাত্র নন। অর্থাৎ, আজকের আলাপের কেন্দ্রে রয়েছেন ‘প্রকৃত’ আবুল আর ‘প্রকৃত’ মফিজ। তাঁরা শুধু কেন্দ্রে রয়েছেন তাই-ই নয়, বস্তুত তাঁদের চিনবার জন্যই এই সামান্য প্রয়াস।

‘আবুল’ বর্গকে চিত্রিত করা হয়, এবং চিহ্নিত করা যায়, তাঁদের ‘নির্বুদ্ধিতা’ দিয়ে। বস্তুত, এখানে নির্বুদ্ধিতা প্রসঙ্গে দুয়েকটা কথা বলতে চাইলে নগরবাসীদের পরস্পরকে ‘আবুল’ সম্বোধনের ক্রিয়াশীলতা নিয়েও দুচারটে কথা চলে আসে। সেখানেও মুখ্যত এই ‘নিবুর্দ্ধিতা’কে স্মারক করেই কাউকে ‘আবুল’ খেতাব বা অভীধা উপহার দেয়া হয়ে থাকে, তা খেতাব অর্জনকারীর যতই না কেন অপছন্দের হোক। চলতি ভাষায় যাকে ‘ধান্দা’, আবুলের মূল অযোগ্যতা এই ধান্দার অনুসন্ধানে। তিনি চেষ্টাচরিত্র হয়তো করতে থাকেন, তবে সেই চেষ্টা হয় অপ্রতুল বিবেচিত হয় অন্যের দ্বারা, কিংবা অকার্যকর বলে সাব্যস্ত হয়। সেই হিসেবে এই বর্গ অর্থাৎ আবুলগণ আসলে মূর্তিমান ‘আনস্মার্ট’। এটাই এই বর্গের পরিচায়ক। করে-কম্মে খেতে পারার যে আগ্রহ নিয়ে শহরে মানুষজন আসেন সেই অভিবাসী মানুষজনের মধ্যে আবুলগণ অনায়াসে অযোগ্য।

‘মফিজ’ বর্গকে চিহ্নিত করা অত সহজে যায় না, এমনকি যাঁরা নিরন্তর চিহ্নিত করেন তাঁরাও অত নিশ্চিত নন এর বৈশিষ্ট্যসূচক ‘গুণাবলী’ বিষয়ে। তবে নিবিড় অনুসন্ধানে আবিষ্কার কঠিন নয় যে এই বর্গের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সম্বলহীনতা। নগরবাসীদের স্বগোষ্ঠীর সঙ্গে রঙ্গরসের বা হাসিতামাশার উপকরণ ধরেই আগানো যেতে পারে। এতেই কাজ হবে। একটা বর্ণনাত্মক খেতাব হিসেবে যাকে ‘ফকিন্নির পুত (বা ঝি)’ বলা হয়ে থেকেছে সেটাই বিশেষণীয় বিশেষ্যবর্গ হিসেবে ‘মফিজ’ হিসেবে বিবর্তিত বা রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থশাস্ত্রীয় বিচার বিচেনার দিক থেকে যাকে ‘ব্যাঙ্করাপ্ট’ বলে তা সমর্থ লোকের অপেক্ষাকৃত সম্বলহীন হয়ে পড়া বোঝায়। কিন্তু অন্য একটা মানে এর মধ্যে লুক্কায়িত থাকে। তা হলো লগ্নি-অযোগ্য। এই মালের উপর আপনি কোনো ‘লগ্নি’ করবেন না যেন! ‘মফিজ’গণ সেদিক থেকেও অনন্য। শেষ কবে এঁরা সম্বলওয়ালা ছিলেন তা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় হতে পারে।

আবুল ও মফিজ উভয়েই মুখ্যত ঢাকায় অভিবাসী। বা যেকোনো বড় শহরে। আরো ভেঙে বললে, এঁদের অভিবাসন প্রক্রিয়া ছাড়া আবুলত্বের ও মফিজত্বের কনসেপ্ট ও কনসিকুয়েন্সেস-এর পুরো কার্যকরিতা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, অভিবাসনের আগে তাঁদের পক্ষে কার্যকরীভাবে আবুল কিংবা মফিজ থাকা সম্ভব নয়। বিশেষত, আবুল যদি নিজগুণে নিজ এলাকায় আবুল থাকেনও, তাঁকে শনাক্তকারী অনাবুল বর্গ অত্যন্ত সীমিত। অন্যদিকে, মফিজের পক্ষে নিজ এলাকায় মফিজ থাকা অসম্ভব একটা প্রস্তাবনা। এখানে শনাক্তকারী থাকা না-থাকাও বিষয় নয়। ফ্যালাসি রীতিমতো। তবে খুব বিরল পরিস্থিতিতে, মফিজের পক্ষে অভিবাসনের পূর্বে আবুল থাকা সম্ভব। এমনকি পরেও। কিন্তু একবার মফিজ হলে তিনি আর আবুল নন। বা তাঁর সেই পরিচয় তখন আর মুখ্য থাকে না, এমনকি থাকেই না। মফিজগণ আবুল থেকে থাকলে তা বিবেচিত হয় না। আবুলগণ মফিজ হয়ে পড়লে তাঁর আবুলত্ব ঘুচে যায়। তবে কোনো আবুলই নিজ পরিচয় থেকে পরিত্রাণের জন্য মফিজ হতে চাইবেন না। পক্ষান্তরে, মফিজগণ নিজ পরিচয় থেকে পরিত্রাণের জন্য কখনো আবুল হতে চাইতেও পারেন। কিন্তু তাঁর সেই উপায় আর থাকে না।

আবুল নিরন্তর নিগৃহীত হতে পারেন, কিন্তু তিনি অবধারিতভাবেই গৃহীও। মফিজ নিগৃহীত হবেনই, এবং তিনি গৃহহীন। মফিজ চূড়ান্তবিচারে উন্মূল। আবুল যখন ঢাকা শহরে, কিংবা কাছেপিঠের কোনো শহরে যথেষ্ট ‘ধান্দা’ করতে নিজেকে অপারগ বিচার করেন তখন ফিরবার তাগিদ তাঁর বোধ হয়। তিনি তখন সঞ্চয়ের শেষ টাকাটা সম্বল করে টিকেট কাটতে ছোটেন। কিংবা তিনি তখন অনাবুল তাঁর বন্ধুবর্গের কাছেই হাত পাততে মনস্থ করেন। আবুল ধার করে হলেও সেই বাস কাউন্টারে চলে যান যেখানে গেলে তাঁর ‘নিজ’ ভূমি সম্বন্ধে ভাবালুতা জেগে ওঠে। পরিবার সম্বন্ধেও। তিনি ফিরবার তাগিদ, ছন্দোময়তা, কারণ খুঁজে পান। হয়তো পরাস্ত, তবুও তিনি সেই দূরপাল্লার বাসটিতে বসে নিজের অযোগ্যতা পর্যালোচনা করতে করতে ‘বাড়ি’ ফিরতে থাকেন। হয়তো নেহায়েৎ অবাসযোগ্য সেই বাড়ি, তাঁকে পুনঃ পুনঃ বলসঞ্চার করতে থাকে। আবুল ঢাকা শহরকে পরিত্যাগের নিমিত্ত খুঁজে পান। হয়তো পুনঃ পুনঃ তাঁর জীবনে এমতো পরিত্যাগাকাঙ্ক্ষা আর স্বসান্ত্বনা ঘটতে থাকে। তবুও তিনি তা পান।

ঠিক একইভাবে মফিজ যখন ঢাকা শহরে কিংবা কাছেপিঠের কোনো শহরে যথেষ্ট ‘ধান্দা’ করতে নিজেকে অপারগ বিবেচনা করেন তখন তিনি সেই মুহূর্তেই উপলব্ধি করেন যে তাঁর ফিরবার কোনো জায়গা তেমন অবশিষ্ট নেই। তাঁর সঞ্চয়ের শেষ সম্বলটুকু ততক্ষণ থাকে না, কিংবা থাকা না-থাকা তাঁকে কোনো উপায় বাৎলে দেয় না। তাঁর অমফিজ বন্ধুকুল বলে তেমন কিছু থাকে না। যাঁরা বন্ধু থাকেন, তাঁরা প্রায় সকলেই মফিজ। পরস্পর মফিজকুল তখন নিজেদের দিকে অসীম এক গহ্বর সমেত তাকান। সেই চাহনিতে কিংবা চাহনির ওপারে কোনোরূপ গন্তব্য থাকে না। থাকে এক শূন্য চরাচর। তারপর ক্ষুধা এবং নিঃসম্ভাবনার এক প্রান্তে ক্লান্ত মফিজ ধীর লয়ে হাঁটেন। পরাস্ত আবুল যখন দূরপাল্লার কোনো সস্তা বাচে চেপে বসেছেন, ক্লান্ত ও পরাস্ত মফিজ তখন কোথাও বহু পুরাতন গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়েছেন।

এই শহরেরই কোনো না কোনো রাস্তার পাশে, ফুটপাতে, শপিং মলের সামনের টাইলস লাগানো বারান্দায়, গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে, কিংবা কমলাপুর রেলস্টেশনে।

প্রকৃত আবুল আর মফিজের মধ্যে তাই আপনার পক্ষে মফিজের সঙ্গে মুলাকাতের সম্ভাবনাই বেশি।



সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:০২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×