somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কন্যা সন্তান একটি অভিশাপ?

১২ ই জুন, ২০১৪ রাত ৮:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সোমবার এমনিতেই কাজে আসতে বিরক্ত লাগে। প্রতি সোমবার সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই ইচ্ছা করে বসকে ইমেইল করি, "প্রিয় ডারলা, আজকে আমার অফিসে আসতে একটু দেরী হবে।"
তার উপর আজকের ওয়েদারটা দারুন! দেশের আবহাওয়া অফিসের ভাষায় "বজ্রসহ বৃষ্টি" হচ্ছে। টেক্সাসের অতি কুখ্যাত সামারের গরম কেটে গিয়ে ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে। এইরকম একটা সুন্দর সকালে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকার মজাই আলাদা!
অফিসে এসে ফেসবুক দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমাদের ক্যানভাসের বিখ্যাত কবি Ranya Rahim একটা লিঙ্ক শেয়ার করেছে, যার সারকথা হচ্ছে, "গত তেইশ বছর ধরে যে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নারী, সেই দেশে এখনও কেন কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে মাকে মেরে ফেলা হয়?"আমির খানের satyamev jayate অনুষ্ঠানেও এরকম একটি বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছিল যে, ইন্ডিয়াতে এখনও মেয়ে সন্তানের জন্মের আগেই ভ্রুণ হত্যা করা হয়। এখনও ইন্ডিয়ার অনেক গ্রামে মেয়ে সন্তানদের জীবিত কবর দেয়া হয়। বছরের পর বছর ধরে এই কুপ্রথা চালু থাকায় এখন এমন অনেক অঞ্চল পাওয়া যাচ্ছে যেখানে বিয়ে করার জন্য ছেলেরা মেয়ে খুঁজে পাচ্ছে না। কারন, মেয়ে নেই। ফলে আরও অনেক কুপ্রথার জন্ম নিচ্ছে। একই মেয়েকে চার পাঁচজনের সাথে পালাক্রমে বিয়ে করাটা হচ্ছে তার একটি।
অনেক শতাব্দী আগে আরবদেশেও এমন বর্বরোচিত প্রথা চালু ছিল। সেদেশের বিভিন্ন গোত্রে মেয়ে সন্তানদের জীবিত কবর দেয়া হতো।একদিন এক সাহাবি (নবীজির সঙ্গী) স্বয়ং নবীজির কাছে নিজের ইসলামপূর্ব জীবনের অপরাধ স্বীকার করছিলেন।
"আমি আমার মেয়েকে জীবিতাবস্থায় যখন কবর দিচ্ছিলাম, তখন তাড়াহুড়া করায় আমার দাড়িতে বালু লেগে যাচ্ছিল। আমার মেয়েটা তখনও সে অবস্থাতেও নিজের হাতে আমার দাড়ির সেই বালু সরিয়ে দিচ্ছিল।"
নবীজির (সঃ) মন অত্যন্ত নরম ছিল। তিনি প্রচন্ড ব্যথিত কন্ঠে বললেন, "কি করে করলে এই কাজ? কি ভাবছিলে তুমি সে সময়ে?"
বলতে বলতে তাঁর চোখ ভিজে উঠেছিল। চোখের পানি গড়িয়ে এসে তাঁর দাড়িও ভিজিয়ে দিয়েছিল। সেই বর্বর যুগেও নবীজির নিজের বেশ কজন কন্যা সন্তান ছিল, এবং তিনি তাঁদের প্রত্যেককেই প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। হয়তোবা সাহাবি নিজের মৃতা সন্তানের কথা মনে করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন।
আরবদের এই বর্বরোচিত প্রথা ধ্বংশ করতেই নাযেল হলো পবিত্র কোরআনের সেই বিখ্যাত আয়াত, "আসমান সমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে পুত্র ও কন্যা উভয়ইদান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।" [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ৪৯-৫০]
আমাদের দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার পরেও এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এখনও ছেলে সন্তানকে "বংশের প্রদীপ" ধরা হয়ে থাকে। যার কোন ছেলে সন্তান নেই, তার দিকে মানুষ করুণার দৃষ্টিতে তাকায়। আহাম্মকেরা ভুলে যায়, স্বয়ং নবীজির কোন পুত্র সন্তান জীবিত ছিলেন না। তাঁর ইন্তেকালের সময়ে একমাত্র জীবিত সন্তান ছিলেন তাঁর কন্যা হযরত ফাতিমা (রাঃ)। এখান থেকেই কি শিক্ষা নেয়া যায়না? বংশের প্রদীপের কথা বলতে আসছেন!
আপনি মারা গেলে আপনি কবরে যাবেন। ছেলে সন্তান থাকলেও একা যাবেন, মেয়ে থাকলেও একা যাবেন, কেউ না থাকলেও একাই যেতে হবে। কাজেই এই "বংশের প্রদীপ" ট্রদীপ সব ভূয়া কথা।
আমার আব্বুর দুইটা ছেলে সন্তান ছিল। কিন্তু আদর বেশি পেয়েছে আমার বড় বোন। বেচারা কোন বিয়ে বাড়িতে গেলেই চোখ ভিজিয়ে ফেলতেন। কারন একটা সময়ে তাঁকেও তাঁর মেয়েকে বিদায় দিতে হবে। আমার বোন যখন ফ্রক পড়ে স্কুলে যায়, তখন থেকেই চলছে এই ঘটনা।
ছেলে সন্তানদের কাছে আব্বুর একটাই আশা ছিল। তাঁর যানাজায় তাঁর ছেলেরা কাঁধ দিবে। দুইদুইটা ছেলে থাকার পরেও তাঁর সে শখ পূরণ হয়নি। তারা তখন বিদেশে! ছেলে সন্তান থাকায় তাঁর লাভটা কি হলো?
আমাদের দেশের সামাজিক ব্যবস্থাও এমন যা মেয়েদের 'বোঝা' ভাবতে বাধ্য করে।মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিতে হবে, বিয়ের খরচ আছে। যৌতুক না হলেও জামাইকে "উপহার" দিতে হবে। মেয়ের গায়ের রং কালো (মেয়েদের ক্ষেত্রে শ্যামলা গায়ের রংকেও কালো বলে ধরা হয়ে থাকে। এমন ভাব যেন বাংলাদেশ না, আয়ারল্যান্ডে বসে মেয়ে দেখা হচ্ছে) হলেতো কথাই নেই। বিয়ের টেনশনে রাতের ঘুম হারাম। তারপর আছে মেয়ের বয়স বেড়ে যাবার ভয়। বিশ পঁচিশ হলেই বিয়ে দিতে হবে। তিরিশ হলেতো কথাই নেই। মেয়ে বুড়ি হয়ে গেছে!
কিছুদিন আগে আমার মামাতো ভাই একটা পত্রিকার বিজ্ঞাপনের ছবি শেয়ার করলো। পোস্টের আগে ক্যাপশনে লিখলো, "শালার পুতের অবস্থা দেখেন।"
পোস্ট পড়ে আমারও একই অনুভূতি। পোস্টটা হুবহু তুলে দিচ্ছি,
"আমি অস্ট্রেলিয়ার সিটিজেন (২০১৩), অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার্স(২০০৮) এবং অধূমপায়ী। তিনটি আবশ্যক রিকয়ারমেন্ট হচ্ছে - পাত্রীর চমৎকার হাসি, ফর্সা এবং উচ্চতা ৫'২" থেকে ৫'৫"। এছাড়াও হতে হবে মুসলিম, শিক্ষিতা, মেধাবী, গুড লুকিং এবং পারিবারিক মূল্যবোধ সম্পন্ন। প্লীজ, শীঘ্রই ছবি ও বায়োডাটা প্রেরণ করুন। probashi১৪@gmail.com"
ইচ্ছা করছিল প্রবাসীকে দাওয়াত দিয়ে বাসায় ডাকি। তারপর ফাজিলের আওলাদের গাল ভর্তি করে জুতা পেটা খাওয়াই। ফাইজলামির একটা সীমা থাকা উচিৎ! এত ডিমান্ডতো গৌরীকে বিয়ে করার সময়ে শাহরুখ খানেরও ছিল না। এইধরনের ফাজিলেই দেশ ভর্তি। খেসারত দিতে হচ্ছে মেয়েদের। মা বাবারা পারলে সেই শৈশবেই অ্যাবর্সন করিয়ে ফেলছে। যদি মেয়ে বেঁচেও থাকে, তবে এমন সব কথা শোনাচ্ছে যা শুনলে মেয়ের মনে হতেই পারে এরচেয়ে ছোটবেলায় মেরে ফেলাটাই ভাল ছিল।
"মুখে একটু ক্রিম ট্রিম মাখতে পারিস না? পাতিলের তলার মতন মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াস!"
"একটা প্রেমও করতে পারলি না জীবনে? প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেললেতো তোর বিয়ে নিয়ে আমাদের আজকে এত টেনশন করতে হতো না।"
"লজ্জা করে না? বিয়ে হচ্ছেনা একটা মেয়ে, অথচ ধেই ধেই করে ঘুরে বেড়াস!"
উপরের একটা কথাও আমি নিজে থেকে বানিয়ে বলছিনা। আমি নিজের কানে শুনেছি এসব। হয় আমার সামনে কেউ বলেছেন, নাহলে মেয়েটা আমাকে বলেছে। কথা শুনলে মনে হয় যেন বিয়েই একটা মেয়ের জীবনের শেষ গন্তব্য। যেই মেয়ের বিয়ে হলোনা, তার যেন কিছুই হলোনা।
কেউ এতটুকু ভাবেনা, যেই ছেলে রূপ দেখে বিয়ে করবে, সেই রূপ যখন কিছুদিন পরেই ধুয়ে যাবে, তখন সেই সম্পর্কের কি কোন মানে থাকবে?
যেই ছেলে বিয়ে করছে স্রেফ যৌতুক থুক্কু 'উপহার' পাবার লোভে, তার কি মুখ বেশি হা হয়ে যাবেনা? তার লোভ সামাল দিতে পারবেন আপনি?
বা উপরের পোস্টের ফাজিলটার কথাই ধরুন। পোস্টের ভাষা পড়ে মনে হচ্ছে যেন কোন মেয়েকে বিয়ে করে সে দয়া দেখাচ্ছে। তাহলে এমন ছেলেদের সাথে কেনই বা বিয়ে দেয়া?
কথা শুরু করেছিলাম মেয়ে সন্তান হত্যাকান্ড দিয়ে। এই বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ কন্যাসন্তান হত্যাকারীদের সাবধান করে বলেছেন,"জীবন্ত কবর দেয়া কন্যা সন্তানকে কেয়ামতের দিন জিজ্ঞেস করা হবে কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।" (সূরা তাকবীর, আয়াত:৭-৮)।
তখন সেই ভীষণ দিবসে সেই নিরপরাধ শিশুর মা বাবা আল্লাহকে কি জবাব দিবেন?
নবীজির অতি বিখ্যাত হাদীস, "মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত" - এখানে এই মাও কিন্তু একজন নারী। এই বোধটা যতক্ষণ না আসবে, ততদিন যতই স্কুল কলেজে পড়ানো হোক না কেন, যতই সভা সেমিনার করা হোক না কেন, কিছুতেই কিছু যাবে আসবে না।
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×