অ্যামেরিকায় আসি ২০০৭ সালে। তখনকার দিনের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষার সিস্টেম সম্পর্কে বলি।
টিচাররা ক্লাসে লেকচার দিয়ে যান। নির্দিষ্ট সপ্তাহে পরীক্ষা হয়। তবে আমাদের দেশের মতন ক্লাসটাইমে ক্লাসরুমে বসে পরীক্ষা নয়। "টেস্টিং সেন্টার" বলে একটি নির্দিষ্ট জায়গা থাকে। প্রশ্নপত্র সেখানে আগে থেকেই দেয়া থাকে। ছাত্রছাত্রীরা সেই নির্দিষ্ট "পরীক্ষা সপ্তাহে" তাঁদের সুবিধামতন সময়ে সেখানে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসে। সকাল ৮টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে সেই টেস্টিং সেন্টার।
টেস্টিং সেন্টারে সাধারণত কোন শিক্ষক কাজ করেননা। বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরাই কাজ করে। দেখা যায়, যার পরীক্ষা, সে নিজেই অথবা তাঁর বন্ধুবান্ধবদের কেউ টেস্টিং সেন্টারে কাজ করে। ইচ্ছা করলেই প্রশ্নপত্র দেখতে পারে সে। তারপরেও "সাধারণত" এরা প্রশ্নপত্র দেখেনা।
এছাড়া অনেক সময়ে দেখা যায় শিক্ষক টেস্টিং সেন্টারে পরীক্ষা না নিয়ে ক্লাসে পরীক্ষা নিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ অতি দ্রুত পরীক্ষা শেষ করে খাতা জমা দিয়ে দেয়। প্রশ্ন কমন পড়েনি। তবুও নকল না করে, বা আশেপাশে না দেখে সে যা পারে তা আনসার করে বেরিয়ে এসেছে।
অনেক সময়ে দেখা যায় একই কোর্সের দুই ভিন্ন সেকশনে একই প্রশ্ন পরীক্ষায় আসে। সকালের সেকশনে যা পরীক্ষায় এসেছে, বিকালের সেকশনেও প্রশ্ন অভিন্ন থাকে। ইচ্ছা করলেই এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে সাহায্য করতে পারে/নিতে পারে। এরা জিজ্ঞেসও করেনা প্রশ্ন কী এসেছে।
এখানে উল্লেখ্য, এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা কিন্তু খুবই এক্সপেন্সিভ। আমি এখানকার গ্রীনকার্ডধারী/সিটিজেন হলেও প্রতি সেমিস্টারে আমাকে নগদ ৪ থেকে পাঁচ হাজার ডলার খরচ দিতে হয়েছে। স্কলারশিপ পাওয়ায় টুকটাক লাভ হয়েছে বটে, নাহলে খরচ আরও বাড়ে। পাঁচ ছয়হাজার মিনিমাম ধরে নিন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই টাকা ছাত্রছাত্রীরা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করে থাকে। একটি সাবজেক্টে ফেল মানে হাজারখানেক ডলারের জলাঞ্জলি। তারপরেও এই সততা মুগ্ধ করার মতন।
এবার আমার পড়াশোনার শেষ বর্ষে আমি কিভাবে পরীক্ষা দিয়েছি সেটা বলি। বলছি ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট ডালাসের কথা। বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা আরও কিছু যোগ করতে চাইলে করতে পারেন।
স্কুলের আইডি এবং ড্রাইভার্স লাইসেন্স টেবিলের উপর রাখতে হবে। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (শিক্ষক এবং শিক্ষকের পেয়ারের কিছু বান্দা অন্যক্লাসের ছাত্রছাত্রী) পরীক্ষার্থীর পরিচয় নিশ্চিত করলে তবেই সে হলে বসতে পারবে। প্রতিটা সারির ডানদিকে একজন সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকবে। বামদিকেও তাই। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরাতে দেখলেই খাতা নিয়ে যাওয়া হবে। কোন কাকুতি মিনতি করলে উল্টো নিজেরই ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। নকল করলেতো কথাই নাই।
এখন কেন শেষ বর্ষে এসে অমন কড়াকড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল? এর কারন হচ্ছে, দেখা গেল কিছু ছাত্র সকালের পরীক্ষার হলে ঢুকে প্রশ্ন নিয়ে রাতে এসে নিজের সেকশনের পরীক্ষা দেয়। দেখা গেল কেউ আরামসে খাতা খুলে বা মোবাইল ফোনে নকল মারছে। কিংবা দেখা গেল, কেউ পয়সা দিয়ে আরেকজনকে দিয়ে ক্লাস/পরীক্ষা দিইয়ে নিজের নামে সার্টিফিকেট কিনে নিচ্ছে। থ্রি ইডিয়টসের আমির খানের অবস্থা। ক্লাস করলো অন্যের নামে, সার্টিফিকেটও নিল অন্যের জন্য।
কারা এমনটা করছে? টিচাররা নাম প্রকাশ না করলেও বুঝতে অসুবিধা হয়না "বিদেশী" ছাত্রছাত্রীরাই (আমরা বাংলাদেশিরা, ভারতীয় পাকিস্তানি, নেপালিরা) এই দুর্নীতি এদেশে ইম্পোর্ট করেছে।
তো যা বলছিলাম, অ্যামেরিকান ছাত্রছাত্রীদের মাথায় ছোটবেলা থেকেই ঢুকিয়ে দেয়া হয় স্কুলে যাওয়া উচিৎ নতুন কিছু শেখার জন্য। তুমি যা শিখতে চাও, তোমার যেখানে আগ্রহ আছে, তা বিস্তারিতভাবে ঝালিয়ে নিতেই তোমার স্কুলে যাওয়া উচিৎ। সার্টিফিকেট এখানে গৌণ বিষয়, নিজের জানাটাই মুখ্য। একারনেই এরা চিটিং করে পাশ করাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করে। কারোর টাকাপয়সা চুরি/ডাকাতি করা এবং পরীক্ষায় নকল করাকে তারা এক ক্যাটাগরিতে ফেলে। এদেশে শিক্ষাজীবনে "প্লেজারিজম" ভয়াবহ অপরাধ। ডিনের অফিসে ডাক পড়ে, ক্ষেত্র বিশেষে বহিষ্কার হতে হয়। সোর্স হিসেবে উইকিপিডিয়া কোন অবস্থাতেই কাউন্ট করা হয় না। গবেষণা করতে হলে নিজেকেই ঘাটাঘাটি করে কষ্ট করে পেপার লিখতে হয়। সহপাঠী বা অন্য কারোর সাথে মিল পেলে সাথে সাথে দুইজনই বহিষ্কার।
আমাদের দেশে ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় পরীক্ষায় ভাল না করলে বড় হয়ে রিকশা চালাতে হবে। যেভাবেই হোক পরীক্ষায় রেজাল্ট ভাল করতেই হবে। না পারলে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করতে হবে, পারলে তাঁর খাতা দেখে লিখতে হবে। নো ম্যাটার হোয়াট, রেজাল্ট কোন অবস্থাতেই খারাপ করা চলবে না। সার্টিফিকেটে লেখা থাকতে হবে গোল্ডেন A প্লাস, যদিও আমি মুখে বলি I am GPA ফাইভ, কিচ্ছু যায় আসেনা। আর সবকিছুর মতন পড়াশোনাটাও আমাদের কাছে এখন শোঅফের বিষয় হয়ে গেছে।
মা বাবা কনস্ট্যান্ট প্রেশার দিয়েই যান, অমুক থেকে তোমাকে ভাল রেজাল্ট করতে হবে। তমুকের চেয়ে ভাল চাকরি করতে হবে। অমুকের চেয়ে বড় বাড়ি কিনতে হবে, তমুকের চেয়ে ভাল গাড়ি। অমুকের চেয়ে সুন্দর বৌ বাড়িতে আনতে হবে, তমুকের এখনও কোন বাচ্চা হয়নি, তোর এত তাড়া কিসের? বাচ্চা পরে নিবি, আগে ক্যারিয়ারে ফোকাস কর! Make us proud! যেই ছেলের ডাক্তারি পেশার প্রতি আগ্রহ ছিল না, তাঁকে হতে হচ্ছে ডাক্তার। যার স্বপ্ন ছিল সিনেমা বানাবার, তাঁকে পড়াশোনা করতে হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং। জগতে কোন বিদ্যাই বৃথা যায় না, আমি বলছিনা কারোর উচিত না অন্য সাবজেক্ট নিয়ে পড়ার। অবশ্যই বিভিন্ন সাবজেক্ট নিয়েই পড়াশোনা করা উচিৎ। একজন শিল্পী ডাক্তার হতে পারবেনা এমন কোন শর্ত নেই। কিন্তু সেটা যেন অবশ্যই আগ্রহের সাথেই করা হয়। জোর করে নয়।
আমি যেমন মাঝেমধ্যে এমন সব বিষয় নিয়ে পড়তে বসি যা একজন একাউন্ট্যান্ট হিসেবে পড়বার কথা নয়। বাইদ্যওয়ে, আমি নিজেও একাউন্টিং খুব ভালবেসে পড়িনি। ভাল বেতনের চাকরি পাওয়া যাবে, এই আগ্রহেই পড়া। আমি যখন এদেশে আসি, তখন খুব ভয়াবহ রিসেশন চলছিল। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের বেকার হয়ে ঘুরতে দেখেছি। যদি দেখতাম তাঁদের রমরমা অবস্থা, তাহলে হয়তো আমিও কম্পিউটার সায়েন্স পড়তাম। অথবা অন্য কোন বিষয়। আর চাকরির তাড়া না থাকলে হয়তো নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের উপর আমার ডিগ্রিই থাকতো না। আজকে ইটা পড়তাম, তো কালকে সেটা।
তো যা বলছিলাম, এখন বাচ্চাদের পড়ালেখার সাথে যোগ হয়েছে তাঁদেরকে অলরাউন্ডার বানানোর ভাবনা। স্কুলে ভাল করছে, এখন শিল্পক্ষেত্রেও ভাল করতে হবে। গানের টিচার রাখো, ইন্সট্রুমেন্ট শেখার টিচার রাখো। কম্পিটিশনে যাও। টিভি অনুষ্ঠানে যাও। কম্পিটিশনে ফেল করলে আরও কথা শোনাও। "এই জন্য এত পয়সা খরচ করে তোকে গান শেখাই?" ইত্যাদি ইত্যাদি। বাচ্চার হয়তো আগ্রহই নেই গানের ব্যাপারে। কিংবা নাচের ব্যাপারে। কিংবা পড়াশোনার ব্যাপারে। কে জানে, হয়তো ছেলের যাবতীয় ট্যালেন্ট ছিল সাকিব আল হাসান হবার, অথচ মিডিওকার রেজাল্ট নিয়ে বেচারা কেরানির চাকরি করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে।
এখন ভিকারুন্নেসার মেয়েটির আত্মহত্যার ঘটনায় দেশ দুইভাগ হয়ে গেছে। একদল সব দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে স্কুলের উপর। সেই স্কুলেরই বর্তমান ছাত্রীরা এবং তাঁদের অভিভাবকরা রাস্তায় নেমে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। তাঁদের অভিযোগ, স্কুল কর্তৃপক্ষ সবার সাথেই দুর্ব্যবহার করে। (সূত্র: প্রথমআলো)
একদল বলছেন স্কুল নির্দোষ। বরং অভিভাবকদেরই সব দোষ। তাঁরাই কথা শুনিয়ে শুনিয়ে মেয়েটিকে ঝুলে যেতে প্রেরণা দিয়েছেন। এখন নিজের দোষ স্কুলের ঘাড়ে চাপাচ্ছে।
অনেকেই মেয়েটিকেই দোষী বলছেন। সামান্য কটুবাক্য কানে নিতে পারলো না, এত বড় মেয়ে! ফাজিল কোথাকার!
কেউই মূল সমস্যা নিয়ে ভাবছে না। শিক্ষাগ্রহণ খাদ্য গ্রহণের চেয়েও আনন্দময় হবার কথা ছিল। সেখানে কেন আমরা বাধ্য হচ্ছি চিটিং করে পাশের ব্যাপারে? বাসি ভাত পঁচা ডাল খেয়ে কখনও কী পেটকে পোলাও কোর্মা খাচ্ছি বলে ভুলানোর চেষ্টা করি? তাহলে শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন জোচ্চুরি কেন? সার্টিফিকেট ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাই কী এজন্য দায়ী নয়? পরীক্ষায় নকলতো সেই বাপ দাদার আমল থেকেই ঘটে আসছে।
তারমানে আমাদের গোড়াতেই সমস্যা। নকল আমাদের রক্তে এমনভাবে মিশে গেছে যে আমরা ফেসবুকের অন্যের লেখা চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দেই। "লেখক" ভাব নিয়ে পাঠকের লাইক, এবং প্রশংসা কুড়াই। সামান্যতম বিবেক জাগেনা। ধরা খেলে উল্টো লোকজনকে ব্যান করে চুরি অব্যাহত রাখি। এইভাবে লোকের লেখা চুরি করে, অন্যের বিদ্যা চুরি করে কতদূর এগোনো সম্ভব? এই বোধ কবে মস্তিষ্কে জাগবে?
কয়জন জানেন জানিনা, অ্যামেরিকায় চাকরির ক্ষেত্রে ডিগ্রি সার্টিফিকেট এইসব সেকেন্ডারি যোগ্যতা। প্রথম যোগ্যতা যেই কাজের জন্য এপ্লাই করেছেন, সেই কাজ আপনি কতটুকু পারেন, বুঝেন ইত্যাদি। এই কাজে আপনার "পূর্ব অভিজ্ঞতা" কতটুকু আছে - এটাই ফার্স্ট প্রায়োরিটি। একাউন্টিং ডিগ্রি থাকার পরেও এন্ট্রি লেভেলেও কেউ চাকরি দিচ্ছিল ইন্টার্নশিপের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না বলে। ফাঁকা বুলি চাপাবাজি ইন্টার্ভিউতেই ধরে ফেলতে পারে তাঁরা। একবার পরিচিত এক মেয়ে এক ভদ্রলোকের রেজুমে দেখে ভিরমি খেয়েছিল। এই ডিগ্রি, ঐ অভিজ্ঞতা, এই সেই কতকিছু। সে মনে মনে ভাবছে এমন লোকের আমি ইন্টারভিউ নিব কী, ওইতো আমাকে ভেজে খেয়ে ফেলতে পারে।
প্রশ্নোত্তরপর্ব শুরু হবার পরে দেখে লোকটা প্রোগ্রামিংয়ের বেসিকটাও জানেনা। চাপাবাজি করে রেজুমে ভরে দিয়েছে।
শুধুমাত্র এই কারণেই হয়তো এদেশের ছেলেমেয়েরা বুঝে সার্টিফিকেটের চেয়েও বেশি মূল্যবান হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা। ওটা নাই তো সার্টিফিকেটও তখন একটি কাগজের টুকরো ছাড়া কিছুই না। আমাদের দেশে এই রীতি চালু হলে আশা করি শিক্ষার জন্য কাউকে আত্মহত্যা করতে হবেনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৫৯